এই ইন্টারফেরন আবিষ্কার হয় ১৯৮৬ সালে। কিউবান চিকিৎসক ল্যুইস হেরেরা ও তার গবেষণা টিম এই ওষুধ তৈরি করে। এই কাজ করা হয়েছিল সেন্টার ফর জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়টেকনোলজি – কিউবা’তে। তারপরে এই ওষুধ ৪০ বছর ধরে এইচআইভি-এইডস (HIV-AIDS), হেপাটাইটিস বি এবং সি (Hepatitis B and C), হারপিস জস্টার (Herpes Zoster), ডেঙ্গু (Dengue) এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সার রোগের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করে অভাবনীয় সাফল্য পেয়েছে কিউবা। তিন বছর আগে মার্স-রোগের মহামারীর সময়েও এই ওষুধ প্রয়োগে সাফল্য এসেছিল।
চিকিৎসক ল্যুইস হেরেরা টেলিস্যুর কে দেওয়া স্বাক্ষাতকারে জানিয়েছেন এই ইন্টারফেরন আলফা– টু বি রিকম্বিট্যান্ট ( Interferon Alpha-2B Recombinant – IFNrec ) আসলে মানব শরীরের কোষের ভিতরে থাকা ইন্টারফেরনের স্বাভাবিক মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয় যা করোনা ভাইরাস আক্রান্ত মানুষের শরীরে ক্রমাগত কমতে থাকে। এই করোনা ভাইরাস মানব শরীরে প্রবেশ করে নিজেকে ক্রমাগত বাড়াতে থাকে (Replication) যার ফলে শরীরে ইন্টারফেরনের মাত্রা কমে আসে।এই ওষুধ ইন্টারফেরন আলফা– টু বি রিকম্বিট্যান্ট (Interferon Alpha-2B Recombinant – IFNrec ) মানুষের শরীরে সজীব উৎপাদনের রাসায়নিক পরিবর্তন বা Metabolism পদ্ধতির একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় কাজ করে একদিকে ইন্টারফেরনের মাত্রাকে স্বাভাবিক রাখে যাতে শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বজায় থাকে অন্যদিকে এই ওষুধ ভাইরাসের ক্রমাগত বৃদ্ধি (Replication) আটকে দেয়। এই স্বাক্ষাতকারে চিকিৎসক ল্যুইস হেরেরা জানান অতিমারির এই দুর্দশা আমাদেরকে সুযোগ করে দিয়েছে যখন সবাইকে একটি সত্য স্বীকার করতে হবে যে স্বাস্থ্য মুনাফার লক্ষ্যে বানিজ্যের কোন বিষয় নয়, বরং মানুষের একটি মৌলিক অধিকার (“The world has an opportunity to understand that health is not a commercial asset, but a basic right”)।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেস ব্লগে প্রকাশিত একটি ফিচারে গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হেলেন ইয়াফি কিউবার আবিষ্কৃত এই ইন্টারফেরন’কে করোনা ভাইরাসের চিকিৎসায় একটি “আশ্চর্য ওষুধ” (Wonder Drug) বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন তার নিজস্ব সুত্রে তিনি জানেন অন্তত ১৫ টি দেশ কিউবার কাছে এই ওষুধটির জন্য আবেদন জানিয়েছে। চীনের জাতীয় স্বাস্থ্য কমিশন এই ওষুধটিকে করোনা (COVID-19) সংক্রমণের চিকিৎসার প্রয়োগ করা যায় এমন ৩০ টি ওষুধের তালিকায় রেখেছে। চীনে সংক্রমণ মোকাবিলায় এই ওষুধ প্রয়োগে ১৫০০ জনকে সুস্থ করে তোলা গেছে।
এই সময়ে সারা পৃথিবীর ৫৯ টি বিভিন্ন দেশে কিউবার চিকিৎসকেরা কাজ করছেন যার মধ্যে ৩৭ টি দেশই করোনা ভাইরাসের (COVID-19) কবলে আক্রান্ত হয়েছে। উল্লেখ করা যেতে পারে গ্রেনেদা, জামাইকা, নিকারাগুয়া, স্যুরিনেম এবং ভেনেজুয়েলার নাম এবং এছাড়াও অন্যান্য আমেরিকান এবং ক্যারিবিয়ান দেশগুলির কথা। সম্প্রতি চীনের সাথে একযোগে তারা চিকিৎসক দল পাঠিয়েছে ইতালিতে। এই চিকিৎসক দল সেখানেও আক্রান্তদের বাঁচাতে এই ওষুধ ইন্টারফেরন আলফা– টু বি রিকম্বিট্যান্ট (Interferon Alpha-2B Recombinant – IFNrec ) প্রয়োগ করবে। চীনের সাথে একযোগে Collaboration Mission’র কাজে নামার আগে কিউবার পেদ্রো কৌরি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে মোট ৪০০ জন চিকিৎসক এবং বিশেষজ্ঞ সারা পৃথিবীতে এই সংক্রমণ ঠেকাতে নিজেরা উপযুক্ত প্রশিক্ষন নিয়েছেন।
পৃথিবী জূড়ে চলা অতিমারির সময়ে কিউবা এখনও অবধি নিজেদের দেশে ১১.৫ মিলিয়ন জনসংখ্যায় মাত্র ৪০ জনকে আক্রান্ত খুঁজে পেয়েছে। গত ২৪ মার্চ,২০২০ মঙ্গলবার আক্রান্তদের মধ্যে একজন মারা গিয়েছেন। কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রোর নেতৃত্বে সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা হবার পর থেকেই জনস্বাস্থ্যকে সরকারের তরফে অন্যতম অগ্রাধিকার ঘোষণা করা হয়। সেই অনুসারে কিউবাতে বিনামুল্যে সর্বজনিন স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু করা হয়। সারা পৃথিবীতে এই মুহূর্তে মাথাপিছু চিকিৎসকের সংখ্যা -এই সুচকে কিউবা এক নম্বর স্থানে রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে শপথ নেবার পরেই ডোনাল্ড ট্রাম্প কিউবার উপরে অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য নিষেধাজ্ঞা আরও বাড়িয়ে দেবার ঘোষণা করেন। এর ফলে এখন কিউবাতে তেল, খাদ্যশস্য এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রি (যেমন সাবান)’র ক্ষেত্রে ঘাটতি চলছে। তবুও কিউবা কখনো তাদের বিনামুল্যে সর্বজনিন স্বাস্থ্য পরিষেবা একদিনের জন্যেও বন্ধ করেনি। সারা পৃথিবীর মানুষের পাশে দাঁড়াতে তারা আন্তর্জাতিক সংহতিকেই নিজেদের কর্মসূচি হিসাবে ঘোষণা করেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) কিউবার তৈরি করা ওষুধ ইন্টারফেরন আলফা– টু বি রিকম্বিট্যান্ট (Interferon Alpha-2B Recombinant – IFNrec ) কে সারা পৃথিবীতে করোনা সংক্রমণের মোকাবিলা করার জন্য ব্যাবহার করতে পরীক্ষা করছে। যদিও আমেরিকা কিউবাকে ধ্বংস করতে তাদের নিজস্ব অবরোধের রাজনিতিতেই স্থির হয়ে রয়েছে। অন্যান্য দেশগুলিকেও তারা সেই অবরোধে সামিল হবার নির্দেশ দিয়ে চলেছে। এই নিয়ে হাভানার বিদেশমন্ত্রকের বক্তব্য হল ওয়াশিংটনের জারি করা অবরোধ (Embargo) হল আন্তর্জাতিক নিয়মবিধি লংঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ যার দ্বারা আমেরিকা কিউবার মানবিক দ্বায়িত্ববোধ এবং চিকিৎসাক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অবদানকে আটকাতে চায়।
তথ্যসুত্রঃ ১. নিউজ উইক ২. আই বি টাইমস
শেয়ার করুন