দখলের ১১ বছর: তৃণমূলের নরক গুলজার,মমতার সব ভাষ্যের হার, জিত সেই বামপন্থারই – চন্দন দাস

৫ জুন, ২০২২ (রবিবার)

দ্বিতীয় পর্ব

গ্রামের দশা? সর্বনাশা।
কেমন? রেশনের উদাহরণ দেওয়া যাক।
১কোটি ১৪ লক্ষ গ্রাহকের কার্ড রাজ্য সরকার গত আট মাসে ‘নিষ্ক্রিয়’ করেছে। তাঁদের মধ্যে ৫৪ লক্ষ মারা গেছেন, ১৪ লক্ষ ‘ডুপ্লিকেট’ — এমনই দাবি রাজ্য সরকারের। এই ৬৮ লক্ষ গ্রাহকের বরাদ্দ চাল, গম ভোগ করেছেন তৃণমূল নেতারাই। এখন রেশন-আধার লিঙ্কের পরে সেগুলি রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু তারপরও প্রায় ৪৬ লক্ষ গ্রাহক আছেন, যাঁরা রেশন পাচ্ছেন না। এদের সিংহভাগ গ্রামবাসী।


তৃণমূল সরকার রেশনে খরচ কমাতে চাইছে। কোপ পড়ছে গরিব মানুষদের উপর। তাঁদের সিংহভাগ স্বভাবতই গ্রামবাসী।
আরও আছে। একশো দিনের কাজের প্রকল্প। কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যের চলতি আর্থিক বছরের লেবার বাজেট এখনও অনুমোদন করেনি। অভিযোগ দেদার চুরির। ভুয়ো মাস্টার রোলের। প্রতিবছরের টাকা আগের বছরের বকেয়া মেটানো অভ্যাসে পরিণত করেছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার। কেন্দ্রীয় সরকার টাকা পাঠানো বন্ধ করেছে। দায় — তৃণমূলের লুটের। ভুগছেন কারা? গরিব গ্রামবাসীরা।

রাজ্য মূলত কৃষিনির্ভর — এটিই এখনও চালু ধারনা। তবে তা কতদূর ঠিক, তা বিচার করার সময় এসে গেছে। দেশের কৃষি কৃষক এবং জমির পরিস্থিতি সম্পর্কে জাতীয় নমুনা সমীক্ষার(এনএসএস)-র ৭৭তম রাউন্ডের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। নমুনা সমীক্ষার হিসাবে রাজ্যে গ্রামে বসবাসকারী পরিবার ১ কোটি ৫২লক্ষ ৬৯ হাজারের বেশি। তার মধ্যে প্রায় ৫৭% আদৌ কৃষিনির্ভরই নন। বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পনীতির ভিত্তি গড়ে উঠছিল ক্রম পরিবর্তিত এই গ্রামীণ চরিত্রের উপর। কৃষক পরিবারের নতুন প্রজন্ম চাষে আগ্রহী হচ্ছেন না। ‘ভালো লাগে না’ বলে নয়। চাষে আয় মারাত্মক কমছে। মমতা-শাসনে তা আরও মারাত্মক চেহারা নিয়েছে। কারন — ফসলের দাম পাচ্ছেন না কৃষক। মমতা ব্যানার্জির কৃষক বাজার ফসলের বিপণনে কোনও সুবিধা করে দিতে পারেনি। সরকারি হারে ফসল বিক্রি করতে পারছেন না কৃষকরা। ফড়েদের দাপট মমতা-শাসনে লাগাতার বেড়েছে।
তাই জাতীয় নমুনা সমীক্ষার রিপোর্ট বলছে, রাজ্যে কৃষিজীবী পরিবারগুলির মাসে গড় আয় ৬,০৮৪টাকা। কিন্তু তার মধ্যে ফসল বিক্রী করে আয় ১১২৬ টাকা। অর্থাৎ ফসল বিক্রী করে মোট আয়ের ১৮.৫% উপার্জন করে কৃষিজীবী পরিবার।
কৃষকের কাছে ফসল বিক্রি আর মুখ্য আয় নয়। জীবনধারনের জন্য তাঁদের অনেক বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে অন্য কাজে। মূলত বিভিন্ন কাজে থেকে পাওয়া বেতন, মজুরিই তাদের প্রধান ভরসা। অর্থাৎ কাজের খোঁজে ঘুরছেন কৃষিজীবী পরিবারের সদস্যরাও। কেউ ভিন রাজ্যে ছুটছেন। কেউ অন্য কাজ করছেন।


রাজ্যে প্রতি মাসে চাষের জন্য গড়ে কৃষকের খরচ হয় ২৮৮৪ টাকা। তুলনামূলক আলোচনায় দেখা যাচ্ছে ২০১৩-তে রাজ্যে কৃষিজীবী পরিবারের মাসিক গড় খরচ ছিল ১৮১৯ টাকা। ছ’ বছরে চাষের খরচ বেড়েছে প্রায় ৫৯%। আর ফসল বিক্রী করে কৃষকের আয় বেড়েছে ১৩%। ফসল বিক্রী করে কৃষিজীবীদের মাসিক গড় আয়ের থেকে চাষের তাঁর মাসিক খরচ অনেক বেশি। নমুনা সমীক্ষা থেকে স্পষ্ট — কৃষক ফসলের অভাবী বিক্রী করছেন। প্রতিমাসে ফসল থেকে কৃষিজীবী পরিবারের গড় লোকসান ১৭৫৮ টাকা।
অভাবী বিক্রী ৬ বছরে বেড়েছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে চাষের খরচ। যা মূলত কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের নীতির কারনে হয়েছে। এই প্রশ্নে রাজ্যের তৃণমূল সরকার চুপ। ২৭শে ধর্মঘটের এটি অন্যতম বিষয় পশ্চিমবঙ্গে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি এখনও পর্যন্ত সে সম্পর্কে নিজের অবস্থান ঘোষণা করেননি।


কৃষকের ফসল উৎপাদনের ক্ষেত্রে খেতমজুরের জন্য মাসে খরচ হয় গড়ে ১০৮৪ টাকা — খরচের তা ৩৬.৬%। সারের জন্য ৬১৫ টাকা — ২১.৩%। বীজের জন্য ২৫৭ টাকা — ৮.৯%। বিদ্যুতের জন্য ১১টাকা। ডিজেলের জন্য ৪৮ টাকা। সেচের জন্য ২৩৪ টাকা। ২০১৩-তে সারের জন্য খরচ হত ৩৯৭ টাকা। বীজের জন্য খরচ হত ১৬০ টাকা। খেতমজুরের জন্য খরচ হত ৬৪৬ টাকা। দেখা যাচ্ছে শতাংশের হারে খেতমজুরের মজুরির জন্য কৃষকের খরচ ৬ বছরে বেড়েছে ১%-র কিছু বেশি। কিন্তু সার, বীজের জন্য খরচ বেড়েছে অনেক।
সব মিলিয়ে কৃষকের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে রাজ্যে। যদিও মমতা ব্যানার্জি দাবি করছেন যে, তাঁর শাসনে কৃষকের আয় তিন গুণ হয়েছে। মোদী দাবি করছেন দ্বিগুণ হচ্ছে। দুটিই ধাপ্পা।
কিন্তু যে কথা বামফ্রন্ট বলেছিল তাই সত্যি প্রমাণিত হচ্ছে — চাষের থেকে আয় কমছে। চাই বিকল্প কাজ, উপার্জনের উপায়। গত ১১ বছরে সেই রাস্তায় কোনও উন্নতি ঘটাতে পারেননি মমতা ব্যানার্জি। কাজের সুযোগ তৈরি হয়নি — গ্রামের শ্রমজীবী, যুবকরা ভিন রাজ্যের শস্তা শ্রমে পরিণত হয়েছেন।
সবচেয়ে আক্রান্ত? গরিব। তাঁদের বেশিরভাগ হয় তফসিলি, নয়তো আদিবাসী, ওবিসি কিংবা সংখ্যালঘু। এরাই সমাজের ৭৩%। দুর্নীতির ফলে ক্ষতিগ্রস্ত সবচেয়ে বেশি তাঁরাই।


উদাহরণ? এসএসসি-র নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি।
তৃণমূলের নেতাদের ঠিক করে দেওয়া ‘রেট’ — প্রাথমিক স্কুলে চাকরির দাম ১২ লক্ষ টাকা। এসএসসি-র মাধ্যমে চাকরির দর ১৬লক্ষ টাকা, গ্রুপ সি-র জন্য ১২লক্ষ টাকা এবং গ্রুপ ডি-র জন্য ১০ লক্ষ দর। এই টাকা দেওয়ার ক্ষমতা আছে শুধু গ্রাম, শহরের নব্য ধনীদের। টাকা দিয়ে চাকরি কেনার দলে গরিব আদিবাসীরা নেই। নেই তফসিলিদের বড় অংশ। নেই রাজবংশী, মতুয়ারাও। নেই সংখ্যালঘুরাও — বিশেষত গ্রামের এবং শহরের বস্তিবাসী মুসলমানরা। অর্থাৎ তৃণমূলের ‘টার্গেট’ গ্রুপ সামাজিক, আর্থিকভাবে পিছিয়ে থাকা ৭৩%-র বাইরের অল্প কিছু অংশ। সেখানেও সবার পক্ষে টাকা দিয়ে চাকরি কেনা সম্ভব হচ্ছে না।

গ্রামোন্নয়নের প্রায় প্রতিটি পর্যায়ে কমিশন, তোলা দিয়েছেন যারা, তারা এই অত্যন্ত গরিব অংশ নয়। এই গরিব সরকারি সুবিধা পাচ্ছেনই না। প্রমাণ? রাজ্য সরকারের উদ্যোগে তৈরি বিশ্বব্যাঙ্কের রিপোর্ট।

দখল এখন, এই রাজ্যে এক মাত্র সত্য।
২০১৫’র গত ৩০শে এপ্রিল রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির স্বশাসনে হস্তক্ষেপ প্রসঙ্গে বলেন, ‘‘একশো বার স্বাধিকারে হাত দেব। মাইনেটা তো আমিই দিই।’’ মানে, নিয়মনীতি নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় মর্জিই নিয়মপদ্ধতি। তৃণমূল কংগ্রেসের দাপটে সরে যেতে হয়েছে একের পর এক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে। কলেজের ছাত্র সংসদ তছনছ করে তৃণমূল কংগ্রেসের দুষ্কৃতীদের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
বামফ্রন্ট সরকার লোকায়ুক্ত গঠন করেছিল রাজ্যে। তৈরি হয়েছিল আইন। সেই আইন বদলে দিয়েছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার। দিনটি ছিল ২০১৮’র ২৬ জুলাই। নতুন আইনে মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনার অধিকার কেড়ে নিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। সেদিন বিলের পক্ষে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘‘আমি টোটো পার্টি নই। আমাদের নিজস্ব মতামত আছে। সেই অনুযায়ী আমরা আইন সংশোধন করে নিচ্ছি। কাল আপনাদের মেজরিটি এলে (বিধানসভায়) তখন আপনারা আইন সংশোধন করে নেবেন।’’
কী দম্ভ! আসলে প্রশ্নহীন কর্তৃত্বের লালসা।
কিন্তু কেন? কারণ সেদিনই ওই বিলের সাহায্যে যে কোনও দুর্নীতির অভিযোগের আওতা থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন ‘সততার প্রতীক’ মমতা ব্যানার্জি!
সম্প্রতি বাংলা আকাদেমির পুরস্কার দখল করেছেন মমতা ব্যানার্জি। প্রতিটি সরকারের আওতাধীন প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হতে বিধানসভায় বিল আনতে চলেছেন তিনি। রাজ্যে মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশনের মত প্রতিটি স্বশাসিত সংস্থার দখল নিয়েছে তৃণমূল। এই দখলের পিছনে একটিই লক্ষ্য — ভাষ্য থাকবে একটিই। তা শাসকের। মমতা ব্যানার্জির। গনতন্ত্রের প্রতিটি প্ল্যাটফর্মের দখল থাকবে তৃণমূলের পথে।

পঞ্চায়েত ভোট ২০১৮ – রাজ্য জুড়ে তৃণমুলী দুষ্কৃতীদের ভূমিকার খণ্ডচিত্র


উদাহরণ হতে পারে ২০১৮’র পঞ্চায়েত নির্বাচন।
সেবার নির্বাচনের আগেই ৩৪% আসনে তৃণমূল কংগ্রেস কোনও বিরোধী প্রার্থীকেই মনোনয়ণ জমা দিতে দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেস। ৯টি জেলা পরিষদে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করেছিল তৃণমূল কংগ্রেস। এছাড়া ভোটগ্রহণের আগেই ৩৪১টির মধ্যে ১২৫টি পঞ্চায়েত সমিতি এবং ৩৩৪৩টি পঞ্চায়েতের মধ্যে ১১২৫টি গ্রাম পঞ্চায়েত শাসকদল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দখল করে ফেলেছিল। যে জায়গায় ভোটের সুযোগ ছিল, সেখানে জেলা পরিষদের আসনগুলির ৯৪% তে মমতা ব্যানার্জির দল জিতেছিল। কারন — ব্যাপক ছাপ্পা, বুথ দখল করেছিল মমতা ব্যানার্জির দল। মানুষ ভোটই দিতে পারেননি। বিরোধী প্রার্থীদের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাই করতে দেওয়া হয়নি। প্রার্থীপদ দিতেই পারেননি বেশিরভাগ। রাজ্যের পৌরসভাগুলিকেও এই ভাবে গত ১১ বছরে করায়ত্ব করেছে মুখ্যমন্ত্রীর দল।
এই ক্ষেত্রে দখল কেন? মূলত দুটি কারনে। প্রথমত, লুটের পথে কোনও বাধা না রাখতে। দ্বিতীয়ত, কোনও সমালোচনাকে সহ্য না করতে। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের যে গনতান্ত্রিক পথ পশ্চিমবঙ্গে বিস্তৃত, মসৃণ হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে, তাকে ধ্বংস করাই মমতা-শাসনের অন্যতম কর্তব্য হয়ে উঠেছে।

মমতা ব্যানার্জির ঘোষিত ‘সাফল্য’ সম্পর্কে মমতা ব্যানার্জিই সন্দীহান। তাই গায়ের জোরে দখলের চেষ্টা।

এই নিদারুণ দাসত্ব কায়েমের তৃণমূলী চক্রান্তের সুযোগ নিয়েছে হিন্দুত্ববাদীরা।
মমতা ব্যানার্জির শাসনে রাজ্যে প্রবলভাবে মাথা তুলেছে আরএসএস। তাদের শাখা বেড়েছে। বিভিন্ন সংগঠন তৈরি করে তারা কাজ করছে রাজ্যে। রাজ্য সরকারের অনুমোদন পেয়ে রাজ্যে বেড়েছে সঙ্ঘের স্কুল। গত ১১ বছরে রাজ্য দেখেছে একাধিক দাঙ্গা — বসিরহাট, আসানসোল, উলুবেড়িয়াসহ অনেকগুলি জায়গায়। তৃণমূলের নেতারা রামনবমীতে নেচেছেন অস্ত্রহাতে। পুলিশের মাধ্যমে দূর্গাপুজোয় এক আর্থিক বছরে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা দিয়েছে সরকার। ২০১৯-র লোকসভা নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু মুসলমানদের ‘দুধ দেওয়া গোরু’ হিসাবে বর্ণনা করে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং হিন্দুত্ববাদীদের উসকানি দিতে সুযোগ করে দিয়েছেন। লোকসভা এবং বিধানসভায় অনেকগুলি আসন পেলেও বিজেপি তবু সুবিধা করে উঠতে পারেনি। মুকুল রায়, বাবুল সুপ্রিয়, অর্জুন সিংয়ের মত একাধিক বিজেপি নেতা তৃণমূলে ফিরছেন। তৃণমূল তাদের সাদরে বরণও করছে। কারন প্রধানত দুটি — তৃণমূল এবং বিজেপি-র আর্থিক নীতি, রাজনৈতিক অবস্থানে বিশেষ কোনও তফাৎ নেই। তা অনেকটা জনমানসে স্পষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত, কাজ এবং গনতন্ত্র — গত ১১ বছরে যে দুটি বিষয়ে লাগাতার আন্দোলন গড়ে উঠেছে রাজ্যে, সেখানে তৃণমূলের মুখোমুখি বিজেপি কোনও চ্যালেঞ্জ হিসাবে হাজির হতে পারেনি।
১১ বছর সুস্পষ্ট ভাবে প্রমাণ করেছে — পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থাই একমাত্র পথ।

Spread the word

Leave a Reply