প্রসঙ্গক্রমে আজকের গণতন্ত্র - পার্থ মুখার্জী

বিগত শতাব্দীতে পুঁজিবাদ ও সমাজতন্ত্র দু‌ই ব‍্যবস্থার সংগ্রামের মধ‍্যে লক্ষ‍্য করা গেছে পুঁজিবাদ যেমন তার চুড়ান্ত বিজয় অর্জন করতে পারেনি, তেমনি সমাজতন্ত্র এক বিকল্প ব‍্যবস্থা হিসেবে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব ধরে রাখতে পারেনি। একুশ শতকেও এই দুই ব‍্যবস্থার মধ‍্যে কেন্দ্রীয় সংঘাত জারি রয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবে মহামতি লেনিনের কথায় বলা যায় সাম্রাজ‍্যবাদ হলো “ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদ”। কিন্তু প্রশ্ন হলো পুঁজিবাদ কি আপনাআপনি খসে পড়তে পারে ? পুঁজিবাদ ইতিহাস থেকে কিছু শিক্ষা গ্রহণ করে চলেছে। পুঁজিবাদী দেশগুলি শ্রমিক শ্রেণীকে কিছুটা তাদের অনুকূলে নিয়ে এসে জন্ম দিতে চাইছে এক অভিজাত শ্রেণীর।

১) পণ‍্য সামগ্রীর শক্তিশালী ক্রেতা হিসেবে বাজারে প্রবেশ করা,

২) যার পূর্ব শর্ত হলো মোটা মাইনে পাওয়া। মোটা মাইনের চাকুরী অল্পসংখ‍্যক মানুষের মধ‍্যে সীমাহিত থাকলেও কিন্তু প্রত‍্যেকে তার স্বাধীন চিন্তায় নিজেকে অভিজাত করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টা রয়ে যাচ্ছে। বলা যেতে পারে হয়ত অজ্ঞানেই স্বীকার করে নিচ্ছে পুঁজির দাসত্ব। এর প্রভাব আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পড়ছে কিনা দেখা দরকার।

সোভিয়েত বিপর্যয় পরবর্তী যুগে বামপন্থী শক্তি (আমাদের দেশে) আপেক্ষিক পশ্চাদ অপসারণের ফলে সমাজতন্ত্র বিরোধী আদর্শ প্রচার শুধু অব‍্যাহত নয় , তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। ফলে ইতিহাসের অগ্রগতির শেষ পর্যায়টি হল উদারনৈতিক গণতন্ত্র এই প্রচার তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পুঁজিবাদের সাথে সমাজতন্ত্রের বিরোধ ও সংঘর্ষের দিকে খেয়াল রেখে ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা সমাজতন্ত্রী দের চুড়ান্ত পরাজয়ের মনগড়া ছবি তুলে ধরেছেন। এই ধারণা অনুযায়ী পুঁজিবাদ হলো এক অপরিবর্তনীয় ব‍্যবস্থা। মার্কসবাদী হিসাবে এই যুক্তি অবশ্যই খন্ডনযোগ‍্য। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা জরুরী মিঃ ফুকিয়ামা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ববর্তী রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পের কার্যকলাপ দেখার পর অতি দক্ষিণপন্থার বিপদের প্রশ্নটি ঘিরে তার অতি সাম্প্রতিক লেখা ব‌ইয়ে কিছু প্রশ্ন তুলে ধরেছেন। অর্থাৎ নিজেই নিজের পূর্ববর্তী যুক্তিকে হয়তো খন্ডন করেছেন। এক্ষেত্রে মার্কসবাদীদের প্রধান কাজ পুঁজিবাদী ব‍্যবস্থাকে অতিক্রম করা এবং শ্রমজীবী মানুষের বিরুদ্ধে চুড়ান্ত লুন্ঠন ও অবদমন রোধ করা। এক্ষেত্রে অনেকগুলি ছোট বড় দ্বন্দের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হতে হবে। সেই পথে কোথাও আসবে অগ্রগতি, আবার সেই পথেই নেমে আসতে পারে বিপর্যয়। ফলে ক্রিয়াশীল এই সংঘাতের মধ্যে দিয়েই গড়ে উঠবে উদীয়মান ভবিষ্যৎ।

মুখে যত‌ই উদারনৈতিক গণতন্ত্রের কথা বলা হোক না কেন, সেই গণতন্ত্র প্রকৃতপক্ষে যে একটি মুখোশ তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ থাকতে পারে না। প্রকৃত গণতন্ত্রের বাস্তবায়ন উন্নততর সমাজতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে‌ই সম্ভব।

সার্বজনীন ভোটাধিকার, সংসদীয় গণতন্ত্র আকাশ থেকে পড়েনি। এসব শ্রমিকশ্রেণীর লড়াইয়ের‌ই ফসল। ফুকিয়ামা বর্ণিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের আপেক্ষিক চরিত্র সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের সময়ই প্রমাণিত হয়েছে। সোভিয়েত পরিচালনার শেষদিকে অর্থাৎ ১৯৯১ এর মার্চ মাসে সারাদেশে গণভোট সংগঠিত হয়েছিল। গণভোটের বিষয় ছিল: সোভিয়েত ইউনিয়ন থাকবে না ভেঙে দেওয়া হবে? ১৫টি প্রজাতন্ত্রের মধ্যে ৯টি (রাশিয়া, ইউক্রেন, আজারবাইজান, কাজাকিস্তান, কিজিকিস্তান,তুর্কিস্তান, উজবেকিস্তান ও বাইলশিয়া) গণভোটে অংশগ্ৰহণ করেছিল। মোট জনগণের ৭৫% ভোটদান করেন এবং তাদের রায় ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন বজায় রাখার জন্য। অবশিষ্ট ৬টি প্রজাতন্ত্র (লাতভিয়া, লিথুয়ানিয়া, এস্টোনিয়া মলদাভিয়া, জর্জিয়া ও আর্মেনিয়া) গণভোট থেকে দূরে ছিল। অথচ এর নয় মাস পরেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে দেওয়া হয়। যে ৯টি প্রজাতন্ত্র স্পষ্টতঃ একত্রে থাকতে চাইছিল সেখানে জনমত কিভাবে যাচাই করা হয়েছিল? একমাত্র ইউক্রেনে এই ধরণের গণমত অনুসারে ১৯% মানুষ বিচ্ছিন্নতাকে সমর্থন করেছিলেন বলে দাবী করা হয়। এরপর নয় মাস বাদে জনগণ কিভাবে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে গেল ? দ্বিতীয়তঃ ইউক্রেনের আদিবাসীদের এক তৃতীয়াংশ জাতিগত ও ভাষাগত দিক থেকে রুশ। ফলে বিচ্ছিন্ন হবার ব‍্যাপারে উল্লসিত হবার কোনো কারণ ছিল না। ইউক্রেনকে না হয় ছেড়েই দিলাম। অন্য ৮টি প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত  কাঠামোর মধ্যেই তো থাকতে চেয়েছিল। তাদের বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হলো কোন্ গণতান্ত্রিক (!) কায়দায়! এটাই কি বুর্জোয়া গণতন্ত্রের মানদন্ড? আর একটি বিষয় আলোচনা করা খুব‌ই জরুরী। সোভিয়েত পতনের পর বহুদলীয় রাজনৈতিক ব‍্যবস্থা শুরু হয়েছে। একে সাধুবাদ জানিয়েও একটি কথা উল্লেখ করতে চাই। বর্তমানে জর্জিয়ার ৪০টির কম বেশি রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব রয়েছে। আরও ক্ষুদ্র কিজিকিস্তানে আক্ষরিক অর্থে প্রায় শতাধিক রাজনৈতিক দল  বিরাজ করছে। ব‍্যাঙের ছাতার মতো রোজ দল গজিয়ে ওঠার নাম যদি গণতন্ত্র হয় তাহলে প্রকৃত প্রস্তাবে সেইসব দেশের সংসদীয় গণতন্ত্র সত‍্যিই কি বিকশিত হয়েছে!

শুধু এক্ষেত্রে নয়, উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ধারক ও বাহকেরা বিভিন্ন দেশের নির্বাচনী কাঠামোতে ঢুকে ফলাফল পরিবর্তনের চেষ্টায় আর্থিক যোগান, প্রচার মাধ‍্যমের ব‍্যবহার। এছাড়াও বহুবিধ কৌশলে পুঁজির পাহারাদাররা পুঁজির অনুকুলে ফলাফল প্রভাবিত করতে চাইছে। এক্ষেত্রে আর্থিক বলের কথা বলা হলেও বাহুবলকেও নীতি হিসাবে ব‍্যবহার করা হচ্ছে (ইরাক, আফগানিস্তান প্যলেষ্টাইন এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ) যুগোশ্লোভিয়ার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মিলোসেভিচকে দেশের  দ্বিতীয় দফার নির্বাচন শুরুর পূর্বেই গ্রেপ্তার করে অল্পদিনের মধ্যেই বন্দী অবস্থায় পাঠানো হয় আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে। তিনি বিচারের প্রহসনের মধ‍্যেই মারা যান। তাঁর বিরুদ্ধে যে জনবিক্ষোভের কথা বলা হয় তা যদি মেনে নেওয়াও যায়, তাহলে এই প্রশ্ন থেকেই যায় ২০০৪ এর ডিসেম্বরের প্রচন্ড শীতে ইউক্রেনের রাজধানীর রাজপথে যে হাজার হাজার আন্দোলনকারী নেমেছিল তাদের উপযুক্ত গরম পোশাকের টাকা যুগিয়েছিল কে ?

প্রাসঙ্গিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রটিও বিবেচনায় রাখা দরকার।অতীতেও কমিউনিস্ট সরকারের পতন ঘটাতে লক্ষ লক্ষ বিদেশি টাকার অনুপ্রবেশ ঘটেছে। কোটি কোটি টাকার বিরুদ্ধে একটি নির্দিষ্ট নীতি ও আদর্শের প্রারম্ভিক কাজটি অসম্ভব না হলেও যে অত্যন্ত কঠিন তা নিয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। দীর্ঘ ৩৪বছরের শাসনকালে ও তার পূর্বে যুক্তফ্রন্ট সরকারের সময় ম‌ইনিহানের ব‌ইয়ে  (A DANGEROUS PLACE) সরকারকে উৎখাতে অর্থদানের কথার স্বীকৃতি রয়েছে। ৩৪ বছরের শাসনকালে পুরুলিয়ার অস্ত্রবর্ষণের কথাও ভুলে গেলে চলবে না। এই ধরণের অর্থপ্রয়োগ ও চক্রান্তের বিরুদ্ধে উন্নততর আদর্শের প্রয়োগ ব‍্যাতিরেকে এই অর্থলোলুপতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা প্রায় অসম্ভব। পশ্চিমবঙ্গের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনকালে ৫০ থেকে ৭০ দশকের কমিউনিস্ট কর্মীদের আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস পুনরায় ঝালিয়ে নেওয়া জরুরী। নচেৎ পরিপূর্ণভাবে বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রচারের ঝড় তোলা যে কতগুলি দুর্বলতা দেখা দেয় তা স্বীকার না করে কিছু অজুহাত হাজির করা কি  গ্রহণযোগ‍্য? বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রয়োগের বিরুদ্ধে পাল্টা মতাদর্শের ঝড় তুলতে প্রয়োজন, উপযুক্ত পাকাপোক্ত নিবিড় সংগঠন। এই প্রসঙ্গে লেনিন–বলেছেন  “একমাত্র অগ্রণী অংশকে নিয়েই জয়ী হ‌ওয়া সম্ভব নয়। সমগ্র শ্রেণী ও জনগণের ব‍্যাপক অংশগ্রহণ যতক্ষণ না অগ্রণী অংশকে প্রত‍্যক্ষভাবে সমর্থন করছে বা তাদের প্রতি মৈত্রী ভাব রেখে নিরপেক্ষতার  মনোভাব গ্রহণ করছে অন্তত শত্রুপক্ষকে সমর্থন জানাতে এগোচ্ছে না – এইরকম অবস্থার আগে অগ্রণী অংশকে চুড়ান্ত সংগ্রামে ফেলে দেওয়াটা শুধু মূর্খতা নয় অপরাধ‍ও বটে। আর সমগ্র শ্রেণী, মেহনতি জনগণের ব‍্যাপক অংশ এবং পুঁজির দ্বারা নিপীড়িত সেই জনগণ বাস্তবিকপক্ষে যাতে এইরূপ একটি অবস্থায় পৌঁছাতে পারে তার জন্য শুধু প্রচারাভিযান যথেষ্ট নয়। এর জন্য চাই জনগণের নিজস্ব অভিজ্ঞতা আর এটাই হলো বিপ্লবের মূলসূত্র”।

প্রকৃত ক্ষমতাগ্রহণের লক্ষ্যে কমিউনিস্টদের হাতে থাকে গ্রানাইট শিলার মতো শক্তপোক্ত যে সংগঠন এই ক্ষেত্রটির প্রতি বোধহয় গভীর মনোযোগ আমাদের জরুরী। পুঁজিবাদ আজ আমাদের মাথার উপরে চেপে উঠেছে – মতাদর্শগত স্তরে, সামাজিক স্তরে, অর্থনৈতিক স্তরে এমনকি সামরিক স্তরে। মার্কসবাদীদের হাতে শক্তিশালী ও দৃঢ় মতাদর্শ থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের বিশ্বায়নে মনমোহিনী ক্ষমতাকেও অস্বীকার করা যাচ্ছে না। এখানে আমাদের‌ও চিন্তার ও গভীর স্তরে চ‍্যালেঞ্জ গ্রহণ করা জরুরী।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন