২০১৮ সাল। পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচনের নামে কার্যত প্রহসন চলে। নির্বাচনের আগের দিন ১৩ই মে, নির্বাচনের আগের রাতেই কাকদ্বীপ- নামখানার বুধাখালির ২১৩ নং বুথে সিপিআই(এম) কর্মী দেবু দাস-ঊষা দাসকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। তাঁদের একমাত্র পুত্র সন্তান দীপঙ্কর দাস বাড়ির বাইরে থাকায় সেই রাতে প্রাণে বেঁচে যান।
শহীদ পরিবারের সন্তান দীপঙ্কর দাসের জীবন রক্ষা ও পড়াশোনার যাবতীয় দায়িত্ব নেয় সিপিআই(এম)। অসংখ্য মানুষের আর্থিক ও অন্যান্য সহযোগিতায় দীপঙ্কর আইনের স্নাতক হয়েছেন। এই লড়াই শুধু একজনের জীবনযুদ্ধ জয়ের কাহিনী না। তৃনমূলী নৈরাজ্যের এগারো বছরে বামপন্থী পরিবারের উপরে লাগাতার এমন আক্রমণ চলেছে… চলছে।
পার্টির রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে দীপঙ্কর দাসের সাথে যোগাযোগ করা হয়। মোবাইল ফোনে নেওয়া সেই সাক্ষাৎকারই লিখিত আকারে ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হল।
ঘটনার দিনটি আপনার কিভাবে মনে পড়ে?
তখন একটি ক্যাটারিং সংস্থায় কাজ করছি। বাড়ি ফিরতে বেশি রাত হয় ঐ কাজের জন্যই। সন্ধ্যার পরে আমার মা ফোন করে জিজ্ঞাসা করেন ফিরতে কত দেরি হবে। যেমনটা অন্য পরিবারে মায়েরা জানতে চান, সেভাবেই। কাজ শেষে সাইকেল চালিয়ে বাড়ির কাছাকাছি এলে দূর থেকে দেখতে পাই আমাদের বাড়ি দাউ দাউ করে জ্বলছে। প্রথমে কিছুটা হতচকিত হয়ে পড়ি, মনে হয়েছিল হয়ত মা-বাবা বাড়িতে আগুন লেগেছে বলে বাইরে রয়েছেন, অন্য কারোর বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছেন। জোরে সাইকেল চালিয়ে বাড়ির সামনে এলে বুঝি গোটা বাড়িটাই আগুনের গ্রাসে চলে গেছে, আশে পাশে বাবা- মা কাউকেই পেলাম না। খোলা দরজা দিয়ে কোনরকমে ঢুকে যাই ভিতরে, আগুন- ধোঁয়ার কারনে চোখে স্পট দেখতে না পেলেও নিজের বাড়ি বলেই কিছুদুর এগোতে পারি। বেরনোর সময় হোঁচট লাগে, পড়েই যাচ্ছিলাম- তখনই বুঝি পায়ে যেটা আটকেছে সেটা মানুষের শরীর। আমার বাবা- সারা শরীরটাই জ্বলে গেছে, একই ঘরে মায়ের দেহ। দুজনেই পুড়েছেন, মাথাটা একবার দুলে ওঠে। কোনরকমে বাইরে এসে পাড়ার লোকজনকে ডাকাডাকি করি। এক এক করে অনেকেই চলে আসেন। কানে আসছে সবাই বলছে- এখন তো আর কিছু হবে না, যা হওয়ার কাল সকালে দেখা যাবে। আমি মা-বাবার মৃতদেহের পাশে বসেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেব মনস্থির করি।
পুলিশের সাথে যোগাযোগ করা হয়নি?
এই ব্যাপারটা মনে রাখার মতো। প্রতিবেশীরা সকলেই পরামর্শ দিয়েছিলেন সকালের আগে কিছু হবে না, আমিও তেমনটাই ভেবেছিলাম। আগেই বললাম মা-বাবার মৃতদেহের পাশে বসেই বাকি রাতটুকু কাটিয়ে দেব মনস্থির করেছিলাম। হঠাতই পুলিশের দুই তিনটি গাড়ি চলে আসে, তারা কিভাবে খবর পেলেন আমি জানিনা। প্রতিবেশীরা কেউ খবর দিয়েছেন বলে মনে হয় না। পুলিশের সাথে কথা বলে বুঝতে পারি তারা আপাতত পোড়া বাড়ি থেকে মা-বাবা’র মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছেন। আমি তাদের স্পষ্ট জানাই এত রাতে আমি কিছুতেই তাদের মৃতদেহ সরিয়ে নিয়ে যেতে দেব না, পরেরদিন সকালে আমি কাকদ্বীপ থানায় এফআইআর করতে যাই। সেই রাতে আমার গ্রামের অনেকেই আমার পাশে ছিলেন।
থানার তরফে সহযোগিতা পেয়েছিলেন?
প্রথমেই আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয় এখন এফআইআর নেওয়া হবে না। বেশ কয়েকবার অনুরোধ করেও কিছুতেই তাদের রাজী করাতে পারিনি, বাড়ি ফিরে আসি। সিদ্ধান্ত নিই বাবা-মায়ের মৃতদেহের সাথে সেইদিনই কলকাতায় নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে পৌঁছব। সেই উদ্দেশ্যে রওনা হই, মাঝে কামারহাট বলে একটি জায়গায় পুলিশ আমাদের পথ আটকে জানায় কলকাতায় যাওয়া চলবে না। আমি তাদের বলি এখন যে আমাদের পথ আটকাচ্ছেন, ঘটনা ঘটে যাওয়ার সময় আপনারা কোথায় ছিলেন? মৃতদেহের সৎকার করা ছাড়া আপনাদের কি আর কোনও কর্তব্য নেই? শেষে পুলিশ কলকাতায় পুলিশ মর্গে মৃতদেহের ফরেন্সিক টেস্টের জন্য রাজী হয়, সকালে থানায় আমি যে অভিযোগ নথিভুক্ত করতে পারিনি তখন মাঝরাস্তায় তারা সেই অভিযোগ নিতে রাজী বলে আমাকে জানানো হল। ১৪ই মে কাকদ্বীপ মর্গেই মা-বাবার মৃতদেহ রাখা হল, কলকাতায় আনা হয় ১৬ই মে।
কলকাতায় আসার পরের অবস্থা কি?
মৃতদেহের ফরেন্সিক টেস্ট হয় কলকাতাতেই। আমাকে জানিয়ে দেওয়া হয় এবার আমি আমার মা-বাবার মৃতদেহের সৎকার করতে পারি। পরিবারের লোকজনের সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিই নিমতলা শ্মশানেই সৎকারের কাজ শেষ করব। এমন সময় হঠাতই আমাকে জানানো হল মৃতদেহ আমাদের হাতে দেওয়া হবে না, মর্গেই থাকবে। পরেরদিন আমি কলকাতা হাইকোর্টে যাই। এখানেই আমার সাথে বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, সৌরভ মণ্ডল এবং সব্যসাচী চ্যাটার্জির পরিচয় হয়। তারা আমার সব কথা শোনেন এবং জানান আমার সাথে যে অন্যায় হচ্ছে তার বিরুদ্ধে যেন আমি হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করি। আমি রাজী হই। পরেরদিনই মামলার শুনানি হয়, মাননীয় বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী অবিলম্বে (বিকাল পাঁচটার মধ্যে) পরিবারের হাতে মৃতদেহ তুলে দেওয়ার রায় দেন। পুলিশ মৃতদেহ দুটি ডায়মন্ড হারবার মর্গে পাঠিয়ে দেয়, আমাকে ফোনে জানানো হয় আপনি এখানে এসে আপনার বাবা-মায়ের মৃতদেহ সৎকারের জন্য নিয়ে যেতে পারেন। কেওড়াতলা শ্মশানে সৎকারের কাজ শেষ হয়।
এই পর্বে আপনার মানসিক অবস্থা ?
নিঃসন্দেহে বিধস্ত ছিলাম, কিন্তু ভেসে যাইনি। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল প্রশাসনের দায়িত্ব কি শুধুই নির্বাচন পরিচালনা করা? সেই নির্বাচন আসলে যাদের উদ্দেশ্যে সেই সাধারণ মানুষজনের নিরাপত্তা কি তাদের কর্তব্য নয়? নির্বাচনে কে জিতবে, কে হারবে এটাই কি আসল কথা? মা-বাবার এমন মৃত্যু আমাকে বিহ্বল করে তুলেছিল, কিন্তু আমি নিজেকে সোজা রাখার চেষ্টা করেছি।
আপনি যে অভিযোগ জানিয়েছিলেন সেই তদন্তের কি হল?
আমি নির্দিষ্ট কিছুজনের নাম উল্লেখ করেই এফআইআর দায়ের করেছিলাম। পুলিশ তদন্ত করে, আমি যাদের নাম উল্লেখ করি তাদের খালাস করে দিয়ে A, B, C বলে উল্লেখ করে কিছুজনের নামে চার্জশিট জমা করে। এই অবস্থায় বাধ্য হয়ে আমি কলকাতা হাইকোর্টে এই ঘটনার সিবিআই তদন্তের দাবী জানিয়ে আবেদন করি। মামলার স্ট্যাটাস জানতে চেয়ে বিচারপতি বলেন আপনারা তদন্ত করেছেন ভালো কথা কিন্তু অভিযোগকারীর বয়ানকে গুরুত্ব দেওয়া হল না কেন? নির্দিষ্ট যাদের নামে অভিযোগ ছিল তাদের বিষয়ে কি তদন্ত করে হয়েছে? কি পদক্ষেপ করা হয়েছে আমাকে জানান। পুলিশের পক্ষে এই প্রশ্নের কোনও সদুত্তর পাওয়া যায় নি – মামলা চলছে।
মা-বাবার মৃত্যুর পরে আপনি নিজের মত লড়াই শুরু করেন…
হ্যাঁ। সেই লড়াই এখনও চলছে। সুবিচার না পাওয়া অবধি আমি সেই লড়াইতে থাকব। এই ঘটনার তদন্ত, মামলা ইত্যাদির সাথে জড়িয়ে থাকার সুবাদে আমি উপলব্ধি করেছি শুধু যে বহু মানুষ আমাকে ভরসা দিয়েছেন, আমার পাশে থেকেছেন- এখনও রয়েছেন এমন না। আদালতে কত মানুষ, কত পরিবারের উপরে এমন অত্যাচার হয়েছে- তারা সকলে আমার মতোই ন্যায় বিচারের লড়াইতে রয়েছেন। এদের সকলের লড়াই আমাকেও সাহস যোগায়।
বাড়ি ফিরেছেন?
না, সেদিনের পর থেকেই আমার নির্দিষ্ট কোন ঠিকানা নেই। নিজের ছোটবেলা, যে ঘরে আমি জন্মেছি, বড় হয়েছি আজও সেখানে ফিরতে পারিনি। আর ফিরবই বা কিভাবে? বাড়িটাই তো আর নেই! শুধু ছাই হয়ে যাওয়া কিছু অবশেষ পড়ে রয়েছে। আমাদের কৃষক পরিবার, নিজেদের চাষের জমি কিছু ছিল, এছাড়াও অন্যের জমিতে আগাম খাজনার ভিত্তিতে চাষ করতেন। মা বাড়ির দায়িত্ব সামলাতেন। এখন হয়ত কাকা’রা সেই জমি চাষ করছেন। ছাপোষা পরিবারে এমন ঘটনা আমার থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। বাড়ি আমি ফিরবই। কিন্তু যে লড়াই আমি শুরু করেছি, এই লড়াই শেষ না হলে আমি ফিরতে পারব না।
আইনে স্নাতক হয়েছেন, এমন সিদ্ধান্ত কি নিজের জীবনযুদ্ধের কারনেই নিলেন?
নিজের জীবনের লড়াই করতে গিয়েই বুঝেছি ন্যায়বিচারের লড়াই আমার মতো আরও অনেকের। সেই লড়াইতে সুবিচার পাওয়া শুধু ন্যায্য তাই নয়, এ হল মানুষের অধিকার। বহু হিতার্থীর পরামর্শে, সহায়তায় সামনে এগোনোর সাহস পেয়েছি, তবু সেই লড়াইতে নিজেরও কিছু ভূমিকা থাকে। বলতে পারেন তেমনই একটা অনুভব আমার এমন সিদ্ধান্তের কারন।
* সাক্ষাৎকার চলাকালীন দীপঙ্কর দাস অনেক কথাই বলেছেন। সব কথা ছাপার অক্ষরে লেখা চলে না, অনুভব করতে হয়। আমাদের বিশ্বাস যারা এই লিখিত প্রতিবেদন পড়বেন তারা নিশ্চিত সেই অনুভব উপলব্ধি করবেন। আগামী লড়াইতে বিজয়ী হওয়ার জন্য ওয়েবডেস্ক দীপঙ্কর দাস’কে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়েছে- কারণ এই লড়াই শুধু তার একার নয়, ন্যায়ের পথে চলা সবারই।
সিপিআই(এম) রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষে সাক্ষাতকারের এপ্রান্তে – সৌভিক ঘোষ