Site icon CPI(M)

Appalling Job Scenario in the Modi-Mamata Regime – Part 3 : Abhas Roychoudhury

২০১১ সালে তৃণমূল কংগ্রেস এরাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই কাজের আকাল আমাদের রাজ্যে ‘‘নিউ নর্মাল’’। শাসক দলের শিল্পায়ন বিরোধী অবস্থান এবং তোলাবাজির জন্য গত এক দশকে রাজ্যে একটিও বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠা হয়নি। যদিও সাত মন তেল পুড়িয়ে অনেক শিল্প সম্মেলন হয়েছে। টেট কেলেঙ্কারি, এসএসসি ও সিএসসি পরীক্ষায় দুর্নীতি, প্রশ্ন ফাঁস, লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষের বিনিময়ে অযোগ্যদের চাকরি, বছরের পর বছর শূন্য পদে নিয়োগ না হওয়া, নিয়োগকারী সংস্থায় শাসক দলের নেতাদের অন্তর্ভ‍ুক্তি ইত্যাদি অজস্র কুকীর্তি তৃণমূলী শাসনের মাইলফলক।

গত ৭ বছর ধরে আপার প্রাইমারি স্কুলে কোনও নিয়োগ নেই। নবম ও দশম শ্রেণিতে নিয়োগ বন্ধ রয়েছে দীর্ঘকাল। পিএসসি-তে ১৪০০০ শূন্য পদে নিয়োগে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। ২০১৯ আগস্ট মাসে মুখ্যমন্ত্রী ৩৩৬৮৭টি পদে গ্রুপ ডি কর্মী নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অথচ নিয়োগের নামগন্ধ নেই। আজ পর্যন্ত রাজ্যে স্নাতকোত্তর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কয়েক লক্ষ যুবক-যুবতী বসে আছে। তারচেয়েও সংখ্যায় অনেক বেশি উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাশ করা চাকরিপ্রার্থী। মেধা তালিকায় নাম থাকা সত্ত্বেও দীর্ঘ আট বছর যোগ্যতা-দক্ষতা সত্ত্বেও নবম থেকে দ্বাদশের শিক্ষকতায় নিযুক্ত হচ্ছে না কয়েক লক্ষ প্রার্থী। সবমিলিয়ে এর সংখ্যা ৫ লক্ষ। একদিকে নিয়োগ নেই, অন্যদিকে প্রকাশ্যে এসেছে অসংখ্য বেনিয়ম ও দুর্নীতি।

তৃণমূল আমলে রাজ্যে কাজ না পেয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয়েছে লক্ষ লক্ষ বেকার যুবক। দেশে লকডাউন ঘোষণার পর এ রাজ্যের বুকে কর্মসংস্থানের করুণ ছবি স্পষ্ট হয় উঠেছে। কর্মসংস্থান নিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর নির্জলা মিথ্যাচার পরিষ্কার হচ্ছে।

প্রতিশ্রুতি ছিল যে পরিযায়ী শ্রমিকরা ফিরে আসার পর তাদের খাদ্য এবং কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা, বিশেষ করে ১০০ দিনের কাজে তাদের নিয়োগের ব্যাপারে উদ্যোগী হবে রাজ্যের সরকার। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে যে রেশন কার্ড না থাকার জন্য একদিকে যেমন খাবার পেতে অসুবিধা হচ্ছে, অন্যদিকে ১০০ দিনের কাজে তাদের যথাযথভাবে নিযুক্ত করা হচ্ছে না, ফলে আর্থিক কষ্ট বেড়েই চলেছে। দুঃখের বোঝা নিয়ে স্বল্প মজুরিতে কাজ করতে আবার ফিরে গেছেন অনেকে।

১০০ ‍‌দিনের কাজে গত এক দশক ধরেই ব্যাপক দুর্নীতি করছে রাজ্যের শাসক দল। এমনকি এই করোনা অতিমারীর সময়েও তৃণমূলের লুটপাটে কোনও খামতি ছিল না। এই সময়ে গ্রামাঞ্চলে ১০০ দিনের কাজ মানুষের হাতে কিছু টাকার জোগান দিতে পারতো। কিন্তু ১০০ দিনের কাজের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত গরমিল, জব কার্ড বিলিতে দুর্নীতি এই সময়েও দেখা গিয়েছে। লকডাউনের দিনেও বিশাল পরিমাণ টাকার ভুয়ো কাজের হিসেব দেখানো হয়েছে। প্রকৃত যাদের কাজ দরকার তারা ঠিকমতো কাজ পাচ্ছেন না, অথচ শাসক দলের নেতার অ্যাকাউন্টে মোটা টাকা কাটমানি হিসেবে জমা হয়ে যাচ্ছে। তোলা, সিন্ডিকেট, জালিয়াতি ও কাটমানি কাণ্ডের সঙ্গে শাসকদল সর্বত্র জড়িয়ে গেছে।

উত্তরবঙ্গে চা শিল্পের সঙ্কট তীব্রতর হয়েছে তৃণমূলের রাজত্বে। অনাহার, অনাহারজনিত মৃত্যু এইসবই চা বাগানগুলির শ্রমিকদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা মহামারির সময় বন্ধ চা বাগানের শ্রমিকদের সঙ্কট ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছে। স্বীকৃত ন্যূনতম মজুরি, জমির পাট্টা, চা-বাগান এলাকায় অ-শ্রমিক যুবকদের কর্মসংস্থান ইত্যাদি দাবি তৃণমূল শাসনে সম্পূর্ণ উপেক্ষিত।
রাজ্যের পৌরসভাগুলিতে প্রচুর শূন্যপদ অথচ সেগুলো পূরণের কোনও আগ্রহ এই সরকারের নেই। গত বছর কলকাতা কর্পোরেশনের ২৬০০০ শূন্য পদে নিয়োগের দাবিতে বাম যুব কর্মীরা কর্পোরেশন অভিযান করার পর মেয়র কিছু পদে নিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলেও আজ পর্যন্ত একটি পদেও নিয়োগ হয়নি। এমনকি করোনা মোকাবিলার জন্য কোনও শূন্য পদে নিয়োগের চেষ্টা করেনি কলকাতা কর্পোরেশন। রাজ্যের সর্বত্র একই অবস্থা।
রাজ্যের যেখানে যেটুকু নিয়োগ হচ্ছে সেখানে প্রায় সর্বত্রই ব্যাপক টাকার খেলা। স্থায়ী কর্মী নিয়োগের বদলে অস্থায়ী এবং অবসরপ্রাপ্তদের নিয়োগের দিকেই ঝোঁক এই রাজ্য সরকারের। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় সরকার করোনা অতিমারীর সুযোগে শ্রম আইনকে কার্যত তুলে দিয়ে কর্মরত শ্রমিকদের শোষণের পথ আরও প্রশস্ত করছে তাই নয়, যারা ভবিষ্যতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত হবেন তাদের কাজের সুরক্ষা কেড়ে নেওয়ার জন্য উদগ্রীব হয়েছে। রাজ্যের শাসক দল সম্পূর্ণ নীরবতা অবলম্বন করে সেই অন্যায়কে সমর্থন জানাচ্ছে এবং বর্তমানে কর্মরত ও ভবিষ্যতের কর্মপ্রার্থী উভয়ের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছে।

আত্মনির্ভরতার ভাঁওতা :

আত্মনির্ভরতার আসল মানে মোদী সরকার কেন্দ্রীয় বাজেটে বুঝিয়ে দিয়েছে। সব সরকারি সংস্থা বেচে দেওয়া, বীমায় বিদেশি লুটও অবাধ করে দেওয়া, জীবনবীমার ভবিষ্যৎ ধ্বংস করা। সাতটি প্রধান বন্দরও সরকার বেচে দেবার কথা বাজেটে ঘোষণা করেছে। অক্সফাম রিপোর্টে বলা হয়েছে, লকডাউনে গোটা দেশের মানুষের সর্বনাশে সরকার যখন নিরুত্তর, তখন দেশের বিলিওনেয়ার বা শত শত কোটি টাকার মালিকদের আয় বেড়েছে ৩৫শতাংশ।
মোদী সরকার ক্ষমতাসীন বলে ভারতবাসী জানল যে ‘আত্মনির্ভর’ হওয়া মানে দেশের সব লাভজনক রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া। সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ব্যবহার করে কার্যত যা খুশি তাই করছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। মোদীর রাজত্বে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রে ‘একে একে নিভিছে দেউটি’। মোদীর রাজত্বে খনি থেকে মহাকাশ সর্বত্র কর্পোরেশনের দাপাদাপি। এমনকি জ্বালানি, প্রতিরক্ষা উৎপাদনেও ঢোকানো হচ্ছে দেশী-বিদেশী ব্যবসায়ীদের। চলতি বছরে দেশের বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা যেমন বিপিসিএল, শিপিং কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া, কন্টেইনার কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়া ইত্যাদির বিলগ্নিকরণ করে ২.১ লক্ষ কোটি টাকা আয় করতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। সরকারের বক্তব্য এই যে সরকারী নিয়ন্ত্রণমুক্ত হলে নাকি সংস্থাগুলি আরও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড করবে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়বে। কিন্তু বাস্তবে কী ঘটছে? ইতিমধ্যেই ভারত পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন লিমিটেড কর্মীদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলক অবসরের আবেদন চেয়েছে। ‘‘রেল হামারি রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হ্যায়, ইসে রক্ষা করনা হামারি কর্তব্য হ্যায়’’—এই বিজ্ঞাপনের সাথে বাস্তবের আসমান জমিন ফারাক। আপাতত ১০৯টি রুটে ১৫১টি ট্রেন চালানোর অনুমতি পেয়েছে বেসরকারি সংস্থাগুলি। এই সমস্ত ট্রেনের কেবল ড্রাইভার আর গার্ড হবে রেলকর্মী, বাকি সকলে সংশ্লিষ্ট বেসরকারি সংস্থার কর্মী। ভাড়ার কোনও ঊর্ধ্বসীমা থাকবে না। সাধু, সাবধান।
রেল বেসরকারিকরণের ফলে কেবল হাজার হাজার রেলওয়ে কর্মীর কাজ চলে যাবে তাই নয়, নতুন নিয়োগের পথও বন্ধ হয়ে যাবে। ইতিমধ্যেই তার সমস্ত ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে। রেলওয়ে বেসরকারিকরণের পদক্ষেপ হিসেবে ইতিমধ্যেই ২ জুলাই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে যে সুরক্ষা ছাড়া আর কোনও পদ তৈরি করা হবে না, নতুন যেসব পদে এখনও নিয়োগ হয়নি সেগুলি অবলুপ্তি করা হবে আর মোট শূন্য পদের ৫০ শতাংশ অবলুপ্ত করা হবে।
দেশের কয়লা খনি, প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশী বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা তু‍‌লে দিয়েছে সরকার। কয়লাখনি বেসরকারিকরণের মাধ্যমে বহুমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদ তাদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে যারা পরিবেশ এবং মানুষের জীবন-জীবিকার তোয়াক্কা না করে বেপরোয়া বাণিজ্যিক ক্রিয়া-কলাপ চালাবে। এদিকে প্রতিরক্ষা খাতে ১০০ শতাংশ বিদেশী বিনিয়োগ দেশের সুরক্ষার ক্ষেত্রে বড় বিপদ।

বর্তমান টালমাটাল পরিস্থিতিতে অর্ধেকেরও বেশি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ককে বেসরকারি হাতে তুলে দিয়ে কেবলমাত্র পাঁচটি বড় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক রাখার পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্রীয় সরকার। এরফলে ব্যাঙ্কের শাখা সংখ্যা কমবে এবং ব্যাপক কর্মী সঙ্কোচন হবে। ঋণখেলাপি কর্পোরেটের হাতে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থাকে তুলে দিয়ে জনগণের সর্বনাশ করছে মোদী সরকার। বীমার মতো গুরুত্বপূর্ণ আর্থিক সংস্থায়ও কর্পোরেটদের দাপট বাড়ছে।

এই মুহূর্তে বাজারে চাহিদা সৃষ্টি না করতে পারেল অর্থনীতিকে সচল ও সবল করা যাবে না। অবিলম্বে আয়, কর্মসংস্থান ও মানুষের হাতে অর্থের যোগান বাড়াতে হবে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
তাই,
১. আয়কর দেন না এমন ব্যক্তিদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ৭৫০০ টাকা দিতে হবে।
২. বেকারদের ৬০০০ টাকা বেকার ভাতা দিতে হবে।
৩. শ্রমিক স্বার্থবিরোধী শ্রম আইন প্রবর্তন করা চলবে না।
৪. কৃষি ফসলের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে হবে।
৫. পরিবারপিছু বিনামূল্যে ৩৫ কেজি খাদ্য সরবরাহ করতে হবে।
৬. সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে।
৭. রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণ চলবে না।
৮. রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি দপ্তরের শূন্য পদে নিয়োগের কাজ শুরু করতে হবে।
৯. কর্পোরেট ঋণখেলাপিদের ঋণ মকুব করা চলবে না।
১০. গ্রামে ১০০ দিনের বদলে ২০০ দিনের কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। মজুরি বাড়াতে হবে।
১১. শহরেও ২০০ দিনের কাজের প্রকল্প চালু করতে হবে
১২. গ্রাম ও শহরে পরিষেবা দান ও স্থায়ী সম্পদ তৈরির কা‍‌জে বেকার ছেলে-মেয়েদের যুক্ত করতে হবে।

শেয়ার করুন