সুকুমার আচার্য
খুব কষ্টে আছেন মানুষ । কেন কষ্টে আছেন? এর প্রথম উত্তরই হল মানুষের হাতে টাকা নেই। সত্যিই কী দেশে টাকা নেই ? নাকি টাকার কারবারিরা তাকে অবিরাম গরম করে চলেছে, আর সেই গরম টাকাকে তারা নিজেদের দিকে টেনে নিয়ে কাজে লাগাচ্ছে।
২০২২-২৩ সালে আমাদের দেশের সব মিলিয়ে জাতীয় উৎপাদন হয়েছিল ২০২৩ এর সেপ্টেম্বরের হিসেবে ২৭২.৪১ লক্ষ কোটি টাকা (চলতি মুদ্রামান অনুযায়ী)। এটাই আর্থিক ভিত্তি। আমাদের দেশে কতই বা বিক্রি-বাটা হয়েছে ! যা হয়েছে তাঁর ভিত্তি তো ঐ জাতীয় উৎপাদন। আমাদের দেশে যে দুটি স্টক এক্সচেঞ্জ রয়েছে তাদের ২০২২-২৩ সালের বার্ষিক রিপোর্ট দেখলে আপনি নিজে সহজেই বুঝতে পারবেন টাকার বন্যা কাকে বলে! আর সেই টাকা কতটাই বা গরম ! যেকোনো অগ্ন্যুৎপাতের সময় তরলের উষ্ণতা ও গতিবেগের সীমানাকেও এই গরম টাকার বন্যা অতিক্রম করেছে।
প্রথমেই আসি শেয়ার বাজারের বিষয়ে। ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে (NSE) গত এক বছরে মাত্র ২৪৯ টি চুক্তি (সেটলমেন্ট) হয়েছে। শেয়ার হস্তান্তর হয়েছে ৮০,৯৫৪.১৫ কোটি। ব্যবসার পরিমাণ ১৪৫,৫২,৯৯৩.৫০ কোটি টাকা। শেয়ার বিক্রির ব্যবসার দুই রকম ভাগ আছে। এক ভাগ হল ডেলিভারি ট্রেডিং -অর্থাৎ একদিনের বেশী থেকে শুরু করে এক শতাব্দীরও বেশী সময় সে স্থায়ী হতে পারে ক্রেতার কাছে। এই ধরনের বিক্রিতে অস্থিরতা অনেক কম।
আর এক ধরনের শেয়ার বিক্রির বিষয়টা হল- সে একদিনের মধ্যে একাধিকবার (ইন্ট্রা ডে ট্রেডিং) হাতবদল হবে। অর্থাৎ বিষয়টা চূড়ান্ত অস্থায়ী। ২০২২-২৩ সালে NSE -তে যত বেশী শেয়ার বিক্রি হয়েছে, তার মধ্যে সংখ্যার বিচারে ৮০.৫৬% শেয়ার অস্থির, তাদের অর্থমূল্যের বিষয়ে ৭৬% হল অস্থির। অনিশ্চয়তার দিকটা ভাবুন ! আরও একটা বিষয় দেখুন, এই যে বড় বড় হাত বদল (সেটলমেন্ট) হচ্ছে তা কাদের মধ্যে হচ্ছে ? হচ্ছে বড়লোকদের মধ্যে। কিন্তু কোম্পানিগুলো শেয়ার বাজারে ছেড়ে দেওয়ার পর, যেইমাত্র প্রাথমিক বাজার ছেড়ে গৌণ বাজারের চলে এল, সঙ্গে সঙ্গে সেটা জড়িয়ে নিল মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্ত এবং বিভিন্ন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরোক্ষে কিছু গরীব মানুষকেও। এত অস্থির এই জগৎ যা কল্পনাও করা যায় না। ২০০১ সালের ডিসেম্বর মাসে ভারতের শেয়ার বাজারে সমস্ত শেয়ারের মোট মূল্য (পুঁজিকরণ বাজার) ছিল জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ২৩%। সেটা ২০০৭ সালের ডিসেম্বরে হল জাতীয় উৎপাদনের ১৪৬.৪%। সম্প্রতি ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সেটা দাঁড়াল জাতীয় উৎপাদনের ১০৩.৭% -এ। টাকার অপর নাম চঞ্চলা -এই কথাটা আমরা গ্রামের লোকেরা বলে থাকি। আর সেটা সত্যে পরিণত হয় ভারতের সবচেয়ে বড় মহানগর মুম্বাইয়ের স্টক এক্সচেঞ্জে এসে।
বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জে (BSE) ৪০ টি কর্পোরেট নতুন করে শেয়ার ছেড়ে ৫৬,৭৪০ কোটি টাকা জনগণের কাছ থেকে তুলেছে। গত বছর কর্পোরেটগুলো আরো বেশী তুলেছিল- ১,১১,৬১০ কোটি টাকা। এই এক্সচেঞ্জে শেয়ার, বন্ড, কমার্শিয়াল পেপার ইত্যাদি নিয়ে ১৪.৮৩ লক্ষ কোটি টাকা জনগনের কাছ থেকে কর্পোরেটরা এবং সরকার সংগ্রহ করেছে। BSE -তে কর্মদিন ভিত্তিক রোজ গড়ে ব্যবসা হয়েছে ৪১৩২ কোটি টাকা। গতবছর পরিমানটা ছিল ৫৩৯৬ কোটি টাকা।
এবার আসা যাক ঋণের বাজারে। কোন কোন বিষয়গুলিকে ঋণ বলা হয় ? কর্পোরেট বন্ড অথবা সরকারি বন্ড, কমার্শিয়াল পেপার, সার্টিফিকেট অফ ডিপোজিট ইত্যাদি -এদেরকে ঋণপত্র বলা হয়। এদের মাধ্যমে কর্পোরেটরা ও সরকার জনগনের কাছ থেকে টাকা ধার নেয়। আর তারা কীভাবে শোধ দেবে, কোন হারে শোধ করবে সেই সব এখানে বলা থাকে। শোধ করার নানা নিয়ম আছে, নানা পদ্ধতি আছে। সেইজন্য ঋণপত্রগুলোর নামও আলাদা আলাদা হয়। এদের আবার সিকিউরিটি বলা হয়। সিকিউরিটি কথার অর্থ নিরাপত্তা। কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে উঠে গেলে, কোথায় যে নিরাপত্তা যায় কে জানে !
যাই হোক, এই বাবদ NSE -তে দেখা যাচ্ছে, কর্পোরেট বন্ড বাবদ ১২১১ টি কোম্পানি তুলেছে ১,১৫,৯২৯.৯৬ কোটি টাকা, গত বছর তুলেছিল ২,২৮,৭৭৬.৬৪ কোটি টাকা (১৭৩১ টি কোম্পানি), এর প্রায় ২০ গুন্ বেশী টাকা তুলেছে কমার্শিয়াল পেপার এবং সার্টিফিকেট অফ ডিপোজিটে। ৮৪,১৪৩ টি এই ধরনের কাগজ লেনদেন করে কর্পোরেটগুলি তুলেছে ২১,০৪,০৬১.৯৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ NSE থেকে কর্পোরেটরা জনগনের কাছ থেকে ঋণ বাবদ তুলেছে ২১,১৯,৯৯১.৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে স্টক এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বাইরের OTC-তে লেনদেন হয়েছে কর্পোরেট বন্ডের ক্ষেত্রে গড়ে প্রতিদিন (ওয়ার্কিং ডে ধরে) ৪৫৯৬.৬৩ কোটি টাকা, কমার্শিয়াল পেপার হয়েছে গড়ে প্রতিদিন ১৮৬০.১৯ কোটি টাকা এবং সার্টিফিকেট অফ ডিপোজিট হয়েছে গড়ে প্রতিদিন ২১৬৬.৩৮ কোটি টাকা। এখানে শুধু পারস্পরিক বিশ্বাস কাজ করে। চুক্তি করে স্টক এক্সচেঞ্জকে কেবল জানিয়ে দেওয়া হয়।
BSE-তে Privately Placed Debt Instrument (PPDI)-এর মাধ্যমে ২০২২-২৩ সালে কর্পোরেটরা তুলেছে ৫,৩১,১৩৯ কোটি টাকা। গত বছর সংগ্রহ করেছিল এই বাবদ ৩,৮৮,০২০ টাকা। BSE-তে কমার্শিয়াল পেপার দ্বারা এই বছর কর্পোরেটরা সংগ্রহ করেছে ৭,৮৮,৭৩১ কোটি টাকা। কর্পোরেটরা এই বছর জনগণের কাছ থেকে ঋণ বাবদ ৩৪,৩৩,৮৬১ কোটি টাকারও বেশী সংগ্রহ করেছে।
এবার আসা যাক মিউচুয়াল ফান্ডের কথায়। মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর আসল কাজ হল জনগণের কাছ থেকে টাকা তুলে শেয়ারবাজারে নিয়ে গিয়ে খাটানো, আর সেখান থেকে লাভ সংগ্রহ করা। NSE-র তথ্য অনুযায়ী ৩১ মার্চ’ ২০২৩ অবধি ৪৬ টি মিউচুয়াল ফান্ড হাউস ২৯,০০৬ রকম স্কিমে টাকা তুলেছে। এই সমস্ত ফার্ম হাউসের অধীনে বহু প্রতিষ্ঠান যুক্ত থাকে। BSE-র তথ্য থেকে এই সময় সীমায় দেখা যায় ২৪৭৮ টি নতুন প্রতিষ্ঠান যুক্ত হয়েছে এবং তাদের মাধ্যমে ৭৪,৭০০ টি নতুন ডিস্ট্রিবিউটরও যুক্ত হয়েছে। পুঁজিবাদী বিশ্বায়নের ফলে কি পরিমান বেকারত্ব বাড়ছে তা এই ঘটনায় অত্যন্ত স্পষ্ট। প্রায় কোথাও কাজ না পেয়ে বহু যুবক-যুবতী মিউচুয়াল ফান্ডের ডিস্ট্রিবিউটর হিসেবে নাম লেখাচ্ছে -এই ঘটনা অত্যন্ত স্পষ্ট। কিন্তু কত টাকা তুলে এখানে লগ্নি করেছে মিউচুয়াল ফান্ডগুলি ? BSE-র তথ্যে দেখা যায় ৫১.৭৯ লক্ষ চুক্তি হয়েছে এই সময় এবং এই বাবদ তারা সংগৃহীত অর্থের মধ্যে ৭২০৭ কোটি টাকা BSE-র মাধ্যমে লগ্নি করেছে। NSE-র তথ্যে দেখা যায় গড়ে প্রতিদিন ২০ কোটি টাকা মিউচুয়াল ফান্ডগুলিতে নিয়োগ করেছে এবং গড়ে প্রতিদিন তারা ৬৬ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে গ্রাহকদের দেবার জন্য (Redemption)। কম টাকা জমা দিল আর বেশী টাকা তুলল। কিভাবে সম্ভব ? আসলে যে টাকা তুলছে সেটা আজ থেকে ১০ কিংবা ১৫ বছর আগে জমা করা টাকার ফল। শেয়ার বাজারে খেটে সেটা পাওয়া গেল। এখন শেয়ার বাজার বাড়ছে, তাই বেশী দাম পাচ্ছে। যেদিন শেয়ার বাজার ডুবে যাবে সেদিন টাকাও ঠিক ততটা ডুবে যাবে। এর থেকে এটা পরিষ্কার যে আজকের প্রাপ্তি যদি অতীতের ফল হয়, তাহলে গোটা প্রক্রিয়াটা একটা ঋণের প্রবাহ। অতীতে ধার দিয়েছি, এখন ফেরত পাচ্ছি। গোটা শেয়ার বাজারের প্রক্রিয়ায় ঋণের মাহাত্ম্যই বেশি।
মিউচুয়াল ফান্ডে আরও দু’টি মজার বিষয় আছে, সেটা হল এদের সম্পদের বিষয়। এদের সম্পদও সেই জমানো শেয়ারের উপর অনেকটা নির্ভরশীল। সেই জন্য এদের সম্পদের সঙ্গে আরও দু’টি শব্দ জুড়ে দেওয়া আছে। শুধু অ্যাসেট নয় যে আপনি বিশুদ্ধ সম্পদ বলবেন। অ্যাসেট আন্ডার ম্যানেজমেন্ট (AUM) -পরিচালনার অধীন সম্পদ। যেমন হবে পরিচালনা, তেমন হবে তার সম্পদ। ভালো পরিচালনা তো বেশী সম্পদ, খারাপ পরিচালনা তো কম সম্পদ। তবু এখন শেয়ার বাজার চকচক করছে, তাই এদের সম্পদও বাড়ছে। ২০২১-২২ সালে এদের এই ধরনের সম্পদের পরিমাণ ছিল ৫,৭৬,৩৫৮ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ সালে তার পরিমাণ ৬,৮৩,২৯৬ কোটি টাকা। এপ্রিল’ ২২ – নভেম্বর’ ২৩ -এর পরিমাণ ৯,৩১,৩৩৩ কোটি টাকা। এই সম্পদের মজাটা দেখুন। SIP কথার অর্থ হল ‘সিস্টেমেটিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’ অর্থাৎ বিনিয়োগকারী নিয়ম মত বিনিয়োগের জন্য যে পরিমাণ অর্থ জমা দেন। ২০২০-২১ সালে এই বাবদ জমা পড়েছে ১,২৪,৫৬৮ কোটি টাকা। আর সেই বছর AUM গিয়ে দাঁড়াল ৫,৭৬,৩৫৮ কোটি টাকা (তবে এই টাকা অতীতের ফল। বর্তমান SIP-র টাকা ভবিষ্যতে সম্পদ তৈরি করবে)। সেই রকম নভেম্বর’ ২০২৩ এর দেখানো সম্পদের পরিমান ৯,৩১,৩৩ কোটি টাকা। কিন্তু জমা পড়েছে ১,২৪,৩১৩ কোটি টাকা। এইভাবে AUM গুলোতে বাড়তে বাড়তে দেখা যায় ৩০ নভেম্বর’ ২০২২ -এ মিউচুয়াল ফান্ডগুলির AUM-এর পরিমাণ ছিল ৪০.৩৮ লক্ষ কোটি টাকা। ঠিক এক বছরের পর ৩০ নভেম্বর’ ২০২৩ -এ মিউচুয়াল ফান্ডগুলির সম্পদ (AUM) ৯ লক্ষ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়ায় ৪৯.০৫ লক্ষ কোটি টাকা (সূত্র- অশ্বিন কুমারের প্রবন্ধ- livemint.com/money)।
সম্পদের সীমাহীন স্ফীতিকরণ
আরও একটি মজার বিষয় দেখুন, প্রতি বছর কি হারে লক্ষ লক্ষ চুক্তিগুলো বছরের মাঝখানে বন্ধ হয়ে যায়। কত চুক্তি হয়, কত চুক্তি রেজিস্ট্রিকৃত হয়, আর কত চুক্তি বন্ধ হয়ে যায় (চুক্তির মেয়াদের বিষয় থাকলে স্বতন্ত্র) -সেই সম্পর্কীয় তথ্য-
সাল | মোট একাউন্ট | রেজিস্ট্রিকৃত | বন্ধ হয়ে যাওয়া |
এপ্রিল’ ২৩ – নভে:’ ২৩ | ৭৪৪.১৪ লক্ষ | ২৪৩.২৫ লক্ষ | ১৩৫.১৬ লক্ষ |
এপ্রিল’ ২১ – মার্চ’ ২৩ | ৬৩৫.৯৯ লক্ষ | ২৫১.৪১ লক্ষ | ১৪৩.১৫ লক্ষ |
এপ্রিল’ ২১ – মার্চ’ ২২ | ৫২৭.৭৩ লক্ষ | ২৬৬.৩৬ লক্ষ | ১১১.৪৭ লক্ষ |
(সূত্র- Association of Mutual Funds in India)
শুরুতেই একাউন্ট খোলার পরেই দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রে নথিভুক্ত করা হচ্ছে না। কিন্তু কেন ? এর সম্ভবত একটা কারণ হতে পারে- মানুষ প্রথমে রাজি হয়ে যাচ্ছেন আর্থিক নিরাপত্তার কথা ভেবে, কিন্তু পরক্ষণে তিনি মত বদল করছেন চুক্তিটি না চালাতে পারার আশঙ্কা থেকে।
এবার আসা যাক প্লাবনের জায়গায়। টাকার প্লাবন তো ডেরিভেটিভ বাজারে। NSE পরিবেশিত ২০২২-২৩ -এর তথ্যে যে পরিমাণ টাকা ডেরিভেটিভ বাজারের আওতায় আসে সেই তথ্য হাজির করা হচ্ছে। এত বড় অংশ কিন্তু স্টক এক্সচেঞ্জে নামমাত্র জানিয়ে দিয়ে সম্পন্ন করা হয়।
বিষয় | চুক্তির সংখ্যা | টাকার পরিমান |
ফিউচার এবং অপশন (পণ্য ইত্যাদি সহ) | ৪২৩০.১৪ কোটি | ৩৮৭,১০,২১,৮৫৮.৫০ কোটি টাকা |
কারেন্সি ফিউচার | ১৭০.৭৪ কোটি | ১,৩৮,৭৩,৬২৬ কোটি টাকা |
কারেন্সি অপশন | ৩৬৩.৯৪ কোটি | ২,৯৪,২৯,৭৫৪ কোটি টাকা |
সুদের হার | ২৬,৪৬২.২৬ কোটি | ৫০,১১৪.১৩ কোটি টাকা |
মোট | ৩১,২২৭.৪৮ কোটি | ৩৯১,৪৩,৭৫,৩৫২.৬৩ কোটি টাকা |
(সূত্র- NSE ২৮ তম বার্ষিক রিপোর্ট ২০২২-২৩)
NSE-তে ১৬ মার্চ’ ২০২৩ তারিখে মাত্র একদিনে ৪,৭৩,৭৩,২১৬.৫৮ কোটি টাকার চুক্তি হয়েছে। শুধুমাত্র NSE-তে গত এক বছরে ডেরিভেটিভের যে ব্যবসা হয়েছে তা জাতীয় উৎপাদনের প্রায় ১৪৪ গুন বেশী। এই জায়গা এত বেশী গতিশীল যে গত বছর শেয়ার বাজারের চেয়ে এখানে বিক্রি-বাটা হয়েছে প্রায় ২৬৯ গুণ বেশী।
দৈনিক ব্যবসার পরিমান | ২০২২-২৩ | ২০২১-২২ |
ইক্যুইটি (শেয়ার) ডেরিভেটিভ | ১,৩৭,৮১৩ কোটি টাকা | ২,৬৬,৪৪৫ কোটি টাকা |
কারেন্সি ডেরিভেটিভ | ২৫,৫৯৯ কোটি টাকা | ২৬,৬৭২ কোটি টাকা |
সুদের হার ডেরিভেটিভ | ৯৬ কোটি টাকা | ১৭৮ কোটি টাকা |
পণ্য ডেরিভেটিভ | ৩২ কোটি টাকা | ২৯৬৯ কোটি টাকা |
মোট ৪ ধরনের ডেরিভেটিভ | ১,৬৩,৫৪০ কোটি টাকা | ২,৯৬,২৬৪ কোটি টাকা |
(সূত্র- NSE ২৮ তম বার্ষিক রিপোর্ট ২০২২-২৩)
এছাড়া সূচক ডেরিভেটিভ (India INX) খাতে ২০২২-২৩ সালে ১৮২১ লক্ষ চুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা হয়েছে ৩,৩৬,৯৮২ কোটি ডলার (প্রায় ৮৩ দিয়ে গুন করলে টাকার অংক পাওয়া যায়- ২,৭৯,৬৯,৫০৬ কোটি টাকা)। গত বছর ১৫১৫ লক্ষ চুক্তির মাধ্যমে ব্যবসা হয়েছিল ২,৬২,৪২৮ কোটি ডলার। অথচ ২০১৭-১৮ সালে ছিল মাত্র ২৭২৩ কোটি ডলার। এবার নিশ্চই সবাই বুঝতে পারছেন ভারতের শেয়ার সূচক পড়ে গেলে হায় হায় কেন করতে থাকে, আর কারাই বা করতে থাকে।
শেয়ার বাজারে মোট একাউন্টের সংখ্যা এবং তার সম্পদের পরিমাণ দেখলে আপনাকে চমকে যেতে হবে এবং তা বাড়ছে কিভাবে তাও দেখার মত।
সময় | বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জ (BSE) (CDSL) | ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জ (NSE) (NSDL) | মোট | |||
একাউন্ট সংখ্যা | পরিমান | একাউন্ট সংখ্যা | পরিমান | একাউন্ট সংখ্যা | পরিমান | |
২০১৮ নভেম্বর | ১.৬৫ কোটি প্রায় | ১৯.২৮ লক্ষ কোটি টাকা | ১.৫২ কোটি প্রায় | ১৩১.১৩ লক্ষ কোটি টাকা | ৩.১৭ কোটি | ১৫০.৮০ লক্ষ কোটি টাকা |
২০২৩ ডিসেম্বর | ১০ কোটির বেশি | ৩৯.৭১ লক্ষ কোটি টাকা | ৩.৪৬ কোটি প্রায় | ৩৯৮.০২ লক্ষ কোটি টাকা | ১৩.৫ কোটি প্রায় | ৪৩৭.৭৩ লক্ষ কোটি টাকা |
এই তথ্য থেকে কতগুলো সিদ্ধান্তে আসা যায়-
(i) শেয়ার বাজারের অ্যাকাউন্ট হোল্ডারদের যা টাকা আছে, তা দেশের ১৪০ কোটি মানুষের সারা বছরের তৈরি করা সম্পদের প্রায় দেড় গুণ। অর্থাৎ সম্পদ কেন্দ্রীভূত হওয়ার কেন্দ্রবিন্দুটি তাহলে শেয়ার বাজার -এ কথা স্পষ্ট।
(ii) সবথেকে বেশি কেন্দ্রীভূত হচ্ছে ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে। কিন্তু বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের দশ গুণ বেশি টাকা ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে গচ্ছিত। তবে এই কথা ভেবে লাভ নেই যে, সব বড় বড় কর্পোরেটরা কেবল ন্যাশনাল স্টক এক্সচেঞ্জে আছে। তারা কেউ কেউ বম্বে স্টক এক্সচেঞ্জেও আছে (সূত্র- CDS India Ltd. Company summary এবং NSDL কোম্পানি রিপোর্ট ২০২২-২৩)।
এবার আসা যাক শেয়ার নাকি ডেরিভেটিভ -কে সবচেয়ে বেশি গতিশীল সেই কথায়।
প্রতিদিন গড় ব্যবসার পরিমান
সময় | শেয়ার ও সিকিউরিটি | ডেরিভেটিভ |
জানুয়ারি ২০২২ | ৬৯,৪৫৭ কোটি টাকা | ৯২ লক্ষ কোটি টাকা |
অক্টোবর ২০২২ | ৫৪,৫৩২ কোটি টাকা | ১৪৮ লক্ষ কোটি টাকা |
(সূত্র- BS রিসার্চ গ্ৰুপ)
(i) কে বেশি গতিশীল এবার আপনি ভাবুন, সেই সাথে এ ও ভাবুন-
(ii) শেয়ার বাজারে কেনা বেচায় উত্থান পতন আছে। কিন্তু সলমন ব্রাদার্সের তৈরি করা ডেরিভেটিভ অস্ত্রে আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজির রকেটের গতিতে কেবল উত্থানই আছে, পতনের ব্যাপারই নেই। অর্থাৎ লুন্ঠনের একেবারে পাকাপাকি ব্যবস্থা।
সমগ্র বিষয়টা যদি বিশ্লেষণ করা হয়, তাহলে দেখা যাবে India INX ডেরিভেটিভ, আর কিছুটা ‘Privately Placed Debt’ নামে ঋণপত্র ছাড়া আর এই বিপুল কর্মকাণ্ডে কোথাও কোন অগ্রগতির বিন্দুমাত্র চিহ্ন নেই। তবু সেনসেক্স ২০২১-২২ বর্ষে ছিল ৫৮,৫৬৮.৫১; আর পরের বছর ২০২২-২৩ -এ হল ৫৮,৯৯১.৫২ -কি করে বাড়ল ? এর উত্তর তো যারা BSE-তে নথিভুক্ত করেছেন, (NSE-তে যারা নথিভুক্ত করেন তারা প্রায় সবাই BSE-তেও নথিভুক্ত করেন) সেই ৫৪৩৩ টি কোম্পানি কিংবা তাদের শিরোমনি কর্পোরেটরাই দিতে পারবেন। বহু টাকার ছড়াছড়ি এখানে। শুধু লক্ষ নয়, শুধু কোটিও নয়, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি। কিন্তু এত ছাপানো টাকা কি দেশে আছে ? হাতে হাতে ঘুরছে তো মাত্র ৩৩.৭৮ লক্ষ কোটি টাকা (RBI-এর বাৎসরিক রিপোর্ট- ২০২৩, The Hindu Business)। আসলে এইসব টাকা হচ্ছে চুক্তির টাকা, পারস্পরিক বোঝাপড়ার কাগজে লেখা টাকা। কিন্তু সে-ও ছাপানো টাকার সমান মর্যাদার। কারণ তার পিছনে আইনের বৈধতা আছে। সে যাই হোক, এইগুলি টাকা তো বটেই। এত টাকা আছে দেশে, তবু দেশবাসীর পকেটে টাকার টান। কিন্তু কেন ? আসল কথা আছে তো সব বড় বড় লোকদের কাছে।
অন্দরমহলে বিদেশী পুঁজির আসা-যাওয়া
১ এপ্রিল’ ২০০০ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর’ ২০২৩ অবধি ভারতের শেয়ার বাজারে মোট বিদেশি পুঁজি এসেছে ৯৫,৩১৪.৩ কোটি ডলার, (১ ডলার = ৮৩ টাকা) টাকার অংকে প্রায় ৭৯,১২০০০ কোটি টাকা। গত ৯ বছরে (১ এপ্রিল’ ২০১৪ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর’ ২০২৩) এসেছে ৬১,৫৭৩ কোটি ডলার, টাকার অংকে ৫১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ গত ২৩ বছরে মোট যা এসেছে, তার ৬৫% ই এসেছে গত ৯ বছরে। আরএসএস-বিজেপি ও কর্পোরেট চক্রের শাসনে ভারতের শেয়ার বাজার আরও লোভনীয় করে তোলা হয়েছে বিদেশি পুঁজির জন্য।
কিন্তু বিদেশি পুঁজি কি আসছে উৎপাদনে সরাসরি লগ্নি হবার জন্য ? আদপেই তা নয়। ২০২২-২৩ বর্ষে বিদেশি পুঁজি এসেছে ৭০৯৭ কোটি ডলার, টাকার অংকে ৫,৮৯০০০ কোটি টাকা। তার মধ্যে শেয়ার কেনাবেচায় ব্যয় হয়েছে ৪৬০০ কোটি ডলার, অর্থাৎ টাকার অংকে ৩,৮১০০০ কোটি টাকা -প্রায় ৬৫%। এরপর বন্ড কেনা, কমার্শিয়াল পেপার কেনা, সার্টিফিকেট অফ ডিপোজিট কেনা ইত্যাদি ঋণপত্র কেনার বিষয় যদি যুক্ত করা হয় এবং সেই সাথে ডেরিভেটিভকেও যদি যুক্ত করা হয়, তাহলে উৎপাদনে সরাসরি লগ্নী হওয়ার জন্য কতটুকুই বা থাকে ? (সূত্র- Invest India)
আরও দু’টি কথা থেকে যায়। যারা এই শেয়ার কেনে তারা কারা ? ইতিমধ্যে অভিযোগ উঠেছে মরিসাস, সিঙ্গাপুর, সাইপ্রাস ইত্যাদি দেশে থাকা ভারতের কর্পোরেটদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখা শেল কোম্পানিগুলি নাকি বেআইনিভাবে শেয়ারগুলি কিনছে, যাতে কোম্পানির মধ্যে পারিবারিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে সেই কথাই যেন সত্য হতে যাচ্ছে। শেয়ার কেনার মধ্যে সিঙ্গাপুরে থাকা লোকরা কিনেছে ২৩%, আর মরিসাসে থাকা লোকেরা কিনেছে ২৪% -মোট ৪৭% সেই দু’টি দেশেই, যাকে ঘিরে অভিযোগের কেন্দ্রবিন্দু (সূত্র- Invest India)।
এবার বিদেশী পুঁজির চলে যাওয়ার বিষয়টাকে ভাবা যাক। সে যখন যায়, ধীরে ধীরে যায় না। এক্কেবারে ঝড়ের বেগে যায়। সম্প্রতি এইরকম একটি তথ্য দিচ্ছি। ২০২৩ সালে ঘটেছে। ২০২৩-২৪ সালের প্রথমদিকে অর্থাৎ এপ্রিল’ ২০২৩ থেকে প্রতি মাসেই বিদেশী পুঁজি আসছিল শেয়ার কিনতে। হটাৎ বিপদের গন্ধ আঁচ করতে পেরে কিংবা অন্য কোথাও বেশি লাভের গন্ধ পেয়ে চলে যাওয়া শুরু করল। ২৯ সেপ্টেম্বর’ ২০২৩ এ Zee Business জানালো মাত্র ৯ দিনেই বিদেশি পুঁজি চলে গেছে ১৭,১১২ কোটি টাকার। নভেম্বর’ ২০২৩ এ আমেরিকার একটি সংস্থা ব্লুমবার্গ জানালো সেপ্টেম্বর-অক্টোবর এই দুই মাসে চলে গেছে ৪৮৮ কোটি ডলার, অর্থাৎ ৪১,৫০৪ কোটি টাকা (সূত্র- CNBC TV ১৮)। এরপর তো রয়েছে হিন্ডেনবার্গ নেটওয়ার্ক রিসার্চ সংস্থার অভিযোগ আদানীদের বিরুদ্ধে।