অর্কপ্রভ সেনগুপ্ত
সাল ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ, তারিখ মার্চ মাসের ১৩ তারিখ, স্থান ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের হৃৎপিণ্ড লণ্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার হলের থেকে মাত্র ৫০০ মিটার দূরে ক্যাক্সটন হল। ঘড়ির কাঁটা তখন বিকেল সাড়ে চারটে ছুঁই ছুঁই। হন্তদন্ত হয়ে হলে ঢুকলেন ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশনের সভ্য মার্জরি উশার। বড়ো দেরি হয়ে গেছে তাঁর। বেলা তিনটে থেকেই হলে ইস্ট ইন্ডিয়া অ্যাসোসিয়েশন আর রয়্যাল সেন্ট্রাল এশিয়ান সোসাইটির যৌথ উদ্যোগে টিউডর রুমে শুরু হয়ে গেছে সেদিনের তারকা খচিত সভা। মূল বক্তা স্যার পার্সি সাইকস। এছাড়াও স্যার সাইকস-এর অনুরোধেই বক্তব্য রাখতেন এসেছেন তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু পাঞ্জাবের প্রাক্তন ডাকসাইটে গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ার। রয়েছেন আরেক প্রাক্তন পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার লুই ডেন, বোম্বের প্রাক্তন গভর্নর লর্ড ল্যামিংটন এবং স্বয়ং ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট মার্কি জেটল্যান্ড। বিষয় – ‘Afghanistan, the present position’। যাঁরা বলতে এসেছেন এবং যাঁরা শুনতে এসেছেন, রাজনৈতিকভাবে অধিকাংশই ভয়ানকভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সমর্থক এবং স্বাধীনতা দূরে থাক, উপনিবেশগুলির স্বশাসনেরও তাঁরা বিপক্ষে। ঠিক সেই কারণেই ঘরে ঢুকে মার্জরি একটু থমকে গেলেন। তিল ধারণের জায়গা নেই। প্রায় সব চেয়ার ভর্তি, পেছনের দিকেই বহু লোক দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুনছেন। কিন্তু তার মধ্যেও মার্জারির চোখ চলে গেল মঞ্চের খুব কাছে ঘরের ডানদিক ঘেঁসে দাঁড়িয়ে থাকা ভদ্রলোকের দিকে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে এ ভারতীয়। বেশ অবাক হলেন মার্জরি, কিন্তু আর ওদিকে মন না দিয়ে নিজের বসার জায়গা খুঁজতে লাগলেন। এদিকে মঞ্চে মাইকেল ও’ডায়ার প্রবল উৎসাহে বলে চলেছেন পাঞ্জাবে শাসক হিসেবে তাঁর অভিজ্ঞতার কথা, বলছেন পাঞ্জাবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরেই যে ‘রায়ট’ হয়েছিল, গুলি চালিয়ে, বোমা মেরে যে ‘রায়ট’ দমন করে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে বাঁচিয়েছিলেন, তা থেকে আফগানিস্তানের জন্য কি শিক্ষা গ্রহণ করা যায় তা নিয়েও। খুব মনোযোগ দিয়ে সেইসব কথা শুনছিল সেই ভারতীয়। ক্লড রিচি নামে এক অবসরপ্রাপ্ত সহকারী ব্যাংক ম্যানেজারও ঐ ভারতীয়কে লক্ষ্য করেছিলেন। কিভাবে এই মিটিং সে এত শান্তভাবে মনযোগ দিয়ে শুনছে, এ তাঁরও বোধগম্য হয়নি।
সভা শেষ হলো, লর্ড ল্যামিংটন ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন। মিটিং শেষে তখন মঞ্চের সামনেই বক্তারা একে অপরের সঙ্গে করমর্দন করছেন, ওদিকে শ্রোতারা একে একে বেরিয়ে যাচ্ছেন হল থেকে, অনেকে ছাতা আর ওভারকোট খুঁজছেন। এমন সময় মঞ্চের সামনে এগিয়ে গেল ওই ভারতীয়। মাইকেল ও’ডায়ার তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত দেখে প্রথমে ভাবলেন তাঁর সঙ্গে হয়তো করমর্দন করতে চাইছে যুবক। কিন্তু যুবকের হাতে ততক্ষণে উঠে এসেছে স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন মার্ক টু রিভলভার। করমর্দন করতে না, সে এসেছে স্যার মাইকেলের মৃত্যুর পরোয়ানা নিয়ে। পর পর দুবার গর্জে উঠল রিভলভার। যুবকের লক্ষ্য অব্যর্থ। বুলেট ভেদ করল স্যার মাইকেলের হৃৎপিণ্ড। লুটিয়ে পড়লেন তিনি। যুবকের রিভলভার ঘুরে গেল লর্ড জেটল্যান্ডের দিকে। আবার পরপর দুইবার কানফাটানো আওয়াজ। চেয়ারে নেতিয়ে বসে পড়লেন ভারতের সেক্রেটারি অফ স্টেট। বাকি দুখানা বুলেট যুবক বরাদ্দ করল লর্ড ল্যামিংটন এবং স্যার লুই ডেনের জন্য। দুজনের ক্ষেত্রেই গুলি লাগল হাতে। খালি বন্দুক নিয়ে হল থেকে বেরনোর সময়েই যুবককে পেড়ে ফেলল লোকজন। তবে ধরা পড়ার পর সে পালানোর চেষ্টাও করল না, বেশি নড়াচড়াও করল না। পুলিশ আসার পরেও তার মধ্যে বিশেষ চিত্তবিকার দেখা গেল না। নির্বিকার ভাবেই সে সিগারেট চাইল পুলিশের কাছে, নিজের কাছে থাকা ছুরি দেখাল, চারজনের মধ্যে শুধু স্যার মাইকেলই মৃত্যুবরণ করেছেন শুনে একটু ক্ষোভও প্রকাশ করল। কিন্তু নিজেকে রক্ষা করার কোনো চেষ্টা করল না। পুলিশ পরিচয় জানতে চাইলে যুবক নাম বলল – মহম্মদ সিং আজাদ, তার আই.ডি কার্ডেও ওই নামই লেখা ছিল। যখন পুলিশ তাকে নিয়ে ক্যাক্সটন হল থেকে বেরোচ্ছে, সিং আজাদের মুখে এক যুদ্ধ জয়ের হাসি। তার ২১ বছরের স্বপ্ন আজ পূর্ণ হয়েছে।
শের সিং-এর জন্ম ১৮৯৯ সালের ২৬-শে ডিসেম্বর পাঞ্জাবের পিলবাদের সুনামে। যখন তার তিন বছর বয়েস তখনই মা নারায়ণ কৌর মারা যান। বাবা তেহাল সিং কাজ করতেন ক্যানাল আর রেল লাইনে মজুর হিসেবে। হাড় ভাঙা খাটুনি খেটে উপার্জন করতেন সামান্য অর্থ। এই পরিশ্রম তাঁর সহ্য হত না। ১৯০৭ সালে দুই ভাইকে নিয়ে অমৃতসরে আসার পথে এক পুকুর পাড়ে বিশ্রাম নিতে তিনি সেই যে বসলেন, আর উঠলেন না। অমৃতসরের কেন্দ্রীয় খালসা অনাথ আশ্রমে স্থান হল শের আর তার দাদা সাধুর। শেরের নতুন নামকরণ হল অনাথ আশ্রমেই। নাম রাখা হল উধম, উধম সিং।
দিন কাটতে লাগল খালসার অনাথ আশ্রমে দুই ভাইয়ের। মিশুকে উধম অচিরেই বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠল। ‘উদে’-র বন্ধু সংখ্যা বাড়লেও তার সবথেকে কাছের বন্ধু ছিল কিন্তু তার ভাই, যাকে আদর করে সে ডাকত ‘সাধ’ বলে। পড়াশোনায় বিশেষ ঝোঁক ছিল না ‘উদে’-র। কিন্তু বুদ্ধি তার ভালোই ছিল। চটপট শিখে নিত সে নানা হাতেকলমে কাজ। বিশেষ করে কাঠের কাজ সে খুব মন দিয়ে শিখেছিল। এভাবেই দিন কাটছিল। হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাত। উদের বড়ো আদরের বড়দা ‘সাধ’ হঠাৎ করে অজানা অসুখে পড়ল, কিছুদিনের মধ্যেই সব শেষ। এই আঘাত উদের পক্ষে সামলে নেওয়া কঠিন ছিল। এদিকে অনাথ আশ্রম ছেড়ে যাওয়ার বয়সও তার ক্রমে হচ্ছে। ভাইয়ের মৃত্যু থেকে সৃষ্টি হওয়া অস্থিরতা এবং কিছু করতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা, এই দুইয়ের তাড়না থেকেই হয়তো উদে যোগ দিল ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। সেনাতেও উদে সহজে মানিয়ে নিতে পারল না। ঊর্ধ্বতন অফিসারদের সঙ্গে তার ঝামেলা লেগেই থাকত। ছয় মাসের মাথাতেই মেসোপটেমিয়া থেকে দেশে ফিরে আসতে হল তাকে। মন টিকল না। আবার সেনাতে নাম লেখাল সে। এইবার জিহ্বাকে নিয়ন্ত্রণ আর মস্তিষ্ককে শীতল রাখার কৌশল সে শিখে গেছে। সসম্মানে বাসরা ও বাগদাদে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর চাকরি করে ১৯১৯ সালে আবার দেশে ফিরে এল উদে। ততদিনে উদে আর উদে নেই, আর বালক নয় সে, পরিপূর্ণ যুবক, উধম সিং নামের যোগ্য।
উধম যখন দেশে ফিরলেন, পাঞ্জাব তখন অগ্নিগর্ভ। রাওলাট সত্যাগ্রহ চলছে দেশজুড়ে। দিল্লীতে গুলি চলেছে। ডঃ সত্যপাল আর সইফুদ্দিন কিচলু পাঞ্জাবে অহিংস আন্দোলনের নেতা। পুলিশ তাদেরও গ্রেপ্তার করেছে। পাঞ্জাবে আসতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছেন গান্ধীও। এই মধ্যে অমৃতসরে শান্তিপূর্ণ এক মিছিলে ব্রিটিশ বাহিনী গুলি চালাল। অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠল অমৃতসর। প্রশাসনের হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ বেরিয়ে গেল পুরোপুরি, রাস্তার দখল নিল জনতা, কিছুকালের জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল শহরের সঙ্গে বাইরের সমস্ত যোগাযোগ। মাইকেল ও’ডায়র সেনাবাহিনী ডাকলেন। অমৃতসরের রাস্তার দখল নিল ব্রিটিশ সেনা। সঙ্গে তাদের মেশিনগান সজ্জিত সাঁজোয়া গাড়ি। নেতৃত্বে দুঁদে সেনানায়ক ব্রিগেডিয়ার রেজিনাল্ড ডায়ার। ডায়ার শহরে রাতে কার্ফু জারি করলেন, তার লোকেরা ঢেঁড়া পিটে ঘোষণা করল কোনো জমায়েত বা মিটিং দেখলেই গুলি চালানো হবে। কিন্তু এই কাজ করা হয়েছিল শহরের অল্প কিছু স্থানে, অল্প সময়ের জন্য। শহরের অধিকাংশ জনতাই এই বিষয়ে কিছুই জানত না। বৈশাখী উপলক্ষে শহরে বাইরে থেকে অসংখ্য মানুষ এসেছিল, তারা তো এই বিষয়ে আরও অজ্ঞ ছিল। ১৩-ই এপ্রিল, ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে জালিয়নওয়ালাবাগে একটি মিটিং ডাকা হয়। মিটিং শুনতে কিছু লোক যেমন এসেছিল, তেমনই সেই সময় বহু লোক ছিল যারা বৈশাখীর জন্য শহরে এসে বাগে বিশ্রাম নিচ্ছিল, অনেকে বিকেলের হাওয়া খেতেও এসেছিলেন। মিটিং-এর খবর পেয়েই ডায়ার হানা দেন জালিয়নওয়ালাবাগে। এরপরেই অনুষ্ঠিত হয় কুখ্যাত সেই হত্যাকান্ড, যা এত বছর পরেও ভারতবাসী ভুলতে পারেনি। বিনা সতর্কতা প্রদান করে ডায়ার তাঁর গোর্খা সৈনিকদের গুলি চালানোর নির্দেশ দেন। দশ মিনিট ধরে নিরস্ত্র জনতার উপর ১৬৫০ রাউন্ড গুলি চালানো হয়। সরকারী হিসেবে নিহত হয়েছিল ৩৭৯ জন, ভারতীয় হিসেবে মৃতের সংখ্যা ছিল হাজারেরও বেশি। এখানেই বিষয় শেষ হলো না। গভর্নর ও’ডায়ার বিমানবাহিনীকে সক্রিয় করলেন। গ্রামে গ্রামে বোমা পড়ল। মেশিন গান চালানো হল আকাশ থেকে সাধারণ নাগরিকের উপর। পাঞ্জাব মাথা তুলে প্রতিবাদ করার সাহস করছে। ও’ডায়ার সেই সাহস জুতো দিয়ে পিষে দিতে ছিলেন বধ্যপরিকর।
জালিয়নওয়াবাগের ঐ ঘটনার সময় উধম ছিলেন কোথায় ? গদরের গুঞ্জন উঠেছে তখন পাঞ্জাবের গ্রামে গ্রামে। বিপ্লব তার সৈনিক চায়। উধম সাগ্রহে নাম লেখালেন সেই সেনাদলে। তাঁর কাজ হল বিপ্লবী গদর দলের পুস্তিকা অমৃতসর শহরে ও তার পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলে বিলি করা। এক সূত্র বলে তিনি ঐদিন মাজাহ-তে পুস্তিকা বিলি করছিলেন। অপর সূত্র থেকে জানা যায় ১৩-ই এপ্রিলের ঐ দিনে উধম জালিয়নওয়ালাবাগেই ছিলেন। তিনি তীর্থ যাত্রীদের জল দিচ্ছিলেন। ডায়ারের আদেশে গোর্খা সৈনিকরা গুলি চালানো শুরু করলে একটা গুলি তাঁর হাতে এসেও লাগে। কথিত আছে ঐদিনই রক্তভেজা জালিয়নওয়ালাবাগের এক খন্ড মাটি মুষ্টিবদ্ধ হাতে নিয়ে উধম শপথ নিয়েছিলেন এর প্রতিশোধ তিনি নেবেনই। এর মধ্যে কোন কাহিনীটি ঠিক, বলা মুশকিল। কিন্তু জালিয়নওয়ালাবাগের হত্যাকান্ড উধম সিং-কে যে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল, তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। এই বিষয়েও মোটামুটি নিশ্চিত ভাবে বলা যায় জালিয়নওয়ালাবাগের হত্যাকান্ডের অব্যহতি পরেই উধম শপথ নেন গভর্নর মাইকেল ও’ডায়ারকে হত্যা করে এই ঘটনার তিনি প্রতিশোধ নেবেন।
শপথ নেওয়া সোজা কিন্তু তা বাস্তবায়িত করা কঠিন। পাঞ্জাবের ঘটনার কিছুদিন পরেই জেনারেল মাইকেল ও’ডায়ার ও ব্রিগেডিয়ার রেজিনল্ড ডায়ার দুজনেই ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন, উধমের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এদিকে সেনাবাহিনীতে কাজ করে জমানো টাকাও ক্রমে শেষ হয়ে আসছে। প্রতিশোধের পরিকল্পনা ভবিষ্যতের জন্য রেখে তরুণ উধম ঝাঁপ দিলেন বর্তমানের জীবন সংগ্রামে। সে অতি কোঠর সংগ্রাম। লাহোর জংশনে টুকি টাকি কিছু কাজ জুটত, দিনের বেলা সেই কাজ করে উধম রাত কাটাতেন স্টেশনের বাইরে জলের ট্যাঙ্কের পাশে শুয়ে। যা আয় হত, তাতে রোজ খাবার জুটত না। স্থানীয় গুরুদ্বারার লঙ্গরই ছিল ভরসা। এইভাবে চালিয়ে যাওয়া বেশিদিন উধমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। উপয়ান্তর না দেখে তিনি নাম লেখালেন উগান্ডান রেলওয়ে কম্পানিতে। মাইনে খাতায় কলমে ২৪০ টাকা প্রতি মাসে। তিন বছরের চুক্তি। উধম পাড়ি দিলেন পূর্ব আফ্রিকায়।
এ কাজে কেউ সহজে আসতে চায় না। উগান্ডান রেলওয়েতে কুলির কাজ করতে গিয়ে হিংস্র শ্বাপদ আর নানাপ্রকার ভয়ানক রোগ কেড়ে নিয়েছে হাজার হাজার ভারতীয়র প্রাণ। পর্যাপ্ত বেতনের আশ্বাস দেওয়া হলেও কার্যক্ষেত্রে টাকা দেওয়া হত যৎসামান্য, আর ওই টাকা আটকে রাখা হত দিনের পর দিন। শ্বেতাঙ্গদের জাতিবিদ্বেষের কোনো সীমা পরিসীমা ছিল না। কিন্তু এই নরকের মধ্যেও উধম বন্ধু খুঁজে পেলেন। এই সময় পূর্ব আফ্রিকায় গদর দলের কার্যকলাপ পরিচালনা করছিলেন সীতারাম আচার্য। উধম তার সংস্পর্শে এলেন। গদরের হয়ে তাঁর কাজ করার অভিজ্ঞতা আগেই কিছু ছিল। পূর্ব আফ্রিকায় তিনি পার্টির আরও আস্থা অর্জন করলেন। নিজের কাজের দুই বছর বাকি থাকতেই দেশে ফিরলেন উধম। সঙ্গে নতুন পাসপোর্ট, আন্তর্জাতিক ভ্রমণের জন্য প্রয়োজনীয় নথিপত্র। এ ছাড়াও তার কাছে আরও একপ্রকার জিনিস ছিল বলে শোনা যায়, আগ্নেয়াস্ত্র। স্যার মাইকেল পাঞ্জাবে গদর পার্টিকে প্রায় ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন, কিন্তু ভারতের বাইরে বিপ্লবীরা আশা ছাড়েনি। উধমের প্রধান কাজ সম্ভবতঃ এই সময় ছিল দেশের মধ্যে আগ্নেয়াস্ত্র পাচার করা। যতদূর বোঝা যায়, সেই কাজই নিষ্ঠা সহকারে করছিলেন উধম। কিন্তু হঠাৎই একদিন ঠিক যেরকম ঝড়ের মতো দেশে ফিরেছিলেন, তেমনই ঝড়ের মতো দেশ থেকে উধাও হয়ে গেলেন তিনি। আসলে গদরের কাজ করলেও উধমের জীবনের আসল লক্ষ্যের নড়চড় হয়নি, জালিয়নওয়ালাবাগের প্রতিশোধ তখনও তাঁর ধ্যান জ্ঞান। প্রীতম সিং নামে পাতিয়ালার এক ছাত্রর সঙ্গী হিসেবে লন্ডনে যাওয়ার সুযোগ জুটে গেল উধমের। এই সুযোগ নিতে তিনি দ্বিধা করলেন না।
উধম ভেবেছিলেন লন্ডনে একবার পৌঁছলেই ও’ডায়ারকে তিনি হাতের মুঠোয় পেয়ে যাবেন। কোথায় কি ? বিশাল এই শহরে দিগভ্রান্ত হয়ে পড়লেন তিনি। তাঁর আশ্রয়স্থল হলো সিনক্লেয়ার রোডে শেফার্ড বুশ গ্রিনের ঠিক পেছনের গুরুদ্বারাটি। কিন্তু ওই থাকা খাওয়ার আশ্রয়টুকু ছাড়া উধম বুঝতে পারলেন তিনি যে কাজের দায়িত্ব নিয়েছেন তা পালন করার মতো ক্ষমতা এখনও তাঁর তৈরি হয়নি। না জানেন ভালো ইংরেজি, না এই শহরে তাঁর কোনো বন্ধু আছে, না জানেন অস্ত্রের ব্যবহার, না জানা আছে ছদ্মবেশের কৌশল – যদি কোনোক্রমে ও’ডায়ারের বাড়ির ঠিকানা খুঁজেও পান তিনি, তাঁকে কিভাবে হত্যা করবেন ? উধম মনস্থির করলেন, এইভাবে হবে না। তাঁর প্রশিক্ষণ চাই – দৈহিক ও মানসিক দুই ধরণের প্রশিক্ষণই। একমাত্র গদর পার্টি তাঁকে এই প্রশিক্ষণ দিতে পারে। ইংল্যান্ড না, আমেরিকা তাঁকে তাঁর লক্ষ্যের আরও আরেকধাপ কাছে নিয়ে যাবে।
উধম আমেরিকা যাত্রায় প্রথমে সেই পাতিয়ালার প্রীতম সিং-এর সঙ্গী হলেন। পাঞ্জাবের এই ছাত্রটির অসাধারণ জ্ঞানতৃষ্ণা তাকে টানছিল মার্কিন দেশে। তাকে সে দেশে নিয়ে আসার জন্য মিশিগানের অধ্যাপক হেনরি আর্ল রিগসের সংগ্রামের একটি পৃথক চিত্তাকর্ষক কাহিনী আছে। সেই কাহিনী লেখার পরিসর এখানে নেই। এইটুকু বললেই যথেষ্ট মেক্সিকো অবধি উধম প্রীতমের সঙ্গী হল। এরপর প্রীতমকে আইনি ভাবে মার্কিন দেশে ঢোকার জন্য সংগ্রাম করতে হল একটা লম্বা সময়, সে এখানে পড়ার জন্য আসতে চায়, বেআইনি ভাবে ঢুকলে বিশ্ববিদ্যালয় তাকে নেবে না। উধমের সেসব সমস্যা ছিল না। তিনি গদর দলের সহায়তায় সীমান্ত পার হয়ে প্রবেশ করলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। ক্যালিফর্নিয়া তখন গদর পার্টির কার্যকলাপের কেন্দ্র। দিল্লির আই.বি-এর ডাইরেক্টর ডেভিড পেট্রি একে ‘শিখ কমিন্টার্ন’-এর স্নায়ুকেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। উধম মার্কিন দেশে প্রবেশ করতেই এই ‘শিখ কমিন্টার্ন’ তাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানালো। উধমের প্রধান দায়িত্ব ছিল গোপন সভার জায়গায় সদস্যদের গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার। কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি পড়তে লাগলেন গদর পার্টির বিভিন্ন পুস্তিকা। হাডসন মোটরকারের কারখানায় একটা মেকানিকের চাকরিও জুটে গেল। কিছুদিন বাদে বিয়েও করলেন উধম লুপে নাম্নী এক হিস্প্যানিয়াক মহিলাকে। পার্টির কাজ এবং সংসার জীবনের চাহিদা মেটাতে নতুন জীবিকার সন্ধান উধমকে নিয়ে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একপ্রান্ত থেকে আরেকপ্রান্তে। লং বিচ, লিং বিচ থেকে ডেট্রয়েট, ডেট্রয়েট থেকে নিউ ইয়র্ক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একেবারে পশ্চিম উপকূল থেকে পূর্ব উপকূলে।
কিন্তু স্থির হয়ে সংসার করা উধমের পক্ষে সম্ভব হল না। বিপ্লবী রত্তন সিং-এর নির্দেশে তাঁকে পাড়ি দিতে হল ইউরোপে। তখনও উধম জানতেন না স্ত্রীর সঙ্গে এই তাঁর শেষ সাক্ষাৎ। ঘূর্ণিঝড়ের মতো সমস্ত ইউরোপের উপর দিয়ে বয়ে গেলেন উধম। তাঁর ঝটিকা সফর তালিকায় ছিল ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জার্মানি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, ইতালি। লিথুয়ানিয়ার ভিলনা হয়ে উধম পাড়ি দিলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন। এই চার মাস তিনি সোভিয়েতে এবং পূর্ব ইউরোপে কি করেছিলেন, কেউ জানে না। অনুমান করা যায় গদর পার্টির বিভিন্ন সেল এবং কমিন্টার্নের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, অর্থ, গোপন বার্তা ও অস্ত্র লেনদেনের কাজেই তাঁর এই সফর ছিল। ১৯২৬ সালের এই সফর শেষ করে, ফ্রাঙ্ক ব্রাজিল নাম ব্যবহার করে উধম মরক্কোর কাসাব্লাঙ্কা থেকে এক জাহাজে ছুতোরের কাজ নিলেন। এশিয়ার দীর্ঘ সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগর হয়ে এই জাহাজ নিউ ইয়র্কে যেত। উধমেরও উদ্দেশ্য ছিল এই জাহাজে কাজ নিয়েই দেশে ফেরার। কিন্তু কিছু গন্ডগোলের কারণে করাচিতে পুলিশের নজরে এসে গেলেন উধম। তখনকার মতো বিপদ এড়ালেও তিনি ধরা পড়তে রাজি ছিল না। তাই কলকাতাতেই জাহাজ থেকে নেমে আত্মগোপন করলেন নিউমার্কেট অঞ্চলে। সেখান থেকে পাঞ্জাবের পথ ধরলেন উধম। দেশের মাটি তাঁকে আবার ডাকছিল।
উধম আশা করেছিলেন বেশ কিছুদিন নিশ্চিন্তে পাঞ্জাবে কাটাতে পারবেন। তাঁর ভাগ্যে সুপ্রসন্ন ছিল না। নিজেরই কিছু ভুলের জন্য পুলিশের হাতে ধরা পড়লেন তিনি। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া গেল দুইখানা পিস্তল, একটা কোল্ট অটোম্যাটিক রিভলভার, ১৫০ খানা কার্তুজ। বন্দুকের থেকেও পুলিশের চোখে আরও সাংঘাতিক ছিল উধমের কাছ থেকে প্রাপ্ত বই এবং পুস্তিকাগুলি। গদর-দি-দুরি, গদর-দি-গুঞ্জ, গুলামি-দি-জেহের, দেশ-ভগত-দি-জান সবই নিষিদ্ধ পুস্তক, সবই ভয়ঙ্কর ভাবে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যর বিরোধী। ধরা পড়ে উধম পরিচয় গোপন করার চেষ্টাই করল না। ‘আমি আমেরিকা থেকে দেশকে ব্রিটেনের থেকে মুক্ত করতে এসেছি’, ‘রাশিয়ানরা ভারতকে মুক্ত করার আপ্রাণ চেষ্টা করছে’ – সোজাসাপ্টা উধমের সব স্বীকারোক্তি। পাঁচ বছরের সশ্রম কারাদন্ড হল উধমের। মুলতান জেলেই প্রথমে তিনি ছিলেন। কিন্তু অচিরেই কারা কর্তৃপক্ষ বুঝলেন এই বড়ো সহজ বন্দি নয়। কয়েদিদের মধ্যেই রাজনৈতিক প্রচার শুরু করলেন উধম। শোনাতে লাগলেন বিপ্লবের কথা, দেশমুক্তির কথা। যতই তাঁর উপর অত্যাচার করা হোক, এই প্রচার কিছুতেই থামানো গেল না। বিরক্ত জেল কর্তৃপক্ষ এই আপদকে পাঠিয়ে দিল মিয়াঁওয়ালি কারাগারে। এখানে মূলতঃ সবথেকে অনমনীয় রাজনৈতিক বন্দীদের পাঠানো হত। কিন্তু কারাগারেই উধমের নবজন্ম হল। তিনি সাক্ষাত পেলেন এমন এক সহবন্দির যে তাঁর জীবনের ভাবনাই দিল বদলে। এই কয়েদির বয়স উধমের থেকে অনেক কম, মাত্র ২২। কিন্তু যে অপরাধ সে করেছে তার জন্য মৃত্যুদণ্ড একপ্রকার নিশ্চিত। তা নিয়ে সে বিশেষ চিন্তিতও নয়। অত্যন্ত পড়ুয়া এই যুবক কয়েদিদের অধিকার নিয়ে সবসময় সোচ্চার থাকত। কিছুদিনের মধ্যে উধম বয়সে ছোটো হলেও এই যুবককে ‘গুরু’ বলে ডাকতে শুরু করলেন। গুরু যা বলেন, তাই মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যান উধম, শুষে নেন স্পঞ্জের মতো। উধমের এই ‘গুরু’ যেদিন ফাঁসির মঞ্চে শহীদ হলেন, সম্ভবতঃ সেইদিন থেকেই উধম ঈশ্বর বিশ্বাস ত্যাগ করলেন। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তার সঙ্গে প্রায় সবসময় ‘গুরু’-র একটা ছোটো ছবি থাকত। ‘আপনার ধর্ম কি ?’ এর পর থেকে কেউ এই প্রশ্ন করলেই উধম তাঁর পার্স খুলে দেখিয়ে দিতেন তাঁর ‘গুরু’-র ছবি – ‘আমি এখন একমাত্র এনাকে বিশ্বাস করি’। উধমের এই ‘গুরু’ ছিলেন শহীদ-ই-আজম ভগৎ সিং।
২৩-শে অক্টোবর, ১৯৩১ সালে উধম জেল থেকে ছাড়া পেলেন। তাঁর শরীর স্বাস্থ্য তখন একেবারেই ভেঙে পড়েছে কোঠর কারাবাসে। জেল কর্তৃপক্ষও সম্ভবতঃ মনে করেছিল উধম বেশিদিন বাঁচবেন না। কিন্তু নিজের গ্রামে বন্ধু ও আত্মীয়দের সেবা যত্নে তিনি ধীরে ধীরে আবার তাঁর আগের শারীরিক শক্তি ফিরে পেলেন। কিন্তু তাঁর মনের যে বিপুল পরিবর্তন ঘটে গেছে, তা সকলেই টের পেল। আগের উধম ছিল ফুর্তিবাজ, হাসিখুশি, আবেগি একটি মানুষ। এই উধম এখনও হাসি ঠাট্টা করতে ভুলে না গেলেও অনেক সংযত, অনেক যেন তীক্ষ্ণ। সে জাতপাত কিছু মানে না, হিন্দু মুসলমান মানে না, নিয়মিত মাংস খায় আর তার মধ্যেও ঝটকা-হালাল কিছুই বাছবিচার করে না। জেলে থাকতেই চুল কেটে ফেলা হয়েছিল উধমের। সেই চুল তিনি আর বাড়তে দিতেন না, ছেঁটে ফেলত।
সুস্থ হওয়ার পর দেশে বেশিদিন থাকলেন না উধম। একটা নতুন পাসপোর্টের বন্দোবস্ত করে আবার পাড়ি দিলেন ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে। ইতালি, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রিয়া, ফ্রান্স হয়ে উধম লন্ডনে এসে পৌঁছলেন ১৯৩৪ সালের শেষের দিকে। এই সময় সম্ভবতঃ তিনি সোভিয়েত দেশে আরেকবার পাড়ি দিয়েছিলেন। সবই গদর পার্টির কাজে। আগেরবার যখন লন্ডনে উধম এসেছিলেন প্রীতম সিং-এর সঙ্গে। তখন তাঁর কাছে ইংরেজি ভাষা জ্ঞান, অস্ত্র শিক্ষা, যোগাযোগ কিছুই ছিল না। এবার তাঁর কাছে সবই আছে। কিভাবে অগ্রসর হতে হবে সেই সম্পর্কে উধমের একটা স্পষ্ট ধারণা ছিল। তিনি নায়ার অ্যান্ড সন্স-এর একটি গুদাম, যেখানে থেকে কাপড় নিয়ে বিক্রি করতে যেতে জড় হত শিখ ফেরিওয়ালারা, সেখানেই তাঁর প্রধান ঘাঁটি বানালেন। অচিরেই এই ফেরিওয়ালাদের সঙ্গে উধমের গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠল। এঁদের মাধ্যম লন্ডন ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকার এমন খবর ছিল না যা উধমের নজরে আসত না। ১৯৩৬ সালে আবার দলের গোপনীয় কাজে ইউরোপ সফরে বের হলেন উধম। জার্মানি, পোল্যান্ড, লাটভিয়া হয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাঁর গন্তব্য। ব্রিটিশ ইন্টেলিজেন্সের নেক নজর পড়েছে ততদিনে তাঁর উপর। তাদের রিপোর্ট থেকেই জানা যায় উধম কাজ শেষ করে ডোভার বন্দরে ফেরেন সরাসরি লেনিনগ্রাদ থেকে। MI5-এর রিপোর্ট থেকে আরও জানা যায় লন্ডনে এই সময় উধমের নিত্যসঙ্গী ছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ রমণী। উধম বন্ধুদের কাছে এঁর পরিচয় দিতেন ‘সাধুনী’ বলে। কিন্তু এই ভদ্রমহিলার আসল নাম কি, ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তর জানত। ইনি ছিলেন আইলিন পামার, তৎকালীন সিপিজিবির অন্যতম প্রধান নেত্রী। সিপিজিবির জেনারেল সেক্রেটারি বেন ব্র্যাডলির ডানহাত, পার্টির ‘কলোনিয়াল ইনফর্মেশন ব্যুরো’-র মাথা। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একজন অনমনীয় শত্রু হিসেবে আইলিনের বিশেষ খ্যাতি ছিল। তিনি ভারতের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখেছিলেন এবং এই দেশের শৃঙ্খল মোচনের জন্য হেন কাজ নেই যা তিনি করতে রাজি ছিলেন না। এহেন পামারের সঙ্গে উধম সিং-এর অসম্ভব বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখে গোয়েন্দা দপ্তর স্থির করল উধমের উপর সর্বদা সাদা পোশাকের গোয়েন্দা কর্তৃক নজরদারি চালানোর। তাতে অবশ্য বিশেষ লাভ হলো না। উধম ততদিনে অনেক পরিপক্ক। সাদা পোশাকের গোয়েন্দাদের তিনি অনায়াসেই ধরে ফেলতেন। অনেক সময় নিজে আগ বাড়িয়ে গোয়েন্দাদের ভিড়ের মধ্যে ধরে ফেলে তাঁদের সঙ্গে খোশগল্পও করেছেন তিনি।
১৯৩০-এর দশকে আকবর আলি খান এবং চরণ সিং চিমা, এই দুই পাঞ্জাবি মিলে নির্মাণ করেন ইন্ডিয়ান ওয়ার্কাস অ্যাসোসিয়েশন বা IWA নামক একটি ট্রেড ইউনিয়ন। এই ট্রেড ইউনিয়ন ছিল গদর এবং কমিউনিস্ট কার্যকলাপের অন্যতম কেন্দ্র। স্বভাবতই এই ইউনিয়নের প্রতি উধমের স্বাভাবিক আকর্ষণ ছিল। এর কাজকর্মের সঙ্গে তিনি অচিরেই জড়িয়ে পড়লেন। ইলেক্ট্রিশিয়ানদের ইউনিয়নের একজন সক্রিয় সদস্য হিসেবে নিজের দায়িত্ব পালন করেছেন উধম, স্থানীয় ট্রেড কাউন্সিলের ডেলিগেটও নির্বাচিত হয়েছেন। বন্ধুত্ব তৈরি হয়েছে সুরাত আলির মতো সিপিজিবি নেতার সঙ্গে যাঁরা IWA-তে সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু এত কিছুর মধ্যেও উধম যে শপথ তিনি নিয়েছিলেন বহু বছর আগে জালিয়নওয়ালাবাগে, তা একবারের জন্যও বিস্মৃত হন নি।
ঠিক যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে, তখনই উধমের এতদিনের প্রচেষ্টার কিছু ফল মিলল। ব্রিটিশ পোস্টাল সার্ভিসে কাজ করা তার বন্ধু মূলচাঁদ কর্তৃক স্যার মাইকেল ও’ডায়ারের ঠিকানা পেলেন তিনি। ব্ল্যান্ডফোর্ড মিলিশিয়া ক্যাম্পে কাজ নিলেন উধম, সিং আজাদ ছদ্মনামে। জায়গাটি ও’ডায়ারের সাউথ ডেভনের বাড়ির অতি নিকটে। কিন্তু হাবভাব সন্দেহজনক মনে হওয়ায় স্থানীয় পুলিশ তার পেছনে লাগল। উধম বাধ্য হলেন আবার স্থান পরিবর্তন করতে। কিন্তু ততদিনে কিভাবে ও’ডায়ারকে হত্যা করবেন, তার একটা ছক তিনি বানিয়ে নিয়েছেন। উধম গুপ্তহত্যার তারিখ ঠিক করলেন ১৩-ই জুন, ১৯৪০। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন হল, তার আগেই তিনি জানতে পারলেন ১৩-ই মার্চ ক্যাক্সটন হলে একটা বক্তৃতা সভায় ও’ডায়ার উপস্থিত থাকবেন। এই সুবর্ণ সুযোগ। যথা সম্ভব প্রস্তুতি নিলেন উধম। মুক্ত মানুষ হিসেবে উধমের শেষ সাক্ষাৎ ছিল পূর্বোক্ত কমিউনিস্ট নেতা সুরাত আলির সঙ্গে। পুলিশের অনেকে ধারণা করেন সুরাত আলিই স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন মার্ক টু পিস্তলটি জোগাড় করে দেন উধমের জন্য, যদিও এর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নি। এরপর ১৩-ই মার্চ কিভাবে উধম সিং-এর পিস্তল একুশ বছর আগের পাঞ্জাবের রাইফেলের অগ্ন্যুদগার ও বিমান থেকে বর্ষিত বোমের বিস্ফোরণের প্রত্যুত্তর দেয়, তার বিবরণ এই প্রবন্ধের শুরুতেই বর্ণিত হয়েছে।
পুরো মামলা চলাকালীন উধম নিজেকে উধম সিং বলে চিহ্নিতই করতে চাননি। পরিচয় বারবার দিয়েছেন রাম মহম্মদ সিং আজাদ, মহম্মদ সিং আজাদ বা শুধুই সিং আজাদ। তিনি কাঠগোড়ায় উঠেছিলেন সকল ভারতীয়র হয়ে এবং তাঁর নামে সেটা ধরা পড়ুক তা তিনি চেয়েছিলেন। আটক হওয়ার পর মৃত্যু নিশ্চিত জেনে উধম জেলে বন্দি থাকা অবস্থাতেই আত্মহত্যা করতে সচেষ্ট হন। যদিও তাঁর সেই চেষ্টা সফল হয়নি। উধমের বন্ধুরা আদালতে তার ডিফেন্সের বন্দোবস্ত করতে চাঁদা তুলে হাজির হন সুরাত আলির কাছে। আলি তাঁর সাধ্যমত বন্দোবস্তের চেষ্টা করেন। অর্থাভাব থাকলেও চেষ্টায় তাঁর কোনো ত্রুটি ছিল না। কিন্তু ইতিমধ্যে ভি. কে. মেনন, ভারতের ভবিষ্যৎ প্রতিরক্ষামন্ত্রী, যিনি এই ঘটনার পর উধমকে তীক্ষ্ণ ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন, তিনিই আবার জনমত বুঝে সচ্চা রাজনীতিবিদের মতো উধমের ডিফেন্সের দায়িত্ব নিজে থেকেই নিয়ে নেন এবং সুরাত আলিকে কার্যত এই মামলা থেকে সরে আসতে বাধ্য করেন। বলাই বাহুল্য, এই ডিফেন্স করা যা, না করাও তাই ছিল। মেনন নিজেও নিজের প্রচার ছাড়া আর কিছুতে আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয় না। উধম নিজেও এই নিয়ে নির্বিকার ছিলেন। তিনি তো মৃত্যুদন্ডই চেয়েছিলেন, তাঁর একমাত্র ইচ্ছে ছিল এই বিষয়ে ‘গুরু’-র শহীদ দিবস, ২৩-শে মার্চে তাঁরও ফাঁসি হলে ভালো হয়। সেইদিন পেরিয়ে গেলে কবে ফাঁসি হল তা নিয়েও উধম নির্বিকার ছিলেন। এই ধরণের মামলাকে সব বিপ্লবীই রাজনৈতিক ভাষণের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করেন। উধমও তাই করবেন, এমন আশঙ্কা ব্রিটিশ গোয়েন্দা দপ্তরের ছিল। তাই আগে থাকতেই রয়টার্স সহ উপস্থিত সকল সংবাদমাধ্যমকে বলা ছিল তারা যেন উধমের একটি কথাও কাগজে না ছাপেন। গোয়েন্দা বিভাগ চেয়েছিল বিপ্লবী বা বৃহত্তর কোনো সংগঠনের সদস্য হিসেবে উধম যাতে চিহ্নিত না হন, অথবা জালিয়নওয়ালাবাগের সঙ্গে এই ঘটনার কোনো যোগ যাতে না তৈরি হয়। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আদর্শবাদী বিপ্লবী না, তারা উধমকে জনতার সামনে এক মানসিক ভারসাম্যহীন পাগলা বন্দুকবাজ হিসেবেই তুলে ধরতে চেয়েছিল। তাই গোয়েন্দা দপ্তরের আশঙ্কা সত্যি প্রমাণ করে উধম তাঁর শেষ বক্তব্যে জ্বালাময়ী ভাষায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমণ করলেও তার একটি অক্ষরও সেদিন প্রকাশিত হয় নি। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের ৩১-শে জুলাই উধম ফাঁসির মঞ্চে উঠলেন যখন, তখন হাতে গোনা লোক ছাড়া কেউ জানলই না তিনি কোনো এক আবেগী বা মানসিক ভারসাম্যহীন বন্দুকবাজ ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন পোড়খাওয়া প্রশিক্ষিত বিপ্লবী। অর্ধশতকেরও অধিক সময় পার আজ আমরা জানি উধমের শেষ বক্তব্য কি ছিল। এখানে উদ্ধৃত করা যেতে পারে –
“I am not afraid to die. I am proud to die. I want to help my native land, and I hope when I have gone that in my place will come others of my countrymen to drive the dirty dogs – when I am free of the country. I am standing before an English jury in an English court. You people go to India and when you come back you are given prizes and put into the House of Commons, but when we come to England we are put to death. In any case I do not care anything about it, but when you dirty dogs come to India – the Intellectuals they call themselves, the rulers – they are of bastard blood caste, and they order machine guns to fire on the Indian students without hesitation. I have nothing against the public at all. I have more English friends in England than I have in India. I have nothing against the public. I have great sympathy with the workers of England, but I am against the dirty British Government. Your people are suffering the same as I am suffering through those dirty dogs and mad beasts – killing, mutilating and destroying. We know what is going on in India hundreds of thousands of people being killed by your dirty dogs.”
তাঁকে যখন এই ভাষণের মধ্যে দিয়েই টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আবার কারাগারের উদ্দেশ্যে উধম সর্বশক্তি দিয়ে খালি বলে চলেছিলেন – ‘Inquilab! Inquilab! Inquilab!’, ‘বিপ্লব ! বিপ্লব ! বিপ্লব’।
উধম সিংকে শুধু ও’ডায়ারের হত্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে ফেলা তাঁর মতো বিপ্লবীর অপমান করা। তিনি শুধু ও’ডায়ারের গুপ্তঘাতক ছিলেন না, তিনি ছিলেন গদর পার্টির এক সক্রিয় সদস্য যিনি প্রায় দুই দশক ধরে স্বদেশকে বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্ত করার প্রচেষ্টায় নানা ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তার জন্য কারাবরণ থেকে অকথ্য অত্যাচার সবই সহ্য করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন প্রথম শ্রেণীর মানুষ যিনি ধর্ম ও জাতির ঊর্ধ্বে নিজের চেতনাকে নিয়ে যেতে পেরেছিলেন। আদালতে তাঁর শেষ ভাষণে তিনি উল্লেখ করেন তাঁর লড়াই ব্রিটিশ জনতার বিরুদ্ধে না, ব্রিটিশ শ্রমিকদের প্রতি তাঁর পূর্ণ সহানুভূতি আছে, তাঁর লড়াই ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে। এই চেতনা কি গভীর আন্তর্জাতিকতাবোধ থেকে আসে, তা বলাই বাহুল্য। ও’ডায়ারকে হত্যা করার শপথ যে একুশ বছর আগে তিনি যে নিয়েছিলেন তা প্রাথমিক ভাবে জ্বলন্ত ক্রোধের ফসল হলেও সময় সেই প্রতিহিংসার লোহাকে সময়, অভিজ্ঞতা ও বিপ্লবী শিক্ষা পিটিয়ে ইস্পাতে পরিণত করেছিল। যখন শপথ নেওয়ার দুই দশক পর ক্যাক্সটন হলে উধম ও’ডায়ারকে লক্ষ্য করে ট্রিগার টানলেন তখন তা নিছক প্রতিহিংসা ছিল না। এই মিটিং-এ জেটল্যান্ড, ও’ডায়ারদের লক্ষ্য করে ধাবিত বুলেট শুধু জালিয়নওয়ালাবাগের প্রতিশোধ ছিল না, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের মাত্র পাঁচশো মিটার দূরে উধম সিং-এর স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেনের কানফাটানো আওয়াজ ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বধিরকে শোনানোর জন্য এক প্রতিবাদের বজ্রনির্ঘোষও। তাই আজ ৩১-শে জুলাই, এই মহান বিপ্লবীর শহীদ দিবসে তাঁকে স্মরণ করি শুধু মাইকেল ও’ডায়ারের গুপ্তঘাতক হিসেবে নয়, একজন প্রথম শ্রেণীর বিপ্লবী ও ভারতের শ্রমজীবী জনতার মধ্যে থেকে উঠে আসা সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যোদ্ধা হিসেবেও।