বাজেট ২০২২ - বিজেপি আর এস এস সরকারের কর্পোরেটের কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ - ঈশিতা মুখার্জি...

৬ ফেব্রুয়ারী ২০২২ (রবিবার)


প্রাক বাজেট দেশের আর্থিক অবস্থা কেমন ছিল , তা বর্তমান বিজেপি আর এস এসের সরকারের একেবারেই অজানা থাকার কথা নয় । সংসদে আর্থিক সমীক্ষা পেশ করার আগে সরকারের সামনে কি কি তথ্য ছিল ? তথ্য ছিল দেশের চরমতম বেকারির , তথ্য ছিল দেশের মানুষের অভুক্ত থাকার কথা, অপুষ্টিতে ভোগার কথা । তথ্য ছিল সরকারী স্বাস্থ্যব্যবস্থা ভেঙ্গে পরার । দেশের আর্থিক বৃদ্ধির স্বপ্ন তো এই সরকার প্রতি বছর দেখিয়ে আসছে । কিন্তু তা বাস্তবায়িত হচ্ছে না । তার কারণ হিসেবে আর্থিক সমীক্ষা এবং কেন্দ্রীয় বাজেটের নথি দুটি তত্ত্ব হাজির করেছে । এক, সারা পৃথিবীর আর্থিক অবস্থা খারাপ। দুই, অতিমারির জন্য আর্থিক অবস্থা খারাপ । এই দুটি অসত্য নয় , তবে এই বাজেটের ক্ষেত্রে অর্ধসত্য । পৃথিবীর আর্থিক অসুখ তো পৃথিবীর দেশগুলি যে যার মত করে সাড়িয়ে তোলার চেষ্টা করছে । প্রতিটি দেশ কি উন্নত কি উন্নয়নশীল তাদের নিজেদের দেশের দিকেই তাকিয়েছে ।

পুঁজিবাদী দেশগুলিও জানে যে দেশের মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে না পারলে দেশের বাজার , পুঁজি কিছুই টিকিয়ে রাখা যাবে না । আমাদের বাজেট ব্যতিক্রম । অতিমারি শেষ হয়ে গেছে এরকম ধারণা কি আমাদের থাকা উচিৎ ? অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতাতে উনি খুব সন্তোষ প্রকাশ করেছেন যে এই সরকার খুব ভালভাবে অতিমারি মোকাবিলা করেছে । কিন্তু আমাদের তো এদেশে অতিমারির যে ছবি চোখের সামনে ভাসে তা তো রেললাইনে পড়ে থাকা কয়েকটি রুটি এবং ট্রেনে কাটা পড়া পরিযায়ী শ্রমজীবী মানুষ । তাদের কথা গত বাজেটেও ছিল না , এবারও নেই । এর কোনটা জানতেন না অর্থমন্ত্রী ?

দ্বিতীয় যে কথাটি আর্থিক সমীক্ষায় আছে তা হল বিশ্বের অন্য দেশের কথা । সে কথায় আসা যাক ।
বিশ্ব ব্যাঙ্ক জানাচ্ছে যে বিশ্ব অর্থনীতি কোভিডের জন্য পিছিয়ে পরে নানা নীতির সাহায্যে মোট ৫.৬% হারে বৃদ্ধি করতে পেরেছে , এই বৃদ্ধির হারে পৌঁছন সম্ভব হয়েছে চীন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৃদ্ধির হারের জন্য । অনেক উন্নত ও উন্নতশীল দেশ পিছিয়ে আছে । ভারত এমন একটি দেশ যা পিছিয়ে আছে । এ দেশের সরকার যে আর্থিক বৃদ্ধির কথা বলে , তা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয় নি । দেশ পিছিয়েই ছিল । ভারতের অতিমারির ব্যপ্তি এবং সেই সংক্রান্ত আর্থিক অধোগতির জন্য দক্ষিণ এশিয়ার বৃদ্ধির হার নীচের দিকে । ভারত যে পিছিয়ে পরা অর্থনীতি , এ কথা এই সরকার স্বীকার করেনি । এই তথ্য সরকার স্বীকার করেনি এই জন্য না যে সরকার নিজের ব্যর্থতা স্বীকার করতে চায় না । এই সরকার তার নথিতে ক্রমাগত অসত্য ভাষণ করেছে । সাধারণ মানুষের কাছ থেকে তথ্য গোপন করেছে । আর্থিক পরিসংখ্যানে এই সরকার আগেও অস্বচ্ছ তা দেখিয়েছে । তাই বেকারির তথ্য সরকারের কাছ থেকে আমরা প্রথমে পাইনি । তাই সারা বিশ্বের যে চিত্র সরকার বলছে , তা সঠিক নয় ।


পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলি কোভিড পরিস্থিতি থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য তাদের বাজেট কিরকম করেছে? উন্নত পুঁজিবাদী দেশগুলি তাদের সরকারী স্বাস্থ্য খাতে , শিক্ষায় ব্যয় বৃদ্ধি করেছে । অতিমারির জন্য ইওরোপীয় ইউনিয়ন সরকারী ব্যয় করেছে মোট জাতীয় উৎপাদনের ১১ . ২৭% । সেখানে ভারতের ব্যয় ৩.৫% । যে মুষ্টিমেয় দেশগুলি এত কম ব্যয় করেছে, তার মধ্যে আছে ভারতের বিজেপি-আর এস এসের সরকার । ২০২০ সালে যদি অতিমারির শুরু ধরি , তাহলে ২০২০-২১ সালে বাজেটে প্রস্তাবিত ব্যয় ছিল ৩৫ লক্ষ কোটি টাকা .২০২১-২২ সালে তা কমিয়ে দিয়ে বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ হল ৩৪.৮ লক্ষ কোটি টাকা । ২০২২-২৩ সালে তা হল ৩৯.৪ লক্ষ কোটি টাকা । যদি মূল্যবৃদ্ধির হার ধরি , তাহলে কিন্তু সরকার ক্রমেই তার দায় থেকে সরে এসেছে কোভিড মোকাবিলায় । সরকার বাজেটে স্বাস্থ্য , শিক্ষা , জনকল্যানে ব্যয় বরাদ্দ কি বাড়ল? বাজেট বক্তৃতায় তো এ বিষয়ে গুরুত্ব বোঝা গেল না । খাদ্য এবং গণবণ্টন দপ্তরে ২০২০-২১ সালে ব্যয় হয়েছিল ৫.৫লক্ষ কোটি টাকা । ২০২১-২২ সালে ব্যয় হল ৩ লক্ষ কোটি । আর বর্তমান ২০২২-২৩ সালে বাজেট প্রস্তাব হল ২.১ লক্ষ কোটি । কোভিডের জন্য স্কুলছুট শিশুর সংখ্যা এত বেড়ে গেল যে সব দেশে স্কুল শিক্ষার উপর জোড় দেওয়া হল , কিন্তু এই সরকার এ বছর বরাদ্দ করল ৬৩ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ব্যয় হয়েছিল ৫১ হাজার কোটি টাকা । এই বৃদ্ধি মূল্যবৃদ্ধির হার ধরলে আদৌ কি বৃদ্ধি? স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণে গত বছর ব্যয় হয়েছিল ৮৩হাজার কোটি টাকা , তা একই রেখে দেওয়া হল । সরকারের গুরুত্ব কি দেশের মানুষের দুর্দশার দিকে আছে ? গত বাজেট গুলিতেও ছিল না , কিন্তু এবারে এত তথ্য সামনে চলে আসার পরেও এই বাজেট নির্লজ্জ ভাবে দেশের মানুষের কল্যাণের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল । এই মুখ ফিরিয়ে নেওয়া নিশ্চিত । আগামীদিনের জন্যও নিশ্চিত । এই বাজেট তারই ইঙ্গিত নিয়ে এল।


অতিমারির সময়ে দারিদ্র্য, ক্ষুধা যেমন বেড়েছে, কয়েকজন মানুষ কিন্তু কোটিপতি হয়েছে । মুনাফা বেড়েছে দেশের কর্পোরেট হাঙ্গরদের । ২০টি কোম্পানি মোট কর্পোরেট কোম্পানিগুলির মোট মুনাফার ৬৫% লাভ করে ২০২১-২২ সালে । এর আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৬২.৪% । দেশের জাতীয় উৎপাদনে এমনিতেই কর্পোরেট মুনাফার অংশ ১০ বছরের রেকর্ড । এর পরিমাণ এখন ২.৬৯% । এই বিপুল পরিমাণে মুনাফা বৃদ্ধি এবং দেশের ১০ টি পরিবারের হাতে দেশের অর্দ্ধেকেরও বেশি সম্পদ –এর পিছনে কি সরকারী মদত নেই? সরকারের কি এসব অজানা ? তাহলে বাজেটে কেন এই ধনকুবেরদের উপর করের বোঝা চাপল না? সরকারের পক্ষে কি আয়ের বৈষম্য একটুও দূর করার পথ ছিল না? অতিধনীদের এক অর্থে করের বোঝা থেকে ছাড় দেওয়া হল। আর অন্য দিকে এই বাজেটে সাধারণ মানুষের একাউন্টে টাকা আসার কোন কথা শোনা গেল না , আগের বাজেট গুলিতে যেরকম ইউনিভার্সাল বেসিক আয় বা সাধারণ ন্যুনতম এক আয়ের কথা শোনা গিয়েছিল , যা গরিব মানুষের একাউণ্টে ঢুকবে , এরকম কোন কথার ধারেকাছেও গেলেন না অর্থমন্ত্রী । অতীতে আমরা দেখেছি নানা ঘোষণা হত , কার্যকরী হত না । এবারে ঘোষণাও নেই । ওদিকে সংসদে প্রশ্নের উত্তরে জানা গেল যে আধার সংযুক্তিকরণ না হওয়ার জন্য বাতিল হয়ে গেছে ৪ কোটি ২৮ লক্ষ রেশন কার্ড । তাহলে সরকার তো নির্লজ্জ ভাবে নিজের নীতি জানিয়ে দিল এই বাজেটে-সরকার আমজনতার নয়, সরকার কয়েকটি কর্পোরেট পরিবারের মুনাফার জন্য সব নীতি গ্রহণ করছে ।


বাজেটের ছত্রে ছত্রে কর্পোরেট হাঙ্গরদের তোষণের কথা । ডিজিটাল হবে সব কিছু লেনদেন এমন কি পোস্ট অফিসে গচ্ছিত টাকাও । একটি খোদ বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হবে যা ডিজিটাল । বাজেট বক্তৃতা জুড়ে ডিজিটালের মাহাত্ম। এই ডিজিটালের কোন পরিষেবা ই সরকারী নয় । কোভিডের সময় এই ধরণের পরিষেবা যে কোম্পানি গুলি দিয়ে থাকে তারাই ফুলে ফেঁপে উঠেছে । ২০২০-২১ সালে গুগল ইন্ডিয়া তার মুনাফা বাড়িয়েছে ৬২% , পরিমান ৫৩.২২ কোটি টাকা । জিও ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গত তিন মাসে মুনাফা বাড়িয়েছে ৪৭%। এখন তার মুনাফা ৩৫০৮কোটি টাকা ।দেশের পঞ্চায়েত দপ্তরের সব প্রকল্প মিলিয়ে মোট বাজেট বরাদ্দ ৮৬৮.৫৭ কোটি টাকা । ভুরি ভুরি এরকম উদাহরণ । সরকারের গতিশক্তি প্রকল্প তো পুরোপুরি বেসরকারী । তাহলে চাকরি হবে কি করে? এই সব পরিকাঠামো পরিষেবা মানুষ ব্যবহার করে নিজেরাই নিজেদের চাকরি দেবে-ঠিক এরকম কথাই বলেছেন অর্থমন্ত্রী ।


কোন ভাবেই বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বিজেপি-আর এস এস সরকার কর্পোরেটের দিকে চোখ রেখে বাজেট করেছে। তাই বাজেটে কৃষকদের দাবি নেই , শ্রমজীবীদের দাবি নেই , গরিব মানুষের কথা নেই ।আছে ক্রিপ্টো কারেন্সির কথা , ডিজিটাল মুদ্রার কথা – যার সাথে এই কর্পোরেট জগতের যোগাযোগ ,সাধারণ মানুষের নয় । এ বাজেট এক উদ্ধত বাজেট যা কোন রাখ ঢাক না রেখেই কর্পোরেটের তোষণ করেছে ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন