ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন
বলরামপুরে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার গুদাম। মহ মাঝি নামের এক ঠিকা শ্রমিক সেই গুদামে মালবাহকের কাজ করতেন। কর্মরত অবস্থাতেই চাল ভর্তি ভারী সিন্থেটিক বস্তা চাপা পড়ে মারা যান। ঠিকাদার ‘ব্যাপারটা’ দশ হাজার টাকার বিনিময়ে রফাদফা নিতে চেয়েছিল। বাধ সাধলেন কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতা, দীর্ঘদিনের সাংসদ। কাজ করতে গিয়ে দুর্ঘটনায় ঠিকা মজদুর মারা যাবেন আর তাই তার পরিবারকে অনাহারে দিন কাটাতে হবে- এই সহজ সত্যটা মানতে রাজি নন তিনি। নয়া-উদারবাদের জমানায় এমন সহজ বাস্তবতা না মেনে তাকে পাল্টে দেওয়ার কাজকেই নিজের রাজনীতি বলে মেনেছিলেন যে মানুষটি তিনিই বাসুদেব আচারিয়া।
পাল্টে দেওয়ার কাজটিকে শেষ অবধি পরিনতি দিতে অশক্ত, অসুস্থ শরীরেও ছুটে এসেছিলেন কলকাতায়, এফসিআই’র সদর দপ্তরে। ঠিকা শ্রমিকের হক, মর্যাদা ও প্রাপ্য আদায় করতে।
সেদিন তার পাশেই ছিলেন সারা ভারত নাবার্ড কর্মচারী সমিতির সাধারণ সম্পাদক রাণা মিত্র সহ আরও দুজন। সকলেই একে অন্যকে কমরেড বলে সম্বোধন করেন। তারা সঙ্গে না থাকলে হয়ত এমন কাজের কথা অজানাই রয়ে যেত। গত ১৩ই নভেম্বর কমরেড বাসুদেব আচারিয়া মারা গেছেন। তার প্রয়াণে স্মৃতিচারণা হিসাবে কমরেড রাণা মিত্র সোশ্যাল মিডিয়ায় কলম ধরেছেন। এই প্রতিবেদনে তার সেই লেখাই আমরা প্রকাশ করলাম। সাথে রইল মৃত শ্রমিকের পরিবারের পাশে থেকে ঐ লড়াইয়ের কিছু মুহূর্ত- ছবির ভাষায়।
‘যতদূর মনে পড়ছে ২০২২, এপ্রিল মাস, গরম কাল।
হঠাৎ বাসুদার (বাসুদেব আচারিয়া) ফোন। ‘রানা, আপনি কি আজ কলকাতায়?’
বললাম, ‘হ্যাঁ’।
‘তাহলে দুপুরের দিকে একবার নাবার্ডের রয়েড স্ট্রীটের অফিসের পিছনে এফ.সি.আই অফিসে যাব। ওখানে জেনারেল ম্যানেজারের সাথে একটা জরুরী মিটিং এ যাব। আপনি একটু থাকবেন আমার সাথে’?
বললাম, ‘নিশ্চয়ই’!
সাথী কমরেড সাগর আর মিলনকে বললাম, ‘বাসুদা আসছেন সেই পুরুলিয়া থেকে এফ.সি.আই-তে জরুরী মিটিং এ। আমাদের থাকতে হবে’।
যথারীতি দুপুরে প্রখর দাবদহের মধ্যে মানুষটা এলেন, একা, সাথে গাড়িতে একজন শুধু ড্রাইভার। শরীর প্রবল খারাপ। গাড়ি থেকে নামতে গিয়ে বার দুয়েক টলে গেলেন। বললেন, ‘শরীরটা বেশ খারাপ। সুগারটা বড্ড ঝামেলা করছে’!
আমরা সাথে, সাথে নাবার্ডের ৫ম তলে আমাদের গেস্ট হাউজে (আগে থেকেই বুক করে রেখেছিলাম) নিয়ে গেলাম। বললাম, ‘শরীরের এই হাল। এতদূর থেকে এসেছেন। আগে একটু বিশ্রাম নিন। কিছু খেয়ে নিন’। বললেন, ‘শুধু একটু চিনি ছাড়া লাল চা’।
আমরা পীড়াপীড়ি করতে দুটো ক্রিম কেকার বিস্কুট খেলেন।
বিশ্রাম? ওমা, চা শেষ করেই বললেন, ‘চলুন, এফ.সি.আই যাই’।
বললাম, ‘যদি কিছু মনে না করেন! শরীরের এই হালে একা দৌড়ে এসেছেন সেই পুরুলিয়া থেকে। পরে এলে হত না’? ।
বললেন, সেই স্বভাববিদ্ধ শান্ত কণ্ঠে, ‘না কমরেড রানা, হত না। কারণ একজন ঠিকা মুটে মজুর পুরুলিয়া রেলওয়ে সাইডিং-এ এফসিআই-র মাল নামাতে গিয়ে মাথায় পে লোড পড়ে মারা গেছে। ওর পরিবারে বউ আর ছোট বাচ্ছারা আছে। ওরা তো ঠিকা মজদুর। তাই এফসিআই সাধারণত এদের দায়িত্ব নিতে চায় না। বউটা আমার কাছে এসে কান্নাকাটি করছে। দেখি জেনারেল ম্যানেজারকে বলে, কিছু যদি করা যায়’!
বুঝুন, মাত্র একজন ঠিকা শ্রমিক, সে দুর্ভাগ্যজনকভাবে মারা গেছে। তার যদি কিছু ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা যায় সেই জন্য ওই অশক্ত শরীরে একা পুরুলিয়া থেকে ছুটে এসেছেন কলকাতায় এফসিআই-র কাছে দরবার করতে।
তা আমরা তিনজন বাসুদার সঙ্গী হলাম পিছনের বিল্ডিং-এ এফসিআই অফিসের উপরে জেনারেল ম্যানেজারের ঘর পর্যন্ত বাসুদার সাথে। জেনারেল ম্যানেজার বাসুদাকে দেখেই ঘরে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। আমরা তিনজন বাইরেই বসলাম জেনারেল ম্যানেজারের সচিবের ঘরে। আধ ঘন্টা গেল!
মানুষটা বেরিয়ে এলেন, সেই ভাবলেশহীন মুখ, মনে হল, যেন কিছুটা উজ্জ্বল, অশক্ত শরীরের সেই মুখ।
বেরিয়েই আমাদের বললেন, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ। কাজটা হয়ে গেছে। জেনারেল ম্যানেজার রাজি হয়েছেন মজুরটির পরিবারকে অর্থ ও অন্যান্য সাহায্য করতে। চলুন এবার’!
নাবার্ডের গেস্ট হাউজে ফিরে আসতে গিয়ে লক্ষ্য করলাম, আবার টলে যাচ্ছেন। আমি, সাগর আর মিলন ধরতে গিয়ে দেখি গায়ে জ্বর। বললাম, ‘বাসুদা, এই অবস্থায় কিছুতেই আপনাকে পুরুলিয়া ফিরে যেতে দেব না। আপনি আজ আমাদের গেস্ট হাউজে থাকুন। কোন অসুবিধা হবে না। আমরা দেখভাল করব’।
স্মিত হেসে বললেন, ‘আরে না, না। আমার এরকম হয়। আবার সেরেও উঠি। একটু বসে বিশ্রাম নিলেই হবে। বলে উপরে এসে গেস্ট হাউজের সোফায় এসে বললেন। শত অনুরোধেও এক্সিকিউটিভ রুমে গেলেন না। আবার এক কাপ লাল চা, সাথে এক পিস ক্রিমকেকার।
বললেন, ‘বড্ড ভাল হল বুঝলেন? না এলে মজুরটির পরিবার অনাহারে থাকত’!
আমরা তিনজন আক্ষরিক অর্থেই বাকরুদ্ধ! মাত্র একজন ঠিকা মজুরের পরিবারের প্রতি এই মমত্ব, এই ভালবাসা, নিজের শরীরকে তুচ্ছ করে! কি বলব একে? প্রখর শ্রেণীচেতনা? শ্রমিক, গরীব মানুষের প্রতি নিখাদ, অকৃত্রিম দরদ? কতটা ভালবাসা থাকলে শুধু একজনের জন্য এত দূর থেকে নিজের অশক্ত শরীরে, বিপদজনকভাবে কলকাতায় ছুটে আসা যায়? কেউ জানল না, কোন প্রচার নেই, কোন মোবাইলে, ফেসবুকে, সামাজিক মাধ্যমে প্রচার নেই, কোন সন্ধ্যায় কোন টিভির টক শোতে মুখ দেখানো নেই। শুধু নিখাদ, অকৃত্রিম দরদ নিজের শ্রেণীর প্রতি।
মানুষটা উঠলেন, খানিক পরে। বললেন, ‘রানা, সাগর, মিলন, কমরেডরা, কিছু মনে করবেন না। আজ পুরুলিয়ায় ফিরতেই হবে। কাল কিছু জরুরী বিষয় আছে। ওখানে কিছু মানুষ বসে থাকবে যে’।
বেরিয়ে যাচ্ছেন মানুষটা, কিছু ধাতস্থ হয়ে, গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলাম আমরা তিনজন। হাত নেড়ে আমাদের ধন্যবাদ দিলেন (বুঝুন, কে কাকে ধন্যবাদ দেয়)!
আর হ্যাঁ, বললেন, যাওয়ার আগে বললেন, ‘নাবার্ডের সংগঠনের যে বিষয়গুলো বললেন তা বিস্তারিত অবশ্যই জানাবেন। যদি কোনওভাবে সাহায্য করতে পারি। এমপি নেই এখন আমি, তবে অসুবিধা নেই। আপনাদের জন্য প্রয়োজনে আবার দিল্লী যাব, আপনাদের সাথে নিয়েই, মন্ত্রীর কাছে’!
চলে গেলেন মানুষটা।
আমাদের সামনে মূর্তিমান মার্কসবাদী প্রয়োগ (হ্যাঁ, সচেতনভাবেই ব্যবহার করলাম শব্দটা) চলে যাচ্ছে,… যাচ্ছেন….!
হঠাৎই দেখছি, ‘Political Marx’ বইতে বিজয় প্রসাদের সাথে কথোপকথনে আইজাজ আহমেদ বলছেন, ‘Knowing the world without acting upon it to change it is pure idealism. Marx comes to see the centrality of acting in history. Praxis is at the centre of epistemology’.
Political Marx, Leftword, p.18
বাসুদা Political Marx পড়েছিলেন কিনা জানা নেই৷ মার্কস নিশ্চয়ই পড়েছিলেন৷ বুঝেছিলেন মোদ্দা কথাটা…নিজের জীবন দিয়েই প্রয়োগের শিক্ষাটা ছড়িয়ে দিতে হবে। আমরা বোধহয় ভাগ্যবান! এইরকম প্রয়োগবিদকে আমাদের মধ্যে পেয়ে।
লাল সেলাম কমরেড বাসুদেব আচারিয়া!’
বলরামপুর এফসিআই’র গেটের সামনে মৃত শ্রমিকের বাড়িতে, তার স্ত্রী ও পরিবারের সাথে
প্রতিবেদনে ব্যবহৃত শিরোনাম ওয়েবডেস্কের
ছবি- রাণা মিত্রের সংগ্রহ