কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য - শিল্প (৩) অর্ণব ভট্টাচার্য

১৯ জানুয়ারি ২০২১ মঙ্গলবার

পশ্চিমবঙ্গে শিল্প : কুৎসা বনাম বাস্তব
পর্ব-৩

১৯৯১ সালে নয়া উদারনীতি চালু হয়। পুঁজির স্বাধীন চলাচলের স্বার্থেই মাশুল সমীকরণ ও লাইসেন্সিং প্রথা উঠে যায়। এসময় বামফ্রন্ট সরকারের সামনে এসে দাঁড়ায় নতুন চ্যালেঞ্জ। প্রায় চার দশকের বঞ্চনা রাজ্যের শিল্পক্ষেত্রে যে ক্ষতি করেছিল তাকে পূরণ করা ছিল দুরূহ কাজ।অন্যদিকে কেন্দ্রের সরকার তখন বিশ্বায়নের রথে সওয়ার হয়ে লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ ও উদারীকরণের  পথে হাঁটতে শুরু করেছে। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বাজারকেই সর্বশক্তিমান ও একমাত্র নিয়ন্ত্রক বলে তুলে ধরতে চাইছে দেশের শাসক শ্রেণী ও কেন্দ্রীয় সরকার। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান মুখী, জনস্বার্থবাহী বিকল্প নীতিকে বলবৎ করার লক্ষ্যকে সামনে রেখেই ১৯৯৪ সালে নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করে পশ্চিমবঙ্গ সরকার।

    এ রাজ্য তখন কৃষি উৎপাদনে ভারতবর্ষের মধ্যে অগ্রগণ্য। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা ও সামগ্রিক  জনকল্যাণমুখী নীতির জন্য এরাজ্যে দারিদ্র্য দূরীকরণ হয়েছিল সারাদেশের মধ্যে সবথেকে দ্রুত গতিতে।
মৎস্য চাষ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ,রেশম সহ কৃষিভিত্তিক শিল্পে তখন নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।রাজ্যে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি ও টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। স্বভাবতই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু দৃঢ়তার সাথে একথা ঘোষণা করেন যে শিল্পে পুনরুত্থানের জন্য পশ্চিমবঙ্গ প্রস্তুত।

কেবলমাত্র ক্ষুদ্রশিল্প নয়, এর সাথে সাথে বৃহৎ শিল্প এবং কর্মসংস্থান মুখী শিল্প প্রতিষ্ঠার মত অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা, রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে শক্তিশালী করা এবং বেসরকারিকরণ রুখে দেওয়া বামফ্রন্ট সরকারের শিল্প নীতির অন্যতম লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বামফ্রন্ট সরকার সেই সমস্ত ক্ষেত্রেই বিদেশি বিনিয়োগ আহ্বান করবার কথা বলে যেখানে দেশীয় প্রযুক্তি অনুন্নত বা অপ্রতুল। বামফ্রন্ট সরকার স্পষ্ট ভাষায় ঘোষনা করে যে পরিকাঠামো উন্নয়ন ও স্বাস্থ্য,শিক্ষার মতো সামাজিক পরিকাঠামোর ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপ বজায় থাকবে।

    বামফ্রন্টের শিল্পনীতির সাফল্যের দরুন রাজ্যে ক্রমাগত শিল্পে উন্নতি লক্ষ্য করা যায়।
১৯৯৩-৯৪থেকে২০০২-০৩ পর্বে পশ্চিমবঙ্গের মোট  আভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল ৮.৫৫% যা ছিল সারা দেশে সর্বোচ্চ ( সূত্র: Central Statstical Organization, Economic Survey 2004-5)
    ১৯৯৯-২০০২ এই চার বছরে পশ্চিমবাংলায় নতুন বিনিয়োগ হয়১৪১৩২.৫৮ কোটি টাকা।

(সূত্র: ASSOCHAMএর রিপোর্ট,২০০২)

CMIEর  রিপোর্ট অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের শিল্প উৎপাদন সূচক ১৯৯৭-২০০১ সালের মধ্যে বৃদ্ধি পায় ৪.৬৪% যেখানে জাতীয় গড় সূচক ছিল ৩%। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পোন্নতির এই ধারা অব্যাহত থাকে পরবর্তী এক দশক।গ্রামাঞ্চলে মানুষের আর্থিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ার দরুন শিল্পপণ্যের বিরাট বাজার সৃষ্টি হয়। সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের সময় কালে গ্রামীণ শিল্পপণ্যের বাজারের আয়তন ছিল কুড়ি হাজার কোটি টাকা।

সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের আমলে ১৩১৩টি শিল্প ইউনিট গড়ে ওঠে,বিনিয়োগ হয় ৩৬৪৮৯.১৩ কোটি টাকা,সরাসরি কাজ পায় ১৪১৮৯৭জন(সূত্র: Statistical Appendix,Economic Review, Govt.of West Bengal,2010-11)। পশ্চিমবঙ্গকে বেকারদের কারাগার বলে বাম বিরোধীরা  প্রচার  করলেও ২০০৬ সালে প্রকাশিত কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী ভারতবর্ষের কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে পশ্চিমবঙ্গ ছিল তিন নম্বরে, তামিলনাড়ু ও মহারাষ্ট্রের পরেই। ২০০৫-১১ সালের মধ্যে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে সারা ভারতবর্ষে যে পরিমান  কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছিল তার ৪০শতাংশ হয়েছিল পশ্চিমবঙ্গে।
    ন্যাশনাল স্যাম্পল সার্ভে অরগানাইজেশনের রিপোর্ট অনুযায়ী এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গে ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে ২৪লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়

হলদিয়ায় মিতসুবিশি প্লান্ট

। সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে বাম বিরোধী শক্তির  ধ্বংসাত্বক বিরোধিতা সত্ত্বেও সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারের শেষ বছরে ২০১০-১১ সালে শিল্পোন্নতির হার ছিল ৫.৮৩%।মাঝারি,ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগের সংখ্যা এবং সেখানে নিযুক্ত কর্মী সংখ্যার নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের স্থান ছিল সারাদেশে চতুর্থ।

১৯৯১সাল থেকে নয়া উদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির বিষময় প্রভাবের সাথে লড়াই করে এবং সাংবিধানিক ও অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতার মধ্যে কাজ করেছে বামফ্রন্ট সরকার। নয়া আর্থিক নীতি রূপায়নের পরিণতিতে এখনও পর্যন্ত এরাজ্যে এম এ এম সি,ভারত অ্যালুমিনিয়াম, ন্যাশনাল ইন্সট্রুমেন্ট সহ মোট ২২টি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। মডার্ন ফুড,জেসপের মত প্রতিষ্ঠানের মালিকানা এখন বেসরকারী হাতে। টায়ার কর্পোরেশন সহ ৬টি কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রায়ত্ত্ব সংস্থা লিকুইডেশনে গিয়ে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছে। অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্ট,ব্রিজ এন্ড রুফের শেয়ার বিলগ্নিকরণের চক্রান্ত আন্দোলন করে আপাতত রুখে দেওয়া গেছে। অর্থাৎ ভারতবর্ষে ১৯৯১সালের পর দিল্লী থেকে কর্পোরেটের স্বার্থে যে শিল্পনীতি গ্রহণ করা হয়েছে তা গোটা দেশ সহ আমাদের রাজ্যেও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলেছে। কোন রাজ্যের সরকারের একক উদ্যোগে একে রুখে দেওয়া সম্ভব না হলেও সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা সত্বেও বামফ্রন্ট সরকার বিকল্প নীতি প্রণয়নের চেষ্টা চালিয়েছিল এবং উল্লেখযোগ্য সাফল্য পেয়েছিল। অন্য দিকে বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়নগুলিও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের কাজে সহায়তা করার সাথে সাথে শ্রেণী শোষণের বিরুদ্ধে বৃহত্তর সংগ্রাম জারি রেখেছিল।


বামবিরোধী শক্তি মিডিয়ার সহযোগিতায় বামপন্থীদের শিল্প বিরোধী ভাবমূর্তি গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েছে এবং এখনও তাদের সে চেষ্টায় ভাটা পরেনি। অথচ তথ্য প্রমাণ করে যে বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্বে নানারকম প্রতিকুলতাকে অতিক্রম করে শিল্পের ক্ষেত্রে এ রাজ্য যে অগ্রগতি ঘটিয়েছিল তা দৃষ্টান্তমূলক। কর্মসংস্থানহীন উন্নয়নের বদলে কর্মসংস্থানমুখী উন্নয়ন  করা ছিল বামফ্রন্ট সরকারের লক্ষ্য। শিল্পায়নের ক্ষেত্রে এই লক্ষ্য নিয়েই এগিয়েছে বামফ্রন্ট সরকার। লৌহ ইস্পাত শিল্পে, ফুড পার্ক,ফাউণ্ড্রি পার্ক ইত্যাদি ক্ষেত্র ভিত্তিক শিল্প তালুকে, জ্ঞাননির্ভর ক্ষেত্র অর্থাৎ তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কর্মসংস্থান হয়েছে। সরকারের উদ্যোগে এখানে বিভিন্ন অধিগৃহীত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা পুনর্গঠনেরও প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল । রাজ্য সরকারের উদ্যোগের ফলে বেশকিছু বন্ধ কলকারখানাও নতুন করে কাজ শুরু করে, যেমন অন্নপূর্ণা কটন মিল,ক্যালকাটা সিল্ক ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি ইত্যাদি।

নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির স্বার্থেই বেসরকারি পুঁজি আকর্ষণ করে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দিকে নজর দেয় বামফ্রন্ট সরকার। পুঁজি নিবিড় শিল্পে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেশি থাকে না। সেক্ষেত্রে যে শিল্প গুলিতে অনুসারী শিল্প গড়ার সুযোগ বেশি সেদিকে বামফ্রন্ট সরকার মনোনিবেশ করে।
হলদিয়ায়  পেট্রোকেমিক্যালস এর মূল শিল্পে কর্মসংস্থান খুব বেশি হয়নি, কিন্তু অনুসারী শিল্প গুলিতে লক্ষাধিক কর্মসংস্থান হয়েছিল। ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যেই পেট্রোকেমিক্যাল ক্ষেত্রে ৭০৫ টি অনুসারী শিল্প গড়ে ওঠে। সিঙ্গুরে টাটা কোম্পানির গাড়ি কারখানা তৈরির ক্ষেত্রেও  মূল কারখানা ছাড়াও কয়েক শত অনুসারী শিল্পে ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছিল অন্যতম লক্ষ্য। কিন্তু পশ্চিমবাংলার বাম বিরোধীদের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির জন্য সেই প্রকল্প বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। শালবনিতে জিন্দাল স্টিল প্লান্ট এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুষ্ঠানের দিন ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণ করে নাশকতা সৃষ্টির কথাও আমাদের স্মরণে আছে। ইতিহাস প্রমাণ করে যে পশ্চিমবাংলায় বামপন্থীদের উদ্যোগে শিল্পায়নের প্রচেষ্টা নানারকম প্রতিকূলতা ও ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে রাজ্যকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম।



(চলবে)
শেয়ার করুন

উত্তর দিন