চন্দন দাস
রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে প্রথম অভিযুক্ত যোগেন্দ্র চন্দ্র বসু।
১৮৯১। ২৫শে আগস্ট হাইকোর্টে এই মামলার প্রথম শুনানি হয়। অভিযোগ ছিল — ওই বছরই ‘বঙ্গবাসী’ নামে একটি সংবাদপত্রে ‘এজ অব কনসেন্ট বিল, ১৮৯১’-র বিরোধিতা করে এক প্রবন্ধ লিখে ব্রিটিশ সরকারের রোষে পড়েন যোগেন্দ্র চন্দ্র বসু। সেই ১২৪এ ধারায় অভিযুক্ত হন তিনি।
ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের যে ধারা নিয়ে এত আলোচনা — সেটিই ওই ১২৪এ।
১৯২২-এ এই ধারায় মহাত্মা গান্ধী এবং শঙ্করলাল বাঙ্কার অভিযুক্ত হন। শঙ্করলালের মালিকানাধীন ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকায় গান্ধীর ৩টি প্রবন্ধই ছিল ’অপরাধের’ কারন।
১০০ বছর পেরোনর পর আইনটি প্রয়োগে স্থগিতাদেশ জারি হয়েছে শীর্ষ আদালতের।
খারিজ হয়নি সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য আইন।
১৮৯০ থেকে অবিভক্ত ভারতে এই ধারাটির প্রয়োগ শুরু।
যদিও যারা এই মারাত্মক আইনটি ব্যবহার শুরু করেছিল, সেই ব্রিটিশরা ২০০৯-এ নিজেদের দেশের ক্ষেত্রে বাতিল করেছে। অন্যদিকে মোদী সরকার ভারতকে যে দেশের বশংবদ বানাতে উঠে পড়ে লেগেছে, সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেল ক্রিমিনাল কোডের ২৩৮৪ নং ধারা অনুসারে রাষ্ট্রদ্রোহ একটি ফেডারেল অপরাধ। তবে অস্ট্রেলিয়া ২০১০-এ তার রাষ্ট্রদ্রোহ আইন বাতিল করেছে। গত বছর সিঙ্গাপুরও আইনটি বাতিল করেছে।
কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ঠিক উল্টো পথে হেঁটেছে।
কেমন?
একটি সমীক্ষা জানাচ্ছে, ভারতে ২০১০-র ১ জানুয়ারি থেকে ২০২০-র ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাষ্ট্রদ্রোহিতা বিষয়ক ৮১৬টি মামলা হয়েছে। সেগুলিতে প্রায় ১১ হাজার জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। তার মধ্যে ৬৫ শতাংশ মামলা হয়েছে ২০১৪-তে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরে। যাঁদের জড়ানো হয়েছে, তাঁদের মধ্যে বিরোধী রাজনীতিবিদ, ছাত্র, সাংবাদিক,শিক্ষাবিদ আছেন।
মূলত সরকার কিংবা রাজনীতিবিদদের সমালোচনা করার জন্য গত দশকে যে ৪০৫ জন ভারতীয়ের বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা হয়েছে, তার ৯৬ শতাংশ হয়েছে ২০১৪-র পরে। এর মধ্যে ১৪৯ জন অভিযুক্ত হয়েছেন মোদীর বিরুদ্ধে ‘সমালোচনা’ বা ‘মানহানিকর’ মন্তব্যের অভিযোগে।
উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের বিরুদ্ধে একই ধরনের ‘অপরাধে’ ১৪৪ জন অভিযুক্ত হয়েছেন। উত্তরপ্রদেশে ২০১০ থেকে রাষ্ট্রদ্রোহিতা সংক্রান্ত ১১৫টি মামলা হয়েছে। তার ৭৭ শতাংশ রুজু হয়েছে যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরে। এর মধ্যে ৫০%-র বেশি অভিযোগ ‘জাতীয়তাবাদ’ সম্পর্কিত। কেউ সিএএ এবং এনআরসি-র প্রতিবাদ করেছেন। আবার কেউ কেউ ২০১৭-য় আইসিসি চ্যাম্পিয়নস ট্রফির ফাইনালে ভারতের হারে আনন্দ করায় রাষ্ট্রদ্রোহিতায় অভিযুক্ত হয়েছেন।
কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনরত কৃষক বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ আইনে মামলা দায়ের রয়েছে।
আমাদের রাজ্যে? ২০১৪ থেকে ২০২০। ইন্ডিয়ান পেনাল কোড(আইপিসি)-র ১২৪এ ধারায় ১০জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে পশ্চিমবঙ্গে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো(এনসিআরবি)-র ২০২১-র রিপোর্ট এখনও প্রকাশিত হয়নি। তাই দেশের বিভিন্ন রাজ্যের পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গেও মমতা ব্যানার্জির সরকার কতজনের বিরুদ্ধে এই ধারায় মামলা দায়ের করেছে গতবছর, তা জানার উপায় নেই।
রাষ্ট্রদ্রোহ আইন কি?
আইপিসি-র ১২৪এ ধারা রাষ্ট্রদ্রোহিতাকে সংজ্ঞায়িত করে এই ভাবে- “যে কেউ, কথার দ্বারা, হয় কথিত বা লিখিত, বা চিহ্ন দ্বারা, বা দৃশ্যমান উপস্থাপনা দ্বারা, বা অন্যথায়, ঘৃণা বা অবমাননা সৃষ্টিতে বা সৃষ্টির চেষ্টা করে, বা উত্তেজিত করে বা অসন্তোষ বৃদ্ধির চেষ্টা করে সরকারের প্রতি, অভিযুক্ত আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত আজীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে, যার সঙ্গে জরিমানা যোগ করা যেতে পারে….।”
ধারাটিতে তিনটি ব্যাখ্যাও রয়েছে। প্রথমত,‘অসন্তোষ’ অভিব্যক্তিটি অবিশ্বস্ততা এবং শত্রুতার সমস্ত অনুভূতির অন্তর্ভুক্ত। দ্বিতীয়ত, উত্তেজনাপূর্ণ বা ঘৃণা, অবমাননা বা অসন্তোষকে আরও উত্তেজিত করার চেষ্টা না করে, আইনানুগ পথে তাদের পরিবর্তন করার লক্ষ্যে সরকারের পদক্ষেপের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে যে মন্তব্যগুলি, এই ধারায় সেগুলি অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না। তৃতীয়ত, উত্তেজনাপূর্ণ বা ঘৃণা, অবমাননা বা অসন্তোষকে উত্তেজিত করার চেষ্টা ছাড়া প্রশাসনিক বা সরকারের অন্যান্য পদক্ষেপের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে যে মন্তব্যগুলি — এই ধারার অধীনে সেগুলি অপরাধ বলে বিবেচিত হয় না।
আইন যাই বলুক ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের তৈরি এই আইন স্বাধীনতার ৭৫ বছর পরেও বলবৎ আছে। এবং তা শাসকরা প্রয়োগ করেছেন। মূলত বিরোধী দল, গোষ্ঠী, ব্যক্তিদের কন্ঠস্বর দমন করার কাজেই এই ধারার ব্যবহার হয়েছে।
এই ধারা সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেছে বিজেপি সরকার।
ব্রিটিশ শাসনে এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ এনে স্বাধীনতা আন্দোলন দমন, স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নিপীড়নও। আজ সেই আইনের কী প্রয়োজন? অতীতে খোদ প্রধান বিচারপতিই এই প্রশ্ন তুলেছেন। স্বাধীন দেশে এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতা আছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলে বিভিন্ন অংশ আবেদন দায়ের করেছে শীর্ষ আদালতে। আবেদনকারীদের যুক্তি, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(এ) ধারা সংবিধানের ১৯(১)(এ), ১৪ এবং ২১ এই তিন অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
প্রসঙ্গত, আইন কমিশন ২০১৮তেই এই আইন পুনর্বিবেচনার সুপারিশ করেছিল। কমিশন বলেছিল, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সময়ে কেউ দায়িত্বজ্ঞানহীন হলেই তাকে রাষ্ট্রদ্রোহ বলে না। গণতন্ত্রের একই সুরে গান গাওয়াকে দেশপ্রেমের মাপকাঠি করা চলে না। যদি সমালোচনার অধিকারই না থাকবে তাহলে পরাধীন আর স্বাধীন দেশে তফাৎ কোথায়? জাতীয় সংহতি রক্ষা করা জরুরী কিন্তু সেই অজুহাত দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা প্রতিহত করা চলে না। সরকারের সঙ্গে একমত হল না বলে রাষ্ট্রদ্রোহিতা করা হলো, এমন ব্যাখ্যাও অচল।
এবার রাষ্ট্রদ্রোহ আইন নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে দায়ের করা মামলাগুলির আবেদনকারীদের মধ্যে আছে এডিটর্স গিল্ড অব ইন্ডিয়া, মানবাধিকার সংস্থা, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অরুণ শৌরি, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এস জি ভোম্বাটকেরে, সাংবাদিক প্যাট্রিশিয়া মুখিম ও অনুরাধা ভাসিন সহ আরও অনেকেই। আবেদনকারীদের যুক্তি, ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪(এ) ধারা সংবিধানের ১৯(১)(এ), ১৪ এবং ২১ এই তিন অনুচ্ছেদের পরিপন্থী।
কিন্তু মোদীর সরকার আইনটির খারিজ চায় না।
প্রমাণ?
গত ৯ মে, সোমবার সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার বলে, রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের সাংবিধানিক বৈধতা বিচারে আদালতের সময় নষ্ট করার দরকার নেই। কেন্দ্রই এই ভারতীয় দণ্ডবিধির ১২৪-ক ধারা পুনর্বিবেচনা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী সেই কাজ করা যায় এমন যথাযথ জায়গায় বিষয়টি আলোচনা হবে।
আর তার দুদিন আগে একই সরকার কী বলেছিল? গত ৭ই মে, শনিবার কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে হলফনামায় রাষ্ট্রদ্রোহ আইন পুনর্বিবেচনার বিপক্ষে সওয়াল করেছিল কেন্দ্রের বিজেপি জোট সরকার। ১৯৬২’তে সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের বেঞ্চ এই আইনের সাংবিধানিক বৈধতায় সম্মতি দিয়েছিল। সেই রায়ের উল্লেখ করে কেন্দ্র বলেছিল যে পুনর্বিবেচনা অপ্রয়োজনীয়। সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ এই আইন।
‘সময়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ আইন’ সম্পর্কে আটচল্লিশ ঘন্টা পরে কেন্দ্রীয় সরকারের হলফনামায় ছিল নরেন্দ্র মোদীর বানী। নরেন্দ্র মোদীকে উদ্ধৃত করে হলফনামায় বলা হয়েছিল, ‘‘প্রধানমন্ত্রী ঔপনিবেশিক আইনের বোঝা ঝেড়ে ফেলতে তৎপর।…প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে ভারতের উচিত ঔপনিবেশিক বোঝা ঝেড়ে ফেলতে আরও তৎপর হওয়া। এমন বহু আইন বাতিলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী তা করেও দেখিয়েছেন। তিনি নাগরিক স্বাধীনতা রক্ষার পক্ষে, মানবাধিকারকে সম্মান করেন।’’
যে সরকার সবচেয়ে বেশি এই আইনকে ব্যবহার করেছে, তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ‘‘এই আইন ঘিরে বিভিন্ন অংশের বক্তব্য কেন্দ্র বিবেচনায় রেখেছে। নাগরিক অধিকার এবং মানবাধিকার ঘিরে উদ্বেগও কেন্দ্রের নজরে রয়েছে। পাশাপাশি দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় কেন্দ্র দায়বদ্ধ।’’
তারপরই কেন্দ্রের পুরোন আর্জি, ‘‘সরকার পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১২৪-ক ধারার বৈধতা বিচারে আদালতের আর সময় নষ্ট করার দরকার নেই।’’
সুপ্রিম কোর্ট তা স্বীকার করেনি। পরেরদিন সুপ্রিম কোর্ট এই ধারা প্রয়োগের উপর আপাতত স্থগিতাদেশ দিয়েছে।
মোদী সরকারের হলফনামায় চালাকি ছিল। বিশেষজ্ঞরা কেউ কেউ মনে করিয়েছেন যে আদালতে পুনর্বিবেচনার আশ্বাস দেওয়া হয়েছে। আবার আদালতকে সরেও যেতে বলা হয়েছে পুনর্বিবেচনা প্রক্রিয়ার থেকে। অর্থাৎ প্রশাসনিক স্তরে নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রেখে এই কাজ সারার আগ্রহ দেখাচ্ছে মোদী সরকার। নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি দায়বদ্ধতার সঙ্গে অখণ্ডতা এবং সার্বভৌমত্বের শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। বারবার প্রধানমন্ত্রীকে টেনে এনে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছে সরকার নাগরিক স্বাধীনতার প্রশ্নে সংবেদনশীল।
গনতন্ত্র, মানবাধিকারের পরিপন্থী এই আইন। খারিজ চাই ১২৪এ — এটিই মূল এবং একমাত্র দাবি।