প্রাককথন
খিলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের ধার কমে এলে ভারতের যুবসম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশের মধ্যে দেশের মুক্তির জন্য কার্যকরী ও নতুন রাজনৈতিক পন্থার জন্য একধরনের খোঁজ শুরু হয়। এদেরই একটি অংশ মুহাজির (দেশের স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে স্বেচ্ছায় দেশান্তরী) পরিচিতি নিয়ে বাইরে থেকে সাহায্যের প্রত্যাশায় বেরিয়ে পড়েছিলেন। নানা ঘাত প্রতিঘাতের শেষে তারা তুরস্কে পৌঁছেছিলেন, ততদিনে তারা রাশিয়াতে বিপ্লবের খবর পেয়েছেন। জার্মানি যে তাদের সাহায্য করবে না একথাও কম বেশি বুঝেছেন। মানবেন্দ্রনাথ রায় এদের তুরস্কে পৌঁছানোর খবর পেলেন। একসময়ের সশস্ত্র বিপ্লববাদী এই মানুষটি অনেক আগেই দেশ ছেড়ে এসেছিলেন। আমেরিকায় নিজের পরিচয় গোপন রাখার উদ্দেশ্যেই তাকে এম এন রায় নামটি ব্যবহার করতে হয়েছিল। ওদেশেই তার সাথে এভেলিন ট্রেন্টের পরিচয়, প্রণয় ও বিবাহ হয়।এদের সাথেই ছিলেন অবনী মুখার্জী ও তার স্ত্রী রোজা ফিটিংগোফ। রোজা শুধু অবনীর স্ত্রীই ছিলেন না, রুশ কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যও ছিলেন। এরাই একসাথে ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্গত উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই পার্টির সম্পাদক ছিলেন মহম্মদ শফিক। এটাই ইতিহাস।
বিদেশের মাটিতে কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার খবর দেশে অনেক পরে এসে পৌঁছায়। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের নজর এড়িয়ে খবর পাঠানোই ছিল অন্যতম প্রধান বাধা। তাসখন্দে প্রতিষ্ঠিত পার্টি খুব একটা কাজ এগোতে না পারলেও এম এন রায় নানাভাবে দেশের বুকে সক্রিয় একাধিক কমিউনিস্ট গ্রুপগুলির সাথে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছিলেন। ১৯২১ সালে গুজরাটের আমেদাবাদ শহরে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ছত্রিশতম অধিবেশনের আয়োজন হয়েছিল। রায় এই আয়োজনে নিজে উপস্থিত হতে না পারলেও অধিবেশনে কমিউনিস্টদের বক্তব্য তুলে ধরতে চাইলেন। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি ও অবনী মুখার্জী একটি ইশতেহার লেখেন। লেখা শেষ হলে খসড়াটি নিয়ে তারা হাজির হন লেনিন ও স্তালিনের সামনে। সাধারণভাবে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তরফে বিবৃতিটি অনুমোদিত হলেও একটি বিশেষ ঘটনার উল্লেখ আজও জরুরী। রায়ের লেখায় এক জায়গায় বিকল্প কর্মসূচি হিসাবে সমস্ত দেশীয় সুদখোরদের ব্যবসা বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এই প্রস্তাবটি শুনতে ভালো লাগলেও, স্তালিন এই সম্পর্কে নিজের মতামত জানিয়ে উল্লেখ করলেন, এমনটা হলে ছোট ও মাঝারি কৃষকরা চাষের কাজে জরুরী অর্থের সংস্থান কোথা থেকে করবে? কে তাদের টাকা ধার দেবে? তখনকার বাস্তবতায় স্তালিনের প্রস্তাব ছিল উচিত হবে সুদের হার যেন কোনোভাবেই ৬শতাংশের বেশি না হয়।
এম এন রায় নিজের স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন সেদিন স্তালিনের প্রস্তাবে তার ভুল ভেঙে যায়। তিনি উপলব্ধি করেন বিপ্লবী কর্মসূচি আকাশ থেকে নামিয়ে আনা যায় না, বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়েই তাকে নির্মাণ করতে হয়, কার্যকরী করতে হয়।
আজ ১৭ই অক্টোবর, ২০২৪।
রাজ্য ওয়েব ডেস্কের তরফে এম এন রায় ও অবনী মুখার্জির লেখা সেই ইশতেহারটি দুই পর্বের প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হল। স্বাধীন ভারত কেমন হবে এই প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের বক্তব্য জানতে এই দলিলটি এখনও প্রাসঙ্গিক। এই দলিলের শুরু থেকে শেষ অবধি দুটি বক্তব্য বারে বারে উঠে এসেছে। এক, স্বাধীন ভারত সম্পর্কে তখনও অবধি যে সকল মতামত রাজনীতির আবহে ভেসে চলছিল তার কোথাও গরীব, মেহনতী ভারতীয়দের সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য ভাবনাচিন্তা ছিল না। দুই দেশের স্বাধীনতা আসবে অথচ দেশের এক বিরাট অংশের মানুষের উপরে যুগ যুগ ধরে চলে আসা শোষন, নিপীড়নের বন্দোবস্তটির কোনরকম বদল ঘটবে না এমন স্বাধীনতায় কার লাভ হবে, কাদের লাভ হবে?
কংগ্রেসের অধিবেশনে এই ইশতেহারটি সহজে প্রচার করা যায়নি, গোপনে বিলি করতে হয়েছিল। এমনকি ইশতেহারের কোথাও একে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির বিবৃতি বলেও উল্লেখ করা হয়নি, রায় ও মুখার্জির নামেই প্রচার হয়েছিল। ব্রিটিশ গোয়েন্দা ও পুলিশের চাপ, কংগ্রেসের দোলাচলে থাকা নেতৃত্ব এমনকি স্বয়ং মহাত্মা গান্ধীর অনুমোদন না থাকা সত্বেও সেদিন এ কাজের দায়িত্ব নিয়েছিলেন দুজন। প্রথমজন মৌলানা হসরৎ মোহানি, দ্বিতীয়জন স্বামী কুমারানন্দ। এই ইশেতাহারের এক বিশেষ দিক, এতে বারে বারে দেশের জনসাধারণকে সহযাত্রী বলে সম্বোধন করা হয়। তখনকার পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের এক বিরাট অংশের মধ্যেই কমিউনিজম ও কমিউনিস্টদের সম্পর্কে কার্যত কোনও ধারানাই ছিল না। এ স্বত্বেও নিজেদের দেশের মানুষ যে তাদের বক্তব্যের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে একমত হবেন এমন অনুভব থেকেই কমিউনিস্টরা সমগ্র দেশবাসীকে ‘সহযাত্রী’ হিসাবে অভিনন্দিত করেছিলেন। এটি নিছক সৌজন্যের বিষয় না, এটাই বিপ্লবী হিম্মৎ।
ভারতের বুকে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফ্ফর আহ্মদের স্মৃতিকথা থেকে ইশতেহারটি সংগৃহীত। মূল লেখার বানান আমরা অবিকৃত রেখেছি। কাকাবাবুর লেখা থেকেই জানা যাচ্ছে ঐ ইশতেহারের বাংলা ভাষান্তর করেছিলেন শুভেন্দুশেখর মুখোপাধ্যায়।
১ম পর্ব
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম মুদ্রিত ইস্তিহার
ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ৩৬তম অধিবেশনে প্রতিনিধিগণের প্রতি ইস্তিহার
সহযাত্রী দেশবাসীগণ,
আমাদের দেশের ইতিহাসে এক অত্যন্ত সংকটের মুহূর্তে আমাদের জাতীয় জীবন ও প্রগতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন প্রশ্ন সমাধানের জন্য আজ আপনারা মিলিত হয়েছেন। ভারতবর্ষ আজ এক বিরাট বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছে শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রেই নয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রেও এই বিপ্লব ঘটবে। এই বিরাট ভূখণ্ডের অধিবাসী বিশাল জনস্রোত এক নির্দিষ্ট লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করেছে। বহু শতাব্দীব্যাপী অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক নির্যাতন থেকে উদ্ভূত সামাজিক জড়তা থেকে এই জনসংঘ মুক্তি পাচ্ছে। জাতীয় কংগ্রেস এই গণ- জাগরণের নেতৃত্বের আসন গ্রহণ করেছে। অত্যন্ত কঠিন আপনাদের দায়িত্ব। আপনাদের সামনে যে পথ সেখানে নানা দূরতিক্রম্য বাধা এবং কষ্টের ও প্রতারণার ফাঁদ পাতা আছে। ভারতবর্ষের মানুষকে জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে পরিচালিত করার দায়িত্ব অতি পবিত্র ও মহান। আপনারা স্বেচ্ছায় এই দায়িত্ব বরণ করেছেন। জাতীয় কংগ্রেস আর অলস বিতর্ক বা অনাবশ্যক প্রস্তাব পাসের ছুটির দিনের মিলন বাসর নয়। কংগ্রেস আজ রাজনৈতিক সংস্থায় পরিণত হয়েছে সে আজ জাতীয় আন্দোলনের নেতৃত্বের আসনে।
সম্প্রতি অর্জিত রাজনৈতিক গুরুত্বের ফলে কংগ্রেসের তত্ত্বগত ভিত্তির পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। আত্মকেন্দ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই প্রতিষ্ঠানের আর চলা সঙ্গত নয়। এর কার্যসূচী ও সিদ্ধান্তসমূহ কোনো নেতার খেয়ালখুশি সংস্কার বা ধারণার দ্বারা নির্ধারিত না হয়ে পারিপার্শ্বিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নির্ণীত হওয়া আবশ্যক। কংগ্রেস যখন নামেই ‘জাতীয় প্রতিষ্ঠান ছিল কার্যত মুষ্টিমেয় কয়েকজন খেয়ালখুশির’ আসর ছিল, তখন এইভাবেই কাজ চলত। মেহতা-গোখলে-বোস- ব্যানার্জি গোষ্ঠী অধ্যুষিত পুরনো কংগ্রেস আজ মৃত। সক্রিয় রাজনীতির আসর থেকে সে গোষ্ঠী বিতাড়িত হয়ে গেছে কারণ তাঁদের মতলব ছিল তাঁদের গোষ্ঠীর স্বার্থে সমগ্র জাতিকে ব্যবহার করা। যে মানুষ নিয়ে তাঁদের কাজ করার কথা, তাদের কথা তাঁরা ভাবেনওনি, ভাববার সাধ্যও তাঁদের ছিল না। সাধারণ মানুষের মনোভাব বুঝতে তাঁরা ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা নিজেরা কী ভাবতেন বা চাইতেন তা তাঁরা বেশ ভালোভাবেই জানতেন, কিন্তু সাধারণ মানুষ তাঁর মঙ্গল ও প্রগতির জন্য কী চায় সেকথা তাঁরা জানতেনও না, জানতে চাইতেনও না। অথচ এই জনগণ নিয়েই জাতি এবং কংগ্রেস দাবি করত যে তারাই জাতির প্রতিনিধি! পুরনো কংগ্রেস রাজনীতির ক্ষেত্রে দেউলিয়া হয়ে গেছে, কারণ সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তারা নিজেদের বলে মনে করতে পারেনি। তারা ধরে নিয়েছিল যে প্রশাসনিক এবং কর সম্বন্ধীয় সংস্কারের দাবি বুঝি সাধারণ মানুষের স্বার্থেরই অনুকূল এবং সে দাবি তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন। নরমপন্থী প্রবীণ নেতারা মনে করতেন যে তাঁদের বিদ্যাবুদ্ধি বুঝি স্বতঃই তাঁদের জাতির নিরঙ্কুশ নেতৃত্বে স্থাপন করেছে। এই শোচনীয় আত্মম্ভরিতার ফলেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদের শ্রদ্ধেয় জনকগণ তাঁদের আপন সন্তানের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। এই আত্মম্ভরিতার জন্ম হয় সমাজশক্তির সম্বন্ধে ভ্রান্ত বা বিকৃত উপলব্ধি থেকে। বস্তুতপক্ষে এই সমাজ-শক্তিই সকল আন্দোলনের মূলে থেকে যথার্থ বল সঞ্চার করছে। নেতৃবৃন্দের ভ্রান্ত বা বিকৃত চিন্তাই তাঁদের নিজেদের অবমাননা, রাজনৈতিক মৃত্যু ও সর্বনাশ ডেকে এনেছে। আপনারা কংগ্রেসের নবীন নেতৃবৃন্দ, একই ভুল আবার করবেন না। মনে রাখবেন একই ভুল একই বিপর্যয় ডেকে আনবে।
নতুন নেতৃত্বে কংগ্রেসের কার্যসূচী হল ন্যূনতম সময়ের মধ্যে স্বরাজলাভ করা। সাংবিধানিক বাদানুবাদের পথে সামান্য মামুলী সংস্কারের দুর্বল কৌশল পরিহার করা হয়েছে। কংগ্রেস এবার গর্বের সঙ্গে তার ‘যে-কোনো উপায়ে স্বরাজ’-এর দৃপ্ত পতাকা উঁচুতে তুলে ধরেছে। এই পতাকার নীচে ভারতের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হতে আহ্বান জানানো হয়েছে। আপনাদের অনুপ্রেরণায় সাধারণ মানুষ লক্ষ্যে না পৌঁছানো পর্যন্ত এ পতাকা উঁচুতে তুলে ধরে থাকবে। এই লক্ষ্য বাস্তবিকই মহান। ভারতীয় জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে এ তো খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু জাতির নেতা হিসাবে শুধু লক্ষ্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশেই কংগ্রেসের কর্তব্য শেষ হবে না, প্রত্যেকটি স্তর অতিক্রম করে অন্তিম লক্ষ্যে এই সংগ্রামকে পরিচালিত করাই তার দায়িত্ব। গত এক বছরে কাজ দেখে মনে হয় কংগ্রেস তার দায়িত্ব সম্বন্ধে ওয়াকিফহাল এবং সেই দায়িত্ব পালনের সর্বোত্তম উপায় উদ্ভাবনে তারা সচেষ্ট! জনগণকে স্বরাজের জন্য সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। এ সংগ্রামে তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে হবে, কারণ একতা ভিন্ন কিছুতেই লক্ষ্যে পৌঁছানো যাবে না।
পুরনো কংগ্রেসের এই বিপর্যয়ের কারণ কী? সে জনগণের সামনে জাতীয় প্রশ্নকে জীবন-সমস্যা হিসাবে তুলে ধরতে পারেনি। পুরনো নেতৃত্বের অধীনে কংগ্রেস রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর আর মামুলী সংস্কারবাদের বদ্ধ জলায় আটকে পড়েছিল। কিন্তু এই রাজনৈতিক কচকচি আর সংস্কারবাদের পরিবর্তে কতকগুলি ভাববাদী আদর্শ আর রাজনৈতিক বিভ্রান্তির মধ্যে গিয়ে পড়লেও বিশেষ কোনো সুবিধা হবে না। তার নামের যোগ্য হতে গেলে এবং সামনের কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য জাতীয় কংগ্রেসকে কিছুতেই মুষ্টিমেয় ব্যক্তির ভাববাদী আদর্শের পথে ভেসে গেলে চলবে না সেই কতিপয় ব্যক্তি যতই না মহৎ দেশপ্রেমিক হোন। রূঢ় বাস্তব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কাজ করতে হবে, নিষ্ঠার সঙ্গে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনের অভাব ও অত্যাচারের খবর পর্যালোচনা করতে হবে। আমাদের সামনে তো কেবল রাজনীতির কূট খেলা নয়, সামনে এক কঠিন সামাজিক সংগ্রাম।
৩৬তম কংগ্রেসের সামনে আজ সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা জাতীয় সংগ্রামে জনগণের পূর্ণ সহযোগিতা জাগিয়ে তোলা। সমস্যা হল অশিক্ষিত জনসাধারণকে কীভাবে স্বরাজের পতাকাতলে নিয়ে আসা যায়। এর জন্য সবচেয়ে প্রথমে জানতে হবে জনগণের প্রকৃত দুঃখ-কষ্ট কোথায়? তারা কী চায়? পার্থিব জীবনধারণের জন্য কী তাদের প্রয়োজন? জনগণের আজকের দুঃখদুর্দশা মোচনের কার্যক্রমকে কংগ্রেসের কার্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেই জনগণের যথার্থ সক্রিয় নেতৃত্ব গ্রহণ করা যাবে।
কয়েক হাজার উচ্ছৃঙ্খল, দায়িত্বহীন ছাত্র, কিছু মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী আর তাদের পিছনে হঠাৎ-ক্ষেপে-ওঠা উচ্ছৃঙ্খল উন্মত্ত জনতা এরা কখনোই একটি জাতির রাজনৈতিক সংগঠনের সামাজিক ভিত্তি হতে পারে না। শহরের মেহনতী মানুষ আর গ্রামের অগণিত নিরক্ষর জনসাধারণকে আন্দোলনে টেনে আনতে পারলেই সংগ্রাম সাফল্যমণ্ডিত হবে। কেমন করে একে সম্ভব করে তোলা যাবে সেটাই আজ কংগ্রেসের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। কারখানার মেহনতী মজুর আর মাঠের খেটে খাওয়া কৃষককে একথা ঠিকমতো বুঝিয়ে দিতে হবে যে জাতীয় স্বাধীনতাই তার দুর্দশার অবসান ঘটাবে। এটা কি সত্য নয় যে ধনী ভারতীয়দের কলে-কারখানায় যে লক্ষ লক্ষ মজুর প্রাণান্তকর পরিশ্রম করছে তারা অসহনীয় অবস্থায় দিনযাপন করছে? সেখানে তারা যে-ব্যবহার পায় তাতে যে কোনো মুহূর্তে বিক্ষোভে ফেটে পড়া উচিত। এই ধনী ভারতীয়দের মধ্যেই অনেকে রয়েছেন যাঁরা আবার আমাদের জাতীয় আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়। অনেক অতি বিবেচক ব্যক্তি এজাতীয় অস্বস্তিকর প্রশ্নকে যদিও জাতীয় স্বার্থের দোহাই পেড়ে ধামাচাপা দিতে চাইবেন। এঁদের যুক্তি হল, ‘আগে আমরা বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি পাই’। এ জাতের হিসেবী রাজনৈতিক বিচক্ষণ উক্তি উচ্চশ্রেণীর মানুষের কাছে প্রশংসা পেতে পারে, কিন্তু দরিদ্র কৃষক- মজুর আজ ক্ষুধায় জর্জরিত। তাদের যদি লড়াইয়ের ময়দানে টেনে আনতে হয় সে-লড়াইকে তাদের নিত্য জীবন-ধারণের লড়াইয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। ‘চাষীর হাতে জমি আর মজুরের মুখে রুটি- এই স্লোগানেই বৃহত্তর জনসাধারণ সচেতনভাবে তাদের আপন স্বার্থ-রক্ষার তাগিদে লড়াইয়ে নেমে আসতে উদ্বুদ্ধ হবে। জাতীয় স্বায়ত্তশাসনের ধোঁয়াটে আদর্শ তাদের জড়ত্বকে ভাঙতে পারবে না। ব্যক্তিগতভাবে কোনো নেতার প্রতি মোহ সৃষ্টি হতে পারে, কিন্তু সে হবে অত্যন্ত শিথিল ও ক্ষণস্থায়ী।
কংগ্রেস কী করে ভাবে যে খিলাফতের নামে বা সেভের্সের চুক্তির সংশোধনের দাবীতে তারা স্থায়ী চেতনা ও প্রেরণা সঞ্চার করতে পারবে? শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীদের পক্ষে এসব দাবীর পিছনকার উন্মার্গী রাজনীতি বোঝা হয়তো সম্ভব, কিন্তু যে- ভারতীয় জনসাধারণ কেবল বিদেশী শাসনের চাপেই নয়, আপন দেশের ধর্ম ও সমাজের হাজার কুসংস্কারের নাগপাশে অজ্ঞতার গভীর অন্ধকারে ডুবে রয়েছে তাদের পক্ষে এ রাজনীতি বুঝে ওঠা একেবারেই অসাধ্য। জনসাধারণের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে কংগ্রেস যদি তাদের নিজেদের মতলব হাসিলের অপচেষ্টা করে, তবে তা থেকে কখনোই অভিপ্রেত ফল প্রত্যাশা করা যাবে না। যদি ভারতের বৃহত্তর জনসাধারণকে জাতীয় সংগ্রামে টেনে আনতে হয়, তাদের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে তা করা যাবে না। তাদের চেতনাকে সর্বপ্রথম জাগ্রত করতে হবে। কিসের জন্য তারা লড়ছে সেটা তাদের বুঝতে দিতে হবে। এবং তাদের এই লড়াইয়ের ভিতর দিয়ে নিত্য জীবনের অভাব দুঃখ-দুর্দশা নিরসন সম্ভব হবে এ উপলব্ধি তাদের মধ্যে আনতে হবে। সাধারণ মানুষ কী চায়? তাদের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন দুবেলা পেটভরে খেতে পাওয়া সে তো তারা প্রায় কখনোই পায় না। এ রকম মানুষের সংখ্যাই শতকরা নব্বই। সুতরাং এটা অত্যন্ত পরিষ্কার যে এই সাধারণ মানুষের স্বার্থানুকূল নয় এমন কোনো আন্দোলনই স্থায়ী গুরুত্ব বা প্রচণ্ড শক্তির সৃষ্টি করতে পারবে না। কংগ্রেসের কার্যসূচী থেকে ভাবালুতাকে সম্পূর্ণভাবে ছেঁটে ফেলতে হবে। ধোঁয়াটে ভাববাদের স্বপ্নচূড়া থেকে তাকে নামিয়ে আনতে হবে। কংগ্রেসকে সাধারণ মানুষের জীবনধারণের অপরিহার্য বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেই হবে। মেহনতী মানুষের ন্যূনতম আশা- আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন দেখা দিক কংগ্রেসের মধ্যে। ভারতবর্ষের জনগণ মেসোপটেমিয়া বা আরব বা কনস্টান্টিনোপলের মতো অজানা অচেনা দেশের জন্য লড়বে কেন, তাদের সংগ্রামের লক্ষ্য হবে তাদেরই জীবন ও পরিবেশ তাদেরই ঘরবাড়ী জমি আর কলকারখানায়। ক্ষুধার্ত মানুষ একটা ভাববাদী অবাস্তব আদর্শ সামনে রেখে লড়াই করে যাবে এটা আশা করা যায় না। কংগ্রেস কি চিরকালই জনগণকে আরও নির্যাতন সহ্য করতে, আরও ত্যাগ করতে উপদেশ দিয়ে যাবে? ভারতীয় জনগণ তো সহনশীলতা এবং ত্যাগের মূর্ত প্রতীক। তাদের যুগসঞ্চিত এই দুঃখ-কষ্টের অবসানের স্পষ্ট সম্ভাবনাকে তাদের দৃষ্টির সামনে আনতে হবে। তাদের অর্থনৈতিক সংগ্রামে সাহায্য করতে হবে। কংগ্রেসের পক্ষে অর্থনৈতিক ও সামাজিক পুনর্গঠনের সুস্পষ্ট কার্যসূচী প্রণয়নের কাজ আর ফেলে রাখা উচিত হবে না। ৩৬তম কংগ্রেসের সামনে প্রধান কাজ অত্যাচারক্লিষ্ট জনসাধারণের দুঃখ-দুর্দশা মোচনের উদ্দেশ্যে এবং তাদের বর্তমানের শোচনীয় অবস্থার উন্নতির দাবিতে একটি গঠনমূলক কার্যসূচী গ্রহণ করা।
১লা ডিসেম্বর, ১৯২১
মানবেন্দ্রনাথ রায়
অবনী মুখার্জি