পর্ব ১
দুই মেরুর বাইরে, আছে অন্য পথ
বাড়ি বাড়ি ঘুরছেন বামপন্থী আন্দোলনের কর্মীরা। পরিচিত অনেকে বলছেন, ‘দুইয়ের কোনটাই আর নেওয়া যাচ্ছে না।’। কেউ বলছেন, ‘সোনার বাংলা আর জয় বাংলা শুনে কান ঝালাপালা। চাকরি-বাকরির কোনও কথা নেই।’ কেন সিভিক ভলান্টিয়ার তো আছে! শুনতে হচ্ছে, ‘ও কাজের গ্যারান্টি কী। আজ আছে কাল নেই’। তা’হলে কেমন কাজ? ‘যেখানে কথায় কথায় দরজা দেখানো যাবে না।’
এখন কথাটা চারিয়ে দেওয়া হয়েছে ভালভাবেই যে তৃণমূলকে বামপন্থীরা ঠেকাতে পারবে না। তারজন্য দরকার বিজেপি। হিসাব কষে পরপর নির্বাচনেই দেখানো হচ্ছে লড়াই দুই মেরুর, তৃণমূল-বনাম বিজেপি। এই আলোচনায় প্রায়ই বাদ পড়ে যাচ্ছে নীতির প্রশ্ন। একজন দুর্নীতিগ্রস্ত এক দল থেকে অন্য দলে গেলেই বা আমার আপনার কী আসে-যায়। এ কথাও ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে ঠিক আগের বিধানসভা ভোটেই দুই দলের বিরুদ্ধে ভোটবাক্সে মত জানিয়েছিলেন এ রাজ্যের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ। সংবাদমাধ্যমে তার উল্লেখটুকুও নেই।
এমন দ্বৈরথ নির্মাণ আরও বড় পরিকল্পনারই অংশ। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন তার প্রতিশ্রুতি রাখার কোনও লক্ষণই দেখাচ্ছে না। আর পাঁচটা দেশের মতো ভারতেও উদারনীতির স্লোগানগুলো বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। মহামারী এবং লকডাউন সেই সত্যকে একেবারে বেআব্রু করে দিয়েছে। বামপন্থীদের পক্ষে সমর্থন ভোটবাক্সে দেখা গেলে বিপদ গুরুতর বড়লোকের!
এমন দ্বৈরথ নির্মাণ আরও বড় পরিকল্পনারই অংশ। সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়ন তার প্রতিশ্রুতি রাখার কোনও লক্ষণই দেখাচ্ছে না। আর পাঁচটা দেশের মতো ভারতেও উদারনীতির স্লোগানগুলো বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না। মহামারী এবং লকডাউন সেই সত্যকে একেবারে বেআব্রু করে দিয়েছে। বামপন্থীদের পক্ষে সমর্থন ভোটবাক্সে দেখা গেলে বিপদ গুরুতর বড়লোকের!
অথচ বিকল্প তো দেখিয়েছে বামপন্থীরা। এরাজ্যে টানা ৩৪ বছরের সরকার তো বটেই। বিকল্প দেখিয়েছে কেরালা বা ত্রিপুরায়। ভূমিহীনের হাতে জমি, বর্গাদারের উচ্ছেদ ঠেকানো আইন করে, শিক্ষায় নৈরাজ্য বন্ধ করা, সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা, সমবায়, তীব্র সীমাবদ্ধতার মধ্যে শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ানো। বিকল্প হতে পেরেছে বিকল্প শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গির কারণে। কেমন বিকল্প নীতি? এক, উৎপাদন বাড়বে এমনভাবে যাতে সাধারণ মানুষের কর্মসংস্থান এবং আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়। পুঁজিপতি বা সামন্তপ্রভুর উন্নয়ন নয়। দুই, উন্নয়নের এই পথে জনগণ কেবল নীরব গ্রহীতা হবেন না। তিনিও হবেন এই উন্নয়ন প্রক্রিয়ার কাণ্ডারি। সেই জন্যই তাঁর অধিকারের স্বীকৃতি, তাঁর মর্যাদা প্রাপ্য। লক্ষ্য করবেন নিশ্চয় যে ভোটের আগে খুচরো ইনাম আর অধিকারের স্বীকৃতি এক বিষয় নয়। যেমন, কৃষককে কিছু নগদ দেওয়ার ঘোষণা আর তাঁর জন্য জমির আইনি পাট্টা এক বিষয় নয়।
খাদ্যশস্য উৎপাদনে ঘাটতির রাজ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গ। স্বাধীনতার পর পাঁচ এবং ছয়ের দশকেও বারবার খাদ্যের দাবিতে আছড়ে পড়েছে ক্ষোভ। তীব্র হয়েছে খাদ্য আন্দোলন। সেরাজ্যই ধান উৎপাদনে কেবল স্বয়ম্ভর হয়নি, সারা রাজ্যে পৌঁছে এক নম্বরে। অন্ধ্র প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা বা মহারাষ্ট্রের মতো রাজ্যও কৃষি উৎপাদনে প্রথম সারির রাজ্য। পার্থক্য হলো, এরাজ্যে প্রায় ৮৪ শতাংশ জমির মালিকানা থেকেছে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের হাতে। অন্ধ্র প্রদেশে যেমন ছোট ও প্রান্তিক কৃষকের হাতে জমি ৩৬ শতাংশের কাছাকাছি। ২০২০-তে সমীক্ষা প্রতিষ্ঠান সিএমআইই’র রিপোর্ট জানাচ্ছে, পাঞ্জাবে এই দুই অংশের হাতে ১২.২০ শতাংশ, হরিয়ানায় ২০.৪২ শতাংশ। আবার কেরালায় এই দুই অংশের হাতে ছিল ৭০ শতাংশ জমি। সারা দেশে এই দুই অংশের হাতে জমির গড় ৩২.২০ শতাংশ। যে কারণে পশ্চিমবঙ্গে কৃষিতে উন্নয়নের সঙ্গে গ্রামে গরিব মানুষের আয় বেড়েছে।
এই ঘটনা এমনি এমনি ঘটেনি। ১৯৭৭-এ এরাজ্যে সরকার গড়ার দায়িত্ব পায় বামফ্রন্ট। রাজ্যে সারা দেশের মধ্যে জমি ছিল ৩ শতাংশ। অথচ ভূমি সংস্কারে গোটা দেশের যত কৃষক জমি পেয়েছেন তার প্রায় ২২ শতাংশ প্রায় এ রাজ্যেরই। বাড়তে থাকল উৎপাদন। শরণার্থী সমস্যায় কোণঠাসা পশ্চিমবঙ্গে কলোনি এলাকায় এগতে থাকল উন্নয়ন। বিদ্যুতের উৎপাদন ১৯৭৭-এ ছিল ১৭০০ মেগাওয়াট। ২০১১-তে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৬৮৩৩ মেগাওয়াটে। বঞ্চনায় অবরুদ্ধ পশ্চিমবঙ্গ কেবল ২০০৯-এ দেখল ৮ হাজার ৪০০ কোটি টাকার শিল্প বিনিয়োগ। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পে রপ্তানি বেড়ে দাঁড়ালো ৬ হাজার ৪০০ কোটি টাকায়। কলেজ সার্ভিসের মতো স্কুল সার্ভিস কমিশন, এসএসসি, পিএসসি’র মাধ্যমে প্রতি বছর স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় চাকরি। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর পৌরসভা এবং পঞ্চায়েতে ভোট নিয়ম করে চালু হয় এরাজ্যে। ১৯৭৭’র আগে সেসবের বালাই ছিল না। সরকারি আধিকারিকদের দিয়ে নিয়ন্ত্রণ, পৌরসভার ভোট আটকে রেখে প্রশাসক বসানোর রেওয়াজ ফের ফিরে এসেছে রাজ্যে তৃণমূলের হাত ধরে।
সারা দেশে বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে সংবিধানের সংশোধন হয় পশ্চিমবঙ্গকে মডেল করে। সরকারে আসীন হয়ে মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকে রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় বামফ্রন্ট। তাঁদের অনেকে ছিলেন নকশালপন্থী, কংগ্রেসও। জরুরি অবস্থা এবং তার আগে এই বন্দিদের অনেকের হাতে খুন হয়েছিলেন বামপন্থী এবং সিপিআই(এম) কর্মীরা। কিন্তু নীতিগত সিদ্ধান্ত থেকে সরেনি বামফ্রন্ট। জরুরি অবস্থার সময় আন্দোলনে নেমে কাজ খোয়ানো সরকারি কর্মীরা ফের বহাল হয়েছেন সরকারি কাজে। তৈরি হয়েছে গণতন্ত্রের নতুন সংজ্ঞা।
৩৪ বছরের মধ্যে প্রায় কুড়ি বছর সরকার চলেছে দেশে নয়া উদারবাদী সংস্কার শুরু হওয়ার পর। রাজ্যগুলির হাত বাঁধা পড়েছে ক্রমশ। সরকার হাত গুটিয়ে নিয়েছে একের পর এক ক্ষেত্র থেকে। রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধ হয়েছে, বেসরকারিকরণ হয়েছে। এরাজ্যেও বন্ধ হয়েছে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ইউনিট। তার মধ্যেই চলেছে নতুন শিল্প গড়ার কাজ। সীমাবদ্ধতা প্রচুর, সঙ্কট ব্যাপক। তার মধ্যেই চলেছে বিকল্পের খোঁজ। মেহনতীর পক্ষে বিকল্প খোঁজা চলেছে জমির অধিকার, ট্রেড ইউনিয়ন গড়ার অধিকার, ধর্মঘটের অধিকার, শিক্ষাঙ্গণে মত প্রকাশের অধিকার, বিধানসভা এবং বাইরে বিরোধীদের মর্যাদা নিশ্চিত করে। নতুন পথের প্রতিটি বাঁকমোড় চিনতে হয়েছে নতুন অভিজ্ঞতায়। শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিকে হাতিয়ার করে। নাগরিকের অধিকার স্বীকৃতির পর্ব হয়ে থেকেছে ৩৪ বছর। বামপন্থীদের সরকার মানেই তাই।