CPIMCC

কেন্দ্রীয় কমিটির বিবৃতি

৩০ জানুয়ারি,সোমবার,২০২৩

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি(মার্কসবাদী)-এর কেন্দ্রীয় কমিটি ২৮-২৯ জানুয়ারি, ২০২৩ তারিখে কলকাতায় বৈঠক করে নিম্নলিখিত বিবৃতি জারি করেছে:

আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগ

আদানি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে হিন্ডেনবার্গ রিসার্চের অভিযোগের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের প্রতিদিনের পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে উচ্চ-স্তরের তদন্ত জরুরি।এই তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত এবং সত্য না জানা পর্যন্ত ভারত এবং আমাদের জনগণের স্বার্থ রক্ষা করতে হবে। এলআইসি-এর প্রায় ৮০,০০০ কোটি টাকা আদানির সংস্থাগুলিতে বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং জাতীয় ব্যাঙ্কগুলির গোষ্ঠীর থেকে নেওয়া সামগ্রিক ঋণের ৪০ শতাংশ স্টেট ব্যাঙ্কের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে। এলআইসি এবং এসবিআই উভয়ই এমন প্রতিষ্ঠান যেখানে কোটি কোটি ভারতীয় তাদের ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য তাদের সারা জীবনের অর্জন সঞ্চয় করে রাখে। এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর থেকে আদানি গোষ্ঠীর পুঁজি শেয়ার বাজারে ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি কমেছে। এইভাবে সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গচ্ছিত মানুষের জীবনব্যাপী সঞ্চয়কে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাওয়া চলতে পারে না।

সিপিআই(এম) অন্যান্য ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সাথে সমন্বয় করবে এবং সংসদের আসন্ন বাজেট অধিবেশনে এই প্রসঙ্গ উত্থাপন করবে।

ভারতীয় অর্থনীতি

মন্দা পরিস্থিতি তীব্র হওয়ার সাথে সাথে ভারতীয় অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ছে। অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের বিষয়ে সরকারের সমস্ত প্রচার এবং দাবি সত্ত্বেও, ভারতের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য বিনিয়োগ বাড়ছে না। এর মানে হল কর্মসংস্থান সৃষ্টি না কমলেও স্থবির হয়ে গেছে যা দেশের মানুষের দারিদ্র্য ও দুর্দশা বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখছে।

বৈষম্যের অশ্লীল প্রসার: অক্সফাম রিপোর্ট, যার শিরোনাম 'সার্ভাইভাল অফ দ্য রিচেস্ট: দ্য ইন্ডিয়া সাপ্লিমেন্ট', দেখায় যে ভারতের ৪০ শতাংশেরও বেশি সম্পদ তার জনসংখ্যার মাত্র ১ শতাংশের মালিকানাধীন।১০ জন ধনীতম ভারতীয়ের মোট সম্পদ ২০২২ সালে ২৭.৫২ লক্ষ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে , ২০২১ থেকে ৩২.৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।জনসংখ্যার নীচের ৫০ শতাংশের হাতে রয়েছে মাত্র ৩ শতাংশ সম্পদ।

ভারতে মোট বিলিয়নেয়ারের সংখ্যা ২০২০ সালে ১০২ থেকে বেড়ে ২০২২ সালে ১৬৬ হয়েছে ৷ এর সম্পূর্ণ বিপরীতে ভারতের প্রায় ২৩ কোটি মানুষ - গোটা বিশ্বের সর্বোচ্চ - দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে৷

ভারতে পশ্চাদপদ কর ব্যবস্থার কথা উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে আমাদের দেশের নীচের তলার ৫০ শতাংশ মানুষ উপরের ১০ শতাংশের তুলনায় আয়ের শতাংশ হিসাবে পরোক্ষ করের ক্ষেত্রে ৬ গুণ বেশি প্রদান করে। খাদ্য এবং খাদ্য ব্যতীত অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস থেকে সংগৃহীত মোট করের মধ্যে ৬৪.৩ শতাংশ নীচের দিকের ৫০ শতাংশ দ্বারা ব্যয় করা হয়েছিল।

মোদি সরকার যে ধনীদের জন্য কর ছাড় অব্যাহত রেখেছে তা বন্ধ করার সময় এসেছে, একটি সম্পদ কর এবং একটি উত্তরাধিকার কর প্রবর্তন করতে হবে এবং সমস্ত প্রয়োজনীয়, বিশেষত খাদ্য সামগ্রীর উপর জিএসটি অবশ্যই বাতিল করা উচিত।

তীব্র সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণকে তীক্ষ্ণ করার প্রচেষ্টা বিভিন্নভাবে বাড়ছে। সমস্ত বিজেপি শাসিত রাজ্য ঘোষণা করেছে যে তারা তাদের রাজ্যে অভিন্ন দেওয়ানী বিধি প্রয়োগের উদ্যোগ নেবে। একই সাথে মুসলমান ব্যক্তিগত বিধি বাতিল সম্পর্কেও তারা কড়া মন্তব্য করছে।সমস্ত বিজেপি রাজ্য সরকার ইতিমধ্যেই 'লাভ জিহাদ' বা 'গরু সুরক্ষা' এর নামে মুসলমান সংখ্যালঘুদের লক্ষ্য করে আইন প্রণয়ন করেছে এবং এমন শর্ত দিয়েছে যা কার্যত কোনো স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরকরণ এবং আন্তঃধর্মীয় বিবাহ নিষিদ্ধ করে।শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিপজ্জনকভাবে মুসলমান পড়ুয়াদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার ঘটনা বাড়ছে।

উত্তরপ্রদেশের বিজেপি পরিচালিত রাজ্য সরকার মুসলমান সংখ্যালঘুদের মৌলিক সাংবিধানিক অধিকার অস্বীকার করে আক্রমনাত্মকভাবে উস্কানিমূলক সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা করছে। সম্প্রতি, উত্তরপ্রদেশের বরেলি জেলার একটি সরকারি স্কুলের অধ্যক্ষ একটি জনপ্রিয় উর্দু প্রার্থনার গান গাওয়া শিশুদের স্কুল থেকে বহিষ্কার করেছেন।

ছত্তিশগড়ের উত্তর বস্তার জেলায় খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ওপর বড় আকারের হামলা হয়েছে। এই ধরনের হামলার অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণের অপপ্রচারকে যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই। জোর করে ধর্মান্তরিত করার একটি ঘটনাও রিপোর্ট করা হয়নি। এটি খ্রিস্টান সম্প্রদায়কে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করার একটি এজেন্ডা এবং আরএসএস/বিজেপির পৃষ্ঠপোষকতায় বজরং দলের দ্বারা 'ঘর ভাপসি' করতে বাধ্য করার একটি স্পষ্ট ঘটনা। বিশেষ করে নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক অপরাধমূলক হামলা সংঘটিত হয়েছে।

একজন বিজেপি সাংসদ এবং রেসলিং ফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ার সভাপতি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগীতায় পদক জয়ী মহিলা কুস্তিগীরদের দ্বারা যৌন হয়রানির গুরুতর অভিযোগের মুখোমুখি হয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সরকার বা ক্ষমতাসীন দল কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

বিলকিস বানো মামলায় দোষীদের যাবজ্জীবন সাজা মকুবের পরপরই, দাঙ্গার দায়ে অভিযুক্ত ২১ জনকে এবং ২০১৪ সালের জুন মাসে পুনেতে মহসিন শেখের ঠাণ্ডা মাথায় হত্যায় অভিযুক্ত সকলকেই মুক্তি দেওয়া হয়েছে এবং হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলোর একটি বড় দল তাদেরকে স্বাগত জানিয়েছে। পুলিশ ও প্রশাসন এখন পর্যন্ত উচ্চতর আদালতে এই রায়ের বিরোধীতা করে কোন আপিল করেনি।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা

একটি 'নিয়ন্ত্রিত' বিচারব্যবস্থা কায়েমের জন্য, সরকার সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্ট কলেজিয়ামের সুপারিশ করা বিভিন্ন নাম নিয়ে দেরি করে বা নিয়োগে অস্বীকার করে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্টে বিচারক নিয়োগে হস্তক্ষেপ করছে।মোদি সরকারের লক্ষ্য উচ্চতর বিচার বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের অধীনস্থ করা। এইভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার অবক্ষয় সাংবিধানিক কাঠামোকে বিপন্ন করবে এবং কর্তৃত্ববাদের সম্পূর্ণ আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা করবে।

রাজ্যপালদের ভূমিকা

যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর আক্রমণকে তীব্র করে, অ-বিজেপি শাসিত রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের রাজ্যপাল এবং উপ রাজ্যপালরা তাদের সাংবিধানিক অবস্থান লঙ্ঘন করে ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলোকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন।কেরালা, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র এবং এখন তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল এবং দিল্লি, লাক্ষাদ্বীপ, আন্দামান এবং পুদুচেরির মত কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের উপ রাজ্যপালরা তাদের সাংবিধানিক পদের চরম অপব্যবহার করছেন।

তামিলনাড়ুর রাজ্যপাল রাজ্য সরকারের তৈরি বিধানসভায় ভাষণটির কিছু অংশ পড়তে অস্বীকার করেন। কেরালার রাজ্যপাল নির্বাচিত রাজ্য বিধানসভা দ্বারা গৃহীত বিলগুলি বলবতের ক্ষেত্রে অহেতুক দেরি করেন।

রাজ্য সরকারগুলির সাংবিধানিক ভূমিকাকে দুর্বল করার জন্য রাজ্যপালের কার্যালয়কে একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা হয় এবং এটি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী প্রবণতা এবং ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের প্রবণতাকেই স্পষ্ট করে।

ত্রিপুরা বিধানসভা নির্বাচন

সিপিআই(এম) ত্রিপুরায় সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির সহযোগিতা চাইছে যাতে বিজেপি রাজ্য সরকার যে সন্ত্রাস ও হিংসাত্মক রাজনীতির সূচনা করেছে, গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনকে ক্ষুণ্ণ করেছে, তা থামানো যায় বিজেপিকে সরকার থেকে হঠিয়ে।

এই হিংসার ধরণ স্পষ্টতই সন্ত্রাস ও ভয়ের পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে যা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনাকে স্পষ্টভাবে প্রভাবিত করবে। ইসিআইকে অবশ্যই জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করতে হবে।একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য ত্রিপুরায় গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হওয়া প্রয়োজন ।

কেন্দ্রীয় কমিটি আহ্বান

১.অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের পূর্বশর্ত হিসাবে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকার পুনরুদ্ধার করতে ত্রিপুরায় জনগণ এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির সাথে সংহতি।সিপিআই(এম) সংহতি প্রকাশ করে সারা দেশে কর্মসূচির আয়োজন করবে।

২. ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দারিদ্র্য এবং বৈষম্যের সাথে জনগণের জীবন জীবিকার উপর ক্রমাগত আক্রমণের বিরুদ্ধে ২২ থেকে ২৮ তারিখ জুড়ে ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে প্রতিবাদী পদক্ষেপের জন্য দেশব্যাপী আহ্বান।

২০২৩-২৪ কেন্দ্রীয় বাজেটে যে সমস্যাগুলি উত্থাপিত হবে তার সাথে, প্রতিবাদ কর্মসূচী ও এই প্রচারাভিযান নিম্নলিখিত দাবিগুলিকে তুলে ধরবে:

  • কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন পরিকাঠামো গঠনের প্রকল্পে সরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।
  • ৫ কেজি বিনামূল্যে খাদ্যশস্যের সাথে ৫ কেজি ভর্তুকিযুক্ত খাদ্যশস্য দেওয়া চালু করতে হবে।
  • বেশি মজুরি সহ মনরেগা-র জন্য বরাদ্দ ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি করতে হবে।
  • একটি সম্পদ এবং উত্তরাধিকার কর আরোপ করতে হবে।
  • ধনীদের করছাড় প্রত্যাহার এবং অতি ধনীদের উপর কর আরোপ করতে হবে
  • ওষুধ সহ খাদ্য ও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের উপর জিএসটি প্রত্যাহার করতে হবে।

৩. সিপিআই(এম) ৫ এপ্রিল, ২০২৩-এ শ্রমিক-কৃষকদের সংসদ সমাবেশের ডাকে তার পূর্ণ সমর্থন জানায়।

মার্চ মাস জুড়ে সিপিআই(এম) সারাদেশে নিম্নলিখিত বিষয়গুলিতে রাজনৈতিক প্রচার এবং কর্মসূচী পালন করবে:

  • যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর উপর ক্রমবর্ধমান আক্রমণের সাথে, নির্বাচিত রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে বিশেষ করে অ-বিজেপি রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে বিজেপির নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোকে ধ্বংস করে একটি কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রীয় কাঠামো চাপিয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টার বিরোধিতা।
  • বিচার বিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করার জন্য বিজেপি সরকারের প্রচেষ্টার নিন্দা করে প্রচার করা হবে। উচ্চতর বিচার বিভাগকে সরকারের অধীনস্থ করার জন্য মোদি সরকারের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিচার বিভাগের সাংবিধানিক ভূমিকা রক্ষার জন্য সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তিকে একত্রিত করতে হবে।
  • একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে নির্বাচনী সংস্কারে গণতান্ত্রিক ও সমানে সমানে লড়াইয়ের ক্ষেত্র তৈরি করা দরকার। সিপিআই(এম) এর ২৩তম কংগ্রেস তার রাজনৈতিক প্রতিবেদনে নির্বাচনী সংস্কারের একটি প্রকল্পের উল্লেখ করেছে যা অবিলম্বে চালু করা উচিত।
  • প্যালেস্তাইনের জনগণের পক্ষে সংহতি জানিয়ে এবং ডানপন্থী ইসরায়েলি সরকারের দমন-পীড়নের বিরুদ্ধে প্রচার সংগঠিত করা হবে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন