২৬ জানুয়ারী, ২০২৩ (বৃহস্পতি বার)
২৬ শে জানুয়ারি এদেশের প্রজাতন্ত্র দিবস। ১৯৫০ সালের এই দিনটিতে ভারতবর্ষের সংবিধান কার্যকর করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২৪ শে জানুয়ারি হাতে লেখা সংবিধানের দুটি কপিতে স্বাক্ষর করেন গণপরিষদের ৩০৮ জন সদস্য। তার আগে ১৯৪৯ সালের ২৬ শে নভেম্বর গণপরিষদের ২৮৪ জন সদস্য সই করার মধ্য দিয়ে সংবিধান আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়। এই দিনটিকে তাই সংবিধান দিবস হিসেবে পালন করা হয়। ডঃ ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা কমিটি বহু পরিশ্রম করে প্রায় দু বছর ১১ মাস ১৮ দিন সময় নিয়ে তৈরি করেছিলেন এই সংবিধান যা কার্যকর করার দায়িত্ব ছিল স্বাধীন সরকারের। সংবিধানের শতাধিক ( ১০৪ টি) সংশোধনী গৃহীত হয়েছে। সব মিলিয়ে এটি কার্যকর হয়েছে কতটা তা নিয়ে বিস্তর বিতর্ক আছে। আরএসএস নিয়ন্ত্রণাধীন বিজেপির সরকার দেশে দ্বিতীয় দফায় তৈরি হওয়ার পর সংবিধানকে অমান্য করার প্রবণতা অনেকটা বেড়েছে। এখন তাই সংবিধান কতটা কার্যকর করা হলো তার চাইতেও সংবিধানকে রক্ষা করাটাই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুরুর দিন থেকেই আরএসএস ভারতের সংবিধানকে মান্যতা দেয়নি। মনুসংহিতার আদলে তারা সংবিধান রচনা করতে চায়। তাই রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর আরএসএসের হস্তক্ষেপ যেমন বেড়েছে, সংবিধানকে অমান্য করার প্রবণতাও পাল্লা দিয়ে বেড়েছে।
ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধ অর্থাৎ প্রস্তাবনার অংশটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার রূপ দিয়েছিলেন স্বয়ং জহরলাল নেহেরু। এই প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে ভারত একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে উঠবে। দেশবাসী হিসেবে আমাদের সকলের দায়িত্ব হল ভারতবর্ষকে এমন ভাবে গড়ে তোলা যাতে এ দেশের সকল নাগরিকের জন্য সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ন্যায় বিচার সুনিশ্চিত করা যায়। তারা যাতে চিন্তা মত প্রকাশ বিশ্বাস ধর্ম ও উপাসনার স্বাধীনতা ভোগ করতে পারেন। তাদের মর্যাদা ও সুযোগ সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে সমতাবিধান হতে পারে এবং সর্বোপরি তাদের সকলের মধ্যে সৌভ্রাতৃত্ব ভাব গড়ে তুলে ব্যক্তির মর্যাদা এবং জাতীয় ঐক্য ও সংহতি রক্ষিত হয়।
সার্বভৌম কথার অর্থ রাষ্ট্র অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক সমস্ত বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী। এখানে অন্য কারো হস্তক্ষেপ থাকবে না। ধর্মনিরপেক্ষ বলতে বোঝানো হয়েছে রাষ্ট্রের কোন ধর্ম থাকবে না বা রাষ্ট্র কোন ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। ধর্মের ভিত্তিতে কোন কর আরোপ করবে না। রাষ্ট্রের সকল নাগরিক স্বাধীনভাবে আপন ধর্ম পালন ও প্রচার করতে পারবেন। গণতান্ত্রিক অর্থে বলা হয়েছে জাতি ধর্ম-বর্ণ লিঙ্গ নির্বিশেষে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের সমান অধিকার সুনিশ্চিত করা। প্রজাতন্ত্রে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকল নাগরিকের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করে নির্বাচিত সরকার গঠিত হবে। আর সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিকল্পিত অর্থনীতিতে রাষ্ট্র পরিচালনার মাধ্যমে সম্পদ ও অর্থ বণ্টনের ক্ষেত্রে সমতা সুনিশ্চিত হবে, নাগরিকদের মধ্যে আয় ও সম্পদের বণ্টনে বৈষম্য থাকবে না । ভারতবর্ষে যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত করতে এই সংবিধানে কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলির মধ্যে ক্ষমতার সুনির্দিষ্ট বন্টন করা হয়েছে। মূলত তিনটি ভাগে এটি বিভক্ত। জাতীয় প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক নীতি, মুদ্রা ব্যবস্থার মত কিছু বিষয় আছে যা কেন্দ্রীয় তালিকার অন্তর্গত। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা, স্থানীয় সরকার অর্থাৎ পঞ্চায়েত পৌরসভা গড়ে তোলা ইত্যাদি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত। আবার শিক্ষা পরিবহন অপরাধমূলক আইন ইত্যাদি বিষয়গুলি যুগ্ম তালিকাভুক্ত যেখানে কেন্দ্র-রাজ্য উভয়কে মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের জায়গায় যেতে হয় ।
ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারের বিষয়টি সুনির্দিষ্ট করে বলা আছে। সাম্যের অধিকার, স্বাধীনতার অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে লড়বার অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার, সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার এবং সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার– এই ছটি হল আমাদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার।
অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে যদি আমরা মেলাতে শুরু করি তাহলে দেখা যাবে, স্বাধীনতার ৭৫ বছরে এ দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা উপরোক্ত অধিকার গুলি থেকে অনেকাংশে বঞ্চিত। পদে পদে আক্রান্ত হচ্ছে এদেশের সংবিধান। সংবিধানের প্রধান চারটি মৌলিক ভিত্তি– ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব আজ বিপন্ন। দেশের আইনসভা অর্থাৎ সংসদ কে খর্ব করে সংখ্যাগরিষ্ঠের একচেটিয়া শাসন কায়েম করার চেষ্টা চলছে। সংসদীয় রীতিনীতি, আলোচনা ইত্যাদি সবটাই খর্ব করা হচ্ছে।
দেশবাসীর মধ্যে বৈষম্য প্রকট চেহারা নিয়েছে। দেশের সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করে মুষ্টিমেয় কিছু বিত্তশালী কর্পোরেট মালিক ও তাদের পরিবার। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এদের মোট সম্পদ এখন গুণিতক হারে বেড়ে চলেছে। বস্তুত এরাই ( আদানি- আম্বানি প্রমুখ) এখন রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রধান পরিচালক বা নিয়ন্ত্রক। তাদের নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করতে আনা হয়েছে ‘ইলেক্টোরাল বন্ড’ পদ্ধতি। এক কথায় দেবে আর নেবে পদ্ধতি। নির্বাচনের আগে তারা পছন্দের রাজনৈতিক দলকে যথেচ্ছ অর্থ যোগাবে এই শর্তে যে নির্বাচনের পর সরকার গঠন হলে পরের পাঁচ বছর নাগরিকদের ও সরকারি সম্পদ লুট করবার লাইসেন্স তাদের দিতে হবে। সারা দেশ জুড়ে এখন হচ্ছেও তাই।
স্বাধীন ভারতে স্বাধীন বিচারবিভাগ তৈরি হয়েছিল যাতে সাংবিধানিক ধারাকে সরকার লঙ্ঘন করতে না পারে। সংবিধান জনগণকে যে মৌলিক অধিকার দিয়েছে তা যেন যথাযথ ভাবে রক্ষিত হয়। সেই বিচার ব্যবস্থায় এখন দখলদারি চলছে। একচেটিয়া দখলদারি সুনিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতি নিয়োগের প্রক্রিয়াতেও নাক গলাতে চায় সঙ্ঘ পরিবার তথা বিজেপি। তাই কলেজিয়াম প্রথার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে শাসক দলের প্রতিনিধিকে এই কলেজিয়ামে ঢোকানোর জন্য তাঁবেদারি করছে। আমজনতা ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। গুজরাট দাঙ্গার নায়ক আদালতের বিচারে এখন নিরপরাধ সাব্যস্ত হয়েছে, অপরদিকে ন্যায় বিচার চাইতে গিয়ে জেলবন্দী হতে হচ্ছে ভারভারা রাও, তিস্তা শীতলাবাদ, ডাক্তার কাফিল খান, উমর খালিদ প্রমূখ সমাজকর্মীদের। গারদের অন্তরালে খুন হয়েছেন সমাজকর্মী স্ট্যান্ স্বামী। ব্রিটিশ যুগের রাষ্ট্রদ্রোহীতার আইন নতুন করে লাগু হয়েছে এই আমলে। মোদির সুরে সুর মেলাতে না পারলেই দেশদ্রোহী খেতাবে জেলবন্দী হতে হবে এটাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে এখন। সি এ এ, এনআরসি সংবিধানসম্মত নয় এই সত্য কথাটুকু বলার অপরাধে দিল্লি উত্তরপ্রদেশে জেলবন্দী হতে হয়েছে বহু নিরপরাধ নাগরিককে। নির্বাচন কমিশনের দখল নিয়েছে শাসক দল। কমিশনের নিরপেক্ষতা ও স্বাধীনভাবে হস্তক্ষেপ করবার অধিকার যায দেশের গণতন্ত্র রক্ষার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়েছে। জনগণের আস্থা হারাচ্ছে নির্বাচন কমিশন যা ফিরিয়ে আনা জরুরী।
সংবিধানে উল্লিখিত মত প্রকাশের অধিকার বর্তমান সরকার কেড়ে নিয়েছে। গুজরাট দাঙ্গার ওপর তৈরি বিবিসির সাংবাদিকদের তদন্তমূলক ডকুমেন্টারি দেখানো যাবে না এই মর্মে ফতোয়া জারি করা হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে তো মোদি অপরাধী নন বলা হয়েছে, তবু কেন এত ভয়? কেন এই ডকুমেন্টারি নিষিদ্ধ করা হচ্ছে? আসলে সত্যকে কিভাবে আড়াল করা হয়েছে তা ফাঁস হয়ে যাওয়ার ভয়ে নরেন্দ্র মোদী ও তার সরকার মরিয়া হয়ে এই আচরণ করছে। সর্বত্র এক নজরদারি মূলক রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু হয়েছে যা গণতন্ত্রের পক্ষে বিপজ্জনক।
দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা এখন বিপন্ন। কেন্দ্রীয় সরকার প্রতিনিয়ত ক্ষমতার কেন্দ্রিকরণের নেশায় মরিয়া হয়ে রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয়গুলিতেও নাক গলাচ্ছে। প্ল্যানিং কমিশন তুলে দিয়ে নীতি আয়োগ গঠনের মধ্য দিয়ে রাজ্যগুলির ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। শিক্ষা যুগ্ম তালিকাভুক্ত, অথচ রাজ্যগুলির সাথে কোনরকম আলোচনা ছাড়াই কেন্দ্রীয় সরকার নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি ঘোষণা করে তা কার্যকর করা শুরু করেছে। কৃষি রাজ্যের এক্তিয়ারভুক্ত বিষয় হওয়া সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সরকার একতরফা একের পর এক কৃষি আইন লাগু করার চেষ্টা করেছে। পরে অবশ্য নাছোড়বান্দা আন্দোলনের চাপে পড়ে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছে। একইভাবে শ্রম আইনের একের পর এক শ্রমিক বিরোধী সংস্কার হয়েছে একতরফা, রাজ্যগুলির কোন মতামত ছাড়াই, যা আদৌ সংবিধানসম্মত নয়।
বিজেপি হলো একটি হিন্দু আধিপত্যকা দল যা পরিচালিত হয় ফ্যাসির সংগঠন আরএসএসের দ্বারা। এরা হিন্দুত্বের প্রচারে ও হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে মরিয়া হয়ে উঠেছে। বিজেপির এই কাজ দেশের সংবিধানে উল্লিখিত বহুত্ববাদী ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়েছে। এদের লক্ষ্য হলো সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের স্তরে নামিয়ে আনা। তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নেওয়া। উত্তরপ্রদেশ সহ বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে তাই হচ্ছে এখন। আদতে এই হিন্দু রাষ্ট্রের ধারণা হলো একচেটিয়া পুঁজির নিয়ন্ত্রণাধীন একটি কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র ব্যবস্থা যেখানে কোন মানুষেরই অধিকার সুরক্ষিত থাকবে না। শুধু রাম মন্দির নয়, মথুরা চাই কাশি চাই– ইত্যাদি দাবি উঠছে সঙ্ঘ পরিবারের মিছিলে। অথচ, ভুখা পেটে খাবার চাই, সব গরিবের রেশন চাই, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম চাই, শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি ও বাঁচার নিরাপত্তা চাই, বেকার যুবকের কাজ চাই, কলকারখানা শিল্প চাই, সরকারি ব্যবস্থায় শিক্ষা চাই স্বাস্থ্য চাই– এই মৌলিক দাবি গুলোর কথা তারা বলে না, যা বলতে হয় আমাদের। যা নিয়ে লড়তে হয় আমাদেরই, হবেও আগামী দিনে। এই লড়াইকে জোরদার করবার জন্য সংবিধান রক্ষা করাই এই মুহূর্তে সবচাইতে জরুরী কাজ।
লেখকের এই একই বিষয়ের উপর অন্য একটি লেখা পাঠ করতে.. লিঙ্কে click করুন…