34 years of Alternative Governance

একটি ওয়েব ডেস্ক প্রতিবেদন

“বামপন্থী ফ্রন্টের সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচী রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে জনগণের স্বার্থের সেবা করবে, তাদের জীবনযাত্রার মান সংরক্ষণ ও উন্নয়নে সহায়া করবে এবং ৩০ বছরের কংগ্রেসী অপশাসনে তারা যে চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়েছেন, তার কিছুটা উপশমের ব্যবস্থা করতে পারবে। বামপন্থী দলগুলো দুর্নীতি, স্বজনপোষণ ও অযোগ্যতামুক্ত একটা পরিচ্ছ্ন্ন প্রশাসনব্যবস্থা চালু করতে সচেষ্ট হবে। মেহনতী মানুষের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলি তুলে ধরা ও তার পক্ষে দাঁড়ানো এবং এক সুন্দর ভবিষ্যত গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই অধিকারগুলির সংরক্ষণ ও প্রসারের সংগ্রামে জনগণকে সাহায্য করা বামপন্থী ফ্রন্টের নিরন্তর প্রয়াস হবে।” গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা, নৈরাজ্যের অবসান ঘটানো, গণতন্ত্রের প্রসার, আইনের শাসন ও ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার স্থাপনের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালের বামপন্থী ফ্রন্টের নির্বাচনী ইস্তেহারের এই অঙ্গীকারগুলোকেই ১৯৭৭ সালের ২১ জুন থেকে ৩৪ বছর ধরে লালন ও বিস্তার ঘটিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার।

১৯৭৭ সালের ২১ জুন শপথ গ্রহনের মূহুর্ত থেকে কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকার নিরন্তর চেষ্টা করে গিয়েছিল ভারতের আর্থ সামাজিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের শাসক শ্রেণীর দৃষ্টিভঙ্গীর চোখে চোখ রেখে কমিউনিস্টদের পরিচালিত বিকল্প গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কে ঊর্ধ্বে তুলে ধরার।

স্বাধীনতার সময় থেকে ১৯৭৭ পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে একের পর এক গণ আন্দোলনে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছিল কংগ্রেসী সরকার। সূর্য সেন, কল্পনা দত্ত, মুজফফর আহমদ পথে হেঁটে , তেভাগার কৃষকদের লড়াইয়ে শক্তিশালী হয়ে ওঠা কমিউনিস্টদের আন্দোলন জন আন্দোলনের রূপ ধারণ বারবার আছড়ে পরে বাংলার মাটিতে। ১৯৫৯ এর খাদ্য আন্দোলন, ১৯৬৬ এর খাদ্য আন্দোলন বারবার করে জনতার শক্তিতে বলীয়ান লালা ঝান্ডার হিম্মতের প্রতীক হয়ে উঠেছিল যার ফলস্বরূপ ১৯৬৭ ও ১৯৬৯সালে পরপর দুবার বিপুল জনাদেশ পায় সিপিআই(এম) সহ কংগ্রেস বিরোধী জোট , কিন্তু এই দুবারেই শাসক শ্রেণী তাদের কায়েমি স্বার্থ ধরে রাখতে বিকল্প জোটের মধ্যে ফাটল ধরানো, রাজ্যপালের ক্ষমতা ব্যবহার করা সহ সমস্ত ধরণের দমনপীড়নকে ব্যবহার করতে পিছপা হয়নি। ১৯৭১-১৯৭৭ পর্বে পুলিশ ও সমাজবিরোধীর যৌথ আক্রমণে আমাদের পার্টির ১৫০০ এর বেশি নেতা কের্মী খুন হন। বামপন্থী জোটের মধ্যে ফাটল ধরানোর লক্ষ্যে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ও প্রবীন ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বসুকে – দায় চাপানো হয় সিপিআই(এম) এর ওপরে ! কিন্তু এই কুৎসা ও রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমেও জনতার বলে বলীয়ান বাম গণ আন্দোলনকে স্তব্ধ করা যায়নি। জরুরি অবস্থা জারি, দমনপীড়ন, বাম নেতা কর্মীদের জেলে আটকে রাখা, খুন করা কোন কিছু করেই রোখা যায়নি বামপন্থীদের। ১৯৭৭ সালে লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দল শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠাই ছিল তখন মূল লক্ষ্য। ১৯৭৭ সালের জুন মাসে বিানসভা নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বামফ্রন্ট জয়ী হয়। সিপিআই(এম) নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করে। বামফ্রন্টের সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯৭৭ সালের আজকের দিনে মন্ত্রিসভা শপথগ্রহণ করে।

Image Source: Google

সিপিআই(এম) তথা বামফ্রন্টের মধ্যে এই বিষয়টি স্পষ্ট ছিল যে এরকম একটা বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্রকাঠামোর মধ্যে কায়েমী স্বার্থের বাধা ও চক্রান্ত এবং অঙ্গরাজ্যের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে জনজীবনে কোন মৌলিক পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব নয়। এই কথা কোন দিন গোপণ ও করা হয়নি। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তর ৩০ বছর সময়কালে পশ্চিমবঙ্গ যে ভয়াবহ অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল তার পরিবর্তন যে সম্ভব এটা প্রমাণ করা গিয়েছিল। সরকার শুধু মহাকরণ থেকে চলবে না , জনগণের বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্বমূলক সংগঠনের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক রেখে , তাদের সথে আলোচনা ও তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে গণতন্ত্রকে তৃণমূল স্তর অবধি পৌঁছে দেওয়াই ছিল মূল লক্ষ্য।

কংগ্রেস আমলে সুষ্ঠু পৌর-পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়নি। নিয়মিত নির্বাচন হত না। বিরোধিদের পরিচালিত পৌরসভাগুলো মিথ্যা অজুহাতে ভেঙে দেওয়া হত। পঞ্চায়েতগুো ছিল গ্রামীন জমিদার ও কায়েমী স্বার্থের ঘাঁটি। এই পরিস্থিতির অবসান ঘটানো হয় বামফ্রন্টের আমলে। আইনের সংশোধন করা হয়। বৈষম্য বন্ধ করা হয়। ১ ৯৭৮ সালের প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন কায়েমী স্বার্থের মেরুদন্ড ভেঙে দিতে সক্ষম হয়। পৌর নির্বাচনকে ও নিয়মিত ও স্বচ্ছতার সাথে করার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা হয়।

পঞ্চায়েত ব্যবস্থা শক্তিশালী হওয়ার ফলে ভূমিসংস্কার, গ্রামোন্নয়ন, কঋষি উৎপাদনে বিরাট অগ্রগতি, গ্রামের মানুষের ক্রয় ক্সমতা বৃদ্ধি , মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি সারা ভারত নয় বরং গোটা বিশ্বের কাছে একটা অনন্য নজির হয়ে ওঠে। ভূমিসংস্কারে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের মালিকানায় এসেছিল ৮৫% জমি, সারা ভরতে যে হার ছিল মাত্র ৪৩%। সরাদরি ৩০ লক্ষের বেশি পরিবার জমিবন্টন থেকে উপকৃত হয়, বর্গা রেকর্ডে উপকৃত হয় ১৫ লক্ষ পরিবার।

ভূমিসংস্কার ও অন্যান্য ব্যবস্থার ফলে কৃষি উৎপাদনেও অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা যায়। ১৯৭৭ সালে রাজ্যে সেচসেবিত জমি ছিল ৩২%, যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭০% এ। চাল ও সবজি উৎপাদনে ভারতের মধ্যে প্রথম স্থানে উঠে আসে বাংলা। ২০০৭ সালের মধ্যে অভাবী গ্রাম বাংলা পরিণত হয় ২০হাজার কোটি টাকার শিল্প পণ্যের উপভোক্তায়। গ্রাম বাংলায় সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেয়েছিল তপশিলি জাতি,উপজাতি আদিবাসী, সংখ্যালঘু ও অন্যান্য অণগ্রসর শ্রেনীর মানুষেরাই।

শিক্ষাক্ষেত্রেও বিপুল পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছিল। অনিয়মিত পরীক্ষা, গণ টোাটুকি সহ শিক্ষা ক্ষেত্রে যে চরম নৈরাজ্য চলেছিল তাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়। এসএসসি,টেট, কলেজ সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়মিত পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ সুনিশ্চিত করা হয় যাতে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতার ভিত্তিতেই নিয়োগ হয়। বিদ্যালয় স্তরে অবৈতনিক শিক্ষা, সুস্থ পরিবেশ ও শিক্ষকদের বেতন প্রায় ২২ গুণ বৃদ্ধির মত পদক্ষেপগুলো শহর ও আর্থিকভাবে স্বচ্ছলদের সুশিক্ষা পাওয়ার যে অগ্রাধিকার ছিল তার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটায়। চিকিৎসা ক্ষেত্রেও আসে আমূল পরিবর্তন। এ রাজ্যের ৭০% মানুষ সরকারি পরিকাঠামোর স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় উপকৃত হতেন। গড় আয়ু বৃদ্ধি, শিশু মৃত্যুর হার কমানো, প্রসূতি মৃত্যুর হার কমানো, অপুষ্টি কমানোর মত একাধিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল।

এই পরিকাঠামোর ওপরে ভিত্তি করেই রাজ্য শিল্পে স্বনির্ভর হওয়ার পথে পা বাড়ায়। কেন্দ্রের সরকারে মাশুল সমীকরণ নীতি পশ্চিমবঙ্গকে অনেকটা পিছিয়ে দিয়েছিল। ১৯৬৫ সালে দুর্গাপুর ইস্পাত কারখানার পরে কেন্দ্রের উদ্যোগে কোন বৃহৎ শিল্প এ রাজ্যে গড়তে দেওয়া হয়নি । দেশভাগের ফলে রাজ্যের যে বিপুল উদ্বাস্তু সমস্যা তার প্রতিও ছিল কেন্দ্রের উদাসীনতা। ৮০র দশকের মাঝামাঝি ইলেকট্রনিক কমপ্লেক্স তৈরি ক্ষেত্রেও সীমান্ত রাজ্য ও নিরাপত্তার অজুহাত দেখিয়ে কেন্দ্র কোন ধরণের সাহায্য করতে অস্বীকার করে। এর মধ্যেই একার প্রচেষ্টায় রাজ্যে বক্রেশ্বর তাপ বিদ্যুত কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়।

১৯৯০ এর দশকে আইএমএফ, বিশ্ব ব্যাঙ্কের,বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার ফর্মূলা মানতে গিয়ে দেশের আর্থিক ও বাণিজ্যিক অবস্থা আরো সঙ্কটে পরে কিন্তু এরফলে মাশুল সমীকরণ নীতি তুলে দিতে বাধ্য হয় কেন্দ্র। এই সুযোগকে সদ্ব্যবহার করতে ১৯৯৪ সালে বামফ্রন্ট সরকার তার শিল্পনীতি ঘোষণা করে। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি লগ্নীকেও বিনিয়োগের রূপরেখা তৈরি হয়। কৃষি ভিত্তিক শিল্প, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ থেকে ভারী শিল্প, আইটি সমস্ত ক্ষেত্রেই বিপুল বিনোয়োগের সুযোগ তৈরি হয়। ১৯৯১ থেকে ২০০৭ এর মধ্যে বিনিয়োগ হয় প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা। ২০০৬ সালে বামফ্রন্ট বিপুল জনাদেশ নিয়ে সপ্তম সরকার গঠন করে। ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি শিল্প আমাদের ভবিষ্যত’ এই ছিল মূল শ্লোগান।২০১৪ সালে প্রকাশিত ন্যশনাল স্যাম্পেল সার্ভে রিপোর্ট যার সমীক্ষা কাল ছিল ২০০৪ থেকে ২০১১ সেখানেও উল্লেখ আছে যে ঐ সময়কালে গোটা দেশে উৎপাদন শিল্পে ৫৮.৭ লাখ কাজ তৈরি হয়েছিল যার ৪০% একা পশ্চিমবঙ্গের, সংখ্যার হিসাবে ২৪ লাখ, দ্বিতীয় গুজরাট ছিল অনেক পেছনে।২০০৬ থেকে ব্যাপক শিল্প বিনিয়োগের কাজ শুরু হলে অতীতের কংগ্রেস ভেঙে তৈরি হওয়া তৃণমূল সহ মাওবাদী, বিজেপি সবাই জোট বাধে বামফ্রন্টকে পরাস্ত করতে। মেকি কৃষকপ্রেম আর ক্রমবর্দ্ধমান মিডিয়াকে কাজে লাগিয়ে বাম সরকাকরকে ভিলেন বানিয়ে তোলা হয়। সমস্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙে ফেলার চেষ্টা হয় । সেই প্রয়াস সফল হয়েছে সাময়িক ভাবে। রাজ্যে এখন তৃণমূল সরকারে। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার যে উজ্জ্বল ব্যতিক্রম হিসাবে মানুষকে সাথে নিয়ে বিকল্পের সন্ধানে পথ হেঁটেছিল তার অবদান কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।

Spread the word

Leave a Reply