Caste Census

জাতিভিত্তিক জনগণনায় সত্যের মুখোমুখি হতে ভয় কেন?

অলকেশ দাস

বহুমাত্রিক সত্য

ভারতে কারাগারে বন্দীদের অর্ধেকের বেশি মুসলিম, দলিত ও আদিবাসী।  ভারতের জনসংখ্যায় এই তিনটি সম্প্রদায়ের অংশ ২০১১ সালের  সর্বশেষ জনগণনা অনুযায়ী ৩৯.৪ শতাংশ৷ কিন্তু এই অংশের মানুষের মধ্যে বন্দীদের অনুপাত ৫০.৮ শতাংশ৷ এই তিনটি সম্প্রদায়ই ভারতে অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে সবচেয়ে পিছিয়ে। শিক্ষার হার কম, স্কুল ও উচ্চ শিক্ষার সুযোগ বেশি সীমিত, দারিদ্র্যের হার বেশি, বেকারত্ব বেশি এবং এদের হাতে গড় জমির পরিমাণ সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের তুলনায় কম।  হিংসা, বৈষম্যের শিকার ।  এটা ভারতের অসম এবং বৈষম্যমূলক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য।  নিছক ব্যতিক্রমী কোন বিকৃতি নয়। পশ্চিমবঙ্গে রাজ্যের বন্দীদের মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ৩৭ শতাংশ। অথচ  রাজ্যের জনসংখ্যায় মুসলিম অংশ ২৭ শতাংশ। মুসলমানদের বন্দী করার ক্ষেত্রে তৃণমূল সরকারের ভূমিকা বিজেপি সরকারের চেয়ে পৃথক নয়। এইসব তথ্যগুলি আমাদের বহুমাত্রিক সত্যে উপনীত হতে সাহায্য করে। জাতিভিত্তিক জনগণনা আমাদের সামনে কিছু তথ্য হাজির করবে। সেই তথ্য অনেক কিছু সত্য আমাদের সামনে উন্মুক্ত করবে। সত্যের মুখোমুখি হতে যারা ভয় পায় তারাই বিরোধিতা করছে  জাতিভিত্তিক জনগণনার।

ধুলোয় মিশবে ৮১ শতাংশ হিন্দুত্বের গর্ব

জাতিভিত্তিক জনগণনার প্রকৃত এবং বৈজ্ঞানিক তথ্য বিভিন্ন জাতি সম্পর্কে,  তাদের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা দেবে।  বিকল্প নীতি গ্রহণে সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বিকল্প নীতি গ্রহণে সাহায্য করবে। আজকের পরিস্থিতিতে দুর্বল অংশ এবং জাতিগত তথাকথিত পিছিয়ে পড়া অংশকে এই বোধে নিয়ে আসতে সাহায্য করবে যে আসলে সমাজের জাতি বিভাগ তাদের কি নির্মমতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আরএসএস, বিজেপি সব সময়ই জাতিভিত্তিক জনগণনার বিরুদ্ধে কারণ তা হিন্দুত্ব সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রকৃত রূপ মানুষের সামনে তুলে ধরবে।মনুধর্ম আদর্শ হলে সে তো সামাজিক ন্যায়ের বিরোধী হবেই। হিন্দুদের যদি হিন্দুত্বের ভিত্তিতে সাম্প্রদায়িকীকরণের পথে নিয়ে যেতে হয় তাহলে বহমান সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক অসমতা এবং অত্যাচার যা জাতির ভিত্তিতে রচিত তাকে ঢাকতেই হবে এবং তাকে সামনে আনা যাবেনা। জাতিভিত্তিক জনগণনা হলে তা জাতি ব্যবস্থার নগ্নরূপ তুলে ধরবে যা আসলে হিন্দুত্বর প্রাণ। ৮১ শতাংশ হিন্দুত্বের গর্ব ধুলোয় মিশে যাবে । যদি বঞ্চিত ও অত্যাচারিতরা যাদের মধ্যে ওবিসিও আছে যারা বিজেপির ভাষায় হিন্দু তারাও চেঁচাতে শুরু করে অসম সম্পদ,পেশা বন্টনের বিষয়ে তাহলে সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব প্রকল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এই জন্যই জাতিভিত্তিক গণনা আরএসএস এবং বিজেপির পছন্দের নয়।

ভাঙবে শ্রেষ্ঠত্ব আর হীনমন্যতার তত্ত্ব

ঠিক যেমন এস ই সি সি'১১'র (সোশিও ইকোনমিক কাস্ট সেন্সাস) জাতিভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলো না বিজেপি'র কেন্দ্রের সরকার, নির্ভুল নয় বলে। অথচ সরকারই বলল প্রতিবেদনে কেবল ১.১৩ শতাংশ ত্রুটি। সেন্সাস পর্যন্ত ২ শতাংশের নিচে ত্রুটিকে নগণ্য বলে ধরেছে।  ওই রিপোর্টের অর্থনৈতিক তথ্য কেন সরকার গ্রহণ করল দারিদ্র্য দূরীকরণের কর্মসূচিতে? আসলে জাতিভিত্তিক সোশিও ইকোনমিক কাষ্ট সেন্সাস প্রকাশিত হলে সমাজে  ভয়ঙ্কর বৈষম্যের চিত্র সামনে আসবে। সাবিত্রীবাই ফুলে পুনে ইউনিভার্সিটি আর জওহরলাল নেহেরু ইউনিভার্সিটি ও ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ দলিত স্টাডিস তাদের গবেষণাপত্রে দেখিয়েছে যে দেশের জনসংখ্যার ২২.৩ শতাংশ তথাকথিত হিন্দু উচ্চ জাতি। তারা  দেশের সম্পদের ৪১ শতাংশ ভোগ করে। জনসংখ্যার ৭.৮ শতাংশ আদিবাসী। যাদের  আরএসএস- বিজেপি হিন্দু বলে চিহ্নিত করতে চায় তারা ভোগ করে দেশের সম্পদের ৩.৭ শতাংশ। আসলে জাতি ভিত্তিক জনগণনা তথাকথিত হিন্দু সম্প্রদায়ের রাজনীতির প্রকৃতি প্রকাশ করবে।  সমাজে বেশি শ্রম করা মানুষের বেশিরভাগ তথাকথিত নিম্নবর্ণের অংশের এই হতদরিদ্র চেহারা আঙুল তুলবে বর্ণাশ্রমের পাহারাদার বিজেপি এবং আরএসএস এর দিকে। নিম্নবর্ণের মানুষকে যারা হিন্দু বন্ধনীতে ঢুকিয়েছে সেই মানুষ সম্পদের অসম বন্টন দেখে ঘৃণা করবে সঙ্ঘ বাহিনীকে। জাতিভিত্তিক জনগণনা প্রয়োজন বর্ণ ও আর্থসামাজিক শিক্ষাগত উন্নয়নের মধ্যে সম্পর্ক বোঝাতে।

শাসক যে কত দেউলিয়া তা ধরা পড়বে এখানে। আর এই বঞ্চনার চিত্র দেখে যদি বহুজাতি যেমন দলিত ,আদিবাসী ,অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতি যদি চলে আসে এক ছাদের তলায়? যদি দাবী করতে থাকে তাদের ওপর চলে আসা বঞ্চনার বৈষম্যের প্রতিবিধানের? খুব চাপ পড়বে জাতিব্যবস্থার উপর। কারণ তারা শেখায় এই জাতি ব্যবস্থায় দুটি জাত কখনো একে অপরের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে পারে না। কারণ তাদের মধ্যে নাকি অবশ্যই  অন্তগ্রথিত শ্রেষ্ঠত্ব এবং হীনমন্যতার সম্পর্ক থাকতেই হবে।  কিন্তু বৈষম্য এবং তার উৎস জানতে পারলে গণতান্ত্রিক উপাদানকে এক করা যায়। সেইজন্যই প্রকৃত জাতিভিত্তিক জনগণনার ফলাফল আমাদের ইতিবাচক অবস্থানের দিকে ধাবিত করতে পারে।

ওবিসি প্রস্থচ্ছেদ: বিজেপির প্রসারিত থাবা

 ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে মোদি নিজেকে ওবিসি বলে ঘোষণা করেছিলেন। বিজেপি দীর্ঘ সময় ধরেই উচ্চ জাতির পার্টি বলে পরিচিত ছিল। দলিত,বহুজনকে তারা এড়িয়ে চলত। কিন্তু যখন আরএসএস অনুভব করে এই বাহ্যিক পরিচিতি সংসদীয় ক্ষমতা দখল করার পথে অন্তরায় তখন তারা ভোলবদল করতে শুরু করে। প্রথমে আদিবাসী, তারপর তপশিলি এবং তার পরবর্তী ক্ষেত্রে ওবিসিদের অন্তর্ভুক্ত করবার ফাঁদ পাতে। যাকে বলে মাইক্রো লেভেল সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। পরিচিতি সত্তার রাজনীতিকে তারা সুকৌশলীভাবে প্রয়োগ করতে শুরু করে। যেমন উত্তরপ্রদেশে তাদের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিং ছিলেন ওবিসি সম্প্রদায়ভুক্ত (লোধ)।২০১৩ সাল থেকে বিজেপির মধ্যেই এক বিশাল পরিবর্তনের ঢেউ রয়েছে। তার প্রভাব পড়ে লোকসভা নির্বাচনে। ২০১৯ এ লোকসভা নির্বাচনে নির্বাচনে বিজেপি মোট ভোট পায় ৩৭.৪ শতাংশ। কিন্তু তার মধ্যে ওবিসি ভোটের শতাংশ ৪৪। বিজেপি ও বি সি ভোট পায়  বিহারে ২৬, উত্তরপ্রদেশে ৬১, পশ্চিমবাংলায় ৬৮, তেলেঙ্গানায় ২৩, কর্নাটকে ৫০, উড়িষ্যায় ৪০ শতাংশ।   অন্তর্ভুক্তিমূলক হিন্দুত্বের প্রভাবে একদিকে যেমন ওবিসিদের মধ্যে বিজেপির উত্থান ঘটে ঠিক তেমনি এতদিন যে আঞ্চলিক দলগুলো(আরজেডি, এস পি ইত্যাদি) ওবিসিদের সিংহভাগের প্রতিনিধিত্ব করছিল তাদের ভোট ক্রমশ কমতে থাকে।২০০৯/১৪/১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে এরা পায় যথাক্রমে ৩৭.৩/৩৯/২৬.৪ শতাংশ। যখন ওবিসিরা বিজেপির পক্ষে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে তখন বিজেপি ওবিসিদের প্রকৃত সংখ্যা নির্ণয়ের জন্য জাতিভিত্তিক জনগণনায় বাধা দিচ্ছে। কেন?

বিজেপি যে ভয়ে কাঁটা

বিহারের জাতি গণনায় নির্ধারণ হয়েছে জনসংখ্যার ৬৩.১৪ শতাংশ ওবিসি। এন এস এস ও যা নির্ধারণ করেছিল তার চেয়েও বেশি। বিহারের জাতিগণনায় ১১২ টি জাতির ইবিসি (এক্সট্রিম ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস, অতি পশ্চাদপদ) জনসংখ্যার ৩৬.০১ শতাংশ।২৯টি জাতির ওবিসি ২৭.১৩ শতাংশ।  মোট ওবিসি ৬৩.১৪ শতাংশ। তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের শতাংশ শতাংশ ১৯.৬৫। আদিবাসী ১.৬৮ শতাংশ। সাধারণ জাতিভুক্ত ১৫.৫৮ শতাংশ। এদের মধ্যে আবার ৪.৮ শতাংশ মুসলিম শেখ, সৈয়দ, পাঠান ইত্যাদি আছে। এদের মধ্যে ব্রাহ্মণ(৩.৬৫) ,রাজপুত (৩.৪৫), ভূমিহার (২.৮৬),কায়স্থ(০.৬০) অর্থাৎ মোট১০.৫৬ শতাংশ যারা দাপটে নিয়ন্ত্রণ করে জনজীবনকে। প্রশ্ন উঠতেই পারে দশ কেন নিয়ন্ত্রণ করবে বাকি নব্বইকে ? কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে সমাজে তথাকথিত উচ্চবর্ণের মানুষ কত? মোটামুটিভাবে দশ শতাংশের কাছাকাছি। কেন্দ্রে যখন বিজেপি অর্থনৈতিক পশ্চাদপদদের জন্য (ই ডব্লিউ সি) সংরক্ষণের কথা তুললো তখন তার মধ্যে তফসিলি জাতি, আদিবাসী, অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জাতিরও অর্থনৈতিক পশ্চাদপদ অংশকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা অন্যরা বললো। বিজেপি তাকে অগ্রাহ্য করলো। তার মানে পড়ে রইল শুধু উচ্চ জাতি। উচ্চ জাতির সংরক্ষন! বলা হলো প্রাপকদের পারিবারিক আয় মাসিক ৬৬,৬৬৬ টাকার মধ্যে হতে হবে। জমির ক্ষেত্রেও প্রায় একই রকম ঊর্ধ্বমুখী শর্ত। তাহলে এটা শুধু আর অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদদের জন্য রইলো না। উচ্চ আয়ের উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ! সবচেয়ে বড় কথা একতরফা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো কোন তথ্য ছাড়াই ১০ শতাংশ সংরক্ষণের কথা। ৫০ শতাংশের সিলিং ক্যাপ ভেঙে সেই সংরক্ষণ দেওয়া হলো। সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার তার অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেনু গোপালকে দিয়ে বলালো - সংরক্ষণের ৫০ শতাংশের সীমা অলঙ্ঘনীয় নয়। এর আগে যখন মন্ডল কমিশন বলেছিল ৫২ শতাংশ ওবিসিদের সংরক্ষণের কথা, তখন এসেছিল সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের সীমার কথা। ইতিমধ্যেই তফসিলি জাতি (১৫), আদিবাসী (৭.৫)দের জন্য মোট ২২.৫ শতাংশ সংরক্ষণ রয়েছে। সেই জন্য সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ সংরক্ষণের সীমাকে মানতে গিয়ে ৫২ শতাংশ ওবিসি পেল ২৭ শতাংশ সংরক্ষণ। বিহারে এখন তো ওবিসি ৬৩ শতাংশ। উচ্চবর্ণ  প্রায় ১০ শতাংশ। যদি ওবিসিরা এখন প্রশ্ন তোলে ৬৩ ভাগের জন্য ২৭ শতাংশ আর ১০ শতাংশের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণ? তামিলনাড়ু ,কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশে উচ্চ জাতিভুক্ত মানুষ ৫ শতাংশেরও নিচে। সেখানেই বা কেন ১০ শতাংশ উচ্চবর্ণের সংরক্ষণ? এ কি রকম 'সবকা সাথ সবকা বিকাশ'? ভোটের সময় তোমার মন কাঁদে ওবিসিদের জন্য। কিন্তু আসল সময়ে তোমার মন খোলে উচ্চবর্ণের জন্য! এই ভয়েই বিজেপি কাঁটা।

বিহার জাতিগণনা: জাতিভেদের প্রতিফলন সম্পদে

সোসিও ইকোনমিক কাস্ট সেন্সাস'১১ বিহারে শুরু হয়েছিল ২০১২ সালে। বিহারের প্রায় ২ কোটি পরিবারে ছ' খানা প্রশ্ন করা হয়েছিল জমি,  বাড়ির ছাদ,  বাড়ির মূল কাঠামো, ‌বাড়ির ঘর, ফোন,গাড়ি সংক্রান্ত। উত্তর যদি 'হ্যাঁ'  স্কোর ১,উত্তর 'না'  স্কোর ০।  এই রকম অনুযায়ী সাজিয়ে দেখা গেল সবচেয়ে কম স্কোর প্রাপকদের একেবারে নিচের তলায় যে আটটি জাতি তারা সকলে তফসিলি জাতিভুক্ত । সর্বোচ্চ স্কোর প্রাপকদের মধ্যে একেবারে উপরে সবর্ণ ব্রাহ্মণ, রাজপুত, ভূমিহার। জাত পাতের উচ্চ- নিচ শ্রেণীবিভাগের প্রতিফলনের এক রূপরেখা প্রকাশ পাচ্ছে সম্পদের বন্টনে।  বিহারের সাম্প্রতিক জাতি গণনায় (২০২৩) বিগত জনগণনার(২০১১) চেয়ে এই ১২ বছরে তফসিলি অংশের  শতাংশ বেড়েছে ৩.৭৫ শতাংশ (১৫ ৯০-১৯.৬৫)। আদিবাসীদের বেড়েছে . ৪০ শতাংশ (১.২৮--১ ৬৮)। মুসলিমদের বেড়েছে .৮০ শতাংশ। জাতিভিত্তিক জনগণনা শেষ হয়েছিল ১৯৩১ সালে। তার ৯২ বছর পর বিহারে ইবিসি, ওবিসি বেড়েছে প্রায় ১০শতাংশ। এন এস এস ও এর সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে ৫ একরের বেশি জমি দ্বিগুণ রয়েছে উচ্চবর্ণীয়দের হাতে ওবিসিদের তুলনায়। সাধারণ জাতিভুক্তদের মধ্যে স্নাতক ১০.৫ শতাংশ। অথচ ওবিসিদের মধ্যে স্নাতক ২.৮ শতাংশ। মুসলিমদের তিন থেকে চার শতাংশ খানিকটা সরকারের সুবিধা পায়। বাকি ১৪ শতাংশে আলো পৌছায় না।বিহারের ১৩.০৭ কোটি জনগণের ২১৪টি জাতির ১৭টি সামাজিক অর্থনৈতিক সূচকের ভিত্তিতে জাতি গণনায় সময় লেগেছে ৯মাস। বিহার রাজনীতিতে প্রাধান্য কারী ওবিসিভুক্ত যাদবেরা জনসংখ্যার ১৪.২৬ শতাংশ,কুশওয়াহ ৪.২৭ শতাংশ, কুরমি ২.৩১ শতাংশ,বেনিয়া ২.৮৭  শতাংশ প্রকাশ পেয়েছে। তফসিলীদের মধ্যে চামার, মুচি, রবিদাস, চর্মকার জনসংখ্যার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ (৫.২৫শতাংশ) দুষার, ধারি, দারাহি সর্বোচ্চ। ৫.৩১ শতাংশ।

এরাজ্যের প্রথমাও জাতি গণনার বিরোধী

বিষয়টি এত স্পর্শকাতর ছিল যে যখন বিহার মন্ত্রিসভায় ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ হয়েছে জাতি গণনায়, সেই সময় বিজেপি সহ কোন দল বিধানসভায় প্রতিবাদ করেনি। বরং বিজেপি নেতা সুশীল মোদী দাবী করেছে যে তারা যখন সরকারে ছিলেন তখনই এই ধরনের সিদ্ধান্তের প্রস্তাব এসেছে। এই বিষয়টি নতুন নয় এই কারণে যে উত্তর প্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে ব্যাপক সাফল্যের পর, প্রায় এক তৃতীয়াংশ বিধায়ক ওবিসিভুক্ত হওয়ার ফলে উত্তেজিত তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং ঘোষণাই করে ফেলেন যে আগামী জাতি গণনায় (২০২১) ওবিসি গণনা অন্তর্ভুক্ত হবে। ২০১০ সালে ইউ পি এ টু এর সময়ে যখন সোশিও ইকোনমিক কাস্ট সেন্সাস এর প্রস্তাব সংসদে গৃহীত হয় তখনো বিজেপির সমর্থন করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না।    বিজেপির শরিকরাও এ ব্যাপারে বিজেপির সঙ্গে একসাথে পথ হাঁটছে না। উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ডের সরকার জাতি গণনার বিষয়ে এগিয়ে গেছে। কর্ণাটকে যখন কংগ্রেস সরকার ছিল তখন ১৪৭ কোটি টাকা দিয়ে এই সমীক্ষা যখন প্রস্তুত করে বিজেপি সরকারে এসেই তার প্রকাশ বন্ধ করে। এখন কংগ্রেসের সিদ্ধারামাইয়া সরকার আবার তা প্রকাশ করতে উদ্যত। ইতিমধ্যে রাজস্থান সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে জাতিগণনার। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেসের দিগ্বিজয় সিং দাবি করেছেন জাতিগণনার। তামিলনাড়ুতে মন্ত্রিসভার অন্য শরিকেরা জোরালো দাবি তুলেছে জাতিগণনার। রাহুল গান্ধী ধারাবাহিকভাবে সোচ্চার হয়েছেন গোটা দেশে জাতিভিত্তিক জনগণনার জন্য। কেরালা সরকারের ওপরেও চাপ বাড়ছে সোসিও ইকোনোমিক কাস্ট সেন্সাস সংগঠিত করার। পশ্চিমবাংলায় তৃণমূল এবং বিজেপি যে একই তিমিরে আছে, বহিরঙ্গের যুযুধান যে শুধু দ্বিমেরুতা তৈরি করার জন্য তা আবার বোঝা গেছে যখন তারা জাতি গণনা সম্পর্কে একই মত পোষণ করেছে। তৃণমূল কংগ্রেস অস্বীকার করেছে জাতিভিত্তিক জনগণনা সংগঠিত করতে। ভোটের আগে মুসলিম প্রীতি, দলিত প্রীতি সব ধরা পড়ে যাবে যে। যখন প্রকাশিত হবে এদের নিদারুণ দারিদ্র্য, কর্মহীনতা তখন কোন মুখে এদের সরকারের উন্নয়নের গান শোনাবে তৃণমূল? পঞ্চায়েত নির্বাচনে কোর্ট দেখিয়ে দিয়েছে কিভাবে নকল জাতিশংসাপত্র এরা বিলি করেছে। রাজ্যের প্রথমা যে সাব অলটার্নের নেত্রী নন,নন সংখ্যালঘু হিতৈষী-ধরা পড়ে যাবেন বলেই তিনি কট্টর জাতি গণনার বিরোধী।

জাতিগণনার রূপালী রেখাগুলি

ইতিমধ্যেই সমীক্ষায় প্রকাশিত যে দেশ এবং রাজ্যগুলির প্রশাসনের সিংহভাগে উচ্চবর্ণ অধিষ্ঠিত। জাতিভিত্তিক জনগণনা প্রশাসনে এক সামঞ্জস্য আনার আবহাওয়া তৈরি করতে পারে। সংরক্ষণে জনসংখ্যার  সমানুপাতিক প্রতিফলন হোক সেই দাবিও উঠবে। আওয়াজ উঠেছে- 'যিতনি আবাদী, উতনা হক'। 'জিসকি জিতনি সংখ্যা ভারী, উসকি উতনি হিস্সেদারি'। তথাকথিত নিম্ন বর্ণের মানুষকে যেভাবে উন্নয়নের মোহ  তৈরি করে হিন্দুত্বের বন্ধনীতে যুক্ত করার চেষ্টা হয় জাতি গণনার তথ্যে তা ধাক্কা খেতে বাধ্য। ৮১শতাংশ হিন্দু ঐক্যের কথা বলে তাকে মুসলমানের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও হিংসা ছড়ানোর কাজে আরএসএস- বিজেপির যে 'হিন্দুত্ব প্রজেক্ট' তাও বিপদে পড়বে। বিহারের জনগণনায় হিন্দু সংখ্যা ৮১.৯ শতাংশ। এদের মধ্যে তফসিলি, আদিবাসী, ওবিসি যখন দেখবে জনসংখ্যার নিরিখে তাদের উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা থেকে অনেক দূরে, বিপরীতে স্বল্প জনসংখ্যার মানুষ নিয়ে যারা ভোগ করে যাচ্ছে সম্পদের বিপুল অংশ তারা হিন্দুত্বের বন্ধনীতে থাকবে না, সেই জাল ছিন্ন করবে। মুসলমানের বিরুদ্ধে তাদের লড়িয়ে দেওয়ার প্রক্রিয়াও তখন শক্তিশালী থাকবে না। এই একই কারণে তথাকথিত হিন্দু জাতীয়তাবাদী এবং মুসলিম অভিজাতরা জাতি গণনা চাইছে না। হিন্দি বলয়ে যাদব, জাতভ, মিনা ইত্যাদিদের যে সর্বত্র সিংহভাগে অবস্থান সেই পরিপ্রেক্ষিতেরও পরিবর্তন করতে পারে জাতি গণনা। তেলেঙ্গানায় অমিত শাহ বলে এসেছে কোন মুসলমানের সংরক্ষণ থাকবে না। ধ্বংস করে দেয়া হবে সেই সব বিধি। জাতি গণনায় যখন মুসলমানের আর্থসামাজিক দুর্দশার রূপ পরিস্ফুট হবে তখন অমিত শাহের এই কথা বলা বন্ধ হবে। জাতিভিত্তিক জনগণনা সমাধানের কোন ম্যাজিক লন্ঠন নয়। এর তথ্য আমাদের আন্দোলনের দিকে ধাবিত করবে।

প্রবাদ: দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না।

মোদিরা জাতিভিত্তিক জনগণনাকে জাতের নামে বজ্জাতি বলে চালাতে চাইছে।  বলছে যে আম্বেদকার চাইতেন-জাতের বিনাশ। অথচ জাতের নাম করে জনগণনার প্রয়াস চলছে। অথচ আম্বেদকারের সংবিধানের সামাজিক ন্যায়কে গ্রহণ করে না আরএসএস- বিজেপি। সামাজিক সমরাস্তার কথা বলে । অর্থাৎ জাতির ভিত্তিতে উচ্চ নিচ ব্যবস্থা থাকবে। যে যার রাস্তায় হাঁটবে। এটা এক ধরনের অস্পৃশ্যতাকে অনুমোদনের লাইন। আম্বেদকার হিন্দু জাতি চতুবর্ণের ব্যবস্থার সবচেয়ে বড় সমালোচক ছিলেন। অথচ আরএসএস এই হিন্দু জাতি ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরেই হিন্দুত্বের ধারায় হিন্দু রাষ্ট্র গঠন করতে চাইছে। আসলে আরএসএস-বিজেপির রাজনৈতিক সদিচ্ছা সহজেই ধরে ফেলা যায়। যেমন ওবিসি সংরক্ষণের বিষয় নিয়ে ছ'বছর আগে রোহিনি কমিশন গঠিত হয়। ওবিসির মধ্যে সাব ক্যাটাগরাইজেশনের জন্য। ছ বছর ধরে সরকার চুপ করে থাকে।জাতি গণনার উত্তেজনা শুরু হতেই বিপদ বুঝে তড়িঘড়ি সাম্প্রতিক সময়ে কমিশনের রিপোর্ট জমা করিয়েছে।  এই বিষয়েই উত্তরপ্রদেশে ২০১৮ সালে রাঘবেন্দ্র কুমারের নেতৃত্বে ৪ সদস্যের কমিটি হয়েছিল। পাঁচ বছর তা অন্ধকারে ঢাকা আছে। যারা বলছে জাতির ভিত্তিতে কোন তথ্য সংগ্রহের প্রক্রিয়া ছিল না। তারা সত্যের অপলাপ করছে। ন্যাশনাল ফ্যামিলি হেলথ সার্ভে, এন এস এস ও, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্যরা সবসময় জাতিভিত্তিক বিভিন্ন সূচকের ওপর সমীক্ষা করেছেন। সেই সমীক্ষার তথ্য সরকার বিভিন্ন প্রকল্পে এবং সরকারি কাজে গ্রহণও করেছেন। তাহলে বাঁধা কোথায়? জাতীয় জনগননায় ধর্মভিত্তিক সমীক্ষা হয়। তা যদি হতে পারে তাহলে জাতিগণনায় অসুবিধা কোথায়? এটাতো মানুষের দুর্দশা চিহ্নিতকরণের একটা প্রক্রিয়া মাত্র। যদি এর সঙ্গে সংরক্ষণের সম্পর্ক  থাকে তাহলে এটা তো বলাই যায় যে সংরক্ষণ মানে দারিদ্র্যের দূরীকরণ নয়। ধর্মীয় ,সামাজিক অবিচার, অনুশাসন যা কয়েক হাজার বছর ধরে চলে আসছে সেই ঐতিহাসিক অবিচারের প্রতিবিধান। সংবিধানেই বর্ণিত আছে প্রতিনিধিত্বমূলক অংশীদারিত্বর কথা। যারা কায়দা করে তপশিলি, আদিবাসী এবং ওবিসিদের সংরক্ষণের বিরোধিতা করে , মেধার প্রশ্ন তোলে তারাই আবার পিছনের দরজায়  উচ্চ আয়ের, উচ্চ বর্ণের মানুষের জন্য ১০ শতাংশ সংরক্ষণে অতি উৎসাহী হয়। তারাই আবার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিত্তবানের পুত্র- কন্যার ভর্তির সুযোগ করে দেওয়ার জন্য ম্যানেজমেন্ট সংরক্ষণে (কোটা)মদত দেয়।

রাজনীতির পিছনের নীতি

সিপিআই (এম) সাচার কমিটি বা রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের গঠন ও সুপারিশে সমর্থন করেছিল। মন্ডল কমিশনের ওবিসি সংক্রান্ত ভাবনা, জাতির ভিত্তিতে পশ্চাদপদতা, জাতের বাধা ভাঙতে সংরক্ষণের যুক্তিকে সমর্থন করেছিল। ১৯৫৭ সালের দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনের প্রাক্কালে সিপিআই যে ইস্তেহার প্রকাশ করে তাতে তপশিলি জাতি ও আদিবাসীদের সংরক্ষণে সমর্থনের কথা ছিল। বলা হয়েছিল অন্যান্য বঞ্চিত অংশে তা প্রসারণ করাকেও পার্টি সমর্থন করে। সংরক্ষণে সমাজের পশ্চাৎপদ অংশ, প্রান্তিক মানুষ খানিকটা সুযোগ পায় সমাজের মূল স্রোতে  আসার। এতে খানিকটা সামাজিক গতিশীলতা সৃষ্টি হয়। কিন্তু আজকের আন্তর্জাতিক লগ্নীপুঁজি তথাকথিত নিম্ন বর্ণকে সামাজিক গতিশীলতা থেকে দূরে রাখতে চায়। উৎপাদনের উপায় ও সম্পদ থেকেও তাকে দূরে রাখতে চায়। জাতিভিত্তিক জনগণনা, জাতিগণনার বিরোধিতাটা কোন মামুলি কারণে নয়। অনেক বড় ক্যানভাসে হিন্দুত্বের ন্যারেটিভ তৈরি করা হয়েছে সংসদীয় ক্ষমতায় আরও জেঁকে বসার জন্য। এত বছরের, এত যত্নের, এত কৌশলী প্রয়াস একটা জাতিভিত্তিক জনগণনায় ধাক্কা খাবে এই নিয়ে চিন্তিত সংঘ পরিবার। ওদের চিন্তায় আমাদের মাথাব্যাথা নেই। আসুন ওদের রাজনীতির পিছনের নীতিকে আমরা মানুষের কাছে নিয়ে যাই।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন