১৯৬৯ সালের ২৫মে তারিখে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার (যুক্তফ্রন্ট) কাজী নজরুল ইস্লামের ৭০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে কলকাতায় রবীন্দ্র সদনে মুজফ্ফর আহ্মদ একটি লিখিত ভাষণ পাঠ করেছিলেন। সেই ভাষণটি পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক “নজরুল জয়ন্তী” পত্রিকায় প্রকাশ করা হয়।
২০১১ সালের ৫ই আগস্ট ‘মুজফ্ফর আহ্মদ নির্বাচিত প্রবন্ধ’ প্রকাশ করে ন্যাশনাল বুক এজেন্সি। সেই বইতে ‘কাজী নজরুল ইসলামঃ আমাদের কর্তব্য’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধটি আজ নজরুল ইস্লামের জন্মদিবসে রাজ্য ওয়েবডেস্কের পক্ষে প্রকাশ করা হল।
মুজফ্ফর আহ্মদ
বাংলার মানুষের প্রতি প্রিয় কবি কাজী নজরুল ইস্লাম আজ সত্তর বছর বয়সে পুরো করে একাত্তরে পা বাড়ালেন। আজকার দিন আমরা কবিকে গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।
আজ হতে ঊনপঞ্চাশ বছর আগে। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে যারা কলকাতায় ছিলেন – যাদেরই তখন যাতায়াত ছিল ৩২ নম্বর কলেজ স্ট্রিটের দোতলায় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির অফিসে, তারা সেদিন নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছিলেন কিভাবে সে বাড়িতে কাজী নজরুল ইস্লাম সশব্দে প্রবেশ করেছিলেন। তার ছাত্র জীবনের বন্ধু শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায় তাকে পৌঁছে দিয়ে গিয়েছিলেন।
করাচিতে একটি অস্থায়ী সৈন্যদলের অবস্থান ছিল, তার নাম ছিল উনপঞ্চাশ নম্বর বেঙ্গলি ব্যাটালিয়ন। তাতে নজরুল ইস্লাম কোয়ার্টারস মাস্টার হাবিলদারের পদে উঠেছিলেন। ১৯২০ সালের মার্চ মাসে যখন এই সৈন্যদলটি পুরোপুরি ভেঙে গেল তখন হলো নজরুল ইস্লামের কলকাতা আগমন। আসতে না আসতেই তার বন্ধুদল জুটে গেল। কারণে-অকারণে তিনি উচ্চরোলে হাসেন, চেঁচিয়ে তিনি বাড়িঘর মাতিয়ে তোলেন, আর নবলব্ধ বন্ধুরা গান গাইতে বললে গান তিনি গেয়েই চলেন। তার শতকরা নিরানব্বই ভাগই রবীন্দ্রনাথের গান। নজরুল ইস্লাম কারোর বাড়িতে গেলে পাশের বাড়ির লোকেরা টের পেয়ে যান যে ও বাড়িতে নজরুল ইস্লাম এসেছেন।
এই সদা প্রাণচঞ্চল যুবকটি কবিতা লেখা আরম্ভ করলেন। কয়েকটি কবিতা তাঁর মাসিক পত্রে ছাপাও হলো। আমরা কিছু বুঝতে না বুঝতেই একরকম রাতারাতি কবি প্রসিদ্ধি লাভ করলেন তিনি। বাংলাদেশে জয়জয়কার হলো তরুণ কবি নজরুল ইস্লামের। সবচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয় এই যে, রবীন্দ্রনাথের পরম ভক্ত এক কবির লেখা রবীন্দ্র প্রভাব মুক্ত।
নজরুল ইস্লাম শুধু নিজেকে বুদ্ধিজীবি মহলে আটকে রাখলেন না। তার যাতায়াত শুরু হলো সাধারণ মানুষের ভিতরেও, মজুরের ভিতরে ও কৃষকের ভিতরে।
নজরুল ইস্লাম শুধু কবিতাই লেখেননি। নব নব অবদান তিনি দিয়েছেন সুর ও সংগীতে র জগৎকেও।
নজরুল ইস্লাম জীবনী শক্তিতে পরিপূর্ণ ছিলেন। একদিন তাঁরও ভিতরে প্রবেশ করল ব্যাধি। এই ব্যাধি তাকে কুরে কুরে খেতে লাগল। অবশেষে ১৯৪২ সালের ৯ই জুলাই তারিখের রাত্রিতে তাঁর ব্যাধি প্রকট হয়ে পড়ল – অল ইন্ডিয়া রেডিওর কলকাতা স্টেশনে। তারপর আমাদের সুপরিচিত নজরুল ইস্লামকে আমরা ধীরে ধীরে হারিয়েছি। তাঁর সম্বিত নেই, তিনি কথা বলতে পারেন না, তিনি আমাদের চিনতে পারেন না। কবি আজ জীবিত থাকলেও তার অবস্থা মৃতের মত।
কবি নজরুল ইস্লাম গত সাতাশ বছর যাবত অসুস্থ ও সম্বিতহারা। এই ২৭ বছরে তিনি আমাদের কিছুই দিতে পারেননি। কিন্তু সাহিত্য ও সংগীতের আসরে তিনি একসঙ্গে বাইশ বৎসর কর্মব্যস্ত জীবন কাটিয়েছেন। এই বাইশ বছরে তিনি আমাদের যে অবদান দিয়েছেন তার কোন তুলনা হয় না। তাঁর অবদান সমস্ত দেশের নিকট হতে স্বীকৃতি লাভ করেছে। নজরুল ইস্লাম দেশকে স্বাধীনতা ও দেশপ্রেমের প্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি নিজেও ছিলেন দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন সৈনিক। এই জন্য আমরা দেখতে পাচ্ছি কবির এই সুদীর্ঘ নীরবতা সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয়তা প্রতিবছরই বেড়ে চলেছে।
ভারত ও পাকিস্তান – এই দুটি রাষ্ট্রের নিকট হতে কবি নজরুল ইস্লাম সাহিত্যিক বৃত্তি পান। এইরকম আর কেউ কোথাও পেয়েছেন কিনা তা আমার জানা নেই। গত ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবাংলায় যখন যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল তখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার কবির বৃত্তি মাসিক একশো টাকা বাড়িয়ে দিয়েছেন। আগে কবি পেতেন পূর্ব পাকিস্তান সরকার ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের মিলিত বৃত্তি মাসিক ৩৫০ টাকা, আর পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর তহবিল হতে মিলিত বৃত্তি তিনি পেতেন মাসিক ৩০০ টাকা। ১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের যুক্তফ্রন্ট সরকার মাসিক ১০০ টাকা বাড়িয়ে দেওয়ার পরে কবি এখন পান ভারত হতে মাসিক ৪০০ টাকা এবং পাকিস্তান হতে মাসিক ৩৫০ টাকা। সবসুদ্ধ কবি এখন পাচ্ছেন মাসিক ৭৫০ টাকার সাহিত্যিক বৃত্তি।
নজরুল ইস্লাম এখন থাকছেন তাঁর এখনকার বড় ছেলে কাজী সব্যসাচীর সঙ্গে ক্রিস্টোফার রোডে কলকাতা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্টের দুই কামরার একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে। সেবার কাজে কিছু শিক্ষা পাওয়া অন্তত দুজন পরিচারক কবির জন্য প্রয়োজন। কবি প্রস্রাব কিছুতেই রুখতে পারেন না। তার জন্য তার কাপড় ভিজে যায়। কিন্তু কবিকে কিছুতেই ভেজা কাপড়ে থাকতে দেওয়া উচিত নয়। তাঁর যখন সুবিধা অসুবিধার কথা প্রকাশ করার ক্ষমতা নেই তখন আমাদেরই সবকিছু বুঝে নিতে হবে। কাপড় ভিজে গেলে সঙ্গে সঙ্গেই তা বদলে দিতে হবে। একরকম রবারের পাউচ আছে। সেটা কবিকে দিয়ে ব্যবহার করানো যাবে কিনা তা জানিনে। করাতে পারলে কাপড় ভিজে যাওয়ার সমস্যার খুব বেশিরভাগ সমাধান হয়ে যাবে। আমার মনে হয় বছরে অন্তত দুবার এক্সপার্ট সার্জন ও চিকিৎসকদের দিয়ে কবিকে পরীক্ষা করানো উচিত। এক্ষেত্রে সার্জন ও চিকিৎসকদের ফিজ দেওয়ার কোনো কথা উঠবে না বলেই আমার ধারণা। অনুরোধ করলে অনেকেই খুশি হয়ে কবিকে দেখতে যাবেন। মামুলি অসুখ-বিসুখে চিকিৎসার ব্যবস্থা বোধ হয় আছে।
কবির বাসস্থানের সমস্যাটি বড় কঠোর ও পীড়াদায়ক। দুই কামরার ফ্ল্যাটে কাজী সব্যসাচী তার ছেলেমেয়ে নিয়ে সস্ত্রীক বাস করে। ছেলেমেয়েরা ক্রমেই বড় হচ্ছে। আসল দু কামরায় সব্যসাচীদেরই স্থান সংকুলান হওয়ার কথা নয়, অথচ এই স্থানটুকুর ভিতরে কবিকেও থাকতে হচ্ছে। তাঁর পরিচারকদেরও স্থানের সমস্যা আছে। কেউ যদি কবিকে দেখতে আসেন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দু মিনিট তাকে দেখে তারা চলে যান; কবিতার যে ছেলের সঙ্গেই থাকুন না কেন, (অনুরুদ্ধও বিবাহিত, তারও সন্তানেরা আছে) বাসস্থানের সমস্যাটি বাস্তব ও কঠোর। কমপক্ষে পাঁচটি কামরা তাদের জন্য চাই। কবির পুত্ররা চাইছে যে, রাষ্ট্র’ কবির জন্য বাড়ি তৈয়ার করে দিন। কবির বাড়ি হোক এটা আমরা একান্তভাবেই চাই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার যদি কবির বাড়ি তৈয়ার করা স্থিরও করেন, তাতে খুব কম করে সময় ধরলেও দু’বছর তো লাগবেই। ততদিন কবি কি বর্তমান দুঃসহ অবস্থার মধ্যেই কাটাবেন ? ততদিন কি কবির দর্শকেরা দু’দশ মিনিট অপেক্ষা করার জন্য এতটুকুও স্থান পাবেন না ? আমি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি। তাঁরাই কলকাতার সবচেয়ে বড় বাড়িওয়ালা। ইচ্ছা করলেই তারা কবির বাসস্থানের একটি ব্যবস্থা করে দিতে পারেন।
কবির লেখা গুলি সম্পর্কে এখন আমি কিছু বলতে চাই। তিনি তার অনেক লেখার স্বত্ত্ব বিক্রয় করে ফেলেছেন। তার সুবিখ্যাত কবিতা পুস্তক “অগ্নিবীণা”র স্বত্ব তিনি বিক্রয় করেছেন, যতটা মনে রাখতে পারছি, ১৯৩১ সালে। যত পুস্তকের যত স্বত্ব বিক্রয় করেছেন সবই ১৯৪২ সালের আগে করেছেন। আমি আগেই বলেছি যে ১৯৪২ সালের ৯ জুলাই কবি তার বর্তমান দুরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হয়েছেন। ধীরে ধীরে তার লেখাগুলিতে বিকৃতি ঘটছে। যে পুস্তকগুলির বিক্রয় কম সেগুলি আর ছাপাও হচ্ছে না। নজরুল ইস্লামকে একজন বড় কবি হিসেবে মেনে নিয়েছেন বলেই রাষ্ট্র তাকে সাহিত্যিক বৃত্তি দিচ্ছেন। এখন তার লেখাগুলির সংস্করণ ও বিশুদ্ধিকরনের ব্যাপারেও রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। যারা স্বত্ব কিনেছেন তাদের সংখ্যা খুব বেশি নয়। আমার বিশ্বাস ডি এম লাইব্রেরীর মালিক শ্রী গোপালদাস মজুমদারই স্বনামে ও বেনামে সর্বাপেক্ষা বেশি পুস্তক কিনেছেন। আরো কয়েকজন আছেন। আমার বিশ্বাস গভর্নমেন্ট স্বত্ব কিনে নিতে চাইলে তারা তা বিক্রয় করে দেবেন। তাছাড়া তারা বিক্রয় করবেন এই জন্য যে সরকার আইন রচনা করলে তখন তো তাদের স্বত্ব ছেড়ে দিতেই হবে। দলিল পড়ে আমি যতটা বুঝেছি তাতে শ্রীঅসীমকৃষ্ণ দত্তের নিকটে কবির আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই।
আমার মনে হয় কবির পুস্তকগুলির প্রকাশ করার জন্যে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি নিযুক্ত করতে হবে। সেই কমিটি বিশেষভাবে যাচাই করে পুস্তকগুলি প্রেসে পাঠাবার অনুমতি দিবেন। কবির নিয়ম ছিল যে প্রথম মুদ্রণের পুস্তকগুলি প্রকাশিত হলে ছাপায় ভুলগুলি শুদ্ধ করে প্রত্যেক পুস্তকের কয়েক কপি বন্ধুদের তিনি উপহার দিতেন। কবির গ্রন্থাবলী প্রকাশ করার জন্য এইরকম পুস্তক সংগ্রহ করতে হবে। আমার বিশ্বাস আছে যে, চেষ্টা করলেই কবির স্বাক্ষরিত ও সংশোধিত প্রস্তাব পাওয়া যাবে।
গ্রন্থাবলি প্রকাশিত হলে তার একটি রয়ালটি নির্ধারণ করে কবির জন্য তা খরচ করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত কবি যদি আর না থাকেন তবে রয়ালটির টাকাটা কবির দুই পুত্র যেন পায় এমন একটা ব্যবস্থা করতে হবে।
কবি আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় পাকিস্তান কিন্তু “নজরুল রচনাবলী” প্রকাশের কাজ আরম্ভ করে দিয়েছেন। এই কাজটি হাতে নিয়েছেন সে দেশের “কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড”। এটি শুনেছি একটি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান। আমাদের দেশের মতো সে দেশে আপাতত স্বত্ব বিক্রয় বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। ডাবল রয়াল অক্টাভো সাইজের দুটি বড় বড় খন্ড বা’র হয়ে গেছে। প্রথম খণ্ডের পৃষ্ঠা ৭৫৪ এবং দ্বিতীয় খণ্ডের ৬৭৫।
পূর্বপাকিস্তানে একদল লোক কবির লেখায় বিকৃতি ঘটাচ্ছেন। কিন্তু, “কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড” সে দলের নন। তাঁরা কবির লেখার বিশুদ্ধি রক্ষা করেছেন। সুখের বিষয় এই যে কবি আব্দুল কাদির নজরুল ইস্লামের একজন বন্ধু এবং তাঁর লেখা সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল।
ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া