“চে” কি একটা চাবুকের নাম ?

১৮ জানুয়ারি ,২০২৩


সন্ধে নামছে আস্তে ধীরে যখন শহরে তখনই মোড়ের মাথায় দেওয়ালে সাঁটানো ছবিটার দিকে থমকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে এক যুবক। কাঁধে ভারী ব্যাগ। আপাতত বন্ধ থাকা বইকটাও সমান ধুঁকছে। কোথায় যেন দেখেছি। খুব চেনা কিন্তু নামটা যেন ঠিক কি! পেটে আসছে কিন্তু মুখে আসছে না! নীচে নাম-টাম-কিসব লেখা আছে বটে কিন্তু এত দূর থেকে স্পষ্ট পড়া যাচ্ছে না। পাশেই পান বিড়ির দোকান। প্রথমে জানতে চাওয়ার ইচ্ছে হলেও শেষে “আমিই জানি না, তো ও আর কি জানবে!” “মার্কা ভাবনা থেকে প্ল্যান বাতিল হলো।” এসব সাত পাঁচ ভাবনার মধ্যেই বাজখাঁই আওয়াজ এলো – সাথে কাঁধে থাবড়া – “কিরে! কখন থেকে দেখছি ঠায় দাঁড়িয়ে। কাজ খোয়ানোর ইচ্ছে হয়েছে নাকি।” শ্যামল দা। পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। নামী কোম্পানীর মেডিক্যাল সেলস রিপ্রেজেনটেটিভ, কিন্তু সেও আমার মতই সারাদিন বাইক নিয়ে ঘুড়ে বেড়ায়। বেশ কিছুটা অস্বস্তি নিয়েই বললাম, “না আসলে এই মাত্র খাবারটা দিয়ে আবার আনতে যাচ্ছি দোকানে, মাঝে সিগনালে দাঁড়ালাম, তা দেওয়ালের পোষ্টারে ছবিটার দেখে কেমন আটকে গেলাম। খুব চেনা যেন। তুমি নাম জানো ?” এক ঝলক পোষ্টারটা দেখে, আর এক ঝলক দীর্ঘশ্বাস ফেলে শ্যামল দা বললো – “তোর দোষ নয় ? সারা বিশ্বের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে এই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। এখনও। আগামীতেও যাবে নিশ্চিত। নামটাই ওরকম যে! চে গুয়েভারা। জীবনের প্রথম পেশা অনুযায়ী ডাক্তার ছিলেন।


এবার ছিলো চমকানোর পালা। হ্যাঁ ঠিকই তো, চে! এই নামটাই এতক্ষন মনে এলো না। “কিন্তু প্রথম পেশা মানে ডাক্তার হয়েছেন। তারপর আবার কি হবেন?” হয়েছেন তো! তোর প্রথম জীবনে ডাক্তারি শুরু করার পরে, উনি লাতিন আমেরিকার লড়াই করা, দাসত্ব করা মানুষের স্বার্থে লড়াই শুরু করেন বন্দুক হাতে।” চমকানোর শেষ এখনই ছিলো না, তা এটুকুতেই বেশ স্পষ্ট। একটু জলদি ব্যাপারটা পুরোটা জেনে নিতে তাগাদা মার্কা প্রশ্ন ছুঁড়লাম, তা, বেঁচে আছেন তো? এখানে আসছেন নাকি! শ্যামলদাও বেশ তাড়ার সাথেই বলে চললো – “বেঁচে আছেন, তবে লাখ লাখ হৃদয়ে আর বেঁচে আছে তার মতাদর্শে। তবে উনি আমাদের কলকাতায় আগেও এসেছিলেন! তখন কিউবার মন্ত্রী হিসাবে। ভারতের সাথে কিউবার আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক তৈরী করেন, এখন ২০ই জানুয়ারি কলকাতায় আসছেন ওনার মেয়ে আর নাতনি। ওটা তাদেরই পোষ্টার।” পরের কাস্টমারের তাগাদার ফোন আসা চালু হলেও একটা প্রশ্ন না করে থাকা গেল না – “আচ্ছা চে কি তাহলে কিউবার মন্ত্রী ছিলেন তারপর মারা যান? শ্যামল দা এবার চওড়া হেসে বলে, “না! চে কে খুন করে আমেরিকার সিআইএ। চে কিউবার মন্ত্রীত্ব ছেড়ে বলিভিয়ার শোষিত মানুষের স্বার্থে লড়াই লড়তে যান, সেখানেই ধরা পড়েন এবং তাঁকে খুন করা হয়। বাইকটা স্টার্ট দিতে গিয়েও বন্ধ হয়ে যায়। “আচ্ছা এরকম মানুষও হয়? ডাক্তার হয়ে ডাক্তারি ছাড়ে! মন্ত্রী হয়ে মন্ত্রীত্ব ছাড়ে? তার পর গুলি খেয়ে মরে!” আমাদের এখানে এখন কেউ মন্ত্রী হলে তার সাত পুরুষ বসে খাওয়ার মতো স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি বানান তারা। পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়ির ছাদেও সুইমিং পুলের ছবি দেখে গরীব মানুষ এখন। তা উনি কলকাতায় এসেছিলেন বললে – কি করেছিলেন? “বরানগর আইএসআই সহ নানান জায়গায় যান দেশের পরিকল্পনা সংক্রান্ত আলোচনা করেন। ওনার ময়ে আলেইদা তিনিও ডাক্তার। তিনি এখন এদেশেই আছেন। ২০ তারিখ সকালে কলকাতা আসার পর বরানগর আইএসআই হয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যারয়ে আসবেন আলোচনায় অংশ নেবেনে আর ২১ তারিখ সকালে উত্তরপাড়া হয়ে আসবেন এই কলেজস্ট্রীটে। গণসম্বর্ধনায় থাকবেন। মোটামুটি আলোচনা শেষ পর্যায়, এরপর শ্যামল দারও ডাক্তার ভিজিট আছে, হেলমেটটা পড়তে গিয়েও থামকে দিয়ে দিলো শেষ চমক – “চে কিন্তু কবিও ছিলেন। সবুজ একটা নোটবুকে তার নিজের লেখা কবিতা পাওয়া গেছে। আবৃত্তি করা অসংখ্য কবিতা পাওয়া গেছে তাঁর মেয়ের জন্য। আর পাওয়া গেছে ছেলেমেয়েদের জন্য লেখা শেষ চিঠি। যা নতুন করে বাঁচতে শেখায়। কিউবা থেকে মন্ত্রীত্ব ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নিজের প্রিয় বন্ধু ফিদেলকেও চিঠিতে বিশ্বাসের সাথে লিখতে পেরেছিলেন বিপ্লবের সবচেয়ে বড় সত্য হলো কেউ হয় জিতবে না হলে মৃত্যুবরণ করবে!”


শ্যামল দার কথা শুনতে শুনতে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো – “সত্যিই এভাবে কেউ ভাবতে পারেতো? আর কেউ ভাবতে পারবে কোনোদিন?” শ্যামল দা বাইকে স্টার্ট দিতে দিতে জবাব দিলো – “কেউ যে ভাবছে না তাই বা কে জানে? একটা লেখা পাঠিয়েছি ফোনে, খাবার রেডি হতে হতে পড়ে নিস আর ২১ তারিখ একবার ঢুঁ মেরে যাস দুপুরে কলেজস্ট্রীটে। শ্যামল দা না বললেও কাজের ফাঁকে একবার নিজের চোখে এরকম একটা মানুষের মেয়ে আর নাতনিকে দেখার – কি বলে শোনার সুযোগ ছাড়া যায়ই না। দোকানে খাবার রেডি হচ্ছে চুল্লিতে। সেই ফুরসতে শ্যামলদার পাঠানো লেখাটা পড়তে লাগলো যুবক –
“ যেখানেই যাই, অলিতে গলিতে
গ্রন্থ বিতানে, ক্যাফেটেরিয়ার ভিড়ে
কি যে তীব্র, অপ্রতিরোধ্য
জ্বলজ্বল করে আমার সত্ত¡া ঘিরে।

            চুরুট রঙের সন্ধ্যায় মনে
            ভেসে ওঠে শুধু দূর বলিভিয়া-বন।
            ভাবি উচাটন বিশ শতকেও
            ঈশ্বরহীন সন্ত শহীদ হন।

            সন্তের চোখ, শহীদের চোখ
            কে যেন দিয়েছে হৃদয়ে আমায় সেঁটে
            রক্তাপ্লুত একটা শরীর
            সকল সময় কি ঋজু যাচ্ছে হেঁটে।

            আমার প্রহর হাঁটু মুড়ে বসে
            অবাধ জাগর তাঁর জীবনীর পানো।
            কবিতায় ছুঁই দুটি হাত তাঁর,
            আত্মার ঘ্রাণ টেনে নিই নি:শ্বাসে।
            তিনি মৃত তবু জীবিতের চেয়ে
            অনেক সজীব এবং কান্তিমান।
            ভবিষ্যতের জন্য হেলায় 
            দিয়েছেন ছুড়ে আপন বর্তমান।’’

লেখাটা শেষ। কবি শামসুর রহমানের লেখা। সময় ও শেষ। খাবার রেডি। ছুটতে হবে অলি-গলি-সিগন্যাল পেরিয়ে – সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে – শুধু মনে থেকে যাবে চাবুকের মতো একটা নাম – “চে”।

ছবি – সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত…।।

Spread the word

Leave a Reply