সূর্যকান্ত মিশ্র
ভারতের প্রথম স্বাধীনতার সংগ্রাম হয়েছিল ১৮৫৭ সালে। মার্কসই প্রথম ব্যক্তি যিনি ১৮৫৭’র সংগ্রামকে ভারতের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধ বলেছিলেন।
স্বাধীনতা কাকে বলে?
একটা ব্যাপক গণ আন্দোলন যার প্রভাবে চলতি সমাজব্যবস্থার মৌলিক পরিবর্তন ঘটে, তাকেই আমরা স্বাধীনতা সংগ্রাম বলি। ভারতীয় সমাজব্যবস্থার কি কোনো পরিবর্তন ঐ লড়াইতে হয়? না, এটাই হল সেই ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ যার আলোকে এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোটা প্রেক্ষাপটকে বিচার করতে হয়। ঐ প্রেক্ষাপটেই ইতিহাসের ধারা বেয়ে জাতীয় কংগ্রেসের আন্দোলন, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম, গান্ধীজির নির্দিষ্ট ভূমিকা এবং সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের নির্মাণ বিবেচনা করতে হবে।
এই প্রবন্ধের পরিসরে তার সবটা আলোচনা করা সম্ভব না। আমাদের দেশে সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে ওঠার ঠিক আগের পর্যায়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে সমাজতান্ত্রিক চেতনার ধারাবাহিক উন্মেষ কিভাবে ঘটেছিল সেই নিয়েই আমরা মূল আলোচনার পরিসর সীমিত রাখবো। এই নির্দিষ্ট পর্যায়ের ইতিহাসকে মনে রাখার কারণ হল বিচ্ছিন্নভাবে ভারতের বুকে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে উঠেছে এমন চিন্তাধারাকে পরিহার করে ইতিহাস নির্দিষ্ট পথ পরিক্রমাকে জানা, বোঝা এবং উপলব্ধি করা।
ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস চর্চায় মূলত দুটি ধারা রয়েছে। এদেশে আধুনিক মনস্ক তার শিকড় সন্ধানে একপক্ষীয় রা বলেন ব্রিটিশদের হাত ধরেই ভারতে আধুনিক যুগের সূচনা হয়েছে। ইতিহাস চর্চার জাতিয়তাবাদী ধারা এই পক্ষেরই অন্তর্গত। এরই বিপরীতে রয়েছে আরেকটি বক্তব্য, এরা বলেন ঔপনিবেশিক শাসনের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সম্পদের লুন্ঠন - আর কিছুই না। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস বুঝতে আমাদের মনে রাখতে হবে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের মধ্যেকার যুদ্ধ সম্পর্ক। ঐ যুদ্ধে ফ্রান্স জিতলে ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনের ইতিহাস কিছুটা হলেও অন্যরকম হতে পারত। প্রাক ঔপনিবেশিক ভারতে সমাজ বিকাশের ইতিহাস মূলত কোন অংশের ভারতে প্রথম শুরু হয় (উত্তর নাকি দক্ষিণ ভারত) সেই নিয়েও কিছু বিতর্ক আছে। এই প্রবন্ধের পরিসরে আলোচনার সুবিধার্থে সেই প্রসঙ্গে আমরা যাব না। শুধু মনে রাখতে হবে এদেশে সামন্তবাদী কাঠামো (এশিয়াটিক মোড অফ প্রোডাকশন বলে মার্কস যে সমাজ ব্যবস্থার কিছু সুনির্দিষ্ট চরিত্রের কথা লিখেছিলেন) বহুযুগ ধরে প্রায় অপরিবর্তিত থেকেছে। পরে অবশ্য বিভিন্ন বামপন্থী ঐতিহাসিক সেই আলোচনাকে আরো এগিয়ে নিয়ে গেছেন। মার্কসের হাতে প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য ছিল না, সেই সুযোগ থাকলে উনি ঠিক কি মন্তব্য করতেন সেকথা অন্য আলোচনার বিষয়। প্রাক ব্রিটিশ শাসন পর্বে গ্রামীণ ভারতের সামন্ত প্রভুদের সাথে বহু লড়াইয়ের ইতিহাস আছে। এইসব লড়াই সংগ্রামে কৃষক সমাজ উল্লেখযোগ্য সংগ্রাম গড়ে তুললেও মূল সামাজিক কাঠামো খুব বেশি বদলায় নি।
ব্রিটিশরা ভারত শাসনে একটি নির্দিষ্ট কৌশল গ্রহণ করে। ১৮৫৭ সালের সংগ্রামে তার প্রতিফলন দেখা যায়। মার্কস কেন এই লড়াইকে প্রথম স্বাধীনতার যুদ্ধ বলে চিহ্নিত করলেন সেকথা বুঝতে হবে। এই লড়াইয়ের ব্যাপ্তি ছিল ইতিপূর্বে সংগঠিত সমস্ত বিদ্রোহের চাইতে অনেক বেশি। ইংরেজ সেনাবাহিনীতে মূলত কৃষক পরিবার থেকেই সেপাই নিযুক্ত হতেন। তাদের সাথে বিদ্রোহের আগুনে যুক্ত হলেন দেশীয় রাজন্যবর্গেরা। এরা কারা? নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপি- এরাই ছিলেন তৎকালীন ভারতে সামন্তবাদী শাসনের শীর্ষে থাকা ব্যাক্তিবর্গ। রাণী লক্ষ্মী বাইয়ের ক্ষেত্রেও সেই বিবেচনা প্রযোজ্য। একদিকে কৃষক সমাজ থেকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করতে যাওয়া সেপাই, দেশীয় সামন্ত রাজা আরেকদিকে জনগণের একটি অংশ। ঠিক এখানেই এই সংগ্রামের ভূমিকা। ব্রিটিশরা বহু চেষ্টা করেও লড়াইতে যুক্ত সংগ্রামীদের মধ্যে হিন্দু মুসলমানের ধর্মীয় বিভাজন প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি। ব্রিটিশদের উচ্ছেদ করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকেই নিজেদের শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে লড়াই চলেছিল।
একদিকে ১৮৫৭ সালের সংগ্রাম আমাদের দেশে স্বাধীনতার সংগ্রামে এক নজির সৃষ্টি করল, আবার সেই সঙ্গে আন্দোলনের সীমাবদ্ধতাকেও তুলে ধরল। ব্রিটিশ শাসনের উপলব্ধি হল জনসাধারণের মধ্যে ধর্মীয় বিভাজন না করে শাসনকার্য পরিচালনা সম্ভব নয়, আরেকদিকে তারা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রণয়ন করল। এই ব্যবস্থা কার্যত এদেশের সামন্ত শাসনের সাথে ঔপনিবেশিক শোষণের এক বোঝাপড়া। জনগণের লড়াই সংগ্রামকে দুর্বল করে উপনিবেশ থেকে ব্যাপক সম্পদের লুট নির্বিঘ্ন রাখতেই এমন বন্দোবস্ত করা হয়।
১৮৫৭ ' র আগে বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে বহু কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস রয়েছে। এইসব বিদ্রোহের লক্ষ্য ছিল সামন্তপ্রভু, রাজা, নবাবদের অত্যাচারের নিরসন। সামাজিক কাঠামোর কোনো মৌলিক পরিবর্তন কিংবা শ্রেণী শোষণের যে ভারসাম্য বহুদিন ধরে চলে আসছে তাকে পাল্টানোর কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ১৮৫৭’র যুদ্ধে যে সামন্তবাদী শাসক গোষ্ঠী মুক্তিসংগ্রামের সহযোগী শক্তি ছিল তারাই পরবর্তীকালে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবে ব্রিটিশদের পক্ষে চলে যায়। সামাজিক কাঠামোর মৌলিক বৈশিষ্ট যে সামন্তবাদ, তাকে উচ্ছেদের লক্ষ্যে কোনও সংগ্রাম তখনও গড়ে ওঠেনি। এই প্রেক্ষাপটেই ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা, তাদের ঐতিহাসিক দায় ও ইতিহাস নির্দিষ্ট কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হওয়াকে বিচার করতে হবে।
ব্রিটিশ বিরোধী লড়াই হত্তয়া সত্বেও ১৮৫৭ সালের যুদ্ধ সমাজকে সামনের দিকে এগোনোর দিশা দেখায় নি। কার্যত দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর হয়ে ওঠেন ভারতীয় সমাজের বহু পুরানো কাঠামোর প্রতিনিধি। দেশের প্রায় সকল প্রান্ত থেকে বেশ কিছুটা সমর্থন এলেও সমাজের সব অংশের মধ্যে এই লড়াই গণবিক্ষোভ কিংবা গণ আন্দোলনের পর্যায়ে উন্নীত হয় নি। এর পরেও দীর্ঘদিন স্বাধীনতার লড়াই সমাজ পরিবর্তনের কর্মসূচি ব্যতিরেকেই ব্রিটিশ বিরোধিতায় একনিষ্ঠ থেকেছে।
এমন সময়েই ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। এই দলে একদিকে যেমন সামন্ত শাসকেরা ছিলেন, তেমনই ছিল ব্যাবসায়ী, বেনিয়া - বুর্জোয়া সমাজের প্রতিনিধিরা। এদেরই প্রাধান্যের ফলে জাতীয় কংগ্রেস এক দীর্ঘ সময় জুড়ে আন্দোলনের নামে ব্রিটিশদের সাথে সহযোগিতার পথেই হেঁটেছিল। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করা হত। এমন সময়ই দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে মহাত্মা গান্ধী ভারতে ফিরে এসে কংগ্রেসে যুক্ত হলেন। গান্ধীর নেতৃত্বে দেশের জনগন জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার মঞ্চ হিসাবে নতুন কংগ্রেসকে খুঁজে পেলেন। যদিও সামন্তবাদী শাসনের পরিবর্তন, জমিদার বনাম কৃষকের লড়াই এবং সামগ্রিক অর্থে গোটা সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সবশেষে স্বাধীনতার প্রসঙ্গে গান্ধীজির নিজস্ব অবস্থানের ফলে অচিরেই অনেকে হতাশ হলেন। তারই প্রতিফলন দেখা গেল জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের ধারায়। ভগৎ সিংহ, মাস্টারদা সূর্য সেন এরা সকলেই নতুন করে অন্য পথে এগোনোর সিদ্ধান্ত নিলেন। যদিও একটা সময় অসহযোগ আন্দোলন ও খিলাফতের লড়াইয়ের মাঝে ঐক্য নির্মাণ করে গীতা দেশের বুঝে ব্যাপক আশার সঞ্চার হয়েছিল। চৌরিচৌরার ঘটনায় আন্দোলন প্রত্যাহার করে নিতে চাইলে মানুষের মনে স্বাধীনতার সম্ভাবনার প্রতি যে ইতিবাচক মনোভাব তৈরি হয়, তাকে নষ্ট করে দেওয়া হল। হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিকথায় এই ঘটনার অসাধারণ বিবরণ পাওয়া যায়।
তাত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে গান্ধীজির আন্দোলন এমন এক মধ্যপন্থা, যার প্রভাবে জনগণের মনে স্থানুভাব গড়ে ওঠে। ভবিষ্যতের ভারত, তার সমাজ কেমন হবে সেই প্রশ্নে বহু ক্ষেত্রেই গান্ধীবাদী দর্শন এক অদ্ভুত অবস্থান নেয়। এসবের মাঝেই কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যে থেকেই সমাজতান্ত্রিক ধারণার প্রতি আকৃষ্ট হলেন।
এই পর্বের সময়টা মনে রাখা জরুরি। তখনও লেনিনের নেতৃত্বে তৃতীয় আন্তর্জাতিক বা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠন হয় নি। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নিজেকে সোশ্যালিস্ট আন্তর্জাতিক বলে চিহ্নিত করেছিল। ভারত থেকে দাদাভাই নৌরজী, মাদাম ভিকাজী কামা’রা সেই আন্তর্জাতিকের সাথে যুক্ত ছিলেন। সেই সময় সোশ্যালিজমের যে ধারণা প্রচলিত ছিল তার ভিত্তিতেই এরা আন্তর্জাতিকের সভায় উপস্থিত হতেন, আলোচনা করতেন। স্বাধীন ভারতের পতাকা কেমন হবে সেই প্রসঙ্গে মাদাম কামার বক্তৃতা কিংবা ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলে বিরাট লুন্ঠনের প্রসঙ্গে দাদাভাই নৌরজীর আলোচনাগুলি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
অর্থাৎ ঊনবিংশ শতাব্দীতে ভারতের বুকে সমাজতন্ত্রের প্রাথমিক ধারণা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে পৌঁছে গেছিল। ভারতের বুঝে বিংশ শতাব্দীতে সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে ওঠার সুনির্দিষ্ট পূর্বশর্ত ছিল এটাই। হঠাৎ করেই আমাদের দেশে কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে উঠেছিল এমন ধারনা একেবারেই ভ্রান্ত। এদেশে সংগঠিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের আগেই সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার রাজনৈতিক চর্চা শুরু হয়। ইতিহাসের ধারা প্রসঙ্গে মার্কসবাদী দর্শন যা বলে সেই ঐতিহাসিক বস্তুবাদের নিয়মেই একে বিচার করতে হবে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনাকে একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিবেচনার যে মনোভাব, তার জোরে আমরা নিজেদের ইতিহাসের প্রতি সুবিচার করতে পারি না, সেই ইতিহাসকে সঠিক অর্থে উপলব্ধিও করতে পারি না।
এদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের মূল দুটি ধারা। একটি হল জাতীয় কংগ্রেসকে লড়াইয়ের একটি সাধারণ মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করে এগোনোর পথ। আরেকদিকে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রাস্তা। দ্বিতীয় পথের বিপ্লবীরা শুরুর দিকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইতে বিদেশের সাহায্যের প্রত্যাশা করতেন। জার্মানি, জাপান এরা লড়াইতে কার্যকরী সাহায্য করতে পারে এমন আশা তাদের ছিল। সেই চেষ্টারও ত্রুটি ছিল না। মানবেন্দ্রনাথ রায় নিজেই সেই উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে গেছেন। আরো আগে যখন ফ্রান্সে ইউটোপিয়ান সোশ্যালিজম এবং নৈরাজ্যবাদী আন্দোলনের ব্যাপক জোয়ার এসেছিল তখনও ভারত থেকে হেমচন্দ্র কানুনগো আর্ট শেখার নাম করে সেখানে যান। বোমা এবং অন্যান্য হাতিয়ার তৈরির কৌশল শিখে দেশে ফিরে আসেন। তার হাত ধরেই বাংলায় বিপ্লবীদের অস্ত্র শিক্ষার শুরু। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্লচন্দ্রের সিদ্ধান্তে তারই প্রতিফলন হয়েছে। ফ্রান্সের রাজনৈতিক ঘটনাবলী তখন মহারাষ্ট্রেও কিছুটা প্রভাব বিস্তার করেছিল।
এই প্রেক্ষাপটেই বহু চড়াই-উৎরাই, ছোট-বড় সাফল্য-ব্যর্থতা পেরিয়ে ভারতে কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। সেই পার্টি মুক্তিসংগ্রামের বহু ধারাকে একজায়গায় নিয়ে আসে, ঐতিহাসিক উপলব্ধি থেকেই সেই কর্তব্য সমাধা হয়। আমাদের দেশে সমাজ ব্যবস্থা বদলের সংগ্রামকে কমিউনিস্ট পার্টির আগে আর কেউই প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য বলে ঘোষণা করে নি। জাতীয় কংগ্রেস এমনকি গান্ধীজির নেতৃত্বের সময়তেও ব্রিটিশ শাসন উচ্ছেদের কথা যেভাবে প্রচারিত হয়েছে তাতে ভবিষ্যতের ভারত কেমন সমাজ গড়বে, বহু যুগ ধরে নিপীড়িত - শোষিত জনগণ কিভাবে মুক্তি পাবে এসব আলোচনার সুযোগ প্রায় ছিলই না। গান্ধীজির কথায় দলিত- হরিজনদের প্রসঙ্গ যেভাবে এসেছে তেমনই জমিদারদের স্বার্থরক্ষায়ও তাঁর বক্তব্য রয়েছে। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কমিউনিস্ট পার্টিই প্রথম পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি জানিয়েছিল। জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে। গান্ধীজিই তখন সেই প্রস্তাব মেনে নেন নি।
এদেশে সামাজিক কাঠামো বদলের লড়াই, তার বিস্তারিত কর্মসূচি কমিউনিস্টরাই নিয়েছিলেন। নিজেদের সামর্থ্য অনুযায়ী সেই কর্মসূচি রূপায়ণের চেষ্টাও করেছিলেন। এসব বিবরণ মুজফ্ফর আহ্মদের লেখায় পাওয়া যাবে।
বহুযুগ দীর্ঘ যে সামন্তবাদী শাসন ভারতীয় সমাজের একান্ত বৈশিষ্ট, তাকে ব্যাখ্যা করে ইএমএস নাম্বুদিরিপাদ কিছু অসামান্য প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন। ফ্রন্টলাইন ও চিন্তা পত্রিকায় সেইসব প্রবন্ধের অনেকটাই প্রকাশিত হয়। তাঁর মৃত্যুর পরে ইংরেজি অনুবাদসহ সেইসব লেখার সংকলন প্রকাশিত হয়েছে পার্টির উদ্যোগেই। যদিও কিছু কাজ এখনও বাকি আছে। আজকের প্রজন্মের পার্টি কর্মীদের সেইসব রচনা নিজেদের চর্চায় রাখতে হবে। আজকের ভারতে আরএসএস- বিজেপির যে উত্থান, তাকে বুঝতে গেলে আমাদের দেশে সামন্তবাদী কাঠামোর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ইতিহাসকে নিজেদের উপলব্ধিতে রাখতেই হবে। এমনটা না হলে হঠাৎ ভোট জিতে এরা কিভাবে ক্ষমতা দখল করেছে, এরা কি করতে চাইছে সেইসব বোঝাপড়া অসমপূর্ণ রয়ে যাবে। ভারতের ইতিহাস চর্চায় ইএমএস নাম্বুদিরিপাদের যে বিশেষ অবদান, প্রখ্যাত মার্কসবাদী ঐতিহাসিক এরিক হবস বম সেইসব রচনাকে ভারত চর্চায় আকর বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন।
আজ স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনে আমাদের কর্তব্য, যে কাজ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারায় অবহেলিত থেকেছে তাকে জানতে হবে, বুঝতে হবে- আজকের সময়ের জন্য উপযুক্ত পথে সেই কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। সমাজ ব্যবস্থার বদলই হল মানুষের মুক্তিসংগ্রামের আসল লক্ষ্য - ইতিহাসের এই শিক্ষাকে শাসক লুকিয়ে রাখতে চায়। আমাদেরই সেই কথা প্রচার করতে হবে, তাকে কাজে পরিণত করতে হবে।