Mandella 2

Mandela: A Memoir (Part II)

সমন্বয় রাহা

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক স্টিফেন এলিস তাঁর রিসার্চ পেপারে লিখেছেন নেলসন ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন। এবং দক্ষিণ আফ্রিকা কমিউনিস্ট পার্টি নেলসনের মৃত্যুর পর ঘোষণা করেছে নেলসন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। এবং আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টি একসাথে রাষ্ট্রের শোষণের বিরূদ্ধে লড়েছিল।

এই প্রশ্নে ইতিহাসকে আরেকটু গভীরে গিয়ে দেখা উচিত আমাদের। ১৯৬০,ডিসেম্বরের এক রাত।জোহানেসবার্গের শহরতলি ইমারেনতিয়া। দক্ষিণ আফ্রিকার কমিউনিস্ট পার্টি (এসএসিপি) তখন বেআইনি। আন্ডারগ্রাউন্ড। কিন্তু পার্টি কংগ্রেস সংগঠিত হচ্ছে ওই শহরতলি এলাকার একটা ভাড়া বাড়িতে। সব মিলিয়ে জনা পঁচিশ জন কমরেড উপস্থিত। কমিউনিস্ট পার্টির সাথেই উপস্থিত আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের (ANC) কয়েকজন সদস্য। তাঁদের অন্যতম ম্যান্ডেলা, সিসুলু, কোতানে।সঙ্গী জো স্লোভো,তুরোক,রাস্টি বার্নস্টাইনরা।

সেসময়ে গোটা দেশ জুড়েই চলছে নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ দের উপর ভয়ঙ্কর রক্তক্ষয়ী আক্রমণ। পার্টি কংগ্রেসে আলোচনা চলছে গোটা দেশজুড়ে জারি হওয়া জরুরি অবস্থার আলোকে পার্টির রণনীতি এবং রণকৌশলের মূল্যায়ন। আগামীর পথ।

দেশের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আভাসও মিলছে। রূদ্ধদ্বার বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সবাই একমত এএনসি-কে নিষিদ্ধ করা এবং জরুরি অবস্থা জারি করে আসলে আইনি পথ থেকে বেআইনি পথে দেশকে নিয়ে চলার কৌশল। এই উপলব্ধির মধ্যেই পার্টি কংগ্রেসে আলোচনা শুরু হল নতুন সামরিক ইউনিট খোলার জন্য। অহিংস পথ ছেড়ে এবার নিতে হবে সশস্ত্র প্রতিরোধের লাইন।শেষে ঠিক হয় এই নতুন ইউনিট হবে চরম গোপনীয়।এবং আফ্রিকান ন্যাশানাল কংগ্রেস এবং কমিউনিস্ট পার্টির কয়েকজন সদস্যের নিয়ন্ত্রণাধীন। সম্পুর্ণ আলাদা এবং স্বাধীন।

শেষে নির্বাচিত হয় নতুন কমিটি। নতুন কমিটি তে যুক্ত হন ম্যান্ডেলা। ১৯৬১ সালেও ন্যাশানাল পার্টির সরকারের কাছে সংসদের বাইরে থাকা বিরোধীদের যুক্ত করে জাতীয় কনভেনশন করার দাবি জানান ম্যান্ডেলা। সম্ভবত সশস্ত্র সংগ্রামের পথ নেওয়ার আগে এটি ছিল তাঁর শেষ প্রচেষ্টা। সরকার স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব দেয়নি।

আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকা অবস্থায় ম্যান্ডেলা একবার গোপন ঘাঁটি থেকে সাক্ষাৎকার দেন ব্রিটিশ সাংবাদিক ব্রায়ান উইডলেক কে। যার টিভি সম্প্রচার  হয়।সেখানে ম্যান্ডেলা পরিষ্কার বলেন, ‘সরকার যদি মনে করে আমাদের অহিংস আন্দোলনকে গুঁড়িয়ে দেবে ভয়ঙ্কর আক্রমণ করে, তাহলে আমাদেরকেও ভাবতে হবে। আমার মনে হচ্ছে, অহিংস নীতির প্রশ্নে এই অধ্যায়টি আমরা শেষ করতে চলেছি।’

কমিউনিস্ট পার্টিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ছয় মাস পরে ম্যান্ডেলা এএনসি-র মিটিংয়ে সামরিক শাখা গঠনের প্রস্তাব দেন। মিটিংয়ে সামান্য বিতর্ক হলেও শেষে সবাই মনে নেন ম্যান্ডেলার প্রস্তাব।

পরবর্তীকালে ঘানার আর্কাইভ থেকে উদ্ধার হয় একটি তথ্য। যেখানে দেখা যাচ্ছে ১৯৬২-তে ম্যান্ডেলা তাঁর বাকি দুই যোদ্ধার সাথে লিখছেন, ‘এমকে হল পরিকল্পিত আক্রমণ হানার জন্য এএনসি-র তৈরি করা একটি শাখা।’

নতুন সংগঠনের কর্মী নিয়োগের জন্য মূল দায়িত্বে ছিলেন ম্যান্ডেলা স্বয়ং। প্রশিক্ষণের জন্য কর্মীদের পাঠানো হয় মস্কো এবং বেজিঙে। বেজিঙে তাঁদের সাথে সাক্ষাৎ হয় কমরেড মাওয়ের। মাও অন্ধভাবে চীনের সংগ্রামের পথ অনুসরণ করতে নিষেধ করেন। তিনি বলেন আলজিরিয়ায় ফরাসী উপনিবেশের বিরুদ্ধে এফএলএন-র লড়াই অনেক প্রাসঙ্গিক।

ম্যান্ডেলা সহ বাকি নেতৃত্ব দের প্রাথমিক পরিকল্পনা ছিল অন্তর্ঘাত হবে প্রতীকি। লক্ষ্য হবে মূলত অর্থনৈতিক দপ্তরগুলো। এমকে-র কর্ণধারের কাছে মূল প্রেরণা ছিল কিউবার বিপ্লব।

১১ই জানুয়ারি,১৯৬২। ডেভিড মোৎসাই ছদ্মনামে ম্যান্ডেলা দক্ষিণ আফ্রিকার সীমান্ত পেরোন।আন্তর্জাতিক সমর্থনের জন্য তিনি ব্রিটেন সহ আফ্রিকার বেশ কিছু দেশ ঘোরেন। তাঁর অভিজ্ঞতা হয় যে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সবাই এএনসি এবং এসএসিপি-র জোট ভালোভাবে নিচ্ছে না। ফিরে এসে তিনি কমিউনিস্ট প্রশ্নে খানিক নিশ্চুপই ছিলেন বটে।

অনেকেই ম্যান্ডেলাকে ‘আফ্রিকার গান্ধী’ বলে দেখানোর চেষ্টা করেন। এড়িয়ে যেতে চান ম্যান্ডেলার সশস্ত্র সংগ্রামী জীবনকে। গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের সাথে তাঁর নৈকট্য ছিল ঠিক। আবার ছিল দূরত্বও। এই দূরত্বই তাঁকে প্রায় কমিউনিস্ট করে তুলেছিল। পরে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের রিভোনিয়া মামলায় সুপ্রিম কোর্টে তিনি অকপটে বলেন, ‘উমখোমতা গঠনে আমিও বাকিদের সাথে উদ্যোগী হয়েছিলাম। প্রথমত আমরা বিশ্বাস করতাম সরকারের নীতির জন্যই জনগণের হিংসার আশ্রয় নেওয়া অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়েছে। এবং দ্বিতীয়ত আমরা বুঝতে পেরেছিলাম শ্বেতাঙ্গ প্রভুদের অত্যাচারের উলটো দিকে আফ্রিকার মানুষ দের হিংসার পথ গ্রহণ করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই। তখনই আমরা ঠিক করলাম হিংসার জবাব আমরা দেবো হিংসার ভাষাতেই।’

ম্যান্ডেলা এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতা জো স্লোভো মিলে লিখলেন “অপারেশন মেইবুয়ে”, যা ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের দলিল।অর্থাৎ “আফ্রিকা কামব্যাক”, ঘুরে দাঁড়াও আফ্রিকা।

যে সময়ে উনি এই স্লোগান ঠিক করছেন ঠিক সময়েই দুনিয়া জুড়ে মুক্তির যুদ্ধ। দিয়েন বিয়েন ফু থেকে আলজিরিয়ার লড়াই। সদ্য সফল হয়েছে চে,ফিদেলের নেতৃত্বে কিউবার বিপ্লব। সিয়েরা মায়েস্ত্রা থেকে আফ্রিকায় নজর রাখছিলেন কিউবার বিপ্লবীরা।চে স্বয়ং ছিলেন আফ্রিকার মাটিতে, আলজিরিয়ায়।সেসময়ে উমখোনতোর নেতৃত্ব গোপমে আলজিরিয়ায় গিয়ে সাক্ষাৎ করেন চে-র সাথে।পরবর্তী কালে যখন ম্যান্ডেলা কিউবা গেলেন স্বয়ং কিউবার সফল বিপ্লবের নেতৃত্বরা প্রয়োজনীয় ও জরুরি ব্যাপারে সাহায্য করতে চান। এই ছিল কিউবা সম্পর্কে ম্যান্ডেলার প্রাথমিক অভিজ্ঞতা।

ঠিক এই কারণেই ওয়াশিংটনের “সন্ত্রাসবাদী” তালিকায় থেকে গেছিলেন ম্যান্ডেলা। CIA ম্যান্ডেলার গতিবিধির উপরে নজর রেখেছিল সমানে।নোবেল শান্তি পুরষ্কার পাওয়ার ২৫বছর পরেও,মৃত্যুর ৫বছর আগে পর্যন্ত ছিলেন আমেরিকার চোখে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদী।

যখন সিআইএ-র চক্রান্তে এবং বিশ্বাসঘাতকার শিকার হয়ে তিনি ধরা পড়েছেন। যখন রাজদ্রোহে অভিযুক্ত ম্যান্ডেলার রিভোনিয়া ট্রায়াল চলছে, সেই মুহূর্তে তিনি যেন বিপ্লবী।

মৃত্যুর আদেশের মুখে দাঁড়িয়ে তাঁর দৃপ্ত জবাব, ‘আমি শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছি। সংগ্রাম করেছি কৃষ্ণাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধেও।আমি সযত্নে লালন করেছি গণতান্ত্রিক ও মুক্ত সমাজের ধারণা কে।এই আদর্শের জন্য যদি প্রয়োজন হয় আমি জীবন দিতেও প্রস্তুত।’

তাঁকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তাঁর ঘর থেকে বাজেয়াপ্ত করা হয় মরিস কনফোর্থের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিয়ে তাঁর লেখা নোট। প্রাভদায় প্রকাশিত বেশ কিছু পুস্তিকা। স্তালিনের লেখা বেশ কিছু নোট। সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির বেশ কিছু বই।

১৯৯০ এ জেল থেকে বেরিয়ে জীবনের শেষ দিন অবধি কমরেড মাদিবা ছিলেন কমিউনিস্টদের এক মহান এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বলছে এসএসিপি।

তাই তো উদাত্ত কন্ঠে তিনি বলতে পারেন ‘কিউবার মানুষদের আত্মত্যাগ কে আমি শ্রদ্ধা করি।দীর্ঘজীবী হোক কিউবার বিপ্লব।দীর্ঘজীবী হোন কমরেড কাস্ত্রো।’ ইয়াসের আরাফত ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু।বারংবার আমেরিকা ব্রিটেন নিয়ন্ত্রিত ইজরায়েলি আক্রমণের প্রবল সমালোচনা করেছেন তিনি।

২০১৩ সালে একটা সিনেমা দেখেছিল বিশ্ব। দেখেছিল এক রাতের মধ্যে কিভাবে নিউইয়র্কে থাকা একজন আফ্রিকান আমেরিকান কে বন্দী করে নেওয়া হয়। দেখেছিল কিভাবে চামড়ার রঙ শোষণের উপাদান যোগায়। অস্কার পেয়েছিল “12 YEARS A SLAVE” সিনেমাটি। গুগলে সার্চ করলে কালো চামড়ার মানুষের অধিকারের লড়াই নিয়ে প্রায় ৫০ এর বেশি নানা ভাষার সিনেমা পাওয়া যাবে। নেলসন ম্যাণ্ডেলার লড়াই। তার দেশের মানুষ, বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নিপীড়িত মানুষকে শোষিত মানুষকে নিজেদের অধিকারের জন্য লড়তে শিখিয়েছে, সমানাধিকার সাম্য প্রতিষ্ঠার লড়াই,ফ্যাসিবাদী সাম্রাজ্যবাদী পুঁজিবাদী আগ্রাসনের বিরূদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর স্পর্ধা জুগিয়েছে।

মাদিবা অর্থাৎ সারাজীবন অনবদ্য এক লড়াইয়ের নক্ষত্রের জন্মদিনে রিভোনিয়ার মামলার উক্তিই মনে থাকুক আমাদের, ‘আজ আমি শ্রেণিহীন সমাজের প্রতি আকৃষ্ট। এবং এই আকর্ষণ জন্মেছে কিছুটা মার্কসবাদ পড়ে। আর কিছুটা এসেছে এদেশের প্রাচীন আফ্রিকান সমাজের কাঠামো ও সংগঠন প্রণালীর প্রতি শ্রদ্ধার ভাব থেকে। সেসময়ে উৎপাদনের প্রধান উৎস ছিল ভূমি। এবং ভূমি ছিল উপজাতির যৌথ সম্পত্তি। একথা সত্য যে আমি মার্কসবাদী ভাবধারার দ্বারা প্রভাবিত।’

Long Live মাদিবা…

তথ্যসূত্রঃ

১। কমিউনিস্ট মাদিবা: শান্তনু দে

২। You Tube link : Powerful Nelson Mandela Interview at Town Hall,USA that amazed the whole world (june 21st,1990)

৩। Online Link :  https://www.nytimes.com/2013/12/08/opinion/sunday/keller-nelson-mandela-communist.html

Spread the word

Leave a Reply