Site icon CPI(M)

ভালোবাসি মাতৃভাষা – ভালোবাসি বিশ্বজনের মাতৃভাষা : মানবেশ চৌধুরি

২১ শে ফেব্রুয়ারী ২০২৩ ( মঙ্গলবার)


দ্বিজাতি তত্বের মধ্যযুগীয় পশ্চাৎপদ মতাদর্শের ষড়যন্ত্রে ভারত যে ভাগ হয়ে গিয়েছিল, সেটা একটা নিদারুণ ঘটনা।
দেশভাগ পরবর্তিকালে বাংলার যেদিকটা পূর্ব দিকে পড়ল, যার নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান, সেই পঞ্চান্ন হাজার বর্গমাইল ভূখণ্ডেই বাস করতেন বাংলাভাষীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ। তার অধিকাংশ মানুষ সম্প্রদায় হিসাবে মুসলমান। বেশিরভাগই দরিদ্র ও সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ।।
অল্প কিছু সমাজ বিচ্ছিন্ন উর্দুভাষি মানুষ ছাড়া, বেশির ভাগ বাঙ্গালী মুসলমানের কেউ পড়তো মক্তব–মাদ্রাসায়। পাঠশালা–মাধ্যমিক বিদ্যালয়-কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়েও অল্প সংখ্যক। আর বেশিরভাগই ছিল নিরক্ষতার তিমিরে।
মুসলিম লিগ, পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকে এই ভূখণ্ডের বিরাট অংশের রিক্ত ব্রাত্য মুসলমান মানসে, পাকিস্তান হলে সব হবে, এই আশাবাদ জাগিয়ে তুলতে সক্ষমপর হয়েছিল।

কিন্তু মোহভঙ্গ হতে বেশি সময় লাগলো না। বঞ্চনা ও প্রতারণা দেখে প্রশ্ন উঠল – এ কেমন পাকিস্তান! সুখ-স্বপ্ন সব যে চুরমার হয়ে যাচ্ছে! কী হলো এতো লড়াই করে! সব ফাঁকা।
ভূখণ্ডটায় পুঁজিবাদী-সামন্তবাদী শোষণ তো থাকলোই। কিন্তু এতো শুধুমাত্র সেই শোষণই নয়। রাজধানী ঢাকা, বানিজ্যকেন্দ্র নারায়ণগঞ্জ, বন্দর শহর চট্টগ্রাম, সব মূল মূল জায়গায় – পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিদের রমরমা। আর চাকরি, পড়াশুনা সব ক্ষেত্রেই সারা পুর্বাপাকিস্তান জুড়েই, পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রাধান্য। এবং এসব শাসকের ষড়যন্ত্রে।
উর্দু উর্দু ব’লে শোরগোল উঠলো – তার আসল মানে হলো পূর্ব বাংলার বেবাক মানুষকে গোলাম বানিয়ে রাখা।
কিন্তু এর মধ্যে মুসলমান মধ্যমিত্ত মানসেও বিরাট পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে! তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগছে, মাতৃভাষা ছাড়া সব বিকাশই তো বন্ধ!। অস্তিত্বটাই তো বিপন্ন! অতএব মাতৃভাষা বাংলার জন্য নতুন বোধ গড়ে উঠছে মানসে – বাংলা কোন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভাষা নয়, একটা ভূভাগের, একটা জনগোষ্ঠীর ভাষা। সে জনগোষ্ঠীর মধ্যে হিন্দু আছে, মুসলমান আছে, বৌদ্ধ আছে, খ্রিষ্টান আছে।
পাঠক, একটা হিসাব মনে রাখবেন। উর্দুও কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা নয়। পুষতু, বেলুচি, পাঞ্জাবী ও সিন্ধি – এই চারটি মুখ্যভাষা। আর সমগ্র পাকিস্তানের মাত্র ছয় ভাগ কথা বলতো উর্দুতে। সমগ্র পাকিস্তানের চুয়ান্ন ভাগ মানুষ বাস করতো পূর্বপাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলায়।। তাদের আবার পঁচানব্বই ভাগের মুখের ভাষা বাংলা।
অতএব উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ফতোয়াটা মামার বাড়ির আবদারেরই সমতুল। কিন্তু একটু আগেই যে বলেছি, সমস্ত ক্ষেত্রকে পশ্চিম পাকিস্তানের ধনাঢ্যদের অধীনস্ত ক’রে রাখবার জন্যই উর্দু নিয়ে এই জোরজুলুম। কখনও ধর্মের নাম দিয়ে গেলানোর চেষ্টা, কখনও ব্যাটনের গুঁতো মেরে গেলানোর চেষ্টা।


এরকম বৈষম্য-বঞ্চনার কারণে পূর্ব পাকিস্তানের জনমনে ক্ষোভ জমতে থাকে। মাঝে মাঝেই ঘটে তার বিষ্ফোরণ।
কিন্তু শাসক শক্তির ষড়যন্ত্রে উপেক্ষিত হতে থাকে ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠান, উপেক্ষিত হন রবীন্দ্রনাথ, উপেক্ষিত হন নজরুল। ফতোয়া জারি হয়, আরবি হরফে বাংলা হরফ লিখতে হবে।
কিন্তু এসব চক্রান্ত-ষড়যন্ত্রের বিপ্রতীপে প্রতিরোধও তো প্রথম থেকেই শুরু হয়ে গিয়েছে। বাংলা ভাষা আর আত্মনিয়ন্ত্রনের অধিকারের সংগ্রাম সমার্থক হতে শুরু করেছে। যাদেরকে কিছুটা পরিমানেও আযাদের একটা আয়েস আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, তাদেরও মোহমুক্ত হতে সময় লাগছে না। প্রকৃত ধার্মিক মুসলমানেরাও বলতে শুরু করেছেন – কে বলেছে বাংলা ইসলাম প্রচারে বাধা হবে? বাংলাভাষার লালিত্য গুনেই পাঠান মোগল যুগে ইসলামের প্রসার ঘটেছে। তাই ধোপে টিকছে না কোন ভাবেই, ওদের ফতোয়া।
১৯৫১ সালের মার্চ মাসেই কুমিল্লায় কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সভায় ড. শহিদুল্লাহ বলেছিলেন – “বাংলা ছাড়া অন্যভাষা চাপানো হ’লে বিদ্রোহ করতে হবে।’’ সেই সময়েই ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলো।
চলতে থাকলো মুক্তবুদ্ধির প্রসার, অসাম্প্রদায়িক চেতনার নানারকম অনুষ্ঠান। হ’তে থাকলো প্রবল উৎসাহে রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল জন্মজয়ন্তী পালন। তার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে দমননীতি আর অন্যায় অধ্যাদেশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চারিদিকে শ্রমিক কর্মচারী শিক্ষকদের রুটিরুজির ধর্মঘট হরতালও চলতে থাকলো।
তবুও ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেবের – “উর্দু, উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা’ – চিৎকৃত হুঙ্কারের মধ্য দিয়ে ওদের যে আগ্রাসন শুরু হয়েছিলো, সেই হুঙ্কার আরও বেড়ে গেলো।
পরে এলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার পল্টন ময়দানের সভায় তিনিও ফতোয়া জারি করলেন –“উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা”।

এই হুংকারের বিরুদ্ধেই ৩১শে জানুয়ারি ১৯৫২ ঢাকার বার লাইব্রেরি হলে একটি সর্বদলীয় কর্মী পরিষদ গঠিত হলো। সেই সভা থেকে বাংলা ভাষার জন্য শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দেবার শপথ নেওয়া হলো।
কিন্তু তবুও আবার ৩রা ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন সাংবাদিক সম্মেলনে একই হুঙ্কার ছাড়লেন – “আমি সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে চলেছে, আর কোন ভাষা নয়। এই ব্যাপারে যিনি আপনাদিগকে বিভ্রান্ত করতে চান, তিনি পাকিস্তানের দুশমন।“
সারা পূর্ব্ব বাংলাই তো হ’য়ে ছিল একটা দাহ্য পদার্থ বিশেষ। ৩রা ফেব্রুয়ারি খাজা সাহেবের এই দম্ভোক্তি অগ্নিতে ঘৃতাহূতি দিল। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ দাবিতে সারা পূর্ব পাকিস্তান উত্তাল হয়ে উঠলো।
১৯৪৯ সালের মার্চ এপ্রিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীরা তাঁদের অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়ার যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাই তার মুখপাত্র ছিলেন। তাঁদের মধ্যে একারণে পারস্পরিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। আর আমরা দেখেছি, তখন থেকেই বাংলা ভাষার আন্দোলন বৃহত্তর মেহনতি গণতান্ত্রিক মানুষের সমর্থন পেতে থেকেছে। কিন্তু তখন তা ছিল উন্মেষ কালের ব্যাপার। আর এই পর্যায়ে তা হয়ে গেল সবার আন্দোলন। সামনের সারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মরণপাগল মরণজয়ী ছাত্র সমাজ।
৪ঠা ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাস্তায় ১০ হাজার ছাত্র-ছাত্রীর বিশাল মিছিল সংঘটিত হলো। ঢাকা ছাড়াও চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, খুলনা, রাজশাহী প্রভৃতি স্থানেও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো। অন্যদিকে দেশে তখন তীব্র খাদ্য সংকট, তীব্র লবন সংকট। তার বিরুদ্ধেও আন্দোলন শুরু হলো।
“ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সর্বদলীয় কর্মী পরিষদ” ২১শে ফেব্রুয়ারি সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিল। শাসকও ১৪৪ ধারা জারি করলো। ছাত্র সভায় ১৪৪ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবির আন্দোলনের প্রধান ঘটনাস্থল তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবন ও মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আসেপাশের জায়গা থেকে, কার্ফু উপেক্ষা করে ছোট ছোট দলে মিছিল এগিয়ে চলেছে। হঠাৎ গুলি। প্রথমে শহীদ হলেন জব্বার আর রফিক। এর পরের ঝাঁকের গুলিতে বরকত। ২২শে ফেব্রুয়ারি আবার হরতাল, আবার মিছিল। আবার গুলি। জায়গায় জায়গায় সেনা বাহিনীর বাধা। দোকানদার ঝাঁপ বন্ধ ক’রে, কর্মচারী অফিসের চেয়ার ছেড়ে এসে মিছিলে সামিল হলেন। ২১ শে ও ২২ শে ফেব্রুয়ারি গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদত্ব বরণ করেছিলেন পূর্বোক্তরা ছাড়াও, শফিক, শফিউর রহমান, অহিউল্লাহ, আউয়াল সহ নাম না জানা আরও কয়েকজন।এই ভাষা আন্দোলনে সাধারণ মানুষের ব্যাপক যোগদান ঘটেছিল। তাতেই তার মহনীয়তা।
আন্দোলন আরও বেগবান হলো। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”র আন্দোলনের সঙ্গে সমগ্র অধিকারের দাবিসনদ যুক্ত করে শুরু হলো তীব্র গণ আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দিদের মুক্তি চাই, লিগশাহীর অবসান চাই – এসব শ্লোগানের ধ্বনিতে প্রতিধ্বনিতে সারা পূর্ব বাংলা উদ্বেল-উত্তাল হয়ে উঠলো।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার মান্যতা দিতে বাধ্য হলো শাসক শ্রেণী।


আন্দোলন সংগ্রামের ঝড়ো অনেকগুলি ধাপ পেরিয়ে ১৯৭১’এ স্বধীনতার সংগ্রামের উপপ্লবের সৃষ্টি হলো। লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত হলো স্বাধীনতা। প্রাণের কি অমিত শক্তি! কি অমেয় সুষমা!

আমরা সকলেই জানি, পৃথিবীর প্রায় ছয় হাজার ভাষাগোষ্ঠীর মধ্যে বাংলা ভাষাগোষ্ঠীর মানুষের সংখ্যা পঞ্চম স্থানে। এই ভাষায় পঁচিশ কোটির বেশি মানুষ কথা বলে। চীনা, ইংরাজী, হিন্দি, স্পানিস – ‘এর পরেই বাংলাভাষীর বাস এই গ্রহে। এবং এটা স্বীকৃত, বাংলা একটি মহৎ ভাষা। গুণমানের বিচারে বাংলাভাষা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাগুলির অন্যতম।
ভাষা আন্দোলনে বিজয় থেকে রাষ্ট্র গঠনের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিজয়ী হয়েছে বাংলাদেশ। ১৯৯২ সালে যে বার একুশে ফেব্রুয়ারি বিশ্বমাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি পেল – সেবার তারা স্লোগান দিয়েছে – “ভালোবাসি মাতৃভাষা/ ভালোবাসি বিশ্বজনের মাতৃভাষা”। এই লেখক তার সাক্ষি।

নিজস্ব ভাষা ছাড়া, সংস্কৃতি ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না। নিশ্বাস নেওয়া ও ছাড়াটা যেমন স্বাভাবিক, এছাড়া যেমন আমাদের প্রান অচল হয়ে যাবে, তেমনই মাতৃভাষাটাও ভালো ভাবে শেখা, জানা ও রক্ষা করাটাও জরুরি। কৃত্রিমভাবে অন্যভাষা দিয়ে কী দৈনন্দিন জীবন চালানো সম্ভব!
এ বংলায় বাংলাভাষা বেশ বিপন্ন। বিশেষ করে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিদ্যমান আবহে।
যদিও এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা লেখালেখি ইত্যাদি হচ্ছে। কিন্তু বাংলাভাষায় লেখাপড়া, অফিস-কাছারির কাজকর্ম, ছাপানো ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে বাংলা শব্দ আরও বেশি ব্যবহার হলে বাংলা ভাষার বিকাশ অনেক সহজ হয়ে যাবে।
তাই এপার বাংলাতেও বাংলাভাষা রক্ষা করার সংগ্রামটা শুধু আবেগের ব্যাপার নয়। এ এক প্রয়োজণীয় কৃত্য।

অন্য ভাষাগোষ্ঠির প্রতি সম্মান রেখেই এ কাজটা আমাদের করে যেতে হবে। কারণ, আমাদের স্লোগান – ‘ভালোবাসি মাতৃভাষা / ভালোবাসি বিশ্বজনের মাতৃভাষা’।

Spread the word