সুদীপ দত্ত
মহান মে দিবসের আহ্বান!
গৌরবময় মে দিবসের ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে শিল্প শ্রমিকদের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য যা বিশ্বব্যাপী শ্রমশক্তির মধ্যে একটি আন্তর্জাতিক শ্রেণি চেতনা বিকাশের জনপ্রিয় স্বপ্নকে জোরলোভাবে প্রজ্বলিত করেছিল। অর্থাৎ নিজের জন্য একটি শ্রেণি গঠনের স্বপ্ন । আজ, যখন আমরা মে দিবসের ১৩৮ তম বার্ষিকী পালন করছি, এই আদর্শগত রাজনৈতিক নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা আগের থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
নয়া উদারবাদী পুঁজিবাদ একটি অসমাধানযোগ্য পদ্ধতিগত সংকটের মধ্যে প্রবেশ করেছে। এই সমস্যাযুক্ত কাঠামোর মধ্যে বিশ্বায়ন এবং অর্থের অবিরাম চলাচল ২০০০ সাল থেকে চক্রাকার সংকটের পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। পুঁজিবাদের বিপর্যয়কর পতন থেকে বাঁচতে সংকটের কেন্দ্র এক দেশ থেকে অন্য দেশে স্থানান্তরিত হচ্ছে । সঞ্চয় ও শোষণের পরবর্তী স্থিতিশীল যুগের সন্ধানে, সঙ্কটে জর্জরিত পুঁজিবাদ মরিয়া হয়ে নব্য-ফ্যাসিবাদী পথ ধরছে, শ্রমিক শ্রেণি, মেহনতি জনসাধারণ এবং সারা বিশ্ব জুড়ে প্রতিরোধের সমস্ত প্রগতিশীল শক্তির অঙ্গহানি ঘটাচ্ছে ।
এই দুর্বৃত্ত আন্তর্জাতিক আর্থিক পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করার একমাত্র বস্তুগত শক্তি হল জীবন্ত শ্রম অর্থাৎ সমগ্র বিশ্বের শ্রমিকদের শ্রম। এই সংকট নিরসনে সক্ষম একমাত্র আদর্শ হল সমাজ পরিবর্তনের আদর্শ।
বর্তমান সময়, একটি রূপান্তরমূলক রাজনীতির মাধ্যমেই জাতীয় সীমানার মধ্যে আটকে পড়া শ্রমকে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বান জানায়; বিশ্বকে সংকটে জর্জরিত পুঁজিবাদের কবল থেকে বাঁচানোর কাজ নিয়ে আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণির চেতনা গড়ে তোলার এটাই সময়। আর এটাই এই মে দিবসের অঙ্গীকার: দুনিয়ার শ্রমিক এক হও ! শান্তি ও সাম্যের জন্য এক হও ! সঙ্কটকে সামাজিক পরিবর্তনের চেতনায় রূপান্তরিত করতে এক হও।
দুনিয়া সংকটে আবদ্ধ – প্রকৃতিগত ভাবে সঙ্কট অবশ্যম্ভাবী: আজ যখন আমরা এই মে দিবস উদযাপন করছি, বিশ্ব অভূতপূর্ব দীর্ঘ মন্দা–স্থবিরতা-মুদ্রাস্ফীতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এর তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক পরিণতি হল ফ্যাসিস্টিক উত্থানের সঙ্গে দক্ষিণপন্থী -জনপ্রিয়-কর্তৃত্ববাদের উত্থান। নিঃসন্দেহে এই সমস্ত আক্রমণের জবাব দেওয়াও হচ্ছে বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধ ও বিদ্রোহের বীরত্বপূর্ণ ঘটনা দিয়ে।
এই যুগ কেন্দ্রীভূতকরন, কেন্দ্রীকরণ এবং তীব্র লগ্নিকরনের মাধ্যমে বিশাল একচেটিয়া গঠনের যুগ। বিশ্বের পাঁচটি বৃহত্তম কর্পোরেশনের মিলিত মূল্য আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকা এবং ক্যারিবিয়ানের জিডিপির চেয়ে বেশি। আশ্চর্যজনকভাবে, এখন ক্রমবর্ধমান একচেটিয়া লাভের হার, সুদ, ভাড়া বা দখল-জবরদস্তি থেকে উদ্ভূত রিটার্ন “উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত মুনাফা” কে ব্যাপকভাবে ছাড়িয়ে গেছে। দখলদারিকে ছাপিয়ে গিয়েছে অধিগ্রহণ।
উৎপাদন-সংযুক্ত মুনাফার পতনের সঙ্কট স্বাভাবিকভাবেই প্রতিযোগিতা, স্বয়ংক্রিয়তা এবং মুনাফার দীর্ঘমেয়াদী হ্রাস-বৃদ্ধির দিকে নিয়ে যায়। স্পষ্টতই একে অনুসরণ করে ক্রমাগত কমতে থাকা ভোগ এবং উদ্বৃত্ত পণ্যের বিশাল তালিকা। পুঁজি তার নতুন এবং সস্তা উৎপাদন নিবেশের সন্ধানে পরিবেশের শোষণ এবং ধ্বংসকে তীব্রতর করে চলেছে। পরিশেষে, পুঁজিবাদ উৎপাদন বন্ধ করে এবং শ্রমিকদের হত্যা করে এবং একই সঙ্গে একচেটিয়া সঞ্চয়কে নিয়ন্ত্রণ করে সংকট থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মন্দা ডেকে আনছে ।
অথচ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার এই নিয়মিত সংশোধনী পদ্ধতি হল এক উদ্বেগজনক ধাক্কা যা গত দশকের বাস্তবতা। দীর্ঘতম মন্দা অভূতপূর্ব, অপ্রতিরোধ্য ক্রমবর্ধমান সঞ্চয়ের সাথে সহাবস্থান করেছিল। এটি অবশ্যই এই আধুনিক সংকটের পদ্ধতিগত প্রকৃতির সবচেয়ে সাম্প্রতিক এবং তীব্র অভিব্যক্তি।
এই সংকটে পুঁজির প্রতিক্রিয়া: এরই প্রতিক্রিয়ায় কর্মদিবসকে দীর্ঘায়িত করা , কাজের গতি বৃদ্ধি-প্রসারিত করা , মজুরি হ্রাস, অপ্রতিষ্ঠানিকীকরণ এবং বেকারত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে শোষণের তীব্রতা বাড়ানো হয়েছে । এর সাথে যোগ হয়েছে বেসরকারী একচেটিয়াদের জন্য রাষ্ট্রীয় ভর্তুকি এবং রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলুপ্তি, আরও লাভজনক বিলাস দ্রব্য উৎপাদনের দিকে নয়া উদারবাদী স্থানান্তর, স্বচ্ছল মধ্যবিত্তের সৃষ্টি এবং উন্নয়নশীল দেশের সার্বভৌম ক্ষমতার বিলুপ্তি।
নিঃসন্দেহে এটি পুঁজিবাদের অভ্যন্তরীণ সংকট নয় বরং পুঁজিবাদের ‘সংকট’ । এ এমন একটি সংকট যা সমগ্র অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-নৈতিক-প্রাতিষ্ঠানিক-বাস্তুতান্ত্রিক পরিসরকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করেছে।
যুদ্ধ হল সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠনকারীদের শেষ আশ্রয়স্থল: সংকট মোকাবিলার শেষ পুঁজিবাদী উপায় হল সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন, জোরপূর্বক আদায় এবং শোষণ। সামরিক হুমকি এবং যুদ্ধ, নাশকতা এবং অর্থনৈতিক অবরোধ, সারা বিশ্বের দেশগুলির সার্বভৌমত্ব ও রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে ল্যাটিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপ আমাদের সময়ের মার্কিন নেতৃত্বাধীন সাম্রাজ্যবাদী ভূরাজনীতির নগ্ন উদাহরণ ।
হিংস্র আন্তর্জাতিক পুঁজি সারা বিশ্বে লুটপাট ও নিরীহ মানুষ হত্যার মাধ্যমে তার প্রাণশক্তি চুষে নেয়। এই মে দিবসে, আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণী এই বিশ্বের নাগরিকদের উপর সাম্রাজ্যবাদ দ্বারা সংঘটিত সমস্ত যুদ্ধের বিরুদ্ধে ক্ষোভ নিয়ে জেগে উঠবে; আসুন আমরা পুঁজির বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সমন্বিত সংহতি দ্বারা আক্রমণের পরিকল্পনা করি। মনে রাখতে হবে, যুদ্ধবিরোধী সংগ্রাম বিশ্ব শান্তি ও ঐক্যের মূলমন্ত্র, সারা দুনিয়ার রূপান্তরের পূর্বসূচী!
এই মে দিবসে বিশ্বের শ্রেণিমুখী ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ঐতিহাসিক দায়িত্ব শুধু শ্রমিকদের অর্থনৈতিক অধিকার সুরক্ষিত ও অগ্রসর করা নয়, সংকট-পীড়িত পুঁজিবাদের মৃত্যুঘণ্টা নিশ্চিত করা। সমগ্র ব্যবস্থাকে সমাজতন্ত্রের দিকে রূপান্তরের কাজ!
মার্কিন-ইসরায়েল কর্তৃক বর্বর গণহত্যা: এই প্রেক্ষাপটে, এই মে দিবসে, বিশ্বের শ্রমিকরা প্যালেস্তাইনের শিশু, মহিলা এবং বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে যারা তাদের মাতৃভূমিকে জায়নবাদী আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য বীরের মৃত্যু বরণ করেছে । তাদের প্রতিরোধ স্বাধীনতা, মানুষ এবং মাতৃভূমিকে রক্ষা করার জীবণপণ লড়াইয়ের বিশ্বব্যাপী আশাকে পুনরুজ্জীবিত করেছে।
২০২৩ সালের ৭ ই অক্টোবর থেকে ৩৩০০০ এরও বেশি প্যালেস্তিনীয়কে হত্যা করা হয়েছে এবং হাজার হাজার নিখোঁজ হয়েছে যা ২১ শতকের অন্য যেকোনো বড় সংঘাতকে ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে ১৩,৮০০ জনের বেশি শিশু। জনসংখ্যার ৬০% জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
নেতানিয়াহু জনগণের ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ এবং তার সরকারের নীতির বিরুদ্ধে সাধারণ ধর্মঘট সহ শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনের কারণে প্রচণ্ড চাপের মধ্যে ছিলেন। নিশ্চিতভাবেই, সংকটে জর্জরিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ব্যর্থতার বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও ক্ষোভকে দমন করতে ফ্যাসিবাদী ও বর্বর আক্রমণ চালানো এবং জাতীয় সীমানার ভিতরে ও বাইরে জনগণের মধ্যে বিভাজন বাড়িয়ে তোলা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
এই হত্যালীলাকল্পে শুধুমাত্র ২০২৩ সালেই ইসরায়েলকে ৩.৮ বিলিয়ন ডলার দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র । যা সবমিলিয়ে ১৯৪৬ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে২৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। অন্যদিকে, ভারত এখন ইসরায়েলের অস্ত্র , উন্নত এবং সংবেদনশীল প্রতিরক্ষা (এবং নজরদারি!) ব্যবস্থার সবথেকে বড় গ্রাহক। নিঃসন্দেহে, যুদ্ধ-ব্যবসায়ী কর্পোরেশনগুলি নৃশংস গণহত্যার মাধ্যমেও তাদের মুনাফার লালসায় উন্মত্তভাবে অভিযুক্ত ।
প্যালেস্টাইন আমাদের গর্ব, প্যালেস্টাইন আমাদের আশা: বিশ্বজুড়ে মানুষ অভূতপূর্ব সংহতি এবং এই নৃশংস হামলার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। গাজায় ইসরায়েলি বোমাবর্ষণের ১০০ দিন পূর্তি উপলক্ষে, সমস্ত মহাদেশের ৪৫ টি দেশের ১২০ টিরও বেশি শহরে প্রতিবাদ কর্মসূচী হয়েছে।
হাজার হাজার প্যালেস্তিনীয়দের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্কের পুনর্নির্মাণ করছে, বিশেষ করে আরব দেশগুলোর মধ্যে এবং তার চারপাশকে কেন্দ্র করে। এখন, আমাদের আরও বেশি সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ক্রোধ নিয়ে ও আন্তরিকতার সঙ্গে জেগে ওঠার সময় – বিশ্বের শ্রমিক শ্রেণি তাদের দেশের সরকারগুলির উপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করবে এবং তাদের মার্কিন-ইসরায়েল সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করবে এটা মুক্ত কণ্ঠে ঘোষণা করা যাক ! প্যালেস্টাইন মুক্ত হোক ! যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি চাই ! মার্কিন-ইসরায়েলের সঙ্গে অস্ত্র ব্যবসায় নিয়োজিত সমস্ত কর্পোরেশন অন্য সব দেশে নিষিদ্ধ করা উচিত।
মার্কিন-ন্যাটো শক্তিকে প্রতিরোধ করুন, যুদ্ধ বন্ধ করুন! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সর্বদা বিশ্বজুড়ে তাদের অর্থনৈতিক-সামরিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে। যদিও নতুন বিকশিত ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায়, ইউক্রেনে ন্যাটোর সাম্প্রতিক মরিয়া আগ্রাসনে রাশিয়া কড়া জবাব দিয়েছে। দীর্ঘ যুদ্ধ এবং রাশিয়ার উপর আরোপিত একতরফা মার্কিন নিষেধাজ্ঞার ফলে সারা বিশ্বে খাদ্য, জ্বালানি এবং আর্থিক সঞ্চালনে ব্যাপক ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
এই অস্থির ভৌগলিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে মার্কিন শক্তি ও অস্ত্র সংস্থাগুলো নৃশংস উপায়ে দেশ ও জনগণকে লুটপাট শুরু করে। ইউএস এনার্জি ফার্ম এক্সন মবিল ২০২৩ সালে ৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি রেকর্ড- পরিমান দ্বিগুণ মুনাফা করেছে। বিডেন প্রশাসন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ইউক্রেনকে ৭৫ বিলিয়নের বেশি মার্কিন ডলার মঞ্জুর করেছে এবং আমেরিকার শীর্ষ পাঁচটি অস্ত্র ব্যবসাদার ২০২২ সালে ১৯৬ বিলিয়ন ডলার মুনাফা অর্জন করেছে।
ইউক্রেন-ন্যাটো দ্বন্দ্ব অপরিশোধিত তেলের দাম বাড়িয়েছে। লোহিত সাগরে ইসরায়েলি গণহত্যার প্রতিক্রিয়ায় পাল্টা আক্রমণ ইতিমধ্যেই মালবাহী চার্জের ৪০% বৃদ্ধি ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। বিশ্বের ৩০% কন্টেইনারের মাধ্যমে ১২% বিশ্ব বাণিজ্য এই অঞ্চলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। আমেরিকার সঙ্গে ইউরোপও নিরাপদ নয়!
আমরা এই মে দিবসে বিনামূল্যে বা কম খরচের জ্বালানির দাবি করি! মার্কিন আগ্রাসন এবং অস্ত্র বাণিজ্য বৃদ্ধি বন্ধ হোক, মারাত্মক অস্ত্র বর্জন হোক। রাষ্ট্রীয় বাজেট অত্যাবশ্যকীয় জনস্বার্থে এবং সামাজিক নিরাপত্তায় ব্যয় হোক।
মার্কিন ডলার – অর্থনৈতিক মারণাস্ত্র: ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে পরাজিত করতে, মার্কিন প্রশাসন ২০০০ অমানবিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল। তারা রাশিয়ার ৬৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাজেয়াপ্ত করেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই জঘন্য কাজটি বিশ্বব্যাপী শঙ্কার ঘণ্টা বাজিয়েছে যে অন্যান্য দেশের ডলার রিজার্ভের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটতে পারে।
এর ফলে রাশিয়া ও চীনের মধ্যে আরও দৃঢ় সমন্বয়, চীন ও সৌদি এবং চীন ও ভিয়েতনামের মধ্যে চুক্তি, ইরান ও সৌদির মধ্যে যুদ্ধবিরতি, আরব লীগ কর্তৃক সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হয়েছে।
এই দ্বিপাক্ষিক, বহুপাক্ষিক অর্থনৈতিক প্রচেষ্টা ডলারমুক্ত বাণিজ্য চুক্তিতে একটি বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করছে যার ফলে ডলারের রিজার্ভ (৫০% এর নিচে) ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। মজার ব্যাপার হল, মার্কিন বা আইএমএফ ঋণের ঝুঁকি ও সীমাবদ্ধতা দেশগুলোকে চীনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে; চীনের সার্বভৌম ঋণ ২০১২ সালে ৩৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে ২০২২ সালে ৯৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হয়েছে। নিঃসন্দেহে, এটি ক্রমবর্ধমান ডি-ডলারাইজেশনের দিকে নিয়ে যাচ্ছে এবং সোভিয়েত-পরবর্তী বিশ্বায়িত বিশ্বের মার্কিন নেতৃত্বাধীন একমুখী ব্যবস্থাকে ভেঙে দিচ্ছে।
এই দ্রুত পরিবর্তনশীল ভূ-রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিশ্ব শ্রমিক শ্রেণিকে তাদের কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। আমরা রাষ্ট্র এবং জনগণের উপর ডলারের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক অর্থ পুঁজির আধিপত্য এবং কর্তৃত্ব রোধ করার জন্য সার্বভৌম আর্থিক নিয়ন্ত্রণ নীতির দাবি জানাই। এই মে দিবসটি হবে মার্কিন ডলারের নৃশংস অস্ত্রায়ন এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন আর্থিক নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে শক্তিশালী সমন্বিত প্রতিক্রিয়ার সূচনা! জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও স্বায়ত্তশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্বের শ্রমিকদের ক্রমবর্ধমান সংহতি সমুন্নত রাখাই লক্ষ্য !
মানুষ সর্বদাই প্রথম লক্ষ্য: বড় কর্পোরেশনগুলি মহামারী থেকে কর্পোরেট পুনরুদ্ধারের জন্য প্রদত্ত উৎসাহী প্যাকেজগুলি ব্যবহার করেছে এবং মূল্যস্ফীতিমূলক পরিবেশের সুযোগ নিয়ে তাদের মূল্য এবং মুনাফা বাড়িয়ে একটি “লোভস্ফীতির”(greedflation) দিকে নিয়ে গেছে! ২০২২ সালে বিশ্বের মুদ্রাস্ফীতি ৮.৭৫ শতাংশে পৌঁছেছে।
মুদ্রাস্ফীতি দমন করার জন্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত অর্থনীতিগুলি সুদের হার বাড়িয়ে আরও মন্দার ব্যবস্থা সৃষ্টি করেছে। এর ফলে পাঁচটি মার্কিন ব্যাংক এবং ক্রেডিট সুইসের পতন ঘটে। অন্যদিকে, অনুন্নত বা উন্নয়নশীল অর্থনৈতিক দেশগুলিতে মূল্যস্ফীতি আকাশচুম্বী। সবচেয়ে বেশি দাম বৃদ্ধি হয়েছে খাদ্য, বাসস্থান, শক্তি এবং পরিবহন ক্ষেত্রে। এর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ সারা বিশ্বে ১২৫ টিরও বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
উন্নত অর্থনীতির মন্দা নিয়ন্ত্রণেরর পদক্ষেপগুলি বিশ্বব্যাপী বৃদ্ধিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। উন্নত অর্থনীতিতে, ঋণ-ও জিডিপি অনুপাত ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১১৩% হতে চলেছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই খুব কম করে দাঁড়াবে সর্বোচ্চ ১২৩%। নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশগুলি এখন থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে ঋণ পরিশোধের জন্য প্রতিদিন প্রায় অর্ধ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিতে বাধ্য হবে যা তাদের সামাজিক নিরাপত্তা ব্যয়ে মারাত্মক হ্রাস ঘটায়।
কোন ভালো কাজ নেই! ২০২২ সালের প্রথম তিনমাসে আনুমানিক মোট বৈশ্বিক কর্মঘণ্টা ২০১৯ সালের শেষ তিনমাসের স্তরের থেকে ৩.৮% এর নিচে ছিল। ২০২২ সালের প্রথমার্ধে বিশ্বব্যাপী মাসিক মজুরি (–) ০.৯ শতাংশে নেমে এসেছে। কম বেতনের অনানুষ্ঠানিক কর্মসংস্থান এবং মজুরি শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি এমএসএমইগুলির ব্যাপক ধ্বংসের পিছনে বড় কারণ।
সারা দুনিয়ার এই নয়া উদারবাদী কার্যক্রম, বিনিয়োগ ও বাণিজ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব রয়েছে। জি ২০-এর অধিকাংশ দেশে প্রকৃত মজুরি কমেছে। অত্যন্ত দরিদ্র শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিক মন্দার দ্বারপ্রান্তে এবং আরেকটি দুনিয়া ব্যাপী আর্থিক সংকট অনিবার্য।
নিম্ন-উৎপাদনশীল এবং পরিকাঠামোগত ক্ষেত্রে বিনিয়োগের প্রবণতা রয়েছে (অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সরকারের রাজস্ব থেকে) যার ফলে সামগ্রিকভাবে ধীরগতিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বেসরকারি উৎপাদনশীল ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী বিনিয়োগের প্রবণতা কম।
আরেকটি বৈশিষ্ট্য হ’ল অনিশ্চিত কর্মসংস্থান যেখানে ম্যানুফ্যাকচারিং, নির্মাণ, আইসিটি(Information and Communication Technology),পরিষেবা, পরিবহন বা খুচরা কাজের মতো প্রয়োজনীয় সেক্টরে নিয়োগ কম। তার উপরে, ৪০% কর্মঘণ্টা এবং ৩০% কর্মচারী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) দ্বারা প্রতিস্থাপনের প্রক্রিয়া দ্রুত গতিতে করা হচ্ছে।
দুনিয়ার ৫৮% শ্রমজীবী মানুষ অস্থায়ী বা স্বনিযুক্ত।২০২৪-২৫-এ শ্রমের বাজারে অংশগ্রহণ আরও কমবে, বাড়বে বেকারত্ব । এমনকি আইএলও ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে শ্রমবাজারে অংশগ্রহণের হার ২০২৪ এবং ২০২৫ সালে হ্রাস পাবে, বিশ্বব্যাপী বেকারত্ব ২ মিলিয়ন বৃদ্ধি পাবে।
অবশ্যই, বিশ্ব পুঁজিবাদ মানুষের উপর দাসত্ব চাপিয়ে দিতে মরিয়া। মেহনতি জনগণের সকল অংশের সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়াই বিশ্বব্যাপী শ্রমিক শ্রেণির কাজ। মধ্যবর্তী সময়ের মধ্যে অনেকগুলি মুখোমুখি লড়াইয়ের মাধ্যমে সম্ভাব্যতা প্রতিফলিত হয়। আমাদের এই সমস্ত সংগ্রামকে আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির উপর সমন্বিত আক্রমণে একীভূত করতে হবে – এই পুঁজিবাদী আবর্তের মধ্যে সংকটের কোন প্রতিকার নেই।
নিয়মতান্ত্রিক সঙ্কটের কবলে পড়েও কেন এই ব্যবস্থাটা ভাঙছে না? সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন উঠছে: কেন মারাত্মকভাবে সমালোচিত হয়েও পুঁজিবাদী ব্যবস্থা নিজে থেকে ভেঙে পড়ছে না? গ্লোবাল সাউথের লাগামহীন লুট হচ্ছে সংকটে জর্জরিত আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজির বেঁচে থাকার শেষ ব্যবস্থা। আইএমএফ-বিশ্বব্যাঙ্ক নিয়ন্ত্রিত অর্থের অবাধ প্রবাহের সাথে যুক্ত হয়েছে দেশের সীমান্তের তোয়াক্কা না করে পণ্য ও পুঁজির নিয়ন্ত্রণমুক্ত চলাচল।
অথচ, শ্রম জাতীয় সীমানার মধ্যে উল্লেখযোগ্যভাবে সীমাবদ্ধ ছিল। আন্তর্জাতিক শ্রম-বাজার খণ্ডিত এবং গ্লোবাল-উত্তর এবং গ্লোবাল-দক্ষিণে শ্রমশক্তির দামের মধ্যে একটি বিশাল ব্যবধান রয়েছে যা ঐতিহাসিকভাবেই ঔপনিবেশিক সময়ের মজুরি পার্থক্যের প্রতিনিধিত্ব করে।
এই বৈশিষ্ট্যটি উৎপাদন এবং পরিষেবা শিল্পগুলিকে বৈশ্বিক দক্ষিণে স্থানান্তরিত করেছে যখন পুঁজির রাজধানী কেন্দ্রগুলি বৈশ্বিক উত্তরে কেন্দ্রীভূত হয়েছে। সারা দুনিয়ার জনসংখ্যার মাত্র ২১% সহ, পৃথিবীর উত্তরের দেশগুলি ৬৯% ব্যক্তিগত সম্পদের আবাসস্থল।
তাই এইসব পণ্যের ব্র্যান্ডভ্যাল্যু যোগ হয় উত্তরের কর্পোরেটদের নামে । মধ্যস্তরীয় উৎপাদন আর এসেম্বলিং চলে সাউথে আর ফিনান্স পুঁজির নির্দেশে এখানাকার শ্রমিকদের ওপর নেমে আসে অমানবিক শোষণ, দুঃসহ জীবনযন্ত্রণা । ধ্বংস করা হতে থাকে ক্ষুদ্র-মাঝারি উৎপাদন, যাতে কাজের বাজারে মেলে আরও সস্তার শ্রম । উল্টোদিকে নর্থে শুরু হয়েছে ডি-ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশন ও কর্মী ছাঁটাই । সংকটের ঘনীভবনের সাথে সাথে উন্নত দেশেও হঠে যাচ্ছে সকল সামাজিক সুরক্ষা । অসন্তোষ রাজপথে ফুটতে শুরু করে। অবশ্যই, বিদ্যমান সাম্রাজ্যবাদ এই মৌলিক দ্বন্দ্বগুলোর সমাধান করতে পারবে না।
এরপরেও মনে রাখতে হবে পুঁজিবাদ কখনই আপনা-আপনি ভেঙে পড়বে না। বৈশ্বিক দক্ষিণের শ্রমিকদের উচিত উত্তরের সঙ্গে তাদের সংগ্রামকে একীভূত করা। মূল্য শৃঙ্খল, পণ্য এবং কোম্পানির বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত উৎপাদনের বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের সংগঠিত করতে হবে এবং পুঁজির মাথায় আঘাত করার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে আন্দোলনগুলি করতে হবে – সাপটিকে তার দেহের সমস্ত সন্ধিতে আঘাত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক মে দিবস আজকের থেকে এত বেশি তাৎপর্যপূর্ণ কখনই ছিল না! জোরে আঘাত করুন, পুঁজির শৃঙ্খল ভেঙে দিন, এর সমস্ত পালানোর পথ অবরুদ্ধ করুন, বর্বর পুঁজিবাদী একাধিপত্যকে উৎখাত করুন।
ভারত, বৈশ্বিক দক্ষিণের প্রতিনিধি হিসাবে: মোদি সরকারের বিজ্ঞাপনের বিপরীত, ভারতের অর্থনীতি এবং জনগণের বাস্তবতা ভয়াবহ। ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২৫০০ মার্কিন ডলার, যেখানে চীন ১৩,০০০ মার্কিন ডলার। আশ্চর্যজনকভাবে, ২০২৩ সালে খরচ বৃদ্ধির জিডিপি ৩% বৃদ্ধি পেয়েছে(consumption GDP)। ইউএনডিপি অনুমান করেছে যে ১৬% ভারতীয় হতদরিদ্র যারা প্রতি মাসে ১২০০ টাকার কম উপার্জন করে। নীচের ৫০% জনসংখ্যার হাতে রয়েছে মোট সম্পদের মাত্র ৩%। শিশুদের মধ্যে, ৩২.১% কম ওজনের, ৩৫.৫% শিশুর বিকাশ রুদ্ধ। ৫০% এরও বেশি মহিলা রক্তাল্পতায় আক্রান্ত।
বেকারত্বের হার এখন ৮%। এটি দুর্ভাগ্যজনকভাবে অত্যন্ত বেশী; এখানে তাদের বিবেচনায় নিচ্ছে না যারা “নিরুৎসাহিত কর্মী প্রভাব” এর কারণে কাজের জন্য রিপোর্ট করেন না। ২৫ বছরের কম বয়সী ৪২.৩% স্নাতক বেকার। ২০-৩৪ বছর বয়সের মধ্যে বেকারত্বের হার খুব বেশি। স্ব-নিযুক্ত ব্যক্তিদের ভাগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি (৫৭.৩%) যাদের আয় প্রতি মাসে১০০০০ টাকার কম। এই সব বেকার বা কর্মহীন মানুষ ক্ষুদ্রঋণের ফাঁদে পড়েছে।
ব্যাঙ্ক আমানত এবং নগদ সহ পরিবারের আর্থিক সম্পদ গত বছরের ৭.২% থেকে ২০২৩ সালের মার্চে শেষ হওয়া অর্থবছরে জিডিপির ৫.১% তে নেমে এসেছে। অন্যদিকে, পারিবারিক ঋণ FY23-এ GDP-এর ৫.৮%- বেড়েছে, (স্বাধীনতার পর থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বার্ষিক বৃদ্ধি)। ভারত ক্রমশই অপুষ্টি এবং দারিদ্র্যের কারণে আত্মহত্যার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
লাগামহীন মুদ্রাস্ফীতির আঘাতে জনগণের অবস্থা আরও অধঃপতন হয়েছে যা এখনও ৫.৫% এর উপরে এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান খাদ্যে (বিশেষ করে ডাল ও শাকসবজি) এটি ৭.৭% । ভারতে গণতন্ত্রের অবস্থা, তথ্য ও জ্ঞানের ব্যবহার খুবই খারাপ। অর্থনৈতিক বৈষম্যের ক্ষেত্রে, ভারতে ২০২২-২৩ সালে ২২.৬% আয় এবং ৪০.১% সম্পদের অধিকারী শীর্ষ ১% মানুষ। যা আসলে ব্রিটিশ রাজের তুলনায়ও অনেক খারাপ।
ভারতের বৈশিষ্ট্য; আমাদের সামনে কাজগুলি: আগে ভারতের জনগণের সামগ্রিক অবস্থার কিছু আলোচনা হয়েছে। তবে এর কিছু বিশেষত্বও রয়েছে এবং এর পরে রয়েছে সুনির্দিষ্ট কাজ।
গণতন্ত্র বাঁচাতে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে বাঁচান: মোদি সরকার জাতীয় মনিটাইজেশান পাইপলাইন এবং অন্যান্য বিভিন্ন ধারার মাধ্যমে বেসরকারি কর্পোরেশনগুলিকে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র উপহার দিচ্ছে। নিশ্চিতভাবেই, এটি ভবিষ্যত কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষমতাকে ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্বকে ধ্বংস করবে এবং এই পরিকাঠামোর উপর নির্ভরশীল নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলবে। শ্রমিক শ্রেণির প্রতিরোধকে দুর্বল করার জন্য, মোদি সরকার চুক্তিভিত্তিক বা নির্দিষ্ট মেয়াদি কর্মী নিয়োগের মধ্য দিয়ে স্থায়ী শ্রমিকদের ব্যাপকভাবে প্রতিস্থাপন শুরু করেছে।
ঐতিহাসিকভাবে বেসরকারীকরণ শ্রমিক শ্রেণীর সাংগঠনিক শক্তি হ্রাস করে। যেহেতু শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন গণতন্ত্র রক্ষার প্রাথমিক শর্ত, তাই এটা বলা যায় যে ফ্যাসিবাদী উত্থানের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র অপরিহার্য।
সুতরাং, আমাদের সামনে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক কাজটি হল চুক্তিভিত্তিক কর্মীদের সংগঠিত করা এবং তাদের আন্দোলনকে মূলধারার আন্দোলনের সাথে একীভূত করা। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ও গণতন্ত্রকে বাঁচানো। আমরা আমাদের জাতীয় সম্পদের কর্পোরেট দখলকে প্রতিহত করার জন্য শ্রমজীবী জনগণ এবং মেহনতি জনগণের সমস্ত অংশকে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বাঁচাতে, গণতন্ত্র এবং ভারতের উৎপাদন ও পরিষেবা সংস্থাগুলির সামাজিক মালিকানা রক্ষার আন্দোলনের অংশ হওয়ার আহ্বান জানাই।
প্রসঙ্গতঃ আমাদের দেশের ৯৫% শ্রমজীবী মানুষ অসংগঠিত ক্ষেত্র বা অনির্দিষ্ট শ্রমসম্পর্কে যুক্ত । রয়েছেন বিশাল অংশের পরিযায়ী শ্রমিকেরা । এদের ভয়াবহ বাস্তবিক দুরাবস্থার সুযোগ নিয়ে ফ্যাসীবাদী শক্তি নিজস্ব বাহিনীতে পরিণত করার চেষ্টা করছে । এদের সজাগ, সংগঠিত করতে হবে শ্রমিক মহল্লায়, গ্রামে বা বস্তিতে । তার জন্য প্রয়োজন বৈপ্লবিক বীক্ষা নিয়ে এদের মধ্যে সৎ দীর্ঘকালীন প্রচেষ্টা, শ্রমিকশ্রেণিকে সমাজের সব ক্ষেত্রের প্রকৃত লিডার হিসাবে প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম । প্রয়োজন বিবিধ আর্থিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক হস্তক্ষেপ যাতে শ্রমজীবী মানুষ সমাজের সব অংশের দায়িত্ব বহনের নিজস্ব সব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে পারেন । আজকের মে দিবসে এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে ভারতের শ্রমিক শ্রেণি ।
নিঃসন্দেহে আজকের ভারতে শ্রমিকশ্রেণির সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মতাদর্শের । কেন্দ্রের কর্পোরেট-হিন্দুত্ব পরিচালিত পরচিতি স্বত্ত্বার রাজনীতি থেকে অর্থ বা পেশীশক্তি, ধর্মীয় উন্মাদনা থেকে উগ্র-জাতীয়তাবাদ নানাভাবে হামলা করছে শ্রমিকশ্রেণির বেঁচে থাকার লড়াইয়ের দিশা, ক্ষমতা আর ইচ্ছাকে । স্বাধীন ভারতের সবচেয়ে জনবিরোধী দেশবিরোধী এই সরকার গত ১০ বছর ধরে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এদেশের শ্রমিক, কৃষক, সাধারণ মানুষের বিরূদ্ধে । আক্রমণ এসেছে আর্থিক, রাজনৈতিক, সামাজিক সর্বক্ষেত্রের ওপর, দলিত হয়েছে আধুনিক বৈচিত্রময় ভারত-অবধারণা ।
কাজেই এই মে দিবসে ভারতের শ্রমিক শ্রেণি আরও একবার শপথ নেয় কেন্দ্রের এই সরকারকে চলতি নির্বাচনে টেনে নামানোর । ভারতের শ্রমিক শ্রেণির ঐতিহাসিক ভূমিকার প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেই তা সম্ভব, সমাজ পরিবর্তনের মতাদর্শ-রাজনীতির দ্বারাই তা সম্ভব । শ্রমিক-কৃষক ও সমাজের সব পিছিয়ে থাকা অংশের ঐক্যবদ্ধ লড়াই ভারতে নিয়ে আসবে নতুন এক সকাল – এই মে দিবস আরও আন্তর্জাতিক আরও প্রাসঙ্গিক তাই আজ ।
অনুবাদ : সুমিত গাঙ্গুলি