Party Congress History Part XIII Cover

History of Party Congress (Part-XIII)

কৃষ্ণায়ন ঘোষ

১৮ তম পার্টি কংগ্রেস

প্রেক্ষাপট

পার্টি এবং বামপন্থীরা জাতীয় স্তরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, সাম্প্রদায়িক শক্তি ক্ষমতা থেকে অপসারিত হওয়ার পরই ১৮তম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়।

১৭তম কংগ্রেস নিজের তিনটি লক্ষ্য অর্জন করে-

১) বিজেপি নেতৃত্বাধীন সাম্প্রদায়িক জোটকে পরাজিত করা,

২) কেন্দ্রে একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা করা এবং

৩) লোকসভায় বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধি।

লোকসভায় বামেরা তাদের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্ব অর্জন করে এবং নীতিগুলোর ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। বেসামাল উদারনীতিবাদ এবং বিজেপির পুনরুত্থানকে প্রতিহত করতে সফল হয়। ফলে সিপিআই(এম), কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করার সিদ্ধান্ত নেয়।

যদিও সিপিআই(এম) ও বামদলগুলো ইউপিএ সরকারের সাধারণ ন্যূনতম কর্মসূচিকে সমর্থন করেছিল। কিন্তু বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসরকারিকরণ এবং সর্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থা বাস্তবায়নে অনীহার মতো বিষয়গুলিতে মতপার্থক্য প্রকাশ করে।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতির তীব্র বিস্তার প্রত্যক্ষ করা যায়। সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের অজুহাতে যুক্তরাষ্ট্র ইরাক দখল করেছে, যা পশ্চিম এশিয়াকে পুনর্গঠনের বৃহৎ পরিকল্পনার অংশ। ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার পর আফগানিস্তান ও ইরাকে আক্রমণ চালানো হয়, এবং অন্যান্য রাষ্ট্র যেমন ইরান, কিউবা, সিরিয়া ও ভেনেজুয়েলাকেও হুমকি দেওয়া হতে থাকে।

মার্কিন নীতি রাষ্ট্রসঙ্ঘের সনদ ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন করে। তারা “আগাম আঘাতের” যুদ্ধনীতি গ্রহণ করে, ন্যাটোর সম্প্রসারণ ঘটাতে থাকে এবং বিশ্বজুড়ে সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করে। এভাবে জাতীয় সার্বভৌমত্ব পদদলিত করে, যুদ্ধ ও হস্তক্ষেপের মাধ্যমে নিজেদের আধিপত্য সুদৃঢ় করে চলে।

ইরাকে আগ্রাসন ও তার তাৎপর্য

ইরাক যুদ্ধ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের লুটের মনোভাব প্রকাশ করে। গণ-বিধ্বংসী অস্ত্র বা আল-কায়েদার উপস্থিতির প্রমাণ ছাড়াই এই আক্রমণ চালানো হয়। প্রকৃত লক্ষ্য ছিল ইরাকের বিশাল তেলসম্পদ ও স্বাধীন নীতি। এক দশকের নিষেধাজ্ঞার পর দখলদার শাসনে লক্ষাধিক ইরাকি নিহত হয়, শিশুরা পঙ্গু হয়ে যায়, নারীরা নির্যাতিত হয়।

মার্কিন সামরিক দখল পশ্চিম এশিয়ায় আধিপত্য বজায় রাখার অংশ। তাদের লক্ষ্য ছিল কেবল ইরাক নয়, সমগ্র মধ্য এশিয়া ও ককেশাস অঞ্চলের জ্বালানি সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করা।

সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদের দ্বন্দ্ব

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। তারা সামরিক শক্তির মাধ্যমে বিশ্ব নিয়ন্ত্রণ করে এবং অর্থনৈতিক দমন, অবরোধ ও রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে। বিশ্ব সম্পদের ওপর একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে যুক্তরাষ্ট্র নানাবিধ পদক্ষেপ নেয়, যেমন মধ্যপ্রাচ্যের তেলক্ষেত্রের দখল ও ন্যাটোর সম্প্রসারণ।

পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থা সংকটে পড়ে। ২০০১-২০০৩ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেয়, যার উত্তরণ হয় মূলত সামরিক ব্যয়ের মাধ্যমে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সামরিক ব্যয়ের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যা লোক-ঋণের মাধ্যমে পরিচালিত হতে থাকে এবং কোষাগারীয় ঘাটতি বৃদ্ধি করে। ফলে ব্যালান্স অব পেমেন্ট সংকট ও ডলারের মূল্যহ্রাসের আশঙ্কা তৈরি হয়।

সে সময় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে ব্যর্থ হয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, কল্যাণমূলক কর্মসূচি কাটছাঁট করা হয়, শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করা হয়। পুঁজিবাদের এই নীতি ধনী-গরিব বৈষম্য বাড়িয়ে তুলতে থাকে এবং জনগণের ওপর শোষণ তীব্রতর হয়।

সংগ্রামের দিশা

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী প্রতিরোধ জরুরি হয়ে পড়ে। যুদ্ধ ও দখলদারির বিরুদ্ধে সংগ্রাম, জাতীয় সার্বভৌমত্ব রক্ষা, অর্থনৈতিক অবরোধের বিরোধিতা এবং রাষ্ট্রসঙ্ঘের গণতন্ত্রীকরণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। বিশ্বের শ্রমজীবী মানুষকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রয়জনিয়তা দেখা দেয়, যাতে ন্যায্য ও ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়।

জাতীয় পরিস্থিতি

২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে বি জে পি পরিচালিত এন ডি এ সরকার পরাজিত হয়, যার মূল কারণ ছিল তাদের সাম্প্রদায়িক নীতি, দুর্নীতি ও জনবিরোধী অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। একই সময়ে অন্ধ্রপ্রদেশ ও পরে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি সমর্থিত সরকারগুলিও পরাজিত হয়। ফলে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা (ইউপিএ) সরকার গঠিত হয়, যা বামপন্থীদের সমর্থনের ওপর নির্ভরশীল ছিল।

১৯৯৮-২০০৪ সালের বি জে পি শাসনকালে সাম্প্রদায়িক শক্তি উত্থান ঘটায়, গুজরাট গণহত্যার মতো ভয়াবহ ঘটনা ঘটে, এবং মুসলিম ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে দমননীতি চালু হয়। বাজপেয়ী সরকার অযোধ্যা বিতর্ককে সাম্প্রদায়িকভাবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল এবং শিক্ষা-ব্যবস্থায় ধর্মীয় গোঁড়ামির অনুপ্রবেশ ঘটায়। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে আর এস এস-এর আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা চলে। এই পরিস্থিতি ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

নয়া উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতির ফলে কৃষি ও শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধি মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়, যা কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাত্রাকে সংকটাপন্ন করে তোলে। কৃষিতে ভর্তুকি কমিয়ে দেওয়া, ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ সংকুচিত করা এবং উৎপাদন খরচ বৃদ্ধির ফলে কৃষকরা বিপুল পরিমাণ ঋণের বোঝায় জর্জরিত হয়ে পড়ে। একদিকে সরকারি সহায়তা কমিয়ে দেওয়া হয়, অন্যদিকে কৃষি খাতকে বহুজাতিক কর্পোরেশনের হাতে তুলে দেওয়া চলতে থাকে, যা কৃষকদের আত্মনির্ভরশীলতার পরিবর্তে তাদের উপর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে তোলে। ফলস্বরূপ, তারা আর্থিক সংকটে পড়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়।

কৃষিজমির ব্যবহারেও পরিবর্তন আনা হয়। কর্পোরেট সংস্থাগুলোর চাহিদা মেটাতে বড় পরিসরে কৃষিজমি হস্তান্তর করা শুরু হয়, যার ফলে চাষের জমি সংকুচিত হতে থাকে এবং খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। মাথাপিছু খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পাওয়ায় দারিদ্র্য ও অপুষ্টির হার বাড়ে। জল ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও সেচ প্রকল্পগুলোর বেহাল দশার কারণে কৃষকরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

শিল্প খাতেও একই ধরণের সংকট লক্ষ্য করা যায়। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর বেসরকারিকরণ দ্রুততর করা হয়, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হতে থাকে, যার ফলে বহু মানুষ কর্মসংস্থানের সুযোগ হারিয়ে ফেলেন। শ্রমিকদের অধিকার সংকুচিত করা হয়, পেনশন সুবিধা কমিয়ে দেওয়া হয়, এমনকি ধর্মঘটের অধিকারও খর্ব করা হয়, যাতে শ্রমজীবী মানুষ তাদের ন্যায্য দাবি নিয়ে সোচ্চার হতে না পারেন।

এই নীতির ফলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত নিচের দিকে নামতে থাকে। মাথাপিছু খাদ্য গ্রহণযোগ্যতা হ্রাস পায়, দারিদ্র্যের হার বাড়ে এবং সরকারি রেশন ব্যবস্থা ভেঙে পড়ে। গ্রামীণ অর্থনীতি দুর্বল হয়ে যাওয়ার ফলে শহরেও বেকারত্ব বাড়তে থাকে। শিশুদের বিদ্যালয়ত্যাগের হার বৃদ্ধি পায়, পাশাপাশি শিশু শ্রমের হারও আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকে।

সার্বিকভাবে, নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি বৃহৎ কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর সুবিধার্থে পরিচালিত হতে থাকে, যা কৃষক, শ্রমিক এবং সাধারণ মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ বয়ে আনে।

বিদেশনীতির ক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের আমলে ভারত-আমেরিকা সম্পর্ককে নতুন মাত্রা দেওয়া হয়, যেখানে জোটনিরপেক্ষতার ধারণাকে ভুল হিসেবে দেখানো হয়। ভারতকে মার্কিন কৌশলগত স্বার্থের অধীনে এনে দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে চেয়েছিল বিজেপি সরকার। তবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানকে বিশেষ মিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করায় বিজেপির কৌশল ব্যর্থ হয়। ইজরায়েলের সঙ্গে সামরিক জোট গঠনের চেষ্টাও করা হয়, যা পরবর্তী সময়ে সমালোচিত হয়। ইউপিএ সরকারকে এই নীতি থেকে সরে এসে বহুমেরু আন্তর্জাতিক সম্পর্কের দিকে নজর দিতে বলা হয়, বিশেষ করে চীন, রাশিয়া, ইউরোপ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরা হয়।

বর্ণ বিদ্বেষের ফলে দলিতরা সবচেয়ে বেশি শোষণের শিকার। তাদের জমি অধিকার খর্ব হয়, অধিকাংশই কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়। জাতিভিত্তিক শোষণ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কমিউনিস্টদের সর্বদা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার নিদান দেওয়া হয় এবং দলিতদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে জমি, মজুরি ও কর্মসংস্থানের প্রশ্নগুলিকে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়। কিছু সংগঠন দলিতদের মধ্যে কমিউনিস্ট বিদ্বেষ ছড়াতে থাকে, যা প্রতিরোধ করা প্রয়োজন বলে মনে করা হয়।

আদিবাসীদের ক্ষেত্রেও শোষণের মাত্রা ব্যাপক আকার নেয়। কর্পোরেট ও বহুজাতিক সংস্থাগুলোর খনিজ আহরণের স্বার্থে আদিবাসীদের জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতে থাকে। সরকারি কল্যাণমূলক ব্যবস্থার ছাঁটাই তাদের দুর্ভোগ আরও বাড়ায়। বিজেপি-আরএসএস আদিবাসীদের সাম্প্রদায়িকীকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হয়, যা প্রতিহত করা দরকার হয়ে পড়ে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে তাদের অধিকার নিশ্চিত করার প্রসঙ্গ ও উঠে আসে।

শিক্ষাখাতেও বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িকীকরণ ও বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে ক্ষতি করেছে। শিক্ষার বেসরকারিকরণ ও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় আনার প্রচেষ্টা শিক্ষাকে পণ্য বানিয়ে তুলেছে। কেন্দ্রীয় সরকারকে শিক্ষায় বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ কমিয়ে সরকারি ব্যয় বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার প্রস্তাব আসে। বাধ্যতামূলক শিক্ষার প্রসঙ্গে সাংবিধানিক ত্রুটিগুলি সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়ে।

স্বাস্থ্য খাতে নয়া উদারনীতির ফলে সরকারি ব্যয় কমে যায়, যা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে দুর্বল করে। ইউপিএ সরকার প্রতিশ্রুতি দিলেও বাজেটে তেমন বৃদ্ধি হয়নি। গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের মাধ্যমে সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলা হয়। ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির মতো নীতিগুলো পর্যালোচনা করা জরুরি হয়ে পড়ে।

সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলোর আগ্রাসন প্রবল হয়েছে বলে মনে করে পার্টি। আরএসএস পরিচালিত কর্মকর্তাদের সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান থেকে সরানোর প্রয়োজন হয়ে পড়ে। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের ফলে ভোগবাদী সংস্কৃতির বিস্তার ঘটে, যা প্রতিরোধ করা জরুরি হয়ে ওঠে।

গণমাধ্যমের ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানাধীন চ্যানেলগুলোর আধিপত্য বাড়তে থাকে এবং তারা দক্ষিণপন্থী নীতির প্রচার চালাতে থাকে। একটি শক্তিশালী প্রসারভারতী গঠনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে এবং মিডিয়ায় বিদেশি মালিকানার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখা দরকার বলে পার্টি মনে করে।

গণতান্ত্রিক অধিকারেও আক্রমণ চলতে থাকে। পোটা আইন সংখ্যালঘু ও রাজনৈতিক বিরোধীদের দমন করতে ব্যবহৃত হয়। ধর্মঘটের অধিকার খর্ব করা হয়েছে এবং উচ্চশিক্ষায় সুযোগ সংকুচিত হয়। এই মৌলিক গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষায় আন্দোলন সংগঠিত করা জরুরি ছিল।

বিচারব্যবস্থার ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দায়িত্ব গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়, যা ভারসাম্যহীন পরিস্থিতি তৈরি করে। বিচারিক দুর্নীতি রোধ ও সুষ্ঠু ন্যায়বিচারের জন্য বিচারব্যবস্থায় সংস্কার প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির পরাজয় বাম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য হলেও, দলটি শক্তিশালী এবং পাঁচটি রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল। এনডিএ জোটের মিত্রদের সমর্থন বজায় থাকায় বিজেপির রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক ভিত্তি অক্ষুণ্ণ থাকে বলে পার্টি মনে করে। হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর কার্যক্রম অব্যাহত থাকে, সংখ্যালঘু ও দলিতদের ওপর আক্রমণও থামেনি। পাশাপাশি, প্রতিক্রিয়াশীল অর্থনৈতিক নীতির মাধ্যমে বড় পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষা করার আশঙ্কার কথা উঠে আসে।

দেড় দশক সময়ে সাম্প্রদায়িক শক্তির প্রসার ঘটে, যদিও তৎকালীন নির্বাচনী বিপর্যয়ে তারা কিছুটা দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে ঝাড়খণ্ডের মতো রাজ্যে তারা অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে ক্ষমতায় ফেরে, যা তাদের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখে।

অন্যদিকে, কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার ধর্মনিরপেক্ষ হলেও অর্থনৈতিক নীতিতে উদারীকরণ ও বৈদেশিক লগ্নির পথ অনুসরণ করতে থাকে, যা জনজীবনের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কংগ্রেস বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিকভাবে দৃঢ় অবস্থান নিতে পারে নি, বরং কৌশলগত সমর্থনের ওপর নির্ভর করে।

জাতপাতভিত্তিক রাজনীতি আরও প্রসারিত হয়, যা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের জন্য বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আঞ্চলিক দলগুলোর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তারা সুবিধাবাদী মনোভাব দেখাতে থাকে।

এ পরিস্থিতিতে, বামপন্থীদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সাম্প্রদায়িকতা, কর্পোরেট স্বার্থনির্ভর অর্থনীতি ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে তীব্রতর করা প্রয়োজন হয়ে ওঠে এবং বিকল্প নীতির মাধ্যমে গণআন্দোলনকে শক্তিশালী করার আহ্বান জানানো হয়।

পার্টির তৎকালীন কাজ

তৎকালীন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধেই নয়, বরং উদারীকরণ ও আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজির আধিপত্যের বিরুদ্ধেও লড়াই তীব্রতর করা জরুরি বলে পার্টি চিহ্নিত করে। কারণ, সাম্প্রদায়িকতা ও অর্থনৈতিক উদারীকরণের প্রবক্তারা উভয়ই সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করে। সিপিআই (এম) এবং বামপন্থী শক্তিকে এই দুই ফ্রন্টেই সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রস্তাবনা হয়।

কংগ্রেসের সঙ্গে সরাসরি মৈত্রী না করার নীতি পুনর্ব্যক্ত করে পার্টি জানায়, তারা কংগ্রেস পরিচালিত সরকারে অংশ নেবে না, বরং বাইরের সমর্থন দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে। পাশাপাশি, তৃতীয় বিকল্প গঠনের প্রয়াস অব্যাহত থাকবে, তবে সেটি কেবলমাত্র তখনই কার্যকর হবে যখন বামশক্তি আরও শক্তিশালী হয়ে উথবে এবং একটি সাধারণ কর্মসূচির ভিত্তিতে আঞ্চলিক ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তোলা যাবে।

যেসব দল কংগ্রেস বা বিজেপির সঙ্গে জোটবদ্ধ, তারা তাদের অবস্থান পরিবর্তন না করলে কার্যকর বিকল্প মোর্চা সম্ভব নয় বলে পার্টি মনে করে। এ জন্য প্রয়োজন ব্যাপক গণআন্দোলন, যা রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটাতে পারে এবং জনসমর্থন বামপন্থী আদর্শের দিকে টানতে পারে। পার্টি মনে করে, একমাত্র সংগ্রামের মাধ্যমেই আঞ্চলিক ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর অবস্থান বদলানো সম্ভব, যা বৃহত্তর রাজনৈতিক পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করবে।

সম্মেলন শেষে

পার্টি কংগ্রেস বিকল্প তৃতীয় শক্তির বাস্তবায়নের ডাক দেয়, যা তখনই সম্ভব ছিল যখন জাতীয় স্তরে বামদের শক্তি বৃদ্ধি পেত। পার্টি তার সমস্ত ইউনিটকে বর্ণ বিদ্বেষের বিরুদ্ধে লড়াই সংগঠিত করতে, লিঙ্গ ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে, আদিবাসীদের অধিকার রক্ষা করতে এবং কুসংস্কার, সামাজিক গোঁড়ামো, পিতৃতন্ত্র ও সামন্ততান্ত্রিক রীতিনীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালানোর নির্দেশ দেয়।

এছাড়াও, পার্টি কংগ্রেস পার্টির বিভিন্ন স্তরে প্রবেশ করা ভিন্ন শ্রেণির প্রবণতাগুলোর বিরুদ্ধে সংশোধন অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।

পার্টি কংগ্রেসে ‘পার্টির ইতিহাস’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ড প্রকাশিত হয় এবং একটি ৮৫-সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়, যা ১৭-সদস্যের পলিট ব্যুরো গঠন করে এবং কমরেড প্রকাশ কারাতকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করে।

১৯ তম পার্টি কংগ্রেস

প্রেক্ষাপট

উনিশতম পার্টি কংগ্রেস ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত হয়। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক ও সামরিক আধিপত্য সম্প্রসারিত করতে চাইছিল, তখন বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধ তীব্রতর হচ্ছিল। লাতিন আমেরিকা এই সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিল।

ভারতে, সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীরা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে গঠিত উদীয়মান জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, বিশেষ করে পারমাণবিক চুক্তির বিরোধিতা করছিল। উনিশতম পার্টি কংগ্রেস নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে চলমান সংগ্রামের ওপর গুরুত্বারোপ করে, যা অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি করছিল। পার্টি স্পষ্টভাবে উল্লেখ করে যে এই নীতিগুলো পরিবর্তন করা না হলে কৃষি সংকট, মূল্যবৃদ্ধি ও বেকারত্বের কোনও সমাধান সম্ভব নয়। পার্টি, বিজেপি-আরএসএস জোটের বিরুদ্ধে নিরলস সংগ্রামের আহ্বান জানায়।

আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার বিশ্ব আধিপত্য ধরে রাখতে সামরিক হস্তক্ষেপ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও বহুজাতিক কর্পোরেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রভাব বজায় রাখার চেষ্টা করতে থাকে। তবে, এই একতরফা নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ বাড়ে, এবং বিশ্বব্যবস্থা বহুমেরুর দিকে এগিয়ে যায়।

বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার মুখে, যার মূল কারণ যুক্তরাষ্ট্রের আবাসন বাজারের ধস, ডলারের মূল্যহ্রাস বৈশ্বিক অর্থনীতিকে অস্থির করে তোলে। সামরিক ব্যয় বৃদ্ধির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনীতি চাঙ্গা রাখার চেষ্টা করে, যা বিশ্বে সামরিক খরচ বৃদ্ধির অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর সম্পদ উন্নত দেশগুলোর হাতে চলে যেতে থাকে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬ সালে উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে মোট ৬৫৭ বিলিয়ন ডলার বহিঃপ্রবাহ হয়েছে। দোহা আলোচনায় অচলাবস্থার পেছনে উন্নত দেশগুলোর কৃষি ভর্তুকি কমাতে অনীহা এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর বাজার উন্মুক্ত করার চাপ ছিল বলে জানা যায়।

পশ্চিম এশিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক আগ্রাসন ভয়াবহ রূপ নেয়। ইরাকে দখলদারিত্বের পর লাখো মানুষ নিহত হয়েছে, দেশটি জাতিগত বিভাজনের শিকার হয়। ইরানকে টার্গেট করে একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলেও, পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধে প্রমাণ মেলেনি।

নেটোর সম্প্রসারণ এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সামরিক উপস্থিতি রাশিয়া ও চীনের উদ্বেগ বাড়ায়। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের নামে মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুয়ানতানামো কারাগার এবং মধ্যপ্রাচ্যে সামরিক হস্তক্ষেপ অব্যাহত রয়ে যায়।

তবে, যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। ইরাক ও আফগানিস্তানে ব্যর্থতা, ইউরোপীয় বন্ধুদের সরে যাওয়া এবং রাশিয়া-চীনের প্রতিরোধ বিশ্ব শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তনের ইঙ্গিতবাহী।

সে সময়ে সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে বিশ্বজুড়ে প্রতিরোধ বেড়ে ওঠে। ইরাকে মার্কিন দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ তাদের পরিকল্পনা ব্যাহত করে। লেবাননে হিজবুল্লাহর প্রতিরোধ ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে দুর্বল করে। প্যালেস্তাইন সংকটেও মার্কিন-ইসরায়েলি সমাধান বাস্তবায়িত হয়নি।

লাতিন আমেরিকায় বামপন্থী শক্তিরা এগিয়ে যায়। ব্রাজিল, ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, নিকারাগুয়া ও ইকুয়েডরে বামপন্থীরা জয়ী হয়। মার্কিন ‘ফ্রি ট্রেড’ পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়, এবং সাতটি দেশ মিলে আইএমএফ-ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের বিকল্প হিসেবে ‘ব্যাংক অব দ্য সাউথ’ প্রতিষ্ঠা করে।

বলিভিয়ায় ইভো মোরালেস ভূমি সংস্কার বাস্তবায়ন করেন, আর ভেনিজুয়েলায় হুগো চাভেজ বিদেশি তেল কোম্পানিগুলোর ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তবে, উভয় দেশে ডানপন্থী প্রতিক্রিয়া শক্তিশালী হতে থাকে।

পুঁজিবাদী দেশগুলোর শ্রমজীবী জনগণও নয়াউদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে শুরু করে। ফ্রান্স ও নেদারল্যান্ডসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সংবিধান বাতিল হয়, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি ও গ্রিসে শ্রমিকরা ধর্মঘটে নামে। চিলিতে শিক্ষার্থী আন্দোলন শিক্ষাখাতে বেসরকারিকরণ রোধ করতে সক্ষম হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্য চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে যায়। রাশিয়া-চীন সহযোগিতা বাড়ে, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (SCO) সামরিক মহড়া চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পূর্ব ইউরোপে ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনের মাধ্যমে বিভাজন সৃষ্টি করতে প্রচেষ্ট হয়, তবে রাশিয়া এর বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নেয়।

চীন অর্থনৈতিক উন্নয়ন তরান্বিত করতে থাকে, তবে আঞ্চলিক ও সামাজিক বৈষম্যও বাড়ে পাল্লা দিয়ে। পশ্চিমা বিশ্ব তিব্বত ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে প্রচার চালাতে শুরু করে। ভিয়েতনাম অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি এশিয় অঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

কিউবা মার্কিন অবরোধ সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অগ্রগতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়। উত্তর কোরিয়া মার্কিন চাপ মোকাবিলা করে পরমাণু ইস্যুতে কূটনৈতিক সমাধান আদায় করে।

জাতীয় পরিস্থিতি

১৮তম কংগ্রেস সতর্ক করেছিল যে সাম্প্রদায়িক শক্তি দুর্বল হলেও বিপজ্জনক। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার উদারীকরণ ও বেসরকারিকরণের নীতিতে জনজীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। পার্টি সাম্প্রদায়িকতা, নয়াউদারবাদী নীতি ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে ইন্দো-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম জারি রাখে।

বিজেপি-আরএসএস এর সাম্প্রদায়িক চরিত্র: ২০০৪ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর, বিজেপি হিন্দুত্ববাদী এজেন্ডায় ফিরে যায়, রাম মন্দির, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি এবং ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের দাবি তোলে। বিজেপি ও আরএসএস বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক ইস্যু উসকে দিয়ে মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, গুজরাট, ওড়িশা ও কর্ণাটকে সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রমণ চালায়। ধর্মান্তরণ বিরোধী আইন কঠোর করা হয়, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে হিংসামূলক কার্যকপাল চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তবে, অর্থনৈতিক ও পররাষ্ট্র নীতির বিষয়ে বামপন্থীদের সক্রিয় ভূমিকায় সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা তেমন সাড়া জাগাতে পারে নি। বিজেপির সংসদে বাধা সৃষ্টি এবং জনগণের প্রকৃত সমস্যাগুলোর প্রতি উপেক্ষার বিপরীতে, সিপিআই(এম) ও বামেরা জনগণের স্বার্থরক্ষায় ধারাবাহিক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে।

অর্থনৈতিক পরিস্থিতি: ইউপিএ সরকারের আমলে ভারতীয় অর্থনীতি নয়াউদারবাদী নীতির পথ অনুসরণ করে। কর্পোরেট বিনিয়োগ ও মুনাফা বৃদ্ধি পেলেও, কর্মসংস্থান ও জীবিকার সুযোগ বাড়েনি। কৃষি খাত উপেক্ষিত থেকে যায়, বেকারত্ব কমেনি। মূলত ভূসম্পত্তি, ফাটকা বাজার ও ঋণনির্ভর ভোগবাদী ব্যয়ের মাধ্যমে শহরকেন্দ্রিক প্রবৃদ্ধি হয়, যা বৈষম্য আরও তোলে। বড় ব্যবসায়ী ও নগর অভিজাতদের আয় বৃদ্ধি পেলেও, শ্রমজীবী ও কৃষিজীবীরা দারিদ্র্যের শিকার হতেই থাকে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এই মডেল উপরের স্তরের সমৃদ্ধি ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বঞ্চনাকে স্পষ্ট করে, যা ভারতের নয়াউদারবাদী শাসনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়।

কৃষি সংকট: ইউপিএ সরকার কৃষি সংকট মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়। উৎপাদন-খরচ বৃদ্ধি, ভর্তুকি হ্রাস, এবং উঁচু মূল্যে সার আমদানির ফলে কৃষকরা চাপে পড়ে যায়। কৃষি বিনিয়োগ কমায় উৎপাদন ও কর্মসংস্থান হ্রাস পায়, ফলে ১৯৯৭-২০০৬ সালে ১.৬৬ লাখ কৃষক আত্মহত্যা করে। জমি কর্পোরেট সংস্থার হাতে চলে যায়, ঋণের বোঝা বাড়ে, এবং সংস্থানহীন কৃষকরা জমি বিক্রি করতে বাধ্য হয়। কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় কৃষক কমিশনের সুপারিশগুলি কার্যকর করেনি শুধু নয়,  কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালিয়েছে, যা কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী। সরকারি হস্তক্ষেপ সীমিত থাকায় কৃষিক্ষেত্রের কাঠামোগত সমস্যাগুলি থেকে যায়।

ইউপিএ সরকারের কার্যক্রমের মূল্যায়ন

ইউপিএ সরকার কর্পোরেট সংস্থা ও বিদেশি মূলধনের স্বার্থরক্ষায় একাধিক নীতি গ্রহণ করে। টেলিকম, বীমা, ব্যাংকিং, খুচরা বাণিজ্য ও কৃষিক্ষেত্রে বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বেসরকারীকরণ, শেয়ার বাজারে কর ছাড় এবং দিল্লি-মুম্বাই বিমানবন্দরকে বেসরকারীকরণের মাধ্যমে কর্পোরেটদের সুবিধা করে দেওয়ার পথ বেছে নেয়। কর্পোরেট কর ছাড়ের ফলে প্রায় ১.৫ লক্ষ কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হয়। ফলে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য বাড়ে।

ভারতীয় ধনীদের সম্পদ বিপুলভাবে বাড়তে থাকে, ২০০৬ সালের তুলনায় বিলিয়নিয়ার সংখ্যা ২০০৭ সালে ২৫ থেকে ৪৮-এ পৌঁছায়। কিন্তু এই উন্নয়ন সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান ও জীবিকা সুরক্ষায় কোনো ইতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। কর্পোরেটরা ২০০৭ সালে ৩২ বিলিয়ন ডলার বিদেশি সংস্থা অধিগ্রহণে ব্যয় করে, অথচ দেশে পর্যাপ্ত কর্মসংস্থান নেই।

বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল (SEZ) নীতির মাধ্যমে কর্পোরেটদের বিপুল কর ছাড় দেওয়া হয় এবং উর্বর কৃষিজমি শিল্পের নামে হস্তান্তর করা হয়, যা আসলে জমি দখল ও রিয়েল এস্টেট মুনাফার জন্য ব্যবহৃত হচ্ছে। কৃষক ও শ্রমিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত না করেই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। সিপিআই(এম) SEZ নীতির সংশোধনের দাবি জানায়।

খুচরা বাণিজ্যে FDI প্রবেশের চেষ্টার বিরুদ্ধে বিরোধিতা করে বামপন্থীরা। রিলায়েন্স সহ বড় কোম্পানিরা খুচরা ব্যবসায় প্রবেশ করে লক্ষ লক্ষ ছোট দোকানদারদের জীবিকা বিপন্ন করতে শুরু করে। খনিজ সম্পদ বেসরকারীকরণ, আয়রন ও বক্সাইট রপ্তানির অনুমতি দেশীয় স্বার্থের পরিপন্থী বলে পার্টি মনে করে।

বামপন্থীদের চাপেই শ্রমিকদের পেনশন বেসরকারীকরণ বন্ধ হয়, শ্রম আইন সংশোধনের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয় এবং শিক্ষা ও খাদ্য সুরক্ষায় বাজেট বৃদ্ধি করা হয়। গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি আইন (NREGA) এবং আদিবাসীদের বন অধিকার আইন কার্যকর হয়। শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করা হয় এবং তথ্য অধিকার আইন গৃহীত হয়।

সিপিআই(এম) ইউপিএ সরকারকে সমর্থন করলেও স্বাধীন অবস্থান বজায় রেখে জনবিরোধী নীতির বিরোধিতা করে। বামপন্থীদের চাপে কিছু জনকল্যাণমূলক নীতি বাস্তবায়িত হলেও সরকার মূলত কর্পোরেট স্বার্থ রক্ষা করে। 

জনজীবনে প্রভাব: ইউপিএ শাসনে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে কঠিন করে তোলে। খাদ্যশস্য, ডাল, তেল, চিনি ও সবজির দাম বেড়ে যায়, যার সঙ্গে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি যোগ হয়ে মুদ্রাস্ফীতি বৃদ্ধি পেতে থাকে। সরকারী নীতির ফলে বেসরকারি সংস্থাগুলি শস্য সংগ্রহ ও বিপণনে আধিপত্য বিস্তার করে, যা মূল্যবৃদ্ধির অন্যতম কারণ।

কর্মসংস্থানের অবস্থা ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। সরকারী ক্ষেত্রে চাকরি কমে যায়, শ্রমিকদের প্রতি শোষণ বেড়ে চলে এবং চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকদের অধিকতর বঞ্চনার শিকার হতে হয়। শহর ও গ্রামে অধিকাংশ শ্রমিক ন্যূনতম মজুরি পায় নি, এবং বেকারত্বের হার বেড়ে চলে। বিশেষত, কৃষিশ্রমিকদের মধ্যে বেকারত্ব ১৫.৩% পর্যন্ত পৌঁছে যায়। গ্রামের দারিদ্র্য ও বেকারত্বের কারণে বিপুল সংখ্যক মানুষ শহরে অভিবাসন করতে বাধ্য হয়।

নির্মাণ খাতে বিদেশি বিনিয়োগের ফলে জমির দাম আকাশ ছুঁয়ে যায়, সাধারণ মানুষের পক্ষে আবাসন পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। সরকার স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ কমিয়ে কর্পোরেট হাসপাতাল ও বেসরকারিকরণকে উৎসাহিত করতে থাকে, যার ফলে চিকিৎসার ব্যয় বাড়ে। অপুষ্টি ও রক্তস্বল্পতার মাত্রা ভয়াবহ আকার নেয়, বিশেষ করে শিশু ও নারীদের মধ্যে। জলের সরবরাহ ও বিদ্যুৎ বেসরকারিকরণের ফলে মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বেড়ে চলে। দুর্নীতি ও অপরাধ বৃদ্ধি পেয়ে জনজীবন আরও অনিশ্চিত করে তোলে।

বিদেশনীতি: ইউপিএ সরকার আমেরিকার সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক গভীর করার চেষ্টা করলেও সিপিআই(এম) ও বামপন্থীদের বিরোধিতায় এটি বাধাপ্রাপ্ত হয়। প্রতিরক্ষা চুক্তি, যৌথ সামরিক মহড়া ও ইন্দো-আমেরিকা পারমাণবিক চুক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়। ইরানের বিরুদ্ধে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় ভারতের সমর্থন এবং ইসরায়েলের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতার বিরোধিতা করা হয়। পারমাণবিক চুক্তির ফলে ভারতের স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে, এই আশঙ্কায় চুক্তি আটকে দেওয়ার ক্ষেত্রে বামপন্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সিপিআই(এম) স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির পক্ষে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত জোট এড়িয়ে চলার উপর জোর দেয়। ভারত-রাশিয়া-চীন সম্পর্ক, দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা ও সার্ককে শক্তিশালী করার আহ্বান জানায়।

প্রান্তিক অঞ্চলগুলির পরিস্থিতি: উত্তর-পূর্ব ভারত জাতিগত সংঘর্ষ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসবাদের সমস্যায় জর্জরিত হতে থাকে। দীর্ঘদিনের অবহেলা ও উন্নয়নের অভাবের ফলে এই অঞ্চলে উন্নতির সম্ভাবনা নষ্ট হয়। অসমে উলফার সহিংসতা ও বোমা বিস্ফোরণ অব্যাহত থাকে, তবে সরকারের শর্তহীন আলোচনার উদ্যোগ নেওয়া ছিল বলে পার্টি মনে করে। মনিপুরে নিরাপত্তা বাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন হয়, যেখানে আফস্পা বাতিলের দাবি ওঠে। নাগাল্যান্ডে শান্তি আলোচনা চললেও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি। ত্রিপুরায় সিপিআই(এম)-এর নেতৃত্বে উপজাতিদের ঐক্য রক্ষিত হয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না হলে বিচ্ছিন্নতাবাদ কমবে না বলে পার্টি মনে করে।

জম্মু ও কাশ্মীরে সহিংসতা হ্রাস পায় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভারত-পাকিস্তান সংলাপ এগিয়ে নিয়ে চলে। নিয়ন্ত্রণরেখা (এলওসি) পেরিয়ে বাণিজ্য ও সংযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। তবে রাজনৈতিক সমাধানের ক্ষেত্রে কেন্দ্রের দিকনির্দেশনার অভাব থেকে যায়। মুশারফের “স্বশাসন” প্রস্তাবের ফলে অগ্রগতির সম্ভবনা থাকলেও, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতার কারণে আলোচনা থমকে যায়। সিপিআই(এম) সর্বোচ্চ স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে কথা বলে, যা সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদের পূর্ণ প্রয়োগের মাধ্যমে কাশ্মীরের পরিচিতি ও সংস্কৃতি রক্ষা করতে সক্ষম। জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার দাবি জানানো হয়। নিরাপত্তা বাহিনীর নিপীড়ন বন্ধ করে তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো জরুরি বলে পার্টি মনে করে।

শ্রেণি রাজনীতি

মহারাষ্ট্রের খেরলাঞ্জির নৃশংস ঘটনা দেশে দলিতদের উপর চলমান সহিংসতা ও বৈষম্যের প্রতীক। আজও দলিতরা পানীয় জল, মন্দির, রাস্তা, ও অন্যান্য পরিষেবায় প্রবেশে বাধার সম্মুখীন। প্রতি বছর গড়ে ২২,০০০ দলিত নিপীড়নের ঘটনা ঘটে। সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বন্ধ থাকায় সংরক্ষিত পদ পূরণ হয়নি। বামশাসিত রাজ্য ব্যতীত দলিতদের উপর অত্যাচার প্রবল। দলিত মুসলিম ও খ্রিস্টানদের অধিকার, বেসরকারি সংস্থায় সংরক্ষণ, ও জাতি নিপীড়নের বিরুদ্ধে আইন কঠোরভাবে কার্যকর করা জরুরি বলে পার্টি মনে করে। শ্রেণি ও সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্ন একত্রিত করে জাতিভিত্তিক বিভাজন মোকাবিলা করার দাবি করে পার্টি।

শিক্ষা ও স্বাস্থ্য

ভারতে শিক্ষার অবস্থা উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে, বাজেট বরাদ্দ ৬% জিডিপির পরিবর্তে মাত্র ২.৮৭% শিক্ষাখাতে বরাদ্দ হয়। মৌলিক শিক্ষার অধিকার স্বীকৃত হলেও কেন্দ্রীয় আইন না থাকায় শিক্ষাব্যবস্থাকে ক্রমাগত চ্যালেঞ্জএর মুখে পড়তে হয়। উচ্চশিক্ষায় বেসরকারিকরণ ও এফডিআই অনুমোদন শিক্ষাকে ব্যয়বহুল করে তোলে। বিজেপি শাসিত রাজ্যে শিক্ষার সাম্প্রদায়িকীকরণ অব্যাহত থাকে। স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় ১% জিডিপির নিচে পৌছায়, সরকারি চিকিৎসা পরিষেবা দুর্বল ও দুর্লভ হয়ে ওঠে। জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন অপ্রতুল, বেসরকারিকরণ বৃদ্ধির ঝুঁকি, সব কিছুই অশনিসংকেত বয়ে আনে সরকারের জন্য। জীবনদায়ী ওষুধের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে কেন্দ্র ব্যর্থ হয়। সিপিআই(এম) শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি, উচ্চশিক্ষায় সংরক্ষণ এবং ওষুধের দামের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার দাবি জানায়।

পার্টির ভূমিকা

সিপিআই(এম) ও বামদলগুলি জাতীয় পর্যায়ে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে, ইউপিএ সরকারের নীতির বিরোধিতা ও বিকল্প নীতি প্রস্তাবনায় অগ্রণী ভূমিকা নেয়। পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা ও ত্রিপুরায় শক্তিশালী উপস্থিতি কেন্দ্রীয় পর্যায়ে বামপন্থীদের অবস্থান মজবুত করে। জাতীয় পর্যায়ে সমন্বিতভাবে নীতি নির্ধারণে কাজ করে বামেরা, যদিও পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়ন ও সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামের ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভেদ রয়ে যায়। বাম ঐক্য সুদৃঢ় করার প্রধান দায়িত্ব সিপিআই(এম)-এর হলেও অন্যান্য বাম দলগুলোরও ঐক্য রক্ষায় ভূমিকা রাখা প্রয়োজন বলে পার্টি মনে করে।

তৃতীয় ফ্রন্ট ও বাম বিকল্প

পার্টি তার রাজনৈতিক ভূমিকার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সারাদেশে প্রভাব ও ভিত্তি বিস্তারের অঙ্গীকার নেয়। স্বাধীন রাজনৈতিক কার্যক্রম ও সংগঠনের শক্তিবৃদ্ধি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের পর পার্টি সম্প্রসারণের অনুকূল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যা কাজে লাগানোর কথা উল্লেখ করা হয়।

মূলত শ্রমজীবী শ্রেণি, কৃষক ও গ্রামীণ দরিদ্রদের সংগঠিত করা অগ্রাধিকার হওয়া উচিত বলে পার্টি মনে করে, কারণ তারা কৃষি সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এছাড়া, দলিত, আদিবাসী, নারী ও সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ সম্প্রসারণ জরুরি হয়ে পড়ে। শহরাঞ্চল ও মধ্যবিত্তদের মধ্যে সংগঠন মজবুত করার প্রয়োজনিয়তা নিয়েও পার্টি আলোকপাত করে।

সাম্প্রদায়িকতা, সাম্রাজ্যবাদী মুক্ত বাজার নীতি ও বামপন্থা বিরোধী প্রচারের বিরুদ্ধে আদর্শগত লড়াই গড়ে তোলার আহ্বান জানানো হয়। উগ্র বামপন্থা ও বিদেশি অনুদাননির্ভর এনজিওদের ভুল দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধেও অবস্থান নেওয়ার ব্যাপারেও পার্টি জোর দেয়।

সিপিআই(এম)-র স্বাধীন নীতি ও জনগণের স্বার্থ রক্ষার ভূমিকা পার্টির ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে চলে। তবে নতুন জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর প্রচেষ্টা আরও জোরদার করার কথা বলা হয়। স্থানীয় ইস্যুতে ধারাবাহিক আন্দোলন গড়ে তুলে বৃহত্তর জনসমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে পার্টি এগিয়ে যাওয়ার কথা বলে।

তৃতীয় বিকল্প কেবল নির্বাচনী সমঝোতা হতে পারে না, বরং এটি হবে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও জনকল্যাণমূলক নীতির ভিত্তিতে গঠিত একটি শক্তিশালী মঞ্চ। বামপন্থীদের নেতৃত্বে এক বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার কথা বলা হয়, যা কংগ্রেস ও বিজেপির শাসননীতির প্রতিপক্ষ হিসেবে কাজ করতে সক্ষম।

বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তোলার মাধ্যমে কৃষি সংস্কার, আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, শ্রমজীবী মানুষের অধিকার সংরক্ষণ এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার শপথ নেওয়া হয়।

সম্মেলন শেষে

কংগ্রেস দল ও বিজেপির বাইরে একটি তৃতীয় বিকল্প গঠনের জন্য উনিশতম পার্টি কংগ্রেস একটি নীতি নির্ধারণ করে, যেখানে জনমুখী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, সামাজিক কল্যাণমূলক পদক্ষেপ ও স্বাধীন পররাষ্ট্র নীতির ওপর জোর দেওয়া হয়। এই প্ল্যাটফর্মটি সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আপসহীন থাকার বিষয়টিও স্পষ্ট করে।

উনিশতম পার্টি কংগ্রেসে ৮৭ সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়, যা ১৫ সদস্যবিশিষ্ট পলিট ব্যুরো নির্বাচন করে। কমরেড জ্যোতি বসু তার অনুরোধে অব্যাহতি পান এবং তাকে পলিট ব্যুরোর বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য করা হয়। কমরেড হরকিষণ সিং সুরজিতকেও অব্যাহতি দেওয়া হয় এবং কেন্দ্রীয় কমিটির বিশেষ আমন্ত্রিত সদস্য করা হয়।

কমরেড প্রকাশ কারাত পুনরায় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

আগের পর্ব

তথ্যসুত্রঃ

১) Documents of The Communist Movement in India,

National Book Agency, Volume I- XXVII

২) আমার জীবন ও কমিউনিস্ট পার্টি,

মুজফফর আহমদ, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি

৩) Galvanising Impact of the October Revolution on India’s National-Liberation Movement

Gangadhar Adhikary, Soviet Land, August 1977

Spread the word

Leave a Reply