করোনা সঙ্কটে 'মাস্ক'-দখলদারিতে অভিযুক্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র

জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান অনুসারে এই মূহুর্তে গোটা বিশ্বে মোট করোনা আক্রান্তের সংখ্যা ১,২০৪,২৪৬ । সবথেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিন মুলুক - আক্রান্ত ৩১২,২৪৫ জন, মৃত ৮৫০৩ জন। যে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন ৪ সপ্তাহ আগেও করোনা ভাইরাসকে বিশেষ পাত্তা দিচ্ছিল না আজ তারা এক ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। মা্স্কের অভাব, ভেন্টিলেটর সহ অন্যান্য জরুরি চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব আজ প্রধান সমস্যা এই নতুন ভাইরাসকে মোকাবিলার ক্ষেত্রে । এতদিন পর্যন্ত গুরুত্ব না দেওয়ায় আজ আমেরিকার এই গুরুতর পরিস্থিতি। ট্রাম্প প্রশাসন বাধ্য হয়েছে সক্রিয় হতে।

এই আবহেই এক অন্যরকম দখলদারি অভিযোগ উঠেছে মার্কিন প্রশাসনের বিরুদ্ধে। জার্মান প্রশাসন সরাসরি অভিযোগ করেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাঙ্কক থেকে জার্মানির জন্য বরাদ্দ ২লক্ষ মাস্ক বাজেয়াপ্ত করে নিজেদের দেশে তা চালান করেছে । বার্লিনের পুলিশ বাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা এই FFP2 মাস্কগুলো তাদের গন্তব্যে পৌঁছায়নি । বার্লিনের স্থানীয় প্রশাসন এই ঘটনাকে 'আধুনিক জলদস্যুবৃত্তি' সম্বোধন করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছে। বার্লিনের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রেইয়াস গাইজেল এই অভিযোগ তুলেছেন। ঘটনাচক্রে শুক্রবার হোয়াইট হাউস থেকে নিয়মমাফিক করোনা ভাইরাস টাস্ক ফোর্সের বিবৃতি দেওয়ার সময়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন যে মার্কিন প্রশাসন ডিফেন্স প্রোডাকশান এ্যাক্ট প্রয়োগ করে ২০০,০০০ N95 রেস্পিরেটার, ১৩০,০০০ সার্জিকাল মাস্ক, ৬০০,০০০ গ্লাভস বাজেয়াপ্ত করেছে । যদিও এগুলো কীভাবে সংগ্রহ করা হয় তা বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়নি।

ট্রাম্প প্রশাসন কোরিয়া-যুদ্ধ সময়কালীন ১৯৫০ সালের ডিফেন্স প্রোডাকশান এ্যাক্ট লাগু করেছে। রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প বলেছেন যে তিনি '3M কে জোরালো ধাক্কা দিতে' আইনটি প্রয়োগ করেছেন।এই আইনবলে মার্কিন সংস্থাগুলিকে জাতীয় প্রতিরক্ষার জন্য পণ্য তৈরি করতে বাধ্য করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে মার্কিন রাষ্ট্রপতিকে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই 3M হল মিনেসোটা ভিত্তিক একটি চিকিৎসা সরঞ্জাম নির্মানকারী বহু জাতিক সংস্থা। যারা এখন মার্কিন প্রশাসনের তীব্র আক্রমণের সামনে পরেছে। তাদেরকে লাগাতার চাপে রাখছে ট্রাম্প প্রশাসন যাতে তারা সার্জিকাল মাস্ক সহ অন্যান্য সরঞ্জাম অন্য কোন দেশে রপ্তানি না করে।

শুক্রবার সন্ধ্যায়, ট্রাম্প প্রশাসন ডিফেন্স প্রোডাকশান এ্যাক্ট এর ভিত্তিতে একটি এক্সিকিউটিভ আদেশ জারি করেছে ফেডেরাল এমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি (FEMA) এবং স্বাস্থ্য আধিকারিকদের জন্য । এই আদেশ বলে তাদের দেশের প্রয়োজনে রেসপিরেটার, সার্জিলকাল মাস্ক এবং গ্লাভস সংরক্ষণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যদিও স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যাপক বেসরকারিকরণের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই আইন প্রয়োগের পরেও New York Times এর প্রতিবেদন অনুসারে ফেডেরাল এমার্জেন্সি ম্যানেজমেন্ট এজেন্সি মার্কিন বহুজাতিক সংস্থাগুলিতে তৈরি অন্যান্য দেশের জন্য বরাদ্দ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংগ্রহ করলেও এর মাত্র ২০ শতাংশ সরকারি ভাবে বিতড়ন হয় ও বাকি ৮০ শতাংশ বেসরকারি সংস্থাগুলোর মাধ্যমে পৌঁছানো হয়। 3M এর অভিযোগ এই নির্দেশকে কাজে লাগিয়ে এখন তাদের বাধ্য করা হচ্ছে পূর্ব নির্ধারিত কানাডা ও লাতিন আমেরিকার জন্য বরাদ্দগুলো বাতিল করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সেগুলো দিয়ে দিতে। 3M এর বক্তব্য এর ফলে "গুরুতর মানবিক প্রভাব" পরবে দুনিয়া জুড়ে।

এই ঘটনার প্রেক্ষিতে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো শুক্রবার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। এইভাবে ট্রাম্প প্রশাসন অন্যান্য দেশের জন্য বরাদ্দ সরঞ্জামে দখলদারি শুরু করলে তা " অত্যন্ত ভুল হবে এবং পারস্পরিক বাণিজ্য হ্রাস পাবে" বলে জানান ট্রুডো। 3M ওপরে মার্কিন প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার পরেই জরুরি ভিত্তিতে কানাডার সরকার অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহকারী সংস্থাগুলির সাথে যোগাযোগ করে এবং চিনা প্রশাসনের সাথেও যোগাযোগ করে। শনিবার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো জানান পরবর্তী ৪৮ ঘন্টার মধ্যে চিন থেকে N95 মাস্ক ও অন্যান্য চিকিৎসা সামগ্রী আনার জন্য তারা যুদ্ধকালীন তৎপরতায় কাজ চালচ্ছেন এবং কানাডিয়ান এয়ারলাইন্স, এয়ার কানাডা ও কার্গো জেট সংস্থাগুলির বিমানে তা নিয়ে আসা হবে। গোটা প্রক্রিয়াটি সময়ের মধ্যে শেষ করার জন্য তারা চিনে একটি গুদামঘর ও লিজ নিয়েছেন।

সবথেকে অবাক করা বিষয় হল এটাই যে ট্রাম্প নিজে ও তার প্রশাসন বারবার করে নভেল করোনা ভাইরাসকে 'চিনা ভাইরাস', 'ইউহান ভাইরাস' নামে সম্বোধন করার পাশাপাশি সরাসরি চিনের বিরুদ্ধে ভাইরাস ছড়ানোর অভিযোগ জানিয়ে এসেছে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে। আর সেই চিনেই 3M সহ গোটা দুনিয়ার বহুজাতিক চিকিৎসা নির্মাণ সংস্থাগুলির বেশিরভাগ মাস্ক ও অন্যান্য চিকিৎসা সরঞ্জাম তৈরি হয়ে থাকে। New York Times এর একটি পরিসংখ্যান অনুসারে করোনা মহামরির রূপ নেওয়ার আগে গোটা পৃথিবীর ৫০ ভাগ মাস্ক তৈরি হত চিনের কারখানগুলোতে আঋ করোনা ছড়ানোর পরে সেই কারখানাগুলির উৎপাদন ক্ষমতা ১২-১৪ গুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে গোটা মার্কিন মুলুক সহ গোটা বিশ্বের মাস্কের জোগান দিতে। 3M জানিয়েছে চলতি সপ্তাহে চিনে তাদের কারখানায় তৈরি হওয়া ১ কোটি N95 রেস্পিরেটার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করার জন্য ইতিমধ্যেই তারা চিনা প্রশাসনের থেকে অনুমোদন পেয়েছে ।

এই আবহে শুধুমাত্র জার্মানি বা কানাডা না অভিযোগ উঠছে অন্যান্য ইউরোপীয় দেশগুলোর পক্ষ থেকেও। ফ্রান্সের স্বাস্থ্য আধিকারিকদের অভিযোগ চিনা বিমানবন্দরগুলোতে রীতিমত নিলাম ডাকার মত করে ফ্রান্সের দরপত্রের থেকে ৩ থেকে ৪ গুণ বেশি দাম দিয়ে আমেরিকানরা অগ্রিম অর্থের বিনিময়ে মাস্ক তাদের দেশের জন্য নিয়ে যাচ্ছে। প্যারিস ও সংলগ্ন অঞ্চল নিয়ে গঠিত প্রশাসনিক বিভাগ 'ইল দ্যুঁ ফ্রান্স' এর প্রধান ভ্যালেরি পেক্রসের মতে এই ভয়াবহ মহামরির সমযে যখন গোটা বিশ্ব জুড়ে মাস্ক ও পিপিই এর আকাল তখন মার্কিনীরা রীতিমত গুপ্তধন সন্ধানী জলদস্যুদের মত আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পরছে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন