কর্ণাটক - হিন্দুত্ববাদী শক্তির ষড়যন্ত্র এবং মেয়েদের শিক্ষার অধিকার

কর্ণাটকে মুসলমান ছাত্রীদের হিজাব পরে স্কুলে-কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়ার ঘটনা প্রসঙ্গে পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকায় ৯ই ফেব্রুয়ারি,২০২২ সংখ্যায় সম্পাদকীয় প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়, সেই প্রবন্ধেরই সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ রাজ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হল।  

নতুন করে বিভাজনকামী ও মুসলমান-বিরোধী মেরুকরণের লক্ষ্যে কর্ণাটকে সক্রিয় হয়েছে বিজেপি ও তাদের সহযোগী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। এবার তারা মুসলমান ছাত্রীদের হিজাব পরাকে কেন্দ্র করে অশান্তি তৈরি করতে চাইছে।

উদুপি’তে একটি সরকারি প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজের ছয়জন মুসলমান ছাত্রী ক্লাস চলাকালীন হিজাব (মাথা ঢাকার ওড়না বিশেষ) পরা প্রসঙ্গে অনড় থাকার ঘটনায় ঐ কলেজের মূল ফটকে কয়েকজন হিন্দু ছাত্র মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে বিক্ষোভ দেখায়। আসলে এই ঘটনায় মেরুকরণের রাজনীতি করার সুযোগ খুঁজে পেয়েছে অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থি পরিষদ এবং হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, তারাই হিন্দু ছাত্রদের দ্বারা প্রতিবাদের নামে অশান্তি বাধাতে চাইছে। মুসলমান ছাত্রীদের হিজাব পরাকে কেন্দ্র করে ঘটনাটি গত বছর ২৯শে ডিসেম্বর কর্ণাটকে ঘটেছে। এর পরেই কুন্দপুরের আরও দুটি কলেজে অন্য ছাত্রছাত্রীরা গেরুয়া ফেট্টি বেঁধে ক্লাসে ঢোকার আবেদন জানিয়েছে এই অজুহাতে মুসলমান ছাত্রীদের হিজাব পরে ক্লাসে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে।

এতদিন হিজাব পরেই যারা নির্বিঘ্নে ক্লাস করেছেন সেই ছাত্রীরা কলেজে ঢোকামাত্রই কিছু হিন্দু ছাত্র তাদের উদ্দ্যেশ্য করে ‘জয় শ্রী রাম’ স্লোগান দিতে শুরু করে। এই ঘটনার আগে অবধি সরকারি প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজগুলিতে নির্ধারিত পোশাকের সাথে একই রংয়ের হিজাব পরে মুসলমান ছাত্রীরা বরাবর ক্লাস করেছে। গেরুয়া বাহিনীর হাঙ্গামার পরে গোটা পরিবেশটাই বদলে গেছে।

যে সব ছবি এবং ভিডিও প্রচারিত হয়েছে তাতে স্পস্ট, হিজাবের অজুহাত তুলে কলেজ পড়ুয়া ছাত্রীদের কলেজে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে, এমন ঘটনায় অন্যায়ভাবে মেয়েদের শিক্ষার অধিকারকেই খর্বিত করা হল। হিজাব পরে পড়তে আসা ছাত্রীদের বাধা দিচ্ছে মাথায় গেরুয়া ফেট্টি বাঁধা কমবয়সী ছেলেরা, একাধিক শিক্ষাঙ্গনেই এমন ঘটনা ঘটছে। পরিস্থিতির মকাবিলায় কর্নাটকের রাজ্য সরকার থেকে তিনদিন রাজ্যের সমস্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়।

৫ই ফেব্রুয়ারি, সমস্ত সরকারি শিক্ষাকেন্দ্রে নির্ধারিত পোশাকবিধি মেনে চলার নির্দেশ জারি করে কর্নাটকের শিক্ষা দপ্তর। বেসরকারি শিক্ষাকেন্দ্রগুলিকে নিজস্ব পোশাকবিধি নির্ধারণের নির্দেশ দেওয়া হয়। ‘সমতা, ন্যায্যতা এবং জনাদেশ’-কে খর্ব করে এমন কোন পোশাক পরা চলবে না বলে সরকারি নির্দেশ জারী করা হয়।

অর্থাৎ, কর্ণাটকের বিজেপি শাসিত রাজ্য সরকার হিন্দুত্ববাদীদের দাবিতেই নীরবে সম্মতি জানালো এবং এর ফলে হিজাব পরিহিতা কোন ছাত্রী সরকারি স্কুল কলেজে পড়তে পারবে না।

কর্ণাটকে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এটাই বিজেপি সরকারের সাম্প্রতিক কর্মসূচি। শিক্ষার্থীদের জন্য ধর্মীয় চিহ্ন ব্যাতিরেকে পোশাক বিধির অছিলায় মুসলমান ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকারকেই খারিজ করে দেওয়া হল। বিজেপি’র একাধিক সাংসদ, এমএলএ-দের বিবৃতি থেকে স্পস্ট যে তারা মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বিবেচনা করতে চাইছেন, সংবিধান স্বীকৃত সকল নাগরিকের সমতার অধিকারকে খারিজ করতে চাইছেন। মাইসোর-কোদাগু নির্বাচনী ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত বিজেপি সাংসদ প্রতাপ সিংহের ঘোষণাতেই সেই নির্লজ্জ পরিকল্পনা পরিষ্কার হয়েছে, তিনি বলেছেন – ‘তোমরা হিজাব, বোরখা পরতে পারো… এবং মাদ্রাসায় ভর্তি হও’।

বর্তমানে কর্ণাটকের সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে এই ঘটনাকে আলাদা করে বিচার করা উচিত না। ২০১৯ সালে কংগ্রেস-জনতা দল(সেকুলার) জোট সরকারকে হারিয়ে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার প্রথম থেকেই রাজ্যের সর্বত্র হিন্দুত্বের কর্মসূচি চাপিয়ে দিতে চাইছে। মাংস বিক্রির ব্যবসায় যুক্ত মুসলমান সংখ্যালঘুদের উদ্দেশ্য করেই রাজ্য সরকার ২০২০ সালে গবাদি পশু হত্যা সম্পর্কিত কঠোর আইনবিধি লাগু করে। একই কায়দায় ২০২১ সালে ‘ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক অধিকার আইন’ প্রণয়ন করা হয়। বলপূর্বক ধর্ম পরিবর্তন রুখতে হবে এই অজুহাতে এমন আইন প্রণীত হয়, আসলে বিজেপি এই আইনের সাহায্যে ভিন্ন ধর্মে বিবাহ রোধ এবং খৃষ্টান সম্প্রদায়কে নিশানা করতে চাইছে। সামাজিক পরিসরে বিভিন্ন ধর্মের যুববয়সীদের যে স্বাভাবিক মেলামেশার অভ্যাস রয়েছে তার উপরে লাগাতার হামলার ঘটনা ঘটছে কর্ণাটকের উপকূলবর্তী জেলাগুলিতে।   

কর্ণাটকের যে সরকারি দপ্তর স্কুল-কলেজে হিজাব পরিধানে নিষেধাজ্ঞা জারী করেছে, তারাই অত্যন্ত নির্লজ্জের মত দেশের স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপন প্রসঙ্গে সপ্তাহব্যাপী ‘সূর্য নমস্কার’-কর্মসূচির আহ্বান জানিয়েছে।

মুসলমান ছাত্রীদের শিক্ষার অধিকার খর্ব করে তাদের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারকেই খারিজ করছে কর্ণাটকের রাজ্য সরকার। যদি শিক্ষাক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীদের পোশাক থেকে যাবতীয় ধর্মীয় চিহ্নকেই সরিয়ে দেওয়া হয় তবে কি শিখ সম্প্রদায়ের ছাত্রেরা নিজেদের পাগড়ি খুলে রাখবেন? মুসলমান ছাত্রীদের হিজাব কিংবা শিখ ছাত্রদের পাগড়ি, এসবই তাদের বুনিয়াদি ধর্মীয় অভ্যাস।

হিজাব পরিহিতা ছাত্রীদের শিক্ষার সুযোগ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আসলে মুসলমান সম্প্রদায়কে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসাবে বিবেচনার কৌশল। এই ঘটনায় দেশের নাগরিকদের এক অংশের সাংবিধানিক অধিকারের প্রশ্ন জড়িয়ে রয়েছে। এই ঘটনায় আক্রান্ত এক ছাত্রী কর্ণাটক হাইকোর্টে বিচার চেয়ে দরখাস্ত জমা করেছেন। হাইকোর্টের এক বৃহত্তর বেঞ্চে সেই দরখাস্তের ভিত্তিতে রায় ঘোষণা করা হবে। আমাদের দেশের সংবিধানে সংখ্যালঘুদের অধিকার প্রসঙ্গে যেসকল নিশ্চয়তা রয়েছে, তার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট প্রসঙ্গে কর্ণাটক সরকারের পক্ষপাতদুষ্ট নির্দেশনামা সরাসরি খারিজ হবে এমনটাই আশা করা যায়।

ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন