'দ্য লেফটওয়ার্ড ব্লগ' - এ ২০১৬ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর Dalit Resistance And The Role Of The Left শিরোনামে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড বৃন্দা কারাতের লেখা একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। আজ ১৪ই এপ্রিল, ডঃ বি আর আম্বেদকরের জন্মদিবসে সেই প্রবন্ধেরই সম্পূর্ণ বাংলা অনুবাদ দুটি পর্বে রাজ্য ওয়েবসাইট থেকে প্রকাশ করা হল।
দলিত সংগ্রাম এবং বামপন্থার ভূমিকা
প্রথম পর্ব
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/ezgif-4-4431820014b3.jpg)
ভারতের অর্থ সামাজিক কাঠামোর প্রধান কেন্দ্রটিই হল বর্ণ বা জাতি ব্যবস্থা। এই দেশে জন্ম এবং বংশ পরিচয়ই সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে কারোর অবস্থান নির্ধারণ করে। আত্মহত্যার পূর্বে ভীষণরকম আবেগ সম্বল করে লেখা রোহিত ভেমুলার চিঠিতে তার দলিত জন্মপরিচয় কে সে এক নিদারুণ দুর্ঘটনা বলে উল্লেখ করে। দুঃখজনক হলেও তার এই উপলব্ধি বাস্তব চিত। দলিত না হয়ে অন্য কোন বংশ পরিচয় থাকলে তার মা রাধিকাকে এত অপমান, অমর্যাদা র শিকার হতে হতো না। রোহিত এবং তার সহোদর রাজাকে বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে বৈষম্যের কবলে পড়তে হতো না। দেশের একটি অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নের যে সুযোগ রোহিত পায় তার প্রধান কারণ ছিল ছাত্র বৃত্তি, সেই বন্দোবস্ত যদি খারিজ না হতো তবে রোহিত নিজের জীবন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিত না। তার মৃত্যু এই কারণেই একটি প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার ঘটনা। এই মৃত্যুতে শুধু একটি কিংকর্তব্যবিমূঢ় বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, আমাদের দেশের জাতিব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোটিরও দায় রয়েছে।
পুঁজিবাদের প্রতি ক্ষমার মনোভাব নিয়ে চলা ব্যক্তিরা যতই অজুহাত হাজির করুন কিংবা পুঁজিবাদ যতই নিজেকে আধুনিক বলে জাহির করুক সত্যি হলো এই যে ভারতে পুঁজিবাদ জাতিভেদের ভয়াবহতা দূর করতে ব্যর্থ হয়েছে। এদেশে পুঁজিবাদের সঞ্চারপথ সামন্তবাদ, আদা সামন্তবাদের সাথে হাত মিলিয়েছে। দলিত শ্রেণীর শ্রমশক্তি কে শোষণ করে উদ্বৃত্ত মূল্য নিষ্কাশন করতে ই পুঁজিবাদ এদেশে জাতিভেদের ব্যবস্থা কে আপন করে নিয়েছে। পুঁজিবাদ এবং জাতিভেদ ব্যবস্থার এই গাঁটছড়া একটি পাকাপাকি বন্দোবস্ত - ভারতে পুঁজিবাদের এ এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নয়া উদার বাদী অর্থনীতি সেই বন্দোবস্তের আরও জোর বাড়িয়েছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/4832a9e1b572638f3327c87b935f9cb4.jpg)
সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দলিতদের জীবন সংগ্রামের তিনটি ক্ষেত্র প্রধান হিসেবে সামনে এসেছে, এই শব্দটি ক্ষেত্রেই বামপন্থীদের জন্য যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক:
১) দলিতদের জীবন জীবিকার প্রসঙ্গ - গুজরাটের উনা আন্দোলন উল্লেখ্য।
২) দলিতদের শিক্ষায় সুযোগ পাওয়ার প্রসঙ্গ - রোহিত ভেমুলা আত্মহত্যার ঘটনা উল্লেখ্য।
৩) দলিতদের বিরুদ্ধে হিংসার প্রসঙ্গ- হরিয়ানার সুনাপদে দুজন দলিত শিশুকে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনা উল্লেখ্য।
এগুলি নিয়ে বিশদ আলোচনার পূর্বে এই সমস্ত ঘটনা এবং সংশ্লিষ্ট সংগ্রাম সমূহের রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটটি বুঝে নেবার প্রয়োজন রয়েছে।
হিন্দুত্ব এবং জাতিভেদ ব্যবস্থা
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/Untitled_Artwork-1024x576.jpg)
ভারতে হিন্দুত্ব দেশের রাজনৈতিক ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর জাতিভেদ ব্যবস্থা দূরীকরণের সংগ্রাম গুণগতভাবে এক নতুন রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। জাতিভেদ ব্যবস্থা সম্পর্কে আরএসএস সর্বদাই দুমুখো নীতি নিয়ে চলেছে। একদিকে তারা সনাতন ধর্মের ভক্ত, যে ব্যবস্থা জাতিভেদ বন্দোবস্তের পক্ষে কথা বলে। অন্যদিকে তারাই হিন্দু পরিবারের ঐক্য স্থাপনের পক্ষে বক্তৃতাও দেয়।
আরএসএস নিজেদের ইচ্ছামত ভারতের ইতিহাসের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে জাতিভেদ ব্যবস্থার প্রাথমিক চেহারায় কোনো গলদ খুঁজে পায়না। তাদের যুক্তি, মুঘল শাসনের সময় থেকেই জাতিভেদ বিষয়টি শোষণের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। আরএসএস এর সেকেন্ড ইন কমান্ড ভাইয়া যশি দলিতদের প্রসঙ্গে একটি বইয়ের মুখবন্ধে লিখেছেন "প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে দলিত এবং শুদ্রদের জন্য কোনো বৈষম্যের উল্লেখ নেই। সেই যুগে কোনরকম অস্পৃশ্যতা ছিলনা। মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরাই এমন ধারার আচার-আচরণ প্রণয়ন করেন।"
মনুস্মৃতি এবং অন্যান্য প্রাচীন হিন্দু সাহিত্য সমূহ, যেখানে জাতিভেদ বন্দোবস্তকে যেভাবে উচ্চস্বরে প্রশংসা করা হয়েছে সেগুলি কি তবে প্রাচীন শাস্ত্র নয়? অবশ্য আরএসএস কোনদিনই তথ্যনিষ্ঠ নয়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/dalitApartheid.jpg)
বর্তমানে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নিজস্ব ব্যাখ্যা অনুযায়ী ধাঙড় কিংবা ঝাড়ুদারের কাজকে 'আধ্যাত্বিক কর্তব্য' বলে প্রচার করা হচ্ছে। একথাও বলা হচ্ছে যে ঐতিহাসিকভাবে দলিতরা আধ্যাত্বিক কর্তব্য পালনে নিজেরাই এই কাজ বেছে নিয়েছিলেন। মোদী তার নিজের লেখা বই কর্মযোগে উল্লেখ করেছেন ' আমি বিশ্বাস করিনা যে দলিতরা শুধুমাত্র জীবন-জীবিকার কারণেই এই কাজ বেছে নিয়েছেন। তেমনটা হলে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তারা এই কাজে ব্রতী হতেন না।' শুধু এই নয়, মোদি আরো উল্লেখ করেছেন ' ইতিহাসের কোন নির্দিষ্ট সময় এদের (যাদের বাল্মিকী বলে উল্লেখ করা হয়) চেতনায় নিশ্চিত আলোকপ্রাপ্তির ঘটনা ঘটে, এবং তারা উপলব্ধি করেন সমাজ এবং ঈশ্বরের সুখের স্বার্থে তাদের এই কাজ (ধাঙড়) করে যেতে হবে। এদের উত্তরসূরিদের কাছে এই কাজ ভিন্ন অন্য কোন কিছুর সুযোগ ছিল না একথা বিশ্বাস করা অসম্ভব।'
বোঝাই যাচ্ছে মোদি মহাশয় ইতিহাসের শিক্ষা থেকে কিছুই গ্রহণ করতে রাজি নন। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্র গুলিতে ঠিক একই রকম নির্লজ্জ কায়দায় জাতিভেদের পক্ষে যুক্তি হাজির করা হয়েছে, এই কারণেই ডক্টর বাবাসাহেব আম্বেদকর এর মত দলিত অধিকার সংগ্রামের অগ্রণীবৃন্দ বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
মহান হিন্দু পরিবারের ধারণা আসলে সেই ঘোড়া যে কোনদিন দৌড় শুরুই করেনি, এই মহান পরিবারের ধারণা বহু তাত্বিক অন্তর্দ্বন্দ্বে জর্জরিত এবং এর প্রাত্যহিক চর্চাও আগাগোড়া ভন্ডামি পূর্ণ। দলিতদের সামাজিক কাঠামোর একেবারে তলায় ফেলে রেখে, জাতিভেদ বন্দোবস্তকে একচুল না বদলিয়ে মহান হিন্দু পরিবারের ধারণা গড়ে তোলা হয়েছে। হিন্দুত্বের সাম্প্রতিক কর্মসূচি ঘর ওয়াপসি সেই ধারণা কে আরো স্পষ্ট করেছে - ঘোষণা করা হয় ধর্ম পরিবর্তন করে ঘরে ফিরতে হলে পুনরায় হিন্দু সমাজে দলিত পরিচয় নিয়েই ফিরতে হবে!
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/download-1.jpg)
আরএসএস দলিতদের অধিকার নিয়ে কথা বললেও দলিতদের সংরক্ষণ দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিটি প্রতিক্রিয়াশীল বিক্ষোভের পক্ষে দাঁড়ায়। আরএসএস প্রধান স্পষ্ট ভাষায় সংরক্ষণের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন, সংরক্ষণের সিদ্ধান্তকে পুনর্বিবেচনার দাবি জানান। হিন্দুত্বের প্রচারে আরএসএস দলিতদের ব্যবহার করে, অযোধ্যায় পরিকল্পিত মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর একজন দলিতের হাতে স্থাপিত হবে বলে ঘোষণা করে। অথচ বহু হিন্দু মন্দিরেই দলিতদের প্রবেশ সম্পর্কিত নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সেই সমস্ত পূজা স্থানে দলিতদের প্রবেশাধিকারের পক্ষে একটি আন্দোলনেও আরএসএস কখনো অংশগ্রহণ করেনি। বাবাসাহেব আম্বেদকর এর সাথে সেই আন্দোলনে পি সুন্দরাইয়া, এ কে গোপালনের মত কমিউনিস্টরা ই সেইসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আজও বামপন্থীরা সেই আন্দোলনের উত্তরাধিকার এগিয়ে নিয়ে চলেছে। আরএসএস দলিতদের সাথে খাবার ভাগ করে নেওয়ার কথা বলে, অথচ একটি দলিত ছেলে এবং একটি উচ্চবর্ণের মেয়ের প্রেম বিবাহ সম্পর্কে খাপ পঞ্চায়েত গুলি যখন হিংসাশ্রয়ী নির্দেশ দেয় তারা সেই পঞ্চায়েতগুলির পক্ষেই অবস্থান নেয়। অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল এবং সামাজিক অবস্থানে প্রান্তিক দলিতদের বিরুদ্ধে বঞ্চনার বহু ঘটনা সারাদেশে ঘটেছে, বিজেপি শাসিত রাজ্য গুলিতে এমন একটি ঘটনার বিরুদ্ধেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। আরএসএস দলিতদের একটি মাত্র ব্যবহার্য ভূমিকাকে স্বীকৃতি দিতে চায়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে দলিতদের জঙ্গী আক্রমণে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করায়, গুজরাটের গণহত্যায় যেমনটা করা হয়েছিল।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/riots-inside_032418084122.jpg)
দলিতদের স্বার্থ এবং হিন্দুত্বের কর্মসূচি পরস্পরের সম্পূর্ণ বিপরীত। সেই বিপরীতমুখী কর্মসূচিকেই সারাদেশে সরকারি সহায়তা সহ প্রচার করা হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তারই প্রতিক্রিয়ায় আরএসএস বিজেপির রাজনৈতিক স্বার্থের বিরুদ্ধে দলিতদের প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
নয়া উদারবাদী নীতিসমূহ দলিতদের অবস্থানকে আরো দুর্বল করেছে
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/094n.png)
বিজেপি সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই দেশে নয়া উদারবাদী নীতিসমূহের প্রণয়ন গতিপ্রাপ্ত হয়েছে। এর ফলে দলিতদের জীবন-জীবিকার লড়াই আরো তীব্র হয়েছে।
সাম্প্রতিক জনগণনার প্রতিবেদনেই স্পষ্ট হয়ে গেছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সিডিউলড কাস্ট সম্প্রদায়ের উপর চেপে বসা ঐতিহাসিক বৈষম্যগুলির একটিও পুঁজিবাদ দূর করতে পারেনি। অন্যান্য অংশের মানুষের সাথে দলিতদের ফারাক একই রয়ে গেছে। ঐ প্রতিবেদনেই স্পষ্ট হয়েছে কিভাবে পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় গরিব এবং বৈষম্যের শিকার হওয়া নিম্নবর্ণের উপরে আক্রমণ আরও বেড়েছে। সারাদেশে মোটের উপরে গরিব মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, জাতিগত শোষণের শিকার হয়ে দলিতেরা গরীব মানুষের মধ্যে আরো গরীব হতে বাধ্য হয়েছেন।
সারাদেশে ৩.৩১ কোটি দলিত পরিবার রয়েছে, এরমধ্যে ৭২.৫৮ শতাংশই চরম বৈষম্যের শিকার, ৫৫ শতাংশের নিজস্ব জমি নেই, ৬৭.২৭ শতাংশ হলেন ঠিকা শ্রমিক হিসাবে কর্মরত, মাত্র ,১১.২৯ শতাংশের নিজেদের পাকা বাড়ি রয়েছে। এই তথ্যের ভিত্তিতে বলা যায় সিডিউল কাস্ট বা সিডিউল ট্রাইব নন এমন মানুষদের তুলনায় সিডিউল কাস্ট / ট্রাইব মানুষের উপরে কুড়ি শতাংশ ক্ষতির বাড়তি বোঝা চেপেছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/200410034634-02-india-coronavirus-dalits-super-tease-1024x576.jpg)
Social Exclusion and Caste Discrimination in Public and Private Sectors in India: A Decomposition Analysis 2016 শীর্ষক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী সমান যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও সিডিউল কাস্ট এবং অন্যান্য সামাজিক অংশ থেকে কাজে যুক্ত ব্যক্তির বেতনের গড় ফারাক সরকারি ক্ষেত্রে ১৯.৪০ শতাংশ এবং বেসরকারি ক্ষেত্রে ৩১.৭০ শতাংশ। উল্লেখযোগ্য তথ্য হল বেসরকারি ক্ষেত্রে বেতনের এই ফারাক নয়া উদারবাদী যুগের পূর্বের ফারাকের চেয়ে অনেকটাই বেশি। সরকারি ক্ষেত্রে এই ফারাক কম হওয়ার অন্যতম কারণ সংরক্ষণ ব্যবস্থা, যদিও সেখানেও ফারাক প্রায় কুড়ি শতাংশ।
এর আগে আইআইএম আমেদাবাদের পক্ষ থেকে এমবিএ স্নাতকদের উপরে একটি সমীক্ষা চালানো হয়। সমীক্ষায় উঠে আসে চাকরিতে নিযুক্ত সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় সিডিউল ড কাস্ট বা সিডিউল ড ট্রাইব স্নাতকদের বেতন ২০ থেকে ৩৫ শতাংশ কম।
সংরক্ষণের কারণে দেশের সংবিধান জাতিভেদ বৈষম্যের শিকার হওয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল অংশের জন্য বিশেষ প্রণিধান দিলেও নয়া উদারবাদী নীতিসমূহ যত বেশি কার্যকরী হয়েছে বেসরকারিকরণের কর্মসূচিও ততই দ্রুত হয়েছে। এতে সরকারি ক্ষেত্রে চাকরি পাওয়ার সুযোগ ক্রমশ কমেছে, দলিতদের জন্য সংরক্ষিত আসন সংখ্যা এক ধাক্কায় অনেকটাই কমে গেছে। এই পর্বে দলিত অংশের শিক্ষিত মানুষের কাজের সুযোগ হ্রাস পেয়েছে।
এই সবকিছুই ঘুরপথে জাতিভিত্তিক কাজে শোষণের মাত্রা বাড়িয়েছে। সাধারণ ধারণায় যে সব কাজ ' অপরিচ্ছন্ন ' বলে বিবেচিত হয় যেমন - ঝাড়ুদারের কাজ, গৃহস্থালির রোজকার সাফাই সংক্রান্ত কাজ, মানুষের মল মূত্র পরিষ্কারের কাজ, নর্দমা পরীক্ষার রাখা কিংবা মৃত পশুর চামড়া ছাড়ানো এসবই মূলত দলিতদের জন্যই সংরক্ষিত। তারাই এসব কাজ করেন। সরকারি ক্ষেত্রগুলিতে সাফ সাফাই এর কাজে আজকাল আউটসোর্সিং কিংবা ঠিকা ভিত্তিতে নিয়োগ হচ্ছে, সেখানেও নিযুক্তদের ৯০ শতাংশই দলিত সম্প্রদায়ের। নয়া উদারবাদের যুগে সরকারি ক্ষেত্রে এ ধরনের কাজে যথাযথ নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে গেলেও কাজের চরিত্রটি আজও একই রয়ে গেছে। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দুটি ক্ষেত্রেই পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা দলিতদের শ্রমশক্তি শোষণ করে চলেছে।
গুজরাট মডেল
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/images.jpg)
ভারতের কর্পোরেটদের নয়নের মনি 'গুজরাট মডেল' আসলে কর্পোরেট মুনাফা এবং দলিত শোষণের দ্বিবিধ অত্যাচারের এক সুসংহত সারসংক্ষেপ। গুজরাটে র উনা এবং সৌরাষ্ট্রে গো হত্যার বিচার হিসাবে চারজন দলিত যুবককে প্রকাশ্যে নগ্ন করে মারধর এবং জনসমক্ষে ঘোরানোর ঘটনায় সেই সুসংহত শোষণের ছবিই আরো স্পষ্ট হয়। নিপীড়িত দুই যুবকের পিতা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলে তাকেও মারধর করা হয়, তিনি বারে বারে বলতে থাকেন রোজগারের অন্য কোনো সুযোগই তাদের নেই।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/ezgif-4-8abef73e94b8.jpg)
গুজরাটে মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ শিডিউল্ড কাস্ট সম্প্রদায়ভুক্ত। এদের বেশিরভাগই জমিহীন পরিবার। গ্রামের দিকে এরা হয় কৃষিমজুর হিসাবে কাজে যুক্ত হন অথবা সম্প্রদায় ভিত্তিক পূর্বনির্ধারিত কাজে। অস্পৃশ্যতা এবং বিভাজনের রাজনীতির হাতে এদের নিপীড়িত হবার প্রধান কারণ এরা গরীব। এমনটাই সেখানকার দস্তুর। গ্রামে এদের জীবন পর্যবেক্ষণ করতে গিয়ে আমরা দেখি দলিত বস্তি গুলিকে মূল গ্রামীণ এলাকা থেকে পৃথক রাখা হয়েছে। মূল গ্রামীণ এলাকা গুলি তুলনামূলক উন্নয়নের সুযোগ পেলেও দলিত বস্তিগুলি অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে। বস্তি গুলিতে কোথাও জলের পাইপটুকু নেই, নর্দমার কোনো ব্যাবস্থা নেই, কোনো বিদ্যালয় নেই এমনকি একটি পাকা সড়কও নেই। আমরা খোঁজ নিয়ে জানতে পারি গোটা সৌরাষ্ট্র অঞ্চলে দলিতদের এটাই অবস্থা। গুজরাট মডেল আগাগোড়া চুঁইয়ে পড়া অর্থনীতির ভিত্তিতে গড়ে তোলা হয়েছে, বিভিন্ন অঞ্চলে এমন অর্থনৈতিক পরিকল্পনার নিদর্শন ছড়িয়ে রয়েছে সর্বত্র। সেইসব নিদর্শন একটাই সত্য তুলে ধরে - এই ধরনের মডেলে শুধু সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বৈষম্যই বৃদ্ধি পায়।
নয়া উদারবাদী নীতি সবচেয়ে বড় আঘাত হেনেছে দলিতদের উপরেই। নয়া উদারবাদী নীতির বিরুদ্ধে যাবতীয় আন্দোলন-সংগ্রামে এই কারণেই দলিতদের বিভিন্ন অংশের আন্দোলন-সংগ্রাম এসে যুক্ত হচ্ছে।
ওয়েবডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ