নিজের মক্কেল, গুজরাট পুলিশের প্রাক্তন ডিজি বানজারাকে ছাড়াতে তাঁর আইনজীবী ভিডি গজ্জর সিবিআই আদালতে ক্রাইম ব্রাঞ্চের অবসরপ্রাপ্ত ডেপুটি পুলিশ সুপার ডিএইচ গোস্বামীর উদ্ধৃতি তুলে ধরেছিলেন। যেখানে গোস্বামী বলছেন, বানজারার কথায়, ‘ভুয়ো সংঘর্ষে ইশরাত সহ অন্যদের সংঘর্ষে খুনের ব্যাপারে কালো দাড়ি ও সাদা দাড়ি দুজনেরই অনুমতি ছিল।’ উষ্মা প্রকাশ করে আদালতকে সেই আইনজীবীর বক্তব্য ছিল, ‘‘সিবিআই চেয়েছিল কালো দাড়ি ও সাদা দাড়ির লোককে গ্রেপ্তার করতে, কিন্তু তা না পেরে লাল দাড়ির লোককে গ্রেপ্তার করেছে।”
গুজরাটে সে সময় লাল দাড়ির নাম উঠলেই সঙ্গে চলে আসত সাদা দাড়ি আর কালো দাড়ির নাম। বলা হতো, ওরা যা বলবে সেই মতোই কাজ করে দেয় লাল দাড়ি। গুজরাট পুলিশের কাছে সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী অমিত শাহের কোড নেম ছিল ওই সাদা দাড়ি আর কালো দাড়ি। আর লাল দাড়ি হলো ডিজি বানজারা।
লাল দাড়ির দাবি, ওদের কথা মতোই খতম করা হয়েছে ইশরাত জাহান, সোরাবুদ্দিন, কিংবা রাজনীতিতে বিরুদ্ধাচারণ করে ‘চক্ষুশূল’ হয়ে যাওয়া এমন কেউ, যাকে যেমন দরকার পড়েছে, সেই মতো। বেচাল হলেই মুশকিল। সেই লাল দাড়ি, ডিজি বানজারাই নাকি খুন করিয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হারীন পান্ডিয়াকে। গোধরা পরবর্তী গণহত্যার সময় স্বরাষ্ট্রের দায়িত্বে ছিলেন এই পান্ডিয়া। খুন করানোর জন্য সোহরাবুদ্দিন শেখকে বরাত দিয়েছিলেন গুজরাট পুলিশের তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল। পরে আবার ভুয়ো সংঘর্ষে খতম করে ফেলা হয় ওই সোহরাবুদ্দিনকেও।
পরে আবার সেই সোহরাবুদ্দিন মামলার বিচারপতি সেন্ট্রাল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (সিবিআই) আদালতের বিচারক ব্রিজগোপাল হরকিষণ লোয়ার মৃত্যু ঘটে রহস্যজনকভাবে। এবারও নাম ওঠে বিজেপি’র তৎকালীন সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহের।
অভিযোগ তো অনেক ওঠে। কিন্তু সাদা দাড়ি, কালো দাড়ির বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে অভিযোগ টিকিয়ে রাখা বড়ই মুশকিল। সোহরাবুদ্দিন মামলায় তবু তো অমিত শাহকে জেলে যেতে হয়েছিল। কিন্তু বিচারপতি লোয়া মামলা ধোপেই টিকলো না। সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ বিচারপতি এই মামলার নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করলেও কিছুই হয়নি। বরং অমিত শাহকে জেলে পাঠিয়েছিলেন যে বিচারপতি সেই আকিল কুরেশিরই নিয়োগ আটকে যায়। ঠিক যেমন, দিল্লির হিংসায় বিজেপি নেতাদের উসকানি নিয়ে সরব হওয়ায় বদলি হয়ে যেতে হলো বিচারপতি এস মুরলীধরকে।
শুধু নিজেকেই ‘বেকসুর খালাস’ করিয়ে নেওয়া নয়, এর মাঝে সবটা সামলে একে একে জেলের বাইরে এসেছে সব কুকর্মের সঙ্গীরাই। জেলের বাইরে এসেছে ‘এনকাউন্টার স্পেশালিস্ট’ বানজারাও। জেলের বাইরে নারোদা পাটিয়ার গণহত্যাকারী মায়া কোদনানিও। জেলের বাইরে বোমা বিস্ফোরণে অভিযুক্ত অসীমানন্দ কিংবা প্রজ্ঞা ঠাকুর। পরের জন তো সংসদের আসনকে ‘গৌরবাম্বিত’ করছেন। আবার গণহত্যায় দোষী ১৪ যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিতকে ছেড়ে দেওয়া হয় ‘ধম্মো-কম্মো করতে’।
কারণ এতদিনে সেই সাদা দাড়ি আর কালো দাড়ি এখন দেশ শাসন করছে। গুজরাটের তখ্ত সামলে এখন সেই জুটি দেশের রাশ হাতে নিয়ে মানুষকে সহবত শেখানোর পাঠশালা চালাচ্ছেন। বিচার বিভাগ থেকে প্রশাসন, কোনও প্রতিষ্ঠানই তাঁদের রাডারের বাইরে নেই। তফাত অবশ্যই আছে। গুজরাটে মোদীর কিচেন ক্যাবিনেটের সদস্য অমিত শাহ একাই ১৮টি দপ্তর সামলালেও প্রতিমন্ত্রী হিসাবে আড়ালে কাটিয়ে গেছেন বরাবর। কিন্তু উনিশে জিতে সেই মোদীই শাহকে এগিয়ে দিতে বাধ্য হয়েছেন সামনে। ৩৭০ ধারা, বাবরি মামলা থেকে শুরু করে অনেক বড় লক্ষ্য পূরণ এবারের চাহিদা। তাই এবার সামনে থেকে সমান্তরালভাবেই কাজ করে চলেছেন কালো দাড়ি, তবে আড়াল খসে পাকে পাকে সে দাড়িতেও এখন বেশ কিছুটা পাক ধরেছে।
সেই ২৭ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে গোধরা থেকে গান্ধীনগর ফিরে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী পুলিশ আর প্রশাসনের বাছাই করা লোকদের নিয়ে যে ‘গোপন বৈঠক’ করেছিলেন অভিযোগ, নিন্দুকেরা বলে থাকে সেই মিটিংয়ের আসল কারিগর আড়ালে থাকা ওই কালো দাড়িই। ‘হিন্দুদের রাগ মিটিয়ে নেওয়ার খানিকটা সুযোগ দেওয়ার’ নির্দেশ দেওয়ার সেই বৈঠকের কথা ফাঁস করেই হয়তো শেষ পর্যন্ত প্রাণ খোয়াতে হলো মোদীর সে সময়ের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী হারীন পান্ডিয়াকে।
আরেক ২৭ ফেব্রুয়ারি যখন পুলিশকে দর্শক দাঁড় করিয়ে দিল্লিতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা তখন সেই পুলিশের ভূমিকার পেছনেও অমিত শাহের ভূমিকাই দেখছেন পর্যবেক্ষকরা।
দিল্লি যখন জ্বলছে, সেই কালো দাড়ির লোকটাই কলকাতায় আসছেন। তবে দিল্লির গণহত্যার রক্ত মাখা হাত নিয়ে কালো দাড়ির সেই অমিত শাহ কলকাতায় এলেই বিক্ষোভ হবে, জানিয়ে দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের ছাত্র-যুব, গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ। কারণ স্পষ্ট, এই অমিত শাহকে চেনেন বামপন্থীরা। এই আড়ালে থেকে ছড়ি ঘোরানোর কাজ করা লোকটাকে চেনেন গণতন্ত্রের পথে থাকা মানুষজন।
তাই তাঁরা পথে থাকবেন। ঘিরে রাখবেন। আওয়াজ তুলবেন, ‘গো ব্যাক অমিত শাহ’।