“তারপর সিধু কানু চাঁদ ভৈরব –
এই সমস্ত আদিবাসী বীর
খেরোয়াল জাতিকে আন্দোলিত করে
যুদ্ধের পতাকা উড়িয়ে দিল।
১৮৫৫ সালের ৩০জুন
তারা দেখিয়ে দিল
বন্য মহিষের শক্তি কত”।
যারে তুমি নিচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে / পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে-রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন। পশ্চাতে থাকার যন্ত্রণা অনুভব করেছিল সাঁওতালেরা। সেই যন্ত্রণা একবার বাঁধ ভেঙেছিল। সকলের মুক্তির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার মুক্তি-এই অনুভব তাদের সম্মিলিত বিদ্রোহী করেছিল। সেই বিদ্রোহের প্রকাশ সাঁওতাল বিদ্রোহতে। ইতিহাসের পাতায় জ্বলজ্বল করছে ১৮৫৫ সালের ৩০শে জুন।’আকাশে প্রকাণ্ড পূর্ণিমার চাঁদ পাহাড়-অরণ্যের শীর্ষে, নীচে জ্যোৎস্নার ঝিলিমিলি খেলা- ভগনাডিহি থেকে ত্রিশ হাজারের এক সাঁওতাল দল’। নির্যাতন, অত্যাচার, বঞ্চনার এক গভীর অন্তর্নিহিত অনুভূতি আদিবাসী সংহতি ও ভ্রাতৃত্ববোধকে চালিত করেছিল কলকাতার পথে। বিচারের প্রকৃত বাণীর আশায়।সেই বিদ্রোহের-হুলের দিন আজ হুল দিবস।
বিদ্রোহ ছিল ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে , ব্রিটিশের সহায়তা পাওয়া জমিদার মহাজনের বিরুদ্ধে -যারা শোষণের জোয়াল নামিয়ে এনেছিল সাঁওতালদের উপর। সেই সাঁওতাল যারা ছিল নিরীহ, সরল, নির্বিবাদী ,শান্তিপ্রিয়। প্রকৃতির সাথে কঠোর সংগ্রাম ছাড়া যাদের গ্রাসাচ্ছাদনের উপায় ছিল না। সুদেহী ও কঠোর শ্রমশীল। এরা ছিল জঙ্গল পরিষ্কার করে পতিত জমি উদ্ধারে দক্ষ। ১৭৯৩ সালে জমির উপর চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্রিটিশরা চালু করবার পরই সমস্যায় পড়ে সাঁওতালেরা। তারা মনোগতভাবে বিশ্বাস করত যে জমি তার যে প্রথম তাতে চাষ করে। ফলে ইতিহাসে যখনই দেখা গেছে যে তাদের জমির উপর আক্রমণ হয়েছে বা দখল হয়েছে তখন তারা অন্য জায়গায় চলে গেছে। নতুন জঙ্গলে নতুন আবাদ গড়ে তুলেছে। সেই স্বাধীনতা আক্রান্ত হল অসংখ্য জমিদারের উৎপত্তি হওয়ার ফলে। জমিদারের খাজনার উৎপাতে শান্তিপ্রিয় সাঁওতালেরা রাজমহল পাহাড়ের পাশে জঙ্গল কেটে বিশাল ভূখণ্ড চাষ আর বাসের উপযোগী করে তোলে। এই অঞ্চলেরই নাম দামিন-ই-কোহ্। পাহাড়ের ওড়না। বীরভূম মুর্শিদাবাদ,
ভাগলপুরের বিস্তীর্ণ পাহাড়, জঙ্গলবেষ্টিত প্রান্তর ঐ নামেই পরিচিত ছিল।
দামিন-ই-কোহ্তে তখন জমি ১৩৬৬.০১ বর্গমাইল। ৫০০ বর্গমাইল ছাড়া বাকি সব পাহাড়। আবার এর মধ্যে ২৪৬ বর্গ মাইল গভীর জঙ্গল। বাকি ২৫৪ বর্গমাইল আবাদযোগ্য জমি। ১৮৩২ সালে ইংরেজ বড়লাট বেন্টিঙ্ক সাঁওতালদের বললেন – জঙ্গল এলাকা পরিষ্কার করো আর বসবাস করো। দলে দলে সাঁওতাল এলো , হাত লাগালো,গ্রামের পত্তন হলো, জঙ্গল পরিষ্কার হলো, বসবাস চাষ শুরু হলো। এককথায় সোনার আবাদ। ১৮৩৬ সালে ৪২৭ গ্রাম প্রতিষ্ঠা হল সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের পর নিজস্ব নাচ, সংস্কৃতি। কিন্তু দিন সমান ভাবে কাটলো না। ব্রিটিশরা সাঁওতালদের লোভ দেখিয়ে বলেছিল জমির রাজস্ব লাগবেনা। ১৮৩৮ সাল থেকে ব্রিটিশরা জমির খাজনা চাপালো বাৎসরিক দু’হাজার টাকা। তেরো বছরের মধ্যে সেই খাজনা বেড়ে গেল ২২গুন। ততদিনে গ্রাম প্রতিষ্ঠা বেড়ে হয়েছে ১৫০০। সাঁওতালদের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে তিরাশি হাজার। ইংরেজের চাপানো খাজনার বাইরেও ছিল জমিদারের নায়েক, পেয়াদা, গোমস্তাদের জোর করে নেওয়া অন্যায় অর্থ।
চাষবাসের মধ্য দিয়ে যখন সাঁওতালদের অর্থনীতির খানিকটা বিকাশ ঘটছে তখন তার লোভে অনেক বাঙালি ,ভোজপুরি ,ভাটিয়া বেপারী ও মহাজন এলাকায় এসে তাদের ব্যবসার পত্তন করল। সাঁওতালদের তখন বিনিময়ের অর্থনীতি। নিজেদের চাষ করা ফসলের অংশ বিনিময় করে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস সংগ্রহ করত। সরল সাঁওতালিদের ঠকানোর জন্য ব্যাপারীরা কেনারাম বা বড় বউ নামের বড় বাটখারা ব্যবহার করত জিনিস কেনার সময়। আর বেচারাম ছোট বউ নামের ছোট বাটখারা ব্যবহার করত জিনিস বিক্রির সময়। ব্যাপারীদের মুনাফা বৃদ্ধির আরেক উপায় ছিল সুদের কারবার। মহাজন’ বেশি সুদে ও চক্রবৃদ্ধি হারে ধার দিত। ঋণফাঁদে জড়াতো। গোলামে পরিণত করত সারা জীবন। এই করেই জমি ,ভিটেমাটি, ফসল, এমনকি গরু ,মোষ ,তৈজসপত্র ,হাঁড়িথালা, লোহার বালা পর্যন্ত কুক্ষিগত হতো কর্জ শোধ না করার দায়ে। কর্জের দায় বংশানুক্রমে উত্তরাধিকারীকে বহন করতে হতো। মহাজনের দল ফসল কাটার মরসুমে গরু বা ঘোড়ায় টানা গাড়ি চেপে বেরিয়ে পরতো সারা বছরের আদায়ে। তাদের খাওয়া-দাওয়ার দায়িত্ব মহাজনেরা চাপাতো কর্জকারীকে। দূরবর্তী ভাগলপুর বা মুর্শিদাবাদ আদালতে গিয়ে এইসব জুলুমের বিরুদ্ধে মামলা করার সংগতি গরিব সাঁওতালদের ছিলনা।
দামিনের জমি ছিল সরকারের খাস। জমিদাররা মহল কিনে বা ইজারা নিয়ে সেখানে প্রবেশ করে। যেমন খুশি জমির খাজনা বাড়ানোতে জমিদাররা সিদ্ধহস্ত ছিল। এই আদায়ে অনাবাসী জমিদারদের জায়গায় অত্যাচার চালাতো নায়েব গোমস্তরা। জমিদার মহাজন’ পুলিশ আমলাদের ঘুষ দিয়ে বশ করে রাখত। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাজ ছিল রাজস্ব আদায় করা , সাঁওতালদের উপর অত্যাচার বঞ্চনা প্রতিরোধে তারা উদাসীন ছিল। রেললাইন স্থাপনের প্রথম পর্যায়ে সাঁওতালরা তাদের ঘরবাড়ি থেকে উৎখাত হয়, চাষের জমি চলে যায়। কোনো ক্ষতিপূরণ তারা পায় না। রেললাইন স্থাপনের কাজের সময় যখন তারা মজুর হিসাবে নিযুক্ত হয় তখন রেল কোম্পানি বহু সাঁওতাল শ্রমিকের মজুরি না দিয়ে বেগার খাটায়। এইসব অভিযোগ পুঞ্জিভূত হতে থাকে। মনের মধ্যে প্রত্যাঘাতের সংকল্প গড়ে ওঠে।
১৮৫৫র আদির দু’বছর খরা ছিল। মহুয়া ফুলের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ধান, রবিশস্য উৎপাদনেও বিপর্যয়। এদিকে ব্যাপারী, মহাজন, জমিদারের অত্যাচার অব্যাহত। বদলা হিসেবে একদল রাগী সাঁওতাল যুবক প্রতিশোধ নেয় অত্যাচারী সুদখোর মহাজনের বাড়িতে অতর্কিতে হানা দিয়ে ধনরত্ন চুরি বা ডাকাতি করার। মহাজনেরা আতঙ্কিত হয়ে পাকুররাজ এস্টেটের দেওয়ান জগবন্ধু রায় এবং দিঘি থানার দারোগা মহেশলাল দত্তকে খবর দেয়। অভিযোগ করে যে সাঁওতালরা গোপন সভা করে ষড়যন্ত্র করছে। পাকুর রাজ এস্টেট থেকে বীরসিংহ পরগনাইতকে ষড়যন্ত্রের দোষী হিসাবে জরিমানা করে। টাকা দিতে না পারায় সকলের সামনে তাকে জুতাপেটা করা হয়। অপমানে ফুঁসে ওঠে সাঁওতালেরা, বদলা নিতে আরো ক’জন মহাজনের বাড়িতে তারা আক্রমণ করে লুটপাট চালায়। মহাজনদের সঙ্গে যোগসাজসে মহেশ দারোগা চৌকিদারদের নিয়ে প্রথম দফায় অবস্থাপন্ন গোচ্চো সাঁওতালের বাড়িতে গালাগালি করে আসে পরের দফায় তাকে এবং আরো অনেক সাঁওতালকে গ্রেফতার করে সর্বসমক্ষে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাস্তায় মারতে মারতে নিয়ে যায়। সঙ্গে থাকে অভিযোগকারী কুখ্যাত মহাজন কেনারাম ভকত। আত্মমর্যাদার এই আঘাত সাঁওতাল সমাজ মেনে নেয় না। প্রতিশোধের আগুন জ্বলে ওঠে।
এ’সবের পরেই দামিন-ই-কোহতে সাঁওতাল মহাসভায় ছয় থেকে সাত হাজার সাঁওতালের জমায়েত হয়। বিদ্রোহের প্রাক-প্রস্তুতি শুরু হয়। বিদ্রোহের নেতা সিদো,কানহু, চাঁদ, ভৈরব চার ভাই, ভগনাডিহি গ্রামের চুনার মূর্মুর ছেলে। এই বিদ্রোহের সঙ্গে কার্যকারণে ধর্মকেন্দ্রিকতা, পশ্চাত্পদ তথাকথিত অলৌকিকতার বিষয়গুলি জড়িয়ে আছে। অসহায় সাঁওতাল সমাজের কাছে সংকট মুক্তির কাজে তা ক্রিয়াশীল হয়। ধীরে ধীরে মতামত তৈরি হলো- জমা হও সিধু-কানু’র গ্রামে। শাল পল্লবের গিরা পাঠানো শুরু হলো সাঁওতাল গ্রামে গ্রামে। পাতা সহ ছোট শালের ডাল। নিমন্ত্রনের সাঁওতালি রীতি। ভগনাডিহিতে ৪০০ গ্রামের প্রতিনিধি হিসেবে প্রায় ১০হাজার সাঁওতাল কৃষকের বিরাট জমায়েত হলো। এরা শুধু দামিনের নয় , বীরভূম, ভাগলপুর, হাজারিবাগ, মানভুম থেকে।
সভা হলো। সবাই বললো- এক হতে হবে। ঠিক হলো
১. জমির খাজনা কেউ দেবে না।
২. যার নিয়ন্ত্রণে জমি আছে সেই জমিতে চাষ করবে-সেটাই তার অধিকার।
৩. যার যা ঋণ আছে তা গ্রাহ্য করা হবে না, ঋণশোধের কোন প্রশ্নই নেই।
ঐক্যমতে সকলে বললো- জমিদারি, মহাজনী মানবো না আর নিজেদের সরকার গড়বো। সকলেরই মূল বিষয় ছিল -শোষণপীড়ন থেকে মুক্তি। উৎপাদনের স্বাধীনতা এবং রক্তঘাম জল করা উৎপাদিত ফসলের উপর অধিকার।
সভা ঠিক করল গভর্নমেন্ট, কমিশনার, কালেক্টরেট, ম্যাজিস্ট্রেট, দারোগা এবং কয়েকজন মহাজনকে এই মর্মে চিঠি দেওয়া হবে। সেই চিঠি দিয়ে বলা হলো ১৫ দিনের মধ্যে উত্তর চাই। কোন উত্তর এলো না।
তাহলে উত্তর দিতে পারে একমাত্র ইংরেজ রাজবাহাদুর। তিনি তো থাকেন কলকাতায়। তাহলে চলো কলকাতা। ভগনাডিহি থেকে ত্রিশ হাজারের গণপদযাত্রা। ব্যাপক কৃষক সমাজের দারিদ্র্য ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাঁচার অধিকারের দাবিতে লাট সাহেবের কাছে দরবারের জন্য যাত্রা। হুল।
মিছিল যত এগোয় লোক তত যোগ দেয়। বহুগুণ বাড়ে মিছিলেন আয়তন। সেই সময় রাস্তায় মিছিল মুখোমুখি হয় কয়েকজন মহাজনদের যারা সাঁওতালদের উপর বর অত্যাচার করে কুখ্যাত হয়েছেন। মিছিল অশান্ত হয় এবং অত্যাচারীর শাস্তির দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। বরকন্দাজ নিয়ে মহেশ দারোগা মহাজনদের পক্ষ নিয়ে উপস্থিত হয়। উগ্রভাবে গালিগালাজ করে সাঁওতালদের গ্রেপ্তার করতে এলেই আগুনে ঘৃতাহুতি হয়।সিদো নিজের হাতে মহেশ দারোগার গলা কাটে। ক্ষিপ্ত সাঁওতালেরা বরকন্দাজ দারোগা চৌকিদার মিলিয়ে উনিশজনকে মেরে ফেলে। বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। বিশাল এলাকা বিদ্রোহীদের দখলে চলে আসে। সাঁওতালদের ধারণা ছিল ব্রিটিশরা তাদের অভিযোগ শুনবে এবং অত্যাচারীদের শাস্তি দেবে। ভুল ভাঙলো যখন জমিদার ,মহাজন, পুলিশ,আমলাদের বাঁচাতে রাষ্ট্রশক্তি ঝাঁপিয়ে পড়লো সাঁওতালদের উপর। প্রথম দিকে ব্রিটিশ বাহিনী পর্যুদস্ত হয় বিদ্রোহীদের হাতে। ভয়ে জমিদার, মহাজন, ব্যাপারীরা বাড়িঘর থেকে পালাতে থাকে। সাঁওতালিদের সামরিক শিক্ষা ছিল না। ছিল না সংগঠন। চাষের মরশুমে কাজ ফেলে বিদ্রোহীরা অংশগ্রহণ করেছিল বিদ্রোহে। কারণ সকলেরই জীবনমরণ সমস্যা ছিল। বহুসংখ্যক সিপাহী, জমিদারদের রসদ, জমিদারদের পাঠানো হাতি, অর্থ দিয়ে বিদ্রোহ মোকাবিলার নামে শুরু হয় ব্যাপক ও সুপরিকল্পিত সাঁওতাল দমন অভিযান। আসলে হয় সাঁওতাল গ্রামগুলোর-জনপদের দহন এবং লুন্ঠন। বেপরোয়া হত্যা। বয়স এবং লিঙ্গ কোন বাধা হয় না নির্বিচারে বন্দী করবার ক্ষেত্রে। ভগনাডিহি গ্রাম জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়। রক্তে লাল হয়ে যায় মাটি। রাজমহল পাহাড় সাক্ষী থাকে। বর্ষায় থৈ থৈ ভরা বুক গঙ্গায় সাঁওতালের বুকের রক্ত মেশে। তবু সাঁওতালরা আত্মসমর্পণ করে না। ব্রিটিশের দেখানো ভয়কে ওরা থুতু ছেটায়। চোখের সামনে দেখে সিদুর মাথার দাম দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার দশ হাজার টাকা। অন্যদের পাঁচ হাজার ,এক হাজার টাকা। নিজেদের সিদ্ধান্তে অচঞ্চল থাকে সাঁওতালেরা। নাগরা যতক্ষণ চলবে ,বাজবে -যুদ্ধ চলবে। এই মেজাজ দেখে ব্রিটিশ সামরিক আইন জারি করল তিন জেলায়। ভাগলপুর, মুর্শিদাবাদ, বীরভূমে। জেনারেল লয়েড এবং জেনারেল বার্ড নেতৃত্ব দিয়ে চৌদ্দ হাজার সেনা নিয়ে বিদ্রোহের এলাকা ঘিরে ফেলে দশ হাজার বিদ্রোহীদের হত্যা করে। ৩১শে ডিসেম্বর সরকার বলে বিদ্রোহ দমন হয়েছে।
এরইমধ্যে সিদো, কানহু ধরা পড়ে ইংরাজদের হাতে। তার ফাঁসি দেওয়া হয় বারহেটেতে এক বিশাল জনতার সামনে। কানুকে ফাঁসি দেওয়া হয় তার নিজের গ্রাম ভগনাডিহিতে। তাতেও রোষ কমে না ব্রিটিশদের। তার শরীরকে পুড়িয়ে ভস্ম করে ফেলে।
অশিক্ষিত, হতদরিদ্র সাঁওতালেরা রক্ত দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের এক গৌরবজনক ইতিহাস রচনা করে গেছে। বিদ্রোহের চরিত্র বিচারে এটি ছিল সামন্ততন্ত্রবিরোধী অভ্যুত্থান। কিন্তু পরবর্তীতে তা উন্নীত হয় প্রকৃত সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিদ্রোহে। সাঁওতাল বিদ্রোহ বর্ণ এবং জাতির গন্ডি পেরিয়ে গিয়েছিল। বাঙালি, বিহারী, মুসলমান ,কৃষক কারিগর ইত্যাদি সকলে যোগ দিয়েছিল সাঁওতালদের বিদ্রোহে। সমাজের তথাকথিত নিম্নবর্ণর মানুষ যেমন কামার, লোহার, কুমোর তেলি, গোয়ালা, চামার, ভুঁইয়া, বাগদি, হাড়ি, ডোম ইত্যাদি যোগ দিয়েছিল এই বিদ্রোহে। অনেকে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেনি কিন্তু যুদ্ধে সাহায্য করেছিল নানাভাবে।আসলে এরা প্রত্যেকেই কোন না কোন ভাবে অত্যাচারিত হয়েছিল।এরাও গলা মিলিয়েছিল ‘জমি চাই- মুক্তি চাই’- এই স্লোগানে। আসলে ঐক্যটা হয়েছিল সাঁওতাল এবং গরিব মানুষের। শ্রমজীবী ও শোষিত শ্রেণীবোধ তৈরি করেছিল এক গভীর সংগ্রামী চেতনার। সাঁওতাল বিদ্রোহ ব্যর্থ হয়। বিদ্রোহের অনেক দাবি সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়। সাঁওতালদের নির্দিষ্ট বাসভূমি হয়। মাইনরিটি বা সংখ্যালঘু হিসেবে তারা স্বীকৃত হয়। রাজমহল, দামনে-কোহ এলাকা সমেত বীরভূম ভাগলপুর জেলার বিস্তৃত অংশ নিয়ে সাঁওতাল পরগনা নামে নতুন জেলা গঠিত হয়। সাঁওতাল বিদ্রোহ প্রাকশর্ত ছিল সিপাহী মহাবিদ্রোহের (১৮৫৭), নীল বিদ্রোহের (১৮৬০-৬১), পাবনা,বগুড়া বিদ্রোহের(১৮৭২),মারাঠা কৃষক অভ্যুত্থানের (১৮৭৫-৭৬)। সাঁওতাল বিদ্রোহের গভীরতার কারণ হিসেবে কেউ কেউ বলেছেন স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায়, কেউ বলেছেন নবযুগের সূচনা, কেউ বলেছেন বর্ণাশ্রমের মধ্যে আত্মসম্মানবোধ, কেউ বলেছেন স্বাধীন সত্তায় আঘাত লাগার কথা। কিন্তু যে আদিবাসীরা আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে এগিয়ে দিল- তারা কিরকম আছে ?
আদিবাসীদের ন্যায় বিচার, রুটি-রোজগার, বাসস্থান কিম্বা জল, জমি, জঙ্গলের অধিকারের দাবি, আদিবাসী সত্তা থেকে জাতীয় সত্তায় বিকশিত হওয়া পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সম্ভব নয়। আর প্রমাণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার পরতে পরতে। ধান্দার ধণতন্ত্র ও আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির সঙ্গে হিন্দুত্ববাদীদের বোঝাপড়া বৃদ্ধি পাওয়ার পর বোঝা যায় শ্রম পুঁজির অমীমাংসিত দ্বন্দ্বে সঙ্ঘ পরিবার সবসময় পুঁজির পক্ষে। আর সঙ্ঘের ‘সাক্ষাৎ মা দূর্গা’ও ঐ একই পথের পথিক। দেশে খনি আর বনের নীতিতে আর রাজ্যে দেউচা- পচামির প্রকল্পের নীতিতে আদিবাসীদের ভিটেমাটি উচ্ছেদের স্পষ্ট প্রতিফলন। সিধু-কানু হাঁক পেড়েছিল মুক্তির। ১৬৮ বছর বয়স হয়ে গেল হুল দিবসের। আজও মুক্তি অধরা। তাই আজও হুল সমান প্রাসঙ্গিক।