লেখায় – বিক্রম সিং
ভারত এইমুহুর্তে তিনটি কৃষি আইন এবং বিদ্যুৎ (সংশোধন) বিলের বিরুদ্ধে কৃষকদের ঐতিহাসিক লড়াইয়ের সাক্ষী হচ্ছে।একাধিভাবে এই সংগ্রাম নজিরবিহীন। ডিসেম্বরের কনকনে উত্তুরে ঠান্ডার মধ্যেই আট থেকে আশি হাজির হয়েছে দিল্লির সীমানায় – সংখ্যাটা হাজারে হাজারে নয় লাখে লাখে। দিল্লি রোহতাক হাইওয়েতে টিক্রি সীমান্তে ১২ কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে ৪৮০০ এর বেশি যানবাহন এবং সিংহু সীমান্তে এনএইচ ১ (দিল্লি চণ্ডীগড় হাইওয়ে) এর ১৮ কিলোমিটারে প্রায় ১২০০০ যানবাহন দাঁড়িয়ে রয়েছে।তাদের সংগ্রামের জন্য দৃঢ় প্রত্যয় এবং আস্থা, অনিশ্চয়তার ও ব্যক্তিকেন্দ্রীকতার বর্তমান মূল্যবোধ যা কিনা পুঁজিবাদী ব্যবস্থার একটি সাধারণ উপজাত পণ্য, তার তুলনায় অনন্য।
কৃষকরা কনকনে ঠান্ডা , লাঠি চালনা,কাঁদানে গ্যাস,জল কামান, গণ গ্রেপ্তারের মত পুলিশী বর্বরতা উপেক্ষা করে যে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন তা এক অদম্য সাহসের নিদর্শন। অবাক করার মত লক্ষণীয় বিষয়টি হল যে হরিয়ানা সরকার সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে জানিয়েছিল যে তারা পাঞ্জাবের কৃষকদের হরিয়ানায় প্রবেশ করতে দেবে না।কৃষকরা হরিয়ানা সরকারের কৃষকবিরোধী চরিত্রটি প্রকাশ করে , পুলিশ বহু যায়গায় তাদের গতিরুদ্ধ করার জন্য রাস্তাও খুঁড়ে দিয়েছিল-এই সকল বাধা-বিপর্যয়কে পরাস্ত করে কৃষকরা ।
দৃঢ়প্রত্যয়ী সংগ্রাম : দিল্লির বাইরের মানুষ বিক্ষোভ এবং বিক্ষোভকারী কৃষকদের উপর নৃশংস হামলা নিয়ে যথাযথভাবেই চিন্তিত।সংগ্রামের স্থায়ীত্ব নিয়ে অনেক উদ্বেগ রয়েছে তবে প্রতিবাদকারীদের উৎসাহ এবং সংকল্প অন্য কথাই বলছে। তারা শান্ত , স্থির এবং সংকল্পবদ্ধ একইসাথে দীর্ঘস্থায়ী লড়াইয়ের মানসিক ও বস্তুগত রসদ নিয়ে হাজির হয়েছে।তাদের যানবাহন (বেশিরভাগ ট্রলি) খাদ্যসামগ্রী ও অন্যান্য রসদে ভরা এবং তাদের হৃদয় পরিপূর্ণ সাহসে। সমস্ত অনিশ্চয়তা সত্ত্বেও তারা দৃঢ় কারণ তারা নিজেদের কারণ সম্পর্কে সুনিশ্চিত। আন্দোলনরত কৃষকদের সোচ্চারে শ্লোগান দেওয়ার ও আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ব্যারিকেড ভাঙার দৃশ্য আজ গোটা দেশের কাছে উপস্থিত । এই দৃশ্য আবেগের সাথে সমস্ত বাধা পেরিয়ে সমগ্র ভারতবর্ষের মানুষকে আকৃষ্ট করছে এবং অনুপ্রাণিত করছে তবে তাদের ধৈর্য ও দৃঢ় ইচ্ছাশক্তি থেকে আরও অনেক বেশি অনুপ্রেরণা পাওয়া উচিত।
যুবকরা বিপুল সংখ্যায় এবং সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে অংশ নিচ্ছে।এটা সাধারণ ধারণার বিরুদ্ধে যে যুবকরা জমির বিষয়ে উদ্বিগ্ন নয় এবং কৃষিতে আগ্রহী নয়।এরা পাঞ্জাবের যুব সম্প্রদায় যারা নিজেদের জমি,কৃষি নিয়ে চিন্তিত ও তা রক্ষার সংগ্রামে আজ অগ্রসর হয়েছে।বিক্ষোভকারীরা সরকারের নীতির বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ কিন্তু পুলিশের উস্কানি সত্ত্বেও কখনও হিংসার আশ্রয় নেয়নি।
সংগ্রামের পটভূমি: যখন পুরো বিশ্ব মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করছিল এবং অনেক দেশের নির্বাচিত সরকার তাদের নাগরিকদের পাশে দাঁড়িয়েছিল, সরকারী পরিকাঠামো তৈরিতে সম্পদ ব্যয় করছিল এবং সমাজকল্যাণমূলক পদক্ষেপগুলো নিচ্ছিল যা তাদের নিওলিবারেল রাষ্ট্রীয় অর্থনীতির চরিত্রের বিরুদ্ধে যাচ্ছিল, কারণ এটা সময়ের প্রয়োজন ছিল।এর বিপরীতে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারত সরকার কর্পোরেশনদের মুনাফার জন্য নিওলিবারেল এজেন্ডার পরবর্তী পর্যায়ের বাস্তবায়নের জন্য এই পরিস্থিতিকে অমানবিকতা ও ধূর্ততার সাথে ব্যবহার করেছে।সরকার জন-বিরোধী আইন ও নীতিগত সিদ্ধান্তগুলো এমন এক সময়ে পাশ করেছিল যখন লোকেরা তাদের বাড়িতে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়েছিল।শ্রমজীবী শ্রেণী এবং তাদের কষ্টার্জিত অধিকার আক্রমণের শিকার হচ্ছে এবং কৃষকদের নিষ্ঠুর বাজারের আদেশের করুণায় ছুঁড়ে ফেলে কর্পোরেটকে উপকৃত করার জন্য পুরো কৃষিক্ষেত্রকে নতুন করে রূপ দেওয়া হচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে কোভিড -১৯ এর কারণে যখন রোগীদের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে থাকে তখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা তিনটি কৃষি বিল প্রস্তাব করে এবং পরবর্তীকালে এটি সংসদের উভয় কক্ষে পাস করে।
সমস্ত সংসদীয় প্রক্রিয়া এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরুদ্ধে গিয়ে এই তিনটি বিল রাজ্যসভায় ধ্বনি ভোটের মাধ্যমে পাস করা হয়েছিল। এই তিনটি আইন হল: ‘Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020’, ‘Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Bill, 2020’ এবং অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন ,২০২০।
এই আইনগুলোকে মনোযোগ সহকারে পর্যালোচনা করলে কৃষকদের উদ্বেগ ও যন্ত্রণার কারণ বোঝা যায়। আইনগুলি কৃষকদের কৃষি-ব্যবসা, বড় খুচরা ব্যবসায়ী এবং রফতানিকারীদের দয়ার ওপরে নির্ভরশীল করবে। এগুলোর ফলে কৃষি ব্যবসা ও ব্যক্তি উদ্যোগগুলোর ওপর থেকে সমস্ত ধরণের নিয়ন্ত্রণ সরে যাবে। এই আইনগুলো আমাদের দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় নীতিগুলোর ওপর প্রত্যক্ষ আক্রমণ এবং রাজ্য সরকারগুলোর অধিকার লঙ্ঘন করে, কারণ কৃষি একটি রাজ্য তালিকাভুক্ত বিষয়।
বিজেপি দাবি করছে যে, ‘Farmers’ Produce Trade and Commerce (Promotion and Facilitation) Bill, 2020’ কৃষকদের মুক্তি দিয়েছে এবং মূলধারার সমস্ত গণমাধ্যম কৃষকদের “স্বাধীনতা” শিরোনামটি ব্যবহার করেছে ও বলছে কৃষকদের স্বাধীনতা রয়েছে ‘যে কোনও মূল্যে তাদের পণ্য বিক্রি করার জন্য’ তবে শিরোনামের বাস্তবতা হল ” যে কোনও মূল্যে যে কোনও কৃষকের কাছ থেকে কোনও পণ্য কেনার কর্পোরেশনদের স্বাধীনতা”। ১৯৬০ ও ১৯৭০ এর দশকে এপিএমসি আইনগুলো চালু করা হয়েছিল বড় ব্যবসাদার ও বড় ক্রেতাদের একচেটিয়া ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। এরা ঐতিহাসিকভাবে নিজেদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা ও অর্থনীতি বহির্ভূত উপায় প্রয়োগ করে দরিদ্র কৃষকদের থেকে স্বল্প মূল্যে ফসল কিনে নিত। ফসলের মূল্য নির্ধারণ,বাছাই,ওজন এবং ফসলের মূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে কৃষকদের শোষণ বন্ধ করার লক্ষ্যেই এই আইনগুলো প্রনয়ন করা হয়েছিল।সর্বদা কার্যকরভাবে লাগু না হলেও এপিএমসি আইনগুলোর ফলে নিলামের মাধ্যমে ফসল বিক্রির একটা পদ্ধতি শুরু হয় যেখানে প্রতিযোগিতার একটা পরিবেশ ছিল। এইরকম ব্যবস্থার পরেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) নিশ্চিত করা যায়নি। বড় ব্যবসায়ী এবং বড় ক্রেতাদের সরাসরি কৃষকদের কাছ থেকে নথীভুক্ত বাজারের বাইরে পণ্য কেনার অনুমতি দেওয়ার অর্থ এই যে পণ্যটি কেনা হবে নিলাম ছাড়াই এবং বড় ব্যবসায়ী এবং দরিদ্র কৃষকের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে। এমন একটা ব্যবস্থা মজ্জাগত ভাবেই কৃষক স্বার্থের পরিপন্থী এবং তারা ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত হবে। কৃষকেরা অনেক সময়েই তাদের ফসল অভাবী বিক্রিতে বাধ্য হয় ধার শোধ করার জন্য , পরিবারের খরচ চালাতে বা পরবর্তী মরসুমে বীজ বপনের খরচ জোগানের জন্য ।তারা একটা অসম ব্যবস্থার মুখোমুখি হবে যখন কোন ধরণের সরকারি হস্তক্ষেপ থাকবে না এবং স্থানীয় ব্যবসায়ীদের পরিবর্তে তারা বৃহৎ পুঁজির সামনে পড়বে। এমনকি বিদ্যমান ব্যবস্থায় যেখানে চুক্তি চাষ চলছে কৃষকদের প্রায়শই পূর্বনির্ধারিত দাম দিতে অস্বীকার করা হয় (যা সাধারণত অযৌক্তিকভাবে কম এবং সি ২ + ৫০% মেনে চলা হয় না) গুণমান বা বাছাইয়ের বিষয়গুলি উল্লেখ করে বা এমনকি ওজন কারচুপি করে।সহায়ক মূল্য আর থাকবে না এবং কৃষকদের অনিশ্চিত বিশ্ব বাজারে ফসল দাম ওঠা পড়ার সামনে ছেড়ে দেওয়া হবে যেখানে বিশ্ব বাজারে ফসলের দাম কমলে তারা ক্ষতির সম্মুখীন হবে কিন্তু দাম বাড়লে তারা সেটা পাবে না । এপিএমসি কে দুর্বল করা গণসংগ্রহ ব্যবস্থা ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য দুর্বল করার প্রথম পদক্ষেপ। এক দেশ এক করব্যবস্থার মতই এক দেশ এক বাজার এর স্লোগান ও আসলে কৃষি উৎপাদকদের অবস্থা আরো সঙ্গীন করে তুলবে। কৃষকদের হাতাশার কারণ বিপণনের বিধিনিষেধ নয় বরং উপযুক্ত পারিশ্রমিক না পাওয়া ও আশ্বাসিত শস্য সংগ্রহের অভাবই মূল সমস্যা। তিনটি বিলের কোথাও সি২+৫০% হিসাবে নির্ধারিত এমসপি এর থেকে কম মূল্যে শস্য সংগ্রহ করা যাবে না এই কথার উল্লেখ নেই।
The Farmers (Empowerment and Protection) Agreement on Price Assurance and Farm Services Act, 2020 চুক্তি চাষের সুবিধার্থে যেখানে সংস্থা বা একজন ব্যক্তি যে নাকি ‘স্পনসর’ বা দায়িত্বগ্রহণকারী ‘নির্দিষ্ট ফসলের একচেটিয়া ক্রয়ের অধিকারের বিনিময়ে কৃষককে (উৎপাদক) বীজ, সার, ঋণ বা সম্প্রসারণের মতো পরিসেবা দেয়।এটি স্পনসর (ক্রেতা) এবং উৎপাদকের মধ্যে একটি আগাম চুক্তি।কৃষক সম্প্রদায়কে বাজারের করুণায় ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হবে এবং তথাকথিত স্পনসরদের কৃষকদের উৎপাদনে একচেটিয়া অধিকার থাকবে।বর্তমান নীতি এবং কৃষক সম্প্রদায়ের করুণ অবস্থার কারণে চুক্তির শর্তাবলী স্পনসরদের অনুকূলেই হবে। বেশিরভাগ কৃষকই প্রান্তিক কৃষক, যারা অসহায় হয়ে পড়বেন।আইনটির নামে দামের নিশ্চয়তার কথা বলা হলেও আইনটিতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের কোনও উল্লেখ নেই।মূল্য নির্ধারণের ভিত্তিতে অস্পষ্টতা বজায় রয়েছে।দামের পরিবর্তন বা এই জাতীয় অন্যান্য মানদণ্ডের নামে এটি বিভিন্ন কারণের জন্য সুদৃঢ় কোন ব্যবস্থা নয়।এটি স্পনসর বা প্রযোজককে উৎপাদনের মূল্য নির্ধারণের সম্পূর্ণ অধিকার দেয়। এই আইনটি মহকুমা ম্যাজিস্ট্রেটকে নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তি কর্তৃপক্ষ গঠনের নির্দেশ দেয় এবং তার সাথে অন্য তিন সদস্য বিবাদ নিষ্পত্তির একমাত্র বিধান। এই আইন সম্পর্কিত কোনও মামলায় হস্তক্ষেপের অধিকার দেওয়ানি আদালতের নেই। এই ব্যবস্থা সর্বদা প্রযোজকের অনুকূলেই থাকবে এবং ক্ষুদ্র-মাঝারি-প্রান্তিক সহ সমস্ত স্তরের কৃষকরা বঞ্চিত হবে।সর্বোপরি, এই আইনের ফলে কৃষকরা কৃষি ব্যবসার দাবি অনুযায়ি ফসল উৎপাদনের জন্য দাসখত লিকে দিতে বাধ্য হবে , এই ফসল হবে মূলত ব্যবসাদারদের রফতানি ও মুনাফা নির্ভর ফসল।
অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইনের (ইসিএ) সংশোধনীগুলোর ফলে খাদ্যশস্য,ডাল,ভোজ্যতেল, তেলবীজ, আলু , পেঁয়াজ অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকার থেকে বাদ যাবে। এটা শুধুমাত্র খাদ্য সুরক্ষার প্রশ্নে একটা ভয়াবহ আশঙ্কা নয়, এছাড়া এই আইন বদলের ফলে কৃষিবিপণন সংস্থা ও ব্যবসাদারেরা কৃষকদের থেকে সরাসরি সীমাহীন পরিমাণে শস্য কিনে মজুত করতে পারবে এমনকি জরুরি অবস্থার সময়েও তাদের এই সুযোগ থাকবে। বিশেষত বর্তমান পরিস্থিতির মত সঙ্কটের সময়ে এটা ছিল অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের মজুতদারী রোধে একমাত্র অতি গুরুত্বপূর্ণ আইন। এমনকি স্বাভাবিক সময়েও বড় ব্যবসাদারদের ক্ষেত্রে এটা স্বাভাবিক অভ্যাস যে তারা মজুতদারী করে কৃত্রিমভাবে খুচরো বাজারে কৃষিজাত পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেয়। ইসিএ ছিল এই ধরণের প্রবণতার বিরুদ্ধে প্রধান আইনী হাতিয়ার।
আইনগুলোর সুদূরপ্রসারী প্রভাব: এই তিনটি কৃষি আইন কেবল কৃষকদেরই ক্ষতিগ্রস্থ করবে না, ক্ষেতমজুরদের জীবন ও জীবিকার উপরেও সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলবে।জমি পুনর্বিতরণের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রশ্নটি নতুন মাত্রা নেবে। ভাড়াটে কৃষকরা, যারা বেশিরভাগ কৃষক পরিবার থেকে আসে, তারা চুক্তি চাষ শুরুর পরে সরাসরি ক্ষতিগ্রস্থ হবে, তারা কোন জমি পাবে না কারণ বড় কর্পোরেশনদের কৃষিতে একচেটিয়া থাকবে এবং তারা কেবল জমির মালিকদের (উৎপাদক) সাথে সরাসরি চুক্তিতে প্রবেশ করবে।কৃষির কর্পোরেটকরণ হওয়ার সাথে সাথে আরও যান্ত্রিকীকরণ হবে যা কৃষি শ্রমিকদের কাজের দিন হ্রাস করবে।কৃষির কর্পোরেটকরণ হওয়ার সাথে সাথে খাদ্যশস্যের চেয়ে বাণিজ্যিক ফসল বা রফতানির জন্য উপযুক্ত ফসলের উপর বেশি জোর দেওয়া হবে।এপিএমসি আইন লঘু করে সরকারি ফসল মান্ডির অনুপস্থিতিতে যখন সরকারের শস্য সংগ্রহ হ্রাস পাবে ও বেসরকারি সংগ্রহ উৎসাহীত করা হবে তা জাতীয় খাদ্য সুরক্ষার জন্য বড় আশঙ্কা হয়ে উঠবে। এটি সবার জন্য খাদ্য নিশ্চিত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, গণবন্টন ব্যবস্থাকে, সরাসরি প্রভাবিত করবে ।
সর্বভারতীয় সংগ্রাম: তিনটি কৃষি আইন এবং চারটি লেবার কোড কার্যকর করার অর্থ মোদি সরকারের বৃহৎ পুঁজির সামনে আত্মসমর্পণ।রাষ্ট্র খাদ্য সুরক্ষা, ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের (এমএসপি) পারিশ্রমিকে কৃষিজ পণ্যের গ্যারান্টিযুক্ত সংগ্রহ এবং ন্যূনতম মজুরির বিধানের দায় প্রত্যাহার করে নিয়েছে।ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের মৌলিক অধিকার এবং শোষণের বিরুদ্ধে শ্রমিকদের সম্মিলিত দর কষাকষির ক্ষমতা ধ্বংস করা হচ্ছে। সারা দেশের শ্রমিক ও কৃষকদের এইসব আইনের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এই পরিস্থিতি জনগণ এবং জনগণের সংগঠনগুলোর দ্বারা সঙ্ঘবদ্ধ গণ প্রতিরোধের দাবি করেছে।
এর ফলে, তথাকথিত আনলক প্রক্রিয়া যখন শুরু হয়, ২০০ টিরও বেশি কৃষক ও ক্ষেতমজুরদের সংগঠনের একটি প্ল্যাটফর্ম সারা ভারত কৃষক সমন্বয় কমিটি বিক্ষোভ সংগঠিত করতে বাধ্য হয়েছিল।পাঞ্জাবের প্রায় ৩০ টি সংগঠন একটি রাজ্য-স্তরের সমন্বয় কমিটি গঠন করে এবং পাঞ্জাবে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম শুরু করে।জাতীয় পর্যায়ে এবং পাঞ্জাবে বিভিন্ন রূপে যে সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে, তা তীব্রতর হয়েছে।বিক্ষোভকারীরা রেলপথ দখল করে নিয়েছিল, রিলায়েন্স পেট্রোল পাম্প এবং আদনির স্টোরহাউস / গুদামগুলির সামনে অনির্দিষ্টকালের জন্য অবস্থানে বসেছিল।এই লড়াইটি দুই মাস অব্যাহত ছিল, কেন্দ্রের সরকার এই আন্দোলনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল এবং মালগাড়ি,যাত্রীবাহী ট্রেনসহ পাঞ্জাবের সমস্ত ট্রেন বন্ধ করে দিয়েছিল যদিও কিছু দিন পরে বিক্ষোভকারীরা রেললাইন থেকে সরে যায় এবং তাদের ধর্নাগুলো রেলওয়ে প্ল্যাটফর্মের বাইরে সরিয়ে নিয়েছিল।কেন্দ্রের সরকারের অসংবেদনশীলতা কৃষকদের সংগ্রামকে তীব্র করতে এবং দেশের রাজধানীর সীমানায় তাদের আন্দোলনকে পৌঁছে দিতে বাধ্য করেছিল।কেন্দ্রীয় সরকার কোন আলোচনায় গুরুত্ব দিতে নারাজ ছিল উপরন্তু কৃষকদের এই আইনগুলোর কাল্পনিক সুবিধা শেখানোর চেষ্টা করেছিল।
দিল্লি চলোর আহ্বান দিল্লি ঘেরাও তে রূপান্তর: পাঞ্জাবের সমন্বয় কমিটির সাথে যৌথভাবে এআইকেসিসি ২৬ ও ২৭ নভেম্বর দিল্লি অভিযানের একটি আহ্বান জানিয়েছিল, ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে।সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল যে গণপরিবহণের সীমাবদ্ধতার কারণে কেবল প্রতিবেশী রাজ্যগুলি দিল্লিতে পদযাত্রা করবে এবং অন্যরা তাদের নিজ নিজ রাজ্যে বিক্ষোভের আয়োজন করবে।এই তারিখটি কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির দ্বারা আহূত সারা ভারত ধর্মঘটের তারিখের সাথে মিলে যায়।ট্রেড ইউনিয়নগুলিও কৃষকদের আহ্বানকে সমর্থন করে এবং ২৭ নভেম্বর কৃষকদের সাথে দিল্লির দিকে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেয়। শ্রমিক শ্রেণী ২৬নভেম্বর একটি সফল ধর্মঘটের আয়োজন করেছিল যার মধ্যে কৃষক ও কৃষি শ্রমিকদের দ্বারা একটি সম্পূর্ণ গ্রামীণ ধর্মঘটও যুক্ত হয়।পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে কৃষকরা ২৫ নভেম্বর দিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিল।এরই মধ্যে হরিয়ানার কুখ্যাত মুখ্যমন্ত্রী কৃষকদের হুমকি দিয়েছিলেন যে পাঞ্জাবের কৃষকদের হরিয়ানায় প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।হরিয়ানার কৃষকরা এই চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করেছিল এবং পাঞ্জাবের কৃষকরা হরিয়ানায় প্রবেশের আগেই রাজ্যের মধ্যে অনেকগুলো ব্যারিকেড ভেঙেছিল।কৃষকরা সাহসের সাথে পুলিশি অত্যাচারকে সহ্য করে এবং এক দীর্ঘ লড়াইয়ের পরে পাঞ্জাব-হরিয়ানার বিভিন্ন স্থানে সমস্ত বাধা, কাঁদানে গ্যাস, জল কামানের ব্যারিকেড ভেঙে দিল্লিতে প্রবেশ করেছিল।ইতিহাসে এমন উদাহরণ বিরল যখন পুলিশ কৃষকদের মিছিল থামাতে রাস্তায় গর্ত খুঁড়ে দিয়েছে।আন্দোলনকারীরা গত আট দিন ধরে দুটি জাতীয় সড়কের সীমান্তে বসে আছেন।বিক্ষোভকারী কৃষকরা দিল্লি-উত্তর প্রদেশ সীমানায় গাজিয়াবাদে এবং নয়ডায় আরও দুটি হাইওয়ে অবরোধ করেছে।নতুন নতুন জাঠা প্রতিদিন প্রতিবাদস্থলগুলোতে যোগ দিচ্ছে এবং প্রচুর কৃষক সংগঠন এই লাগাতার সংগ্রামে যোগ দিচ্ছে।কেন্দ্রীয় সরকারের মনোভাব সন্দেহজনক এবং উদাসীন।আন্দোলনে বিভাজন করার জন্য সরকার তার সমস্ত শক্তি এবং কৌশল প্রয়োগ করছে।তবুও এই আন্দোলন গ্রাম ভারতকে নজিরবিহীনভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছে।
সংগ্রাম থামাতে বিজেপির প্রচেষ্টা: সরকার ও বিজেপি আইটি সেল কর্তৃক এই গণ-সংগ্রামকে খালিস্তানের ষড়যন্ত্র হিসাবে চিত্রিত করার বিদ্বেষমূলক প্রচার ও প্ররোচনা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ।তারপরে তারা দাবি করে যে এটা শুধুমাত্র পাঞ্জাবের কৃষকদের আন্দোলন, তাদের দ্বিমুখী কৌশল ছিল এই আন্দোলনে বিভাজন সৃষ্টি করা ও সারা দেশের কৃষকদের সমস্যাগুলোকে ধামাচাপা দেওয়া।
যেহেতু এটা সচেতন সিদ্ধান্ত ছিল যে কেবল আশেপাশের রাজ্যগুলো থেকে দিল্লির পদযাত্রা করা হবে , তাই পাঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্য প্রদেশের কৃষকরা দিল্লিমুখী পদযাত্রায় অংশ নিয়েছে।এটা স্বীকার করা উচিত যে সংহতির প্রধান অংশটা পাঞ্জাবের এবং পাঞ্জাব ও হরিয়ানায় সংগ্রামের তীব্রতা ভারতের অন্যান্য অংশের তুলনায় অনেক বেশি।এই দুটি রাজ্যের কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন কারণ এই দুটি রাজ্যের ফসল সংগ্রহ পরিকাঠামো খুব ভাল।পাঞ্জাবের ৯৫ শতাংশেরও বেশি ধান চাষী এবং হরিয়ানায় প্রায় ৭০ শতাংশ কৃষক ফসল ক্রয় ব্যবস্থার আওতায় রয়েছে, অন্য প্রধান ধান উৎপাদনকারী রাজ্যগুলিতে যেমন উত্তর প্রদেশ (৩.৬%), পশ্চিমবঙ্গ (৭.৩%) ওড়িশা (২০.৬%) এবং বিহার (১.৭%) খুব কম সংখ্যক ধানের কৃষক ফসল ক্রয় কার্যক্রমে উপকৃত হন।উত্তরপ্রদেশ গমের সর্বাধিক উৎপাদক হলেও এর উৎপাদনের মাত্র ১১-১২% সরকার সংগ্রহ করে।
এটা বলা হচ্ছে যে কৃষকরা বিপথগামী এবং এই আন্দোলন বিরোধীদের মদতপুষ্ট , এমনকি নরেন্দ্র মোদিও এই মিথ্যা তোতাপাখির মত আউড়ে যাচ্ছেন। এই যুক্তি ধূলিস্যাত হয়েছে, এনডিএর প্রবীণতম মিত্র হিসাবে আকালি দল এনডিএ ছেড়েছে এবং তাদের একমাত্র মন্ত্রী কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছে।হরিয়ানায়, বিজেপির জেজেপির মিত্ররা কৃষি আইন বাতিলের দাবি করেছে।বিজেপির মিত্র হনুমান বেনিওয়াল সরকারের বিরুদ্ধে সুর চড়াতে বাধ্য হয়েছিল।এটি একটি সংগঠন বা দলের আন্দোলন নয় বরং ভারত এবং বিদেশে জনগণের ব্যাপক সমর্থন পাওয়ার কৃষকদের একটি গণআন্দোলন।দিল্লির বাসিন্দারা বিক্ষোভ-আন্দোলনগুলোকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করছেন।স্থানীয় হোটেল এবং বাসিন্দারা আন্দোলনকারীদের জন্য দরজা খুলে দিয়েছে।বিভিন্ন নাগরিক সমাজ সংস্থা, ছাত্র সংগঠন, যুবক, মহিলা, শিক্ষক ইত্যাদি তাদের সম্পূর্ণ সমর্থন এবং সহায়তা দিয়েছে।বিক্ষোভকারীরা তাদের সাথে পর্যাপ্ত পরিমাণে রেশন এবং অন্যান্য খাবারের সরবরাহ নিয়ে আসা সত্ত্বেও স্থানীয়রা বিক্ষোভস্থলগুলোতে লঙ্গর শুরু করেছে।উদাহরণস্বরূপ, হরিয়ানার রোহতকের একটি গ্রাম একদিনেই টিক্রি সীমান্তে ২৫০০ লিটার দুধ পাঠিয়েছে।পশ্চিমবঙ্গ এবং তেলেঙ্গানা থেকে ডাক্তারদের দুটি দল দিল্লির ডাক্তারদের সাথে হাত মিলিয়ে বিক্ষোভস্থলগুলোতে শিবির চালু করেছে।
গোটা সমাজ এই ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ এবং কৃষকদের সাথে দাঁড়িয়েছে তবে নির্বাচিত সরকারের ভিন্ন পরিকল্পনা রয়েছে।প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বিভিন্ন মন্ত্রী কৃষকদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিচ্ছেন।আন্দোলনের চাপের মুখে কেন্দ্রের সরকার তাদের আলোচনার জন্য ঘোষিত ৩ ডিসেম্বরের রহস্যজনক তারিখের আগেই আলোচনা শুরু করতে এবং আলোচনার প্রস্তুতি নিতে বাধ্য হয়েছিল।নেতৃত্বকে বিভক্ত করার লক্ষ্যে সরকার কেবলমাত্র পাঞ্জাবের নেতৃত্বকে আমন্ত্রণের প্রাথমিক অবস্থানের থেকে সরে আলোচনার জন্য এআইকেসিসির নেতৃত্বকে ডাকতে বাধ্য হয়েছিল।১ ডিসেম্বর সরকারের সাথে প্রথম দফার আলোচনার বিষয়টি ফলপ্রসূ হয়নি।কৃষক নেতারা আপত্তি ও পর্যালোচনার জন্য ৫ সদস্যের কমিটি গঠনের সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।তারা সরকারকে জানিয়েছিল যে অতীতে এ জাতীয় কমিটিগুলো করে কোন লাভ হয়নি। এআইকেএসসিসি সারা দেশে কৃষকদের আন্দোলন তীব্র করার আহ্বান জানিয়েছে।
যুদ্ধক্ষেত্রের লাইনগুলি দুটি পক্ষের মধ্যে খুব স্পষ্ট করে আঁকা।একদিকে, কৃষক এবং অন্যান্য শক্তিগুলি যারা সরকারী ক্ষেত্রকে বাঁচাতে চায় এবং অন্যদিকে বিজেপি সরকার এবং তাদের কর্পোরেট সহযোগীরা।জয় জওয়ান-জয় কিসানের স্লোগানকে নতুন করে সংজ্ঞায়িত করেছে বিজেপি।জওয়ানরা যখন কোনও বহির্শক্তির হুমকী থেকে দেশের সীমান্তকে রক্ষা করছে, তখন বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার কৃষকদের দেশের রাজধানীর সীমান্তে বসতে বাধ্য করেছে।এই আন্দোলন বিজেপি এবং তার সহযোগীদের সম্পূর্ণ উন্মোচিত করেছে।এই আন্দোলন হিন্দুত্ববাদের রাজনীতিকেও চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে, যার লক্ষ্য মানুষকে ধর্মীয় ও বর্ণের ভিত্তিতে ভাগ করা।জীবন ও জীবিকার উপর হামলা ধর্ম, বর্ণ, রাজ্য এবং রাজনৈতিক সীমা অতিক্রম করে সকল মানুষকে এক করেছে।বিজেপি এবং তার রাজনীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একমাত্র উপায় হ’ল জনগণের সংগ্রাম।আগামী দিনগুলিতে কৃষকরা জঙ্গি আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, শ্রমিকরা যোগ দিচ্ছে তাদের সাথে , এবং বিভিন্ন অংশের জনসাধারণ রাস্তায় নেমেছে।সংগ্রামের বিজয় অনিবার্য এবং বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে দীর্ঘকাল স্মরণ করা হবে।