প্রভাত পট্টনায়েক
ফ্যাসিবাদী মনোভাব রয়েছে, এমন যেকোনো সরকারের অন্যতম লক্ষ্যই হল কিভাবে জনগণকে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়। ভারতে মোদী সরকারও তার ব্যতিক্রম নয়। মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম (MGNREGS) যা প্রত্যেক গ্রামীণ পরিবারে একজন সদস্যকে বছরে সর্বাধিক ১০০ দিনের কর্মসংস্থানের (যা তৎকালীন পরিস্থিতির চাহিদা অনুযায়ী নির্ধারিত ছিল) প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। তাই, সীমিত অর্থে হলেও এই প্রকল্প মানুষকে কর্মসংস্থানের অধিকার দিয়েছে (প্রত্যেকের জন্য না হলেও এবং একজন কর্মপ্রার্থী যত দিনের কাজ চাইছিল চেয়েছিল ততটা না হলেও) কিন্তু তবুও বলতে হবে এমন কাজ পাওয়া অবশ্যই একটা অধিকার। এহেন নীতি নয়া-উদারনীতিবাদ পছন্দ করে না, কিন্তু বামেদের চাপের কারণেই ঐ দাবী আদায় করা সম্ভব হয়েছিল। কারণ তখন কেন্দ্রীয় সরকার বামেদের সমর্থনের উপর নির্ভরশীল ছিল। অবশ্য তারপর থেকেই কোনো না কোনো অজুহাতে এই প্রকল্পটি বন্ধ করার জন্য অবিরাম চেষ্টা চলেছে। বর্তমানে বিজেপির নেতৃত্বে চলা ফ্যাসিবাদী সরকারের আমলে সেই প্রচেষ্টা একেবারে চরমে পৌঁছেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষনেই তার প্রমাণ মেলে।
ভোট পাওয়ার জন্য অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতো মহিলাদের হাতে নগদ টাকা দেবার ব্যবস্থা করতে বিজেপিও রাজী। এ ধরনের ফান্ড ট্রান্সফার প্রকল্পের সুবাদে অতীতে মধ্যপ্রদেশে এবং সাম্প্রতিক কালে মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে তারা নিজেদের নির্বাচনী জোটের বিজয় নিশ্চিত করতে এক বড় ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা হয়। মহিলাদের জন্য এহেন ফান্ড ট্রান্সফার প্রকল্প প্রকৃতপক্ষে MGNREGS-কে ধ্বংস করার চেষ্টারই নামান্তর। দুটি প্রকল্পের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য এটাই যে নগদ দেবার প্রকল্পটি হল একধরণের দান যার জন্য প্রাপকেরা কৃতজ্ঞ থাকবে, অন্যদিকে MGNREGS প্রকল্প জনগণকে কর্মসংস্থানের অধিকার দেয়। MGNREGS-র অন্তর্গত কাজের বিনিময়ে যে অর্থ মজুরি হিসাবে দেওয়া হয় তার জন্য কোনোরকম কৃতজ্ঞতার প্রশ্নই আসে না। এ হল এক অধিকার, যা MNREGS-এ কর্মরতদের জন্য নাগরিকত্বের মর্যাদা, এবং বিজেপির চক্ষুশূল হবার মূল কারণ আসলে এটাই। এমজিএনআরইজিএস (মহাত্মা গান্ধী জাতীয় গ্রামীণ কর্মসংস্থান গ্যারান্টি স্কিম) হল ক্ষমতায়নের এমন এক রূপ যেখানে নগদ অর্থের হস্তান্তর করা হয় না। অবশ্য একথাও সত্যি যে এহেন রোজগার আইন কার্যকর থাকা সত্ত্বেও সরকার নিজেদের ইচ্ছামতো যে কোনও মুহুর্তে এস্কল প্রকল্পের আর্থিক বরাদ্দ কমিয়ে ফেলতে পারে। ফ্যাসিবাদী রাজনীতি সবসময় জনগণকে ক্ষমতাচ্যুত করার চেষ্টা করে, MGNREGS- প্রকল্পকে ক্রমাগত আক্রমণের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সে জন্যই।
পাঁচটি স্বতন্ত্র কৌশলে সেই আক্রমণ চলছে। প্রথমটি হল ন্যাশনাল মোবাইল মনিটরিং সিস্টেম সম্পর্কে সরকারের গাজোয়ারির মনোভাব। এর ফলে কাজের জায়গায় উপস্থিতি, নির্ধারিত কাজ শেষ হওয়ার প্রমাণ ইত্যাদির জন্য প্রত্যেক কর্মীকে নিজেদের ছবি আপলোড করতে হবে, এসবের পরে আসবে আধার-ভিত্তিক মজুরির ব্যবস্থা। প্রত্যেককে নিজেদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের সাথে আধার কার্ডের তথ্য সংযুক্ত (লিংক) করতে হবে। MGNREGS-র সুবাদে কাজের সুযোগ পাওয়া শ্রমিকদের জন্য এধরণের প্রযুক্তিনির্ভর বন্দোবস্তের সুবিধা নেওয়া অত্যন্ত কঠিন কাজ। বহুবিধ অসুবিধার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একটি কারণ হল গ্রামীণ ভারতের বিশাল অংশে ইন্টারনেটের কোনও সংযোগই নেই। ফলস্বরূপ, বিপুল সংখ্যক শ্রমিক MGNREGS-র সুবাদে কাজ পাওয়ার দাবিই জানাতে পারে না। নিউজক্লিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন অনুসারে লিবটেক ইন্ডিয়া নামের এক এনজিও’র অনুমান আধার সংযোগ না হওয়ার কারণে ৬৭০ লক্ষ কর্মী কাজ ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।
দ্বিতীয় কৌশল, MGNREGS বাবদ নির্ধারিত তহবিল থেকে রাজ্যগুলির বকেয়া পাওনা না মেটানো। যে সমস্ত রাজ্যে বিজেপি বিরোধী শক্তি সরকার পরিচালনা করছে সেখানেই প্রকল্পের কাজে বড় আকারের দুর্নীতি জড়িত রয়েছে এমন অভিযোগে সেই বকেয়া আটকে রাখা হচ্ছে। এর অন্যতম উদাহরণ হল পশ্চিমবঙ্গ। দুর্নীতি সংক্রান্ত অভিযোগগুলিকে যাচাই করার একটি উপায় হল সামাজিক নিরীক্ষণ (সোশ্যাল অডিট)। অভিযুক্ত রাজ্যগুলি কাজ যাচাই করতে সামাজিক নিরীক্ষণ করেনি বলে কেন্দ্রীয় সরকার অভিযোগ করছে। অথচ বেশ কিছুদিন ধরে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল থেকে সামাজিক নিরীক্ষণ (সোশ্যাল অডিট) ইউনিটগুলির জন্য নির্ধারিত বরাদ্দ বকেয়া পড়ে রয়েছে। যদি ধরেও নেওয়া যায় রাজ্য সরকারের দোষ রয়েছে তাহলেও প্রকল্পের বরাদ্দ আটকে রাখার অর্থ রাজ্য সরকারের পাপের জন্য জনগণকে শাস্তি দেওয়া। আসলে এসব হল অজুহাতমাত্র, আসল উদ্দেশ্য প্রকল্পটিকেই বন্ধ করে দেওয়া।
তৃতীয় কৌশল, মজুরি বাবদ অর্থ বকেয়া রেখে দেওয়া। সম্প্রতি দিল্লিতে MGNREGS-এ কর্মরত শ্রমিকদের বিক্ষোভ চলাকালীন অনেকেই অভিযোগ জানায় যে তিন বছর কাজ করার পরেও তাদের মজুরি বকেয়া রেখে দেওয়া হয়েছে! অথচ এমএনরেগা আইনে মজুরি চোকানোয় বিলম্ব হলে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার শর্ত রয়েছে। এমনকি এই প্রকল্পের অন্তর্গত কাজ বরাদ্দ না করা হলে বেকার ভাতা দেওয়ার শর্তও রয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত বেকার ভাতা কিংবা ক্ষতিপূরণ কোনটিই দেওয়া হয়নি। আইনের এমন চরম লঙ্ঘন হওয়া স্বত্বেও কেউ কোনও শাস্তিও পায়নি। মজুরি পাওয়ায় এমন দেরই শ্রমিকদের কাজে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করে। এরই প্রভাবে প্রকল্পটি ক্রমশ দুর্বল হতে থাকে।
চতুর্থ উপায়টি হল কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে প্রকল্পের জন্য ক্রমাগত অপর্যাপ্ত বরাদ্দের সিদ্ধান্ত। মজুরি বাবদ বকেয়া মেটানোয় দেরি হওয়ার অন্যতম কারণ এটাই। ইউপিএ-২ সরকারের আমলেই এমনটা করা শুরু হয়েছিল। তৎকালীন অর্থমন্ত্রী, পি চিদাম্বরম সবসময় বাজেটে MGNREGS-এর জন্য কম অর্থ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত নিতেন। এমন সিদ্ধান্তের কারণ জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন যেহেতু এটি চাহিদানুসারে-পরিচালিত প্রকল্প তাই পরবর্তীকালে প্রয়োজন হলে এর জন্য পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করা যায়। এধরণের প্রকল্পে যা খুবই স্বাভাবিক তা হল সময় বিশেষে কখনো যেমন বরাদ্দ বৃদ্ধির প্রয়োজন দেখা দেয় আবার কখনও তেমন প্রয়োজন থাকেও না। অথচ আইনের এহেন ফাঁক ব্যবহার করেই মজুরি দেওয়ার কাজে বিলম্ব ঘটে এবং তার প্রভাবে কাজের চাহিদা কমে যায়। কারণ মজুরি পেতে দেরি হওয়ার পরিস্থিতিতে ‘নিরুৎসাহিত কর্মীর প্রভাব’ দেখা দেয়। সেই অবস্থাকেই বিজেপি সরকার এক চরম সীমায় নিয়ে গেছে।
২০২৪-২৫-এর জন্য MGNREGS-এর জন্য বাজেট বরাদ্দ ছিল ৮৬ হাজার কোটি টাকা। হিসাব অনুযায়ী মজুরি বাবদ আগেকার বকেয়া মেটানোর পরে, সেই পরিমাণ প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকায় নেমে যাওয়ার কথা। এমন সামান্য বরাদ্দ প্রয়োজনের তুলনায় এতটাই কম যে এর ফলে পুনরায় মজুরি বাবদ বকেয়া তৈরি হবে। এমনটা চলতে থাকলে মজুরি বাবদ বরাদ্দের এক স্থায়ী ও ক্রমবর্ধমান ঘাটতি তৈরি হবে। এমন পরিস্থিতি কাজে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করবে। ফলে প্রকল্পটি দুর্বল হতে থাকবে। কোভিডের কারণে আচমকা লকডাউনের ঘোষণা হওয়ার কারণে হাজার হাজার শ্রমিক নিজেদের গ্রামে ফিরে গিয়েছিল, তখন MGNREGS-র জন্য সংশোধিত বাজেট বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা। তৎকালীন পরিস্থিতিতে ঐ বরাদ্দের সুবাদে দেশের গ্রামাঞ্চলগুলিতে মানুহসের হাতে নগদ অর্থ যোগানের ক্ষেত্রে একধরণের উৎসাহের পরিবেশ তৈরি করেছিল। শহর থেকে গ্রামের অভিমুখে সেই অভিবাসন অবশ্য কোভিদেড় প্রভাব হ্রাস হওয়া সত্ত্বেও বিপরীত হয়নি। তাই আজকের অবস্থায় ঐ প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ তখনকার বরাদ্দের মতোই হওয়া উচিত। অথচ এ বছর মজুরি বাবদ বকেয়া বাদ দিয়ে মাত্র ৬০ হাজার কোটি টাকার বরাদ্দ নির্ধারিত হল। এতে কি হবে? বকেয়া মজুরি মেটানোয় বিলম্ব ঘটবে, কাজে যুক্ত হতে ‘নিরুৎসাহিত কর্মীর প্রভাব’ আরও বাড়বে। গত ৬ই ডিসেম্বর দিল্লিতে বিক্ষোভ প্রদর্শনের সময় MGNREGS কর্মীরা প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো এবং ২.৫ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দের দাবি জানিয়েছে। এই দাবী আজকের পরিস্থিতিতে বাস্তবিক প্রয়োজনের কিছুটা ইঙ্গিত দেয়।
MGNREGS-কে শ্বাসরোধ করার চক্রান্তে সরকারের পঞ্চম কৌশলটি হল মজুরির হার অত্যধিক কম করে রাখা। নিচের পরিসংখ্যান থেকে বর্তমানে এ প্রকল্পের কাজে মজুরি কত কম হয়ে রয়েছে তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে। একসময় যাকে আমরা প্ল্যানিং কমিশন বলে জানতাম তারা গ্রামীণ ভারতে দারিদ্র্যের মাপকাঠি হিসাবে মাথাপিছু ২২০০ ক্যালোরি’কে একটি সূচক হিসাবে নির্ধারণ করে। ২০১১-১২ নাগাদ জাতীয় নমুনা নিরীক্ষণ (এনএসএস)-র অন্তর্গত এক বড় আকারের সমীক্ষা অনুসারে, ২২০০ ক্যালোরি গ্রহণ করা তখনই সম্ভব যদি শুধুমাত্র খাদ্য বাবদ মাথাপিছু দৈনিক ব্যয় প্রায় ৫০ টাকার উপরে হয়। তারপর থেকে তুলনামূলক আর কোনও সমীক্ষা এনএসএস করেনি। যদি গ্রামীণ এলাকায় খাদ্য বাবদ খরচের হিসাব করার জন্য কেবলমাত্র খরিদ্দারের মূল্যমানের সূচক (কনজিউমার প্রাইস ইনডেক্স)-ই ব্যবহৃত হয় তাহলেও ২০২৩-২৪’এ সংশ্লিষ্ট মজুরির হার ৮২ টাকা হতে হয়। সুতরাং স্বামী, স্ত্রী, দুই সন্তান ও একজন বয়স্ক মানুষকে ধরে হিসাব করলে শুধু খাদ্যের প্রয়োজন মেটানোর জন্যই পাঁচজনের একটি পরিবারে ন্যুনতম দৈনিক মজুরির হার কমপক্ষে ৪১০ টাকা হয়। মোট দৈনিক মজুরির হার এর চাইতে আরও বেশি হতে হবে, কারণ আপতকালীন অবস্থার জন্য বাড়তি কিছু অর্থ খরচ হবে। এমনটা হলেও একথা মনে রাখতে হবে যে কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স জীবনযাত্রার প্রকৃত ব্যয় বৃদ্ধিকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে যথেষ্ট না। কারণ শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি প্রয়োজনীয় পরিষেবার উপরে বেসরকারীকরণের যে প্রভাব তা কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্সে ধরা পড়ে না। ঐ প্রভাব জরুরী পরিষেবাগুলিকে ক্রময়াগত ব্যয়বহুল করে তোলে।
MGNREGS-র কর্মরত শ্রমিকদের দৈনিক মজুরির হার নির্ধারণ করতে সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকা একটি বিশেষজ্ঞ কমিটিকে দায়িত্ব দেয়। তারাও ঐ মজুরির হার ৩৭৫ টাকা করার সুপারিশ করেছে। সারা দেশের কোথাও মজুরির হার ৩৭৫ টাকার কাছাকাছিও নেই। হরিয়ানা, কেরালা, কর্ণাটক এবং পাঞ্জাব, চারটি প্রধান রাজ্যেই কেবলমাত্র দৈনিক মজুরির হার ৩০০ টাকার উপরে ছিল। বাকি সমস্ত রাজ্যেই মজুরির হার রয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ টাকার মধ্যে। একে তো অত্যন্ত কম মজুরি, তাও সময়মতো প্রাপ্য টাকা না দেওয়ার কারণে দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া পড়ে থাকছে। এমন পরিস্থিতি শ্রমিকদের ঘাড়ে বড় বিরক্তিকর এক বোঝা হিসাবে চেপে বসে।
স্বাধীনতা উত্তর ভারতে প্রগতিশীল আইনী বন্দোবস্তের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হল গ্রামীণ রোজগার প্রকল্প। কাজ পাওয়ার অধিকার-ভিত্তিক এমন সরকারী প্রকল্পকে উপরোক্ত কৌশলসমূহের মাধ্যমে মোদী সরকার ক্রমাগত ধ্বংস করে চলেছে। আরেকদিকে অধিকারের নামে নগদ অর্থ হস্তান্তরের মাধ্যমে মানুষকে করুণা ভিক্ষা করতে বাধ্য করা হচ্ছে।
অবশ্য যে সরকারের মধ্যে ফ্যাসিবাদের উপাদান রয়েছে তার থেকে আর কিই বা আশা করা যায়?