‘দেশপ্রেমিক’ নাথুরাম,বিক্ষুব্ধ সময়,এবং গান্ধীহত্যা -চন্দন দাস…

৩০ জানুয়ারী ২০২২ (রবিবার)

প্রথম পর্ব

গান্ধীকে হত্যার আগ্নেয়াস্ত্র সরবরাহের দায় একজন উদ্বাস্তুর ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছিলেন গডসে।
গান্ধীহত্যার আগের কয়েকমাস দেশ নিদারুণ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছে। দেশভাগের বেইমানিতে সর্বস্ব হারানো উদ্বাস্তুদের ঢেউ দুই সীমান্তে। আবার ওই সময়কালেই সাভারকারের মহারাষ্ট্র থেকে শ্যামাপ্রসাদের আবাসস্থল পশ্চিমবঙ্গ উত্তাল ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবীদের একের পর এক সংগ্রামে। কামগড় ময়দান যখন পুলিশী বাধা ভেঙে ছাত্র সমাবেশের সাক্ষী হচ্ছে ৩১ ডিসেম্বর, প্রায় তখনই ২১ নভেম্বর, ১৯৪৭ ওয়েলিংটন স্কোয়ার দেখছে ‘জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ এবং তেভাগা আইন পাশের দাবিতে’ কৃষক সমাবেশের সাক্ষী হচ্ছে। যুদ্ধোত্তর কলকাতায় প্রথম শহীদ রামেশ্বরের স্মরণে ছাত্র সমাবেশে উদ্বেল মহানগর। অসীম রায় ‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় লিখছেন — ‘‘নতুন শপথ এসেছে আবার; অস্ফুট কলস্বরে/হাতের মুঠিতে এখনও যখন আগামীর আনাগোনা/ মিলেছি আবার, হয়েছি জমাট একুশে নভেম্বরে।’’
এমন সময়ে গান্ধীহত্যা। ১৯৪৪-এ নয়। ১৯৪৬-এ নয়। ১৯৪৮-র গোড়ায়। দেশ যখন বিক্ষুব্ধ মানুষের আর্তিতে। সোচ্চার সংগ্রামে। তখন, ঠিক তখনই পুনার বাসিন্দা, হিন্দুত্বাবদী নাথুরামকে নাকি পিস্তল জোগালেন দিল্লির এক উদ্বাস্তু!
তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির দাবি অনুসারে যারা ‘প্রকৃত দেশপ্রেমিক’ তাদেরই একজন তিনি — পুরো নাম নাথুরাম বিনায়ক গডসে। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ গডসে পুনা থেকে একটি পত্রিকা প্রকাশ করতেন। নাম — ‘হিন্দুরাষ্ট্র।’ পত্রিকাটির শেষ সংখ্যা প্রকাশিত হয় ১৯৪৮-র ৩০ জানুয়ারি — গান্ধীহত্যার দিন। সেখানে গান্ধীহত্যা এবং পত্রিকার সম্পাদকের গ্রেপ্তারের খবর প্রকাশিত হয়েছিল।


গডসের নেতা বিনায়ক দামোদর সাভারকার গান্ধীহত্যার ৭নং অভিযুক্ত ছিলেন। মোট অভিযুক্ত ছিলেন ১২ জন। বিচারের সময় ৯জন ধরা পড়েন। তাদের একজন দীগম্বর ব্যাজ রাজসাক্ষী হন। ব্যাজ একইসঙ্গে হিন্দুত্ববাদী এবং বেআইনি অস্ত্রের কারবারী ছিলেন। গোয়ালিয়র নিবাসী ৩জন বিচারের পরে, সাজা হবে না বুঝে আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। বিনায়ক দামোদর সাভারকার প্রমাণের অভাবে ছাড়া পান — আইনের চোখে ‘বেনিফিট অব ডাউট’-র বলে।
শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি উত্তরসূরী ছিলেন সাভারকারের, হিন্দু মহাসভায়। নাথুরামকে তিনি জানতেন, চিনতেন। ১৯৪৭-র ৯ আগস্ট দিল্লিতে হিন্দু মহাসভার কার্যকরী কমিটির সভা হয়। সেখানে সভাপতি ছিলেন সাভারকার। সাভারকার, গডসে, নারায়ন আপ্তে একসঙ্গে বিমানে পুনা থেকে দিল্লি গেছিলেন। দিল্লির সভায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিসহ অন্যান্যদের সঙ্গেই হাজির ছিলেন নাথুরাম গডসে, নারায়ন আপ্তে। দীর্ঘক্ষণ তাদের হিন্দু মহাসভার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলোচনা, বিতন্ডা চলে। এ’ কথা নাথুরাম তার জবানবন্দীতে জানিয়েছেন।
নাথুরাম এবং আপ্তে — গান্ধীহত্যায় যাদের ফাঁসি হয়েছিল, তারা এতটাই ঘনিষ্ট ছিল ‘বীর’ সাভারকারের এবং শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিরও খুবই পরিচিত ছিল।
১৯৪৮-র ৩০ জানুয়ারি বিকাল সওয়া ৫টা নাগাদ গুলিবদ্ধ মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর মৃত্যু হয় দিল্লির বিড়লা হাউসে। তাঁকে তিনটি গুলি করা হয়েছিল খুব কাছ থেকে। ঘটনাস্থলেই নাথুরাম গডসে ধরা পড়েন।
১৯৪৮-র ৮ নভেম্বর আদালতে বিশেষ বিচারপতি আত্মাচরণের সামনে গডসে নিজের জবানবন্দী পাঠ করেন। গডসে স্পষ্ট জানান, তিনি রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের কর্মী। একসময় সরাসরি রাজনীতিতে অংশ নেওয়া দরকার মনে করায় তিনি হিন্দু মহাসভায় যোগ দেন। তার ভাই গোপাল গডসের গান্ধী হত্যায় যুক্ত থাকার অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়। ১৯৬৪-তে মুক্তির পরে গোপাল এক সাক্ষাৎকারে জানান, তারা দুই ভাই-ই ছোট থেকে আরএসএস-এ যুক্ত। নাথুরাম ছিলেন আরএসএস-র বৌদ্ধিক প্রচারক। হিন্দু মহাসভায় যুক্ত হয়ে তিনি সাভারকারের অত্যন্ত ঘনিষ্ট ছিলেন। তারা সাভারকারের দ্বারা প্রবল অনুপ্রাণিত ছিলেন। মুম্বাইয়ের(তৎকালীন বোম্বে) শিবাজী পার্কে সাভারকারের বাড়িতে নাথুরামের অবাধ যাতায়াত ছিল। রাজসাক্ষী দীগম্বর ব্যাজের সাক্ষ্য অনুসারে গান্ধীহত্যার ১২দিন আগে ১৭ জানুয়ারি নাথুরাম, তার সহযোগী আপ্তে ‘তাতিয়ারাও’ সাভারকারের সঙ্গে দেখা করে তাঁর আশীর্বাদ দিয়েছিলেন। সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, যাঁর বিরাট মূর্তি নরেন্দ্র মোদী বসিয়েছেন, তিনিও সাভারকারের বিরুদ্ধে গান্ধীহত্যায় যুক্ত থাকার প্রমাণ উড়িয়ে দেননি।

আদালতে নাথুরাম গডসে, নারায়ণ আপ্তেসহ গান্ধীহত্যার অভিযুক্তরা। পিছনে টুপি পরিহিত সাভারকার।

স্বাধীন ভারতের সর্বপ্রথম সংগঠিত চক্রান্তের মাধ্যমে ব্যক্তিখুনের অপরাধ হল মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর হত্যাকান্ড। সেই খুনের ঘটনায় অস্ত্র কিভাবে সংগৃহীত হয়েছিল, তা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। গডসে এই ক্ষেত্রে এক সিনেমাটিক বিবরণ পেশ করেছিলেন। তার দাবি ছিল ২৭ জানুয়ারি, ১৯৪৮-এ তিনি রাতে গোয়ালিয়র পৌঁছোন অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। ২৮ জানুয়ারি হিন্দু মহাসভার একনিষ্ট ডা. পার্চুরের কাছে যান। তিনি বিকালে আসতে বলেন। বিকালে গডসে তার কাছে যান। কিন্তু তিনি সাহায্য করতে পারেননি। বিফল মনোরথ গডসে প্লেনে দিল্লি চলে আসেন। তারপর কী করেন?
গডসে আদালতে জানান,‘‘চরম হতাশা নিয়ে দিল্লি পৌঁছে আমি দিল্লির উদ্বাস্তু কলোনীতে গেলাম। উদ্বাস্তু শিবিরে ঘুরতে ঘুরতে আমার চিন্তাভাবনা একটা স্পষ্ট চূড়ান্ত মোড় নিল। আকস্মিকভাবেই আমার এক উদ্বাস্তুর সঙ্গে দেখা হল — সে অস্ত্রাদির লেনদেন করত এবং আমাকে একটি পিস্তল দেখাল। এটা পাওয়ার জন্য আমি প্রলুব্ধ হলাম এবং তারপর তার থেকে কিনে ফেললাম। এই পিস্তলটাই পরে আমি যে গুলি ছুঁড়েছিলাম তাতে ব্যবহার করেছিলাম।’’
গোয়ালিয়র, মুম্বাই, পুনে — কোথাও অস্ত্র না পাওয়া নাথুরাম গডসে পিস্তল পেলেন ‘আকস্মিকভাবে’ দিল্লির এক উদ্বাস্তু কলোনীতে। একজন উদ্বাস্তু তার মত অচেনা লোককে কিছুক্ষণের মধ্যেই জানিয়ে দিল যে, সে সর্বস্ব হারিয়ে পাকিস্তান থেকে এসে ছ’ মাসের মধ্যে ভারতে অস্ত্রের কারবারী হয়ে উঠেছে। অচেনা এলাকার কয়েক মাসের বাসিন্দা এক উদ্বাস্তু অচেনা গডসেকে একটি পিস্তলও দেখাল!
আদালত এমন কোনও উদ্বাস্তুর সন্ধান পায়নি। কিন্তু গান্ধীহত্যার সঙ্গে উদ্বাস্তু এবং উদ্বাস্তু কলোনীকে জড়িয়ে দেওয়ার এই চেষ্টা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত।
চক্রান্ত শুধু নাথুরামের মস্তিষ্কপ্রসূত নয়। এক সংগঠিত উদ্যোগ তার মাধ্যমে রাখা হয়েছিল। তার জবানবন্দীও আসলে খুব সতর্কতার সঙ্গে তৈরি হিন্দুত্ববাদের এক ঘোষণাপত্র — এক ‘স্যাটানিক ভার্সেস।’ তার সেই জবানবন্দী পড়লে বোঝা যাবে আগামী ভারতে বিভাজনের বীজ পুঁতে রাখার চক্রান্তের প্রায় সব ধরনের উপাদান সেখানে আছে। গান্ধীহত্যার অস্ত্র ‘আকস্মিকভাবে’ উদ্বাস্তু কলোনীতে পাওয়ার আপাত হাস্যকর বিবরণ সেই সুদূর প্রসারী চক্রান্তের অংশ।


সাভারকারকে ‘রক্ষার’ চেষ্টা লাগাতার করে গেছেন গডসে। যদিও রাজসাক্ষী দীগম্বর ব্যাজের বিবরণ থেকে স্পষ্ট গান্ধীহত্যার আগে, ১৭ জানুয়ারি গডসে এবং আপ্তে শিবাজী পার্কে সাভারকারের সঙ্গে ‘শেষ দেখার’ জন্য যান। ব্যাজও ছিলেন। ব্যাজকে নিচে বসিয়ে গডসে, আপ্তে দোতলায় গেছিলেন। সাভারকারের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। সাভারকার তাদের সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন। এবং বলেছিলেন, ‘‘যশ্বসী হৌন ইয়া।’’ অর্থাৎ ‘সফল হও এবং ফিরে এসো।’ গডসে আগাগোড়া সাভারকারের গান্ধীহত্যায় সংযোগ অস্বীকার করেছেন। সাভারকারও আগাগোড়া নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে গেছেন।

গান্ধীজীর মরদেহ

তাৎপর্যপূর্ণ হল তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল ১৯৪৮-র ৬ মে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জিকে একটি এক চিঠিতে জানান যে, সাভারকারকে গান্ধীহত্যার অভিযুক্তদের তালিকায় যুক্ত করার আগে তার বিরুদ্ধে আনা প্রমাণগুলি প্যাটেলকে দেখাতে হবে। তারপর তিনি সাভারকারকে অভিযুক্ত করায় অনুমোদন দেবেন। তার আগে সাভারকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ১৯৪৮-র ৬ মে প্যাটেলকে চিঠি লিখেছিলেন। গান্ধীহত্যার বিচারের চেয়েও শ্যামাপ্রসাদ আকুল ছিলেন সাভারকারের জন্য। লিখেছিলেন,‘‘নিশ্চয়ই এমন কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না যাতে পরে এমন কথা উঠতে পারে যে, তাঁর (সাভারকারের) রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।’’
প্যাটেলেরও দৃঢ় ধারনা হয়েছিল যে, সাভারকার এই চক্রান্তের অংশ। তাই সাভারকার গ্রেপ্তার হন। বিচার হয়। তার আগে আর একবার সাভারকার মুচলেকা দেন জেলজীবন এড়াতে। কিন্তু ১১ মার্চ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
আর শ্যামাপ্রসাদের মনে হয়েছিল — এটা সাভারকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত!
এই ‘বীর’ সাভারকার পূজিত হচ্ছেন আজকের ভারতে। এই শ্যামাপ্রসাদকে মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘অটলজীর মতই অটল।’ ধর্মনিরপেক্ষতা, বহুত্ববাদের আদর্শই এই ভারতে বিপন্ন।
গান্ধীহত্যার প্রায় ৫৫ বছর পরে সেই নয়াদিল্লিতেই আরএসএস-র কার্যালয়ে হাজির হন তৎকালীন বাজপেয়ী সরকারের দপ্তরবিহীন মন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। ২০০৩-র ১৫ সেপ্টেম্বর সেই বই প্রকাশ অনুষ্ঠানে সঙ্ঘের তাবড় নেতাদের সামনে তৃণমূল নেত্রী বলেন,‘‘আপনারা প্রকৃত দেশপ্রেমিক। আমি জানি আপনারা দেশকে ভালোবাসেন। যদি আপনারা ১ শতাংশ সাহায্য করেন, আমরা কমিউনিস্টদের সরাতে পারব।’’

সেদিন গডসে হয়ে গেলেন ‘দেশপ্রেমিক।’ যে দাবি হিন্দুত্ববাদীরা ছাড়া এই দেশে আর কোনও রাজনৈতিক দল করেনি। ব্যতিক্রম মমতা ব্যানার্জি। নাথুরাম-সাভারকারের উত্তরসূরীরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ব্যানার্জিকে সেদিন ‘সাক্ষাৎ দূর্গা’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।

আগামীকাল দ্বিতীয় পর্ব বা শেষ পর্ব…………

Spread the word