সুস্নাত দাশ
সুভাষচন্দ্র বসু ব্যক্তিগত জীবনে প্রবল ধার্মিক ছিলেন, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা তাঁকে কোনদিনও স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী ‘ভারত পথিকে’ সুভাষচন্দ্র লিখেছেন যে ছোটবেলায় ( কটক বসবাসকালে ) মুসলিম প্রধান অঞ্চলে বাস, তাদের সঙ্গে গভীরভাবে মেলামেশা, বন্ধুত্ব স্থাপনের এবং সাংস্কৃতিক দিক থেকে মুসলমানদের কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য সুভাষ চন্দ্রের হয়েছিল। তাঁর ভাষায় —–“ বস্তুত আমার মনে হয় না যে মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়া ছাড়া আর কোনভাবে তাদের নিজেদের চাইতে পৃথক মনে করেছি। “ শুধুমাত্র বাল্য বা কৈশোরেই নয় , রাজনৈতিক জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি তার প্রমাণ দিয়েছেন। ভারতে সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবে ঔপনিবেশিক শাসকদের ভূমিকা সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসুর মূল্যায়ন প্রণিধানযোগ্য। বসুর মতে যদিও মুসলিমরা বাইরে থেকে ভারতে প্রবেশ করে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিল এবং ভারতীয় সংস্কৃতি গ্রহণ করেনি ; তা সত্বেও তারা ভারতের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ইংরেজ শাসনে ভারতীয়রা প্রথম অনুভব করেন তারা বিদেশী শাসনের অধীনে রয়েছে। তবে ভারতবর্ষের সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভবে এবং প্রসারে ঔপনিবেশিক শাসনের রাজনীতি দায়ী হলেও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু নিজেদের দায়িত্বের প্রতি সজাগ ছিলেন।
আত্মসমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, “আজ আমরা সকলেই এই কথা বলিয়া আক্ষেপ করিতেছি যে,ইংরেজ মুসলমানদিগকে হিন্দুর বিরুদ্ধে উত্তেজিত করিয়া দিতেছে। মুসলমানকে যে হিন্দুর বিরুদ্ধে লাগানো যাইতে পারে এই তথ্যটাই ভাবিয়া দেখিবার বিষয়। কে লাগাইল, সেটা তত গুরুতর বিষয় নয়। শনিত ছিদ্র না পাইলে প্রবেশ করতে পারেনা। অতেয়ব শনির চেয়ে ছিদ্র সম্মন্ধেই সাবধান হইতে হইবে।”
সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্যের অপসারণ অর্থাৎ ছিদ্র বন্ধ করে শনি প্রবেশের রাস্তা বন্ধ করতে চিত্তরঞ্জন দাশ আগ্রহী ছিলেন। ঐতিহাসিক বেঙ্গল প্যাক্ট হিন্দু মুসলমান সমস্যা সমাধানে ছিল বলিষ্ঠ পদক্ষেপ। ‘বেঙ্গল প্যাক্ট’ দ্বারা মুসলমানদের নিকট চিত্তরঞ্জন দাশের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পেল। ফলত মুসলিম সমর্থন লাভে তিনি সমর্থ হলেন। তবে বাংলা কংগ্রেসের একাংশ বেঙ্গল প্যাক্টের বিরোধিতা করেছিল। হিন্দু প্রেস হতেও বিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। অপর দিকে মুসলিম সমাজের একাংশও চুক্তির বিরোধিতা করেছিলেন। আঞ্জুমানই মুসলিম নেতাগণ এবং মৌলানা ইসমাইল হোসেন সিরাজী বেঙ্গল প্যাক্ট বিরোধী ছিলেন । তবে কলকাতা খিলাফত কমিটিতে চুক্তির সমর্থনে প্রস্তাব গৃহীত হয়। যদিও বিপিসিসি-র সভায় সিরাজগঞ্জ প্রাদেশিক সভায় বেঙ্গল প্যাক্ট পাশ হয়েছিল; এ আই সি সি র কোকোনদ বার্ষিক সম্মেলনে সর্বভারতীয় স্তরে চুক্তিটি গৃহীত হয়নি। উল্লেখ্য যে চিত্তরঞ্জন দাশের পূর্বেই গান্ধীজী ধর্মীয় বিষয়কে ( খিলাফত) অস্ত্র করে সর্বভারতীয় স্তরে হিন্দু- মুসলমান সহযোগিতা লাভে সচেষ্ট এবং সফল হয়েছিলেন।
উল্লেখ্য যে ১৯২৩ সালের নভেম্বর হতেই চিত্তরঞ্জন দাশের নেতৃত্বে স্বরাজ্য দলের বিপিসিসির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। যা হোক, স্বরাজ্য দল গঠনের পর বঙ্গীয় আইন সভার নির্বাচনে জয়লাভই নয়, আইন সভাতেও দাশ মুসলিম সমর্থন পেয়েছিলেন। দাশের পরবর্তী উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল কলকাতা মিউনিসিপাল কর্পোরেশনের নির্বাচনে জয়লাভ। চিত্তরঞ্জন দাশ মেয়র নির্বাচিত হলেন। স্বভাবতই কলকাতা কর্পোরেশনের কর্মী নিয়োগে বেঙ্গল প্যাক্টের বাস্তব প্রয়োগের বাধ্যবাধকতা এবং চ্যলেঞ্জের মুখোমুখি হলেন দাশ। উল্লেখ্য যে কর্পোরেশনে কর্মী নিয়োগের অধিকর্তা ছিলেন কর্পোরেশনের চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। বলাই বাহুল্য যে ঐ পদে নিয়োজিত হয়েছিলেন দাশের সেনাপতি সুভাষ চন্দ্র বসু। চিত্তরঞ্জন দাশ এবং সুভাষ চন্দ্র বসুর কার্যকালে কলকাতা কপরেশনে মোট ৩৩ টি শুন্যপদে কর্মী নিয়োগ করা হয়। যার মধ্যে ২৫ টি পদে মুসলিমরা নিয়োজিত হয়েছিলেন। বস্তুত মুসলিমরা নিয়োজিত হলেন ৭৫ শতাংশ যা প্রতিশ্রুত ৫৫ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশ বেশি। ফলে দাশ এবং বসুর প্রতি শিক্ষিত মুসলিমদের আস্থা বৃদ্ধি পায়। বেঙ্গল প্যাক্টের বাস্তব প্রয়োগ শুধুমাত্র রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার জন্য নয়, যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গেই সুভাষ চন্দ্র কার্যকারী করেছিলেন। মনে রাখতে হবে আর-এস-এসের জন্মের মাত্র কয়েক মাস আগেই জীবনাবসান ঘটে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের। তারিখটি 16জুন 1925 ছিল । স্বরাজ্য পার্টির দেশবন্ধু অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছিল দেশবন্ধু সুভাষচন্দ্র তার অন্যতম প্রধান ধারক ও বাহক ছিলেন দেশবন্ধুর নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জ সম্মেলন। যার ফলশ্রুতি বেঙ্গল প্যাক্ট বাংলায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মাইলস্টোন ছিল। স্বরাজ্য দল ভারতীয় বুর্জোয়াদের তথা হিন্দু সমাজের বড় অংশের সাংবিধানিক দল হয়ে উঠলেও মুসলমান সমাজের বিশ্বাসযোগ্যতাও তারা লাভ করেছিল। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন, সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন মুসলিম সমাজের গ্রহণযোগ্যতা নেতা। মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, স্যার আব্দুর রহি্ম, জনাব মুজিবুর রহমান, মাওলানা আকরাম খা, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদ, নেতৃত্ব বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদনায় দেশবন্ধুর সহযোগী ছিলেন। বস্তুত বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পাদন করতে গিয়েই স্বরাজ্য দল হিন্দু মহাসভা তথা হিন্দুত্ববাদীদের দ্বারা প্রবলভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এই সময় যুক্তবঙ্গ-এ চরম হয়ে উঠেছিল। ১৯২৫ সালে দেশবন্ধুর মৃত্যুর পর যে বাংলা দাঙ্গাপীড়িত হয়ে উঠেছিল তার জন্য হিন্দু-মহাসভার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি গান্ধীজী পর্যন্ত এক্ষেত্রে হিন্দুত্ববাদী শক্তির কথা মেনে এই সময় হিন্দুত্ববাদীদের চাপেই কলকাতা পৌরসভার মেয়র হিসেবে যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত মেনে নিতে বাধ্য হন; কারণ এই সময় কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে পূর্বেকার ডেপুটি মেয়র হোসেন শহীদ সুরাবর্দী এই পদের জন্য বিবেচিত হতে পারতেন; কিন্তু তার দাবি কে অস্বীকার করে যতীন্দ্রমোহন কে মেয়র করা হয়। মেয়র হওয়ার অব্যবহিত পরেই যতীন্দ্রমোহন শুদ্ধি আন্দোলনের নেতা শ্রদ্ধানন্দ শ্রদ্ধানন্দ নামে শিয়ালদা মির্জাপুর পার্কের নাম পরিবর্তিত করে শ্রদ্ধানন্দ পার্ক রাখেন এটা ছিল দেশবন্ধুর বেঙ্গল প্যাক্টের চিন্তাধারার উপর একটি চরম আঘাত। প্রকৃতপক্ষে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেকার দক্ষিণপন্থী হিন্দু সাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের প্রবল উত্থান এই সময় লক্ষণীয় ছিল। এদের খামখেয়ালিপনায় আর-এস-এসকে সামাজিক ভিত্তি প্রসারে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। দেশবন্ধুর মৃত্যুর পরবর্তী কালে এই সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে জাতীয় কংগ্রেসের অভ্যন্তরে সুভাষচন্দ্র বসুকে তার ভারতে অবস্থান কাল পর্যন্ত লড়াই করে যেতে হয়েছে।
সম্পূর্ণ লেখাটি তিনটি পর্বে প্রকাশিত।
One comment