কিন্তু, উদ্বৃত্ত মূল্যটার কী হলো?
আপনার বক্তব্য শুনলাম। সে কারখানাও নেই, সে শ্রমিকও নেই, সে সোভিয়েত ইউনিয়নও নেই। শুনলাম, মানলাম সবটা এখনই বলতে পারছি না। যা হোক, তর্কের খাতিরে, শুনলাম। এবং শুনে বললাম, তো, তাতে কী হয়েছে?
এবার আপনি বোঝাতে শুরু করবেন, মার্কস যবে ক্যাপিটাল গ্রুন্ড্রিসে ইত্যাদি লিখছেন, তখনকার দুনিয়া আর আজকের দুনিয়ার কত ফারাক। ইংল্যান্ডে দেখা এঙ্গেলসের শ্রমিকরা আজ কত্ত পালটে গিয়েছে। বারো হাত কাঁকুড়ের তেরো হাত বিচিওয়ালা কর্পোরেট কোম্পানিগুলো মাঝখানে শ্রমিককে ‘এক্সিকিউটিভ’ নামে ডাকতো, আজকাল তো এমনকি ‘কোল্যাবোরেটর’ নামেও ডাকছে। শ্রমিক নিজেও এখন শেয়ার কিনে অল্প মালিক মালিক গন্ধ পাচ্ছে নিজের গায়ে, একদম পাচ্ছে না তাও নয়। তবে? আজকাল আর ওসব শ্রেণীসংগ্রাম-টংগ্রাম চলে নাকি?
আমায় সিপিএম পার্টি বলেছে, মানুষের কথা শোনো ধৈর্য্য ধরে। আমি পুরোটা ধৈর্য্য ধরেই শুনব। একবারও আপনাকে আটকাবো না। সব শুনে টুনে নিষ্পাপ নিরপরাধ মুখে প্রশ্ন করব, সবই তো বুঝলাম, কিন্তু, উদ্বৃত্ত মূল্যটার কী হলো?
*
ধরুন, এই যে কোভিড হলো, লকডাউন হয়ে থাকল দু’বছর, এই বাজারে আপনার রোজগার একটু হলেও গোলমাল হয়েছে তো? আমি ধরে নিচ্ছি আপনি ছোট চাষি, ক্ষেতমজুর, রাজমিস্ত্রী, অটোচালক বা বিড়ির দোকানদার নন। ধরে নিচ্ছি আপনি ডাক্তার, উকিল, সফটওয়্যার এমপ্লয়ি, ট্রেড অ্যানালিস্ট, ফ্যাশন ডিজাইনার ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি। ধরে নিচ্ছি আপনার অফিস আপনাকে বাড়ি পৌঁছনোর জন্য গাড়ি দেয়, মাঝে মাঝে শনিবারে ককটেল পার্টিতেও ডাকে। আরে আপনারও তো রোজগার মার খেয়েছিল লকডাউনে খানিক, খায়নি?
অথচ, মুকেশ আম্বানি ওই লকডাউনের মধ্যেই, নতুন করে লন্ডনে ৩০০ একর জমি কিনেছেন। বিরাট রাজপ্রাসাদ বানাবেন প্রমোদভ্রমণের জন্য।
এই আদানি লোকটাকে পাঁচ বছর আগে আপনি নিজে চিনতেন? হিন্ডেনবার্গের হিমশৈলে ধাক্কা খাওয়ার আগে এ লোকটা দুনিয়ার দু’নম্বর ধনীতম লোক হয়ে গিয়েছিল! আজ্ঞে হ্যাঁ, এমনকি আম্বানির থেকেও বড়লোক। কী করে? আপনি বলবেন, ব্যবসা করে। কই, আপনার পাশের বাড়ির লোকটাও তো বনেদি ব্যবসায়ী, বড়বাজারে সোনার দোকান আছে। সে তো আদানি হতে পারল না! তার মানে, আদানির ব্যবসার মধ্যে এমন কিছু ঢপবাজি আছে, যা খালি চোখে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বছর বছর আদানির মালকড়ি বাড়িয়ে যেতে সাহায্য করছে বিনা বাধায়।
আপনি এবার একটু হোঁচট খাবেন। শ্রমিক মালিক কোনোটাই আগের মত নেই, এ তো দেখাই যাচ্ছে খালি চোখে। কিন্তু তাতে তো বড়লোক আর গরিবের ফারাকটা কমছে না! আচ্ছা আপনার কথামতো ধরে নিলাম গরিব লোকের জীবনযাত্রার মান খানিক উন্নত হয়েছে বিগত বিছরগুলোয়। যদিও এই গরিবির সংজ্ঞাগুলো সবই বড়লোকের স্বার্থ অনুযায়ী ফিটিং করা, এবং ভারতে হতদরিদ্র ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে, তবুও, তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম, আপনার নয়া-উদারবাদের সুফল চুঁইয়ে পড়েছে নাহয় অল্প কিছু লোকের উপর। গরিবের ঘরেও চাষের মেশিন মোবাইল ফোন ফ্যান লাইট ইত্যাদি একদম নেই তা বলা যায় না। তো, কী যায় আসে তাতে?? তিরিশ বছর আগের বড়লোক, আর আজকের বড়লোকের মধ্যে যে বিপুল ফারাক, দুনিয়ার সম্পদের যে বিপুল কেন্দ্রীভবন অল্প কিছু লোকের হাতে, তা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না? গরিবের জীবনে মোবাইল এল কিনা তা দিয়ে মার্কসবাদের সারবত্তা বিচার হয় না! উৎপাদিকা শক্তির অগ্রগতির সাথে মানবসমাজে চাট্টি পরিবর্তন আসবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। আসল কথা হলো, ধনী আর গরিবের তফাৎটা, বাড়ল না কমল দুনিয়াজুড়ে?
১৯৯১-পরবর্তী একটা তথ্য-পরিসংখ্যানও বলছে না, যে বড়লোক আর গরিবের ফারাক কমেছে। বাড়ছে, বাড়ছে। কী করে বাড়ছে। ভাববেন না?
যদি বলি, যে যাই থিওরি নামাক গত দেড়শো বছর ধরে, যতই দুনিয়ার চেহারা আপাতভাবে পালটে যাক, যতই আপনার তথাকথিত ‘এক্সিকিউটিভ’দের জামায় সাদা কলার উঠুক – মালিক দ্বারা শ্রমিককে প্রবঞ্চনা করে উদ্বৃত্ত মূল্য আহরণের বেসিক গল্পটা আজো একই আছে, ওপরের জামাটা পাল্টেছে শুধু, তাহলে কি আপনি আমাকে তাড়া করবেন?
*
তাড়া করলেন না বটে, তবে আপনার মুখচোখ বলছে আপনি একটু কনফিউজড হয়ে গেছেন। আর ঘেঁটে গেলেই আপনারা যা করতে শুরু করেন, অর্থাৎ ব্যক্তিস্বাধীনতা ব্যক্তিস্বাধীনতা বলে লাফানো, সেটা শুরু করবেন ভাবছেন। বলিহারি আপনাদের। দুনিয়ার ৮৫ ভাগ মানুষ হলো গরিব আর মধ্যবিত্ত। তারা ব্যক্তি নয়? তাদের স্বাধীনতা নেই নিজের মতো করে বাঁচার? ওই সমাজের উঁচুতলার কয়েকটা লোক, ওরাই যাবতীয় স্বাধীনতা ভোগ করবে, আর বাকিরা সভ্যতার পিলসুজ হয়ে ওদের তেলা মাথাকে আরো চকচকে করা বন্দোবস্ত করে যাবে আজীবন, এই আপনাদের ফিকির?
আম্বেদকর তো কমিউনিস্ট ছিলেন না। কন্সটিটুয়েন্ট অ্যাসেম্বলির শেষ ভাষণে আম্বেদকর বলেছিলেন, “On the 26th of January 1950, we are going to enter into a life of contradictions. In politics we will have equality and in social and economic life we will have inequality…How long shall we continue to deny equality in our social and economic life? If we continue to deny it for long, we will do so only by putting our political democracy in peril.” কেন বলেছিলেন, বোঝেন?
জ্যোতিপ্রিয় মল্লিকের জমি অপারেশন বর্গায় চলে গেলে আপনাদের কাছে সেটা ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, আর জোতদারের বাঁদরামো বছর বছর সহ্য করে ধারকর্জে জড়িয়ে খাজনা দিতে না পেরে ভুখা পেটে মরে যেত যে মজুর, তার জীবনটা আপনাদের কাছে অপাঙক্তেয়। ব্যক্তিস্বাধীনতার সর্বোচ্চ উন্মেষের ক্ষেত্র উন্নততর সমাজতন্ত্রই, আর কিছু নয়। পুঁজির শাসন মানে সরাসরি বা ঘুরিয়ে, অধিকাংশ মানুষের গোলামিরই খতিয়ান। গোলাম কখনো, স্বাধীন হতে পারে না। আপনার ছেলে সপ্তাহান্তে আপনাকে বোস্টন বা ম্যাসাচুসেটস থেকে ভিডিও কল করতে পারে, তার মানে এই নয় যে আপনিও খুব একটা স্বাধীন। আম্বানির ৩০০ একর কেনার ঐশ্বর্য্যে আপনারও ব্যাঙ্কে রাখা টাকার ভাগ আছে।
*
ক্ষেপে গেলেন? সরি। আমার উদ্দেশ্য আপনার মতামতকে অসম্মান করা নয়। আপনাকে ওরা ভাবিয়েছে যে সোভিয়েত পড়ে গেল মানে মার্কসবাদ শেষ, আপনি ভেবেছেন কিছুদিন, অসুবিধা নেই। এবার প্লিজ চোখটা খুলুন। দেখুন চারপাশে। মার্কসবাদীরা পুঁজিবাদকে যে যে কারণে প্রতিস্থাপন করা উচিৎ মনে করে, সে কারণগুলো বিশ্লেষণ করে দেখুন। দুনিয়ার শাসকরা ডানদিকে ঝুঁকেছে গত কিছুদিন ধরে। প্যালেস্তাইনের উপর ইজরায়েলের এই নির্বিচার আক্রমণ আসলে দুটো দেশের যুদ্ধ না, দুনিয়াজোড়া রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থার আস্ফালন। আস্ফালন কেন? কারণ, সোজা আঙুলে আর ঘি উঠছে না। আদিম লুটের কারবারিরা পৃথিবীজুড়ে মানবসভ্যতার সঙ্কট বাড়িয়ে দিয়েছে। রোজগার নেই, কাজের নিশ্চয়তা নেই, সামাজিক নিরাপত্তা মর্যাদা নেই, ফাটকাবাজির দিকে চলে যাচ্ছে সমগ্র পুঁজিবাদী অর্থনীতি। ভারতজুড়ে, বাংলাজুড়ে গরিব মানুষের অবস্থা শোচনীয়। আপনি দেখছেন, দেখছেন না এমনটা নয়। বাজারি আনন্দের মার্কসবাদ বিরোধিতার হ্যাংওভার আপনাকে সত্যি কথাটা স্বীকার করতে দিচ্ছে না।
হ্যাঁ সমাজতন্ত্রের প্রয়োগে ত্রুটি হয়েছিল। জ্যোতি বসুর সংক্ষিপ্ত কথাটাই এক্ষেত্রে আপ্তবাক্য ধরা যাক, “ওখানে পার্টি মানুষের থেকে বড় হয়ে গিয়েছিল।” সে ত্রুটি সামলেই সামনে এগোবে একুশ শতকের সমাজতন্ত্রীরা। আবার কোনোদিন পৃথিবীর নতুন কোনো প্রান্তে সুযোগ পেলে মানুষের সুক্ষ্মতর চাওয়াপাওয়াগুলো খেয়াল রাখা হবে আরো ভাল করে। বৈচিত্র্যের খিদে স্বীকার করেই রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে জুড়ে নেওয়া হবে শ্রমজীবী জনতাকে। পুঁজিবাদ বছর বছর ফেল করে না? ১৮৫৭, ১৯২৯ বা ২০০৮’এর মন্দা কি সমাজতন্ত্রের জন্য হয়েছিল? ভারত এই মুহূর্তে ক্ষুধার সূচকে দুনিয়ার ১১১তম দেশ, তা কি কমিউনিস্টদের জন্য?
সো হোয়াট, যদি বিশ শতকে একটি দেশের সমাজতন্ত্রের প্রয়োগে ভুলত্রুটি ধরা পড়ে?
অর্থনীতিবিদ প্রভাত পট্টনায়ককে সোভিয়েত পতন নিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিল মিডিয়া। তিনি হাসতে হাসতে বলেছিলেন, কাল যদি তাজমহল ভেঙে যায়, তাহলে কি মানুষ আর কোনোদিন প্রেমে পড়বে না?
*
আমি সমৃদ্ধির জীবন চাই। আমার জন্য, আপনার জন্যও। এখানে কোনো দানছত্রসুলভ মহানুভবতার কেস নেই। কমিউনিস্টরা নিজেদের লক্ষ্য গোপন করতে ঘৃণাবোধ করে, মার্কস-এঙ্গেলস লিখেছেন ইশতেহারে। আমরা যে আগামীর শোষণহীন বিশ্ব চাইছি, তা আমাদের সকলের জন্যই চাইছি। দুনিয়ার সম্পদের সুষম বন্টন না হলে তা হবে না। আমাদের নেতারা শিখিয়েছেন, সমাজতন্ত্র মানে দারিদ্র্যের পুনর্বন্টন নয়, সমৃদ্ধির পুনর্বন্টন। আমরা সে লক্ষ্যেই ভারতের মাটিতে লড়ে চলছি গত ১২৩ বছর ধরে। এই চারপাশে যা ‘অধিকার’ আপনি দেখেন মানুষের, যে অধিকারগুলোর অধিকাংশই আপনি নিজেও এনজয় করে থাকেন, সেগুলো বহুক্ষেত্রেই আমাদের, বা আমাদেরই সমমনোভাবের কারো লড়াইয়ের ফলে অর্জন করা। আমরা মাঝপথে ইউ টার্ন নেব না। যে অধিকারগুলো অর্জন করা যায়নি, সেগুলোর জন্য লড়ব ক্লান্তিহীন। আরো অনেকদিন অনেক বাঁক মোড় পেরিয়ে হাঁটতে হবে আমাদের। এ লড়াই একদিনের না। এ লড়াই চিরদিনের।
এ লড়াইতে, আজ অবধি, সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনটির নাম নভেম্বর, ১৯১৭। লেনিন আমাদের কাছে কোনো ভগবান-টগবান নয়। ভগবান স্বপ্নে দর্শন দেন কেবল। লেনিন, দুনিয়ার গরিব লোকের কাছে, স্বপ্নটাকে সত্যি করে ফেলার হাতিয়ার।
*
দুনিয়াজুড়ে শুধু তো মোদি-মমতারাই নেই। প্রতিরোধেরও অসংখ্য ছোটবড় গল্প আছে। মাদ্রিদের রাজপথ থেকে সিংঘু সীমান্ত হয়ে পুরুলিয়ার অঘোরপুরের আলরাস্তা, রুখে দেওয়ার মানুষরাও কিন্তু নেহাত কম নয়। একতরফা অত্যাচার সয়ে মরে যাওয়ার দিন শেষ। জাত ধর্ম চামড়ার রঙ ভাষা, যতই ভাগ করার চেষ্টা হোক – কপালে ভ্রূকুটি বাড়ছে দালালদের। কখনো আদানি জেতে, কখনো মানুষ। কোনো ভোটে পরপর দুবার আদানির পার্টি জেতে, কখনো মানুষের পার্টি। আমাদের কাজ কঠিন নিঃসন্দেহে, বিশেষত যখন ওদের হাতেই টাকার থলির মালিকানা। তবে, কঠিন আর অসম্ভবের ফারাক আছে। বলশেভিকরা পেত্রোগ্রাদ দখলের আগে অবধি অনেকগুলো ‘কঠিন’ কথাই চিরতরে ‘অসম্ভব’ ছিল। এখন তারা, কেবল কঠিন। অসম্ভব নয় আর বিপ্লবের উৎসবের দিন।
ইদানীং খুব হইচই হচ্ছে নজরুলের গান নিয়ে। কারার ওই লৌহ কপাট, সেও তো কঠিনই হয়। ভাঙতে যাবেন নাকি আমাদের সাথে?