পশ্চিমবঙ্গে অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি এবং ক্ষুদ্রশিল্প। এই দু’টি ক্ষেত্রে শ্রমজীবীর গুরুত্বপূর্ণ অংশ নিযুক্ত ছিলেন। নয়া উদারবাদের আক্রমণ সবচেয়ে বেশি হয়েছে এই দুই ক্ষেত্রে। জনকল্যাণকর রাষ্ট্রের ধারণা বাতিল করে বাজারসর্বস্ব অর্থনীতির পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রে আসীন একের পর এক সরকার। কৃষিতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগের সম্ভাবনা ক্রমশ কমেছে। সুলভে পাওয়ার বদলে বেড়ে কৃষি, সারের দাম। দাম বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতেরও। ফলে সীমাবদ্ধ আর্থিক ক্ষমতার মধ্যেও রাজ্যকেই দিতে হয়েছে ভরতুকি। ক্ষুদ্রসেচের বিস্তারের কারণেই পাম্পসেট চালাতে কৃষককে ভরসা করতে হয় বিদ্যুতের ওপর।
নজর এড়িয়ে যাবে না করোরই যে দিল্লি ঘিরে বসে থাকা কৃষক আন্দোলনের অন্যতম দাবি বিদ্যুৎ আইনে কেন্দ্রের সংশোধনী বিল খারিজ করা। ১৯৯১ থেকে ধাপে ধাপে বিদ্যুৎ এবং জ্বালানির দামে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে দেওয়ার নীতি নেওয়া হয়। ১৯৯৭ থেকে ২০০৪ পর্যন্ত অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ সরকার দেশ চালিয়েছে। সেই সরকারের শরিক ছিল তৃণমূল, অধুনা মুখ্যমন্ত্রী মন্ত্রিত্ব করেছেন। কিন্তু বাজারের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার মারাত্মক নীতির প্রতিবাদ করেননি কোনোদিন। এনডিএ সরকারের সময়েই শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন তুলে নেওয়া হয়। মূলত ফাটকা আবাসন ব্যবসায় মদত দেওয়াই ছিল লক্ষ্য। সেই নীতির শরিক তৃণমূলকে সামনে রেখে এরাজ্যে তথাকথিত জমির আন্দোলন চলেছে যার এক এবং একমাত্র লক্ষ্য ছিল বামফ্রন্ট সরকারকে উচ্ছেদ করা।
উদারনীতির আক্রমণের চেহারা কী? সিপিআই(এম) এবং কৃষক আন্দোলনের প্রয়াত নেতা কমরেড বিনয় কোঙার তাঁর ‘উদারনীতির চাবুক ও কৃষিতে নতুন ভাবনা’ প্রবন্ধে ব্যাখ্যা করেছিলেন। তাঁর সূত্রায়ণ: এক, সরকারি শস্য সংগ্রহ নিয়ন্ত্রণ এবং ভরতুকি হ্রাস করা হয়েছে বাজার বিকৃতির সম্ভাবনা এড়ানোর যুক্তিতে। নানা কৌশলে কমানো হয়েছে সার বা বীজের জন্য ভরতুকি। অর্থাৎ, সরকার ন্যূনতম সংগ্রহমূল্যে শস্য কিনতে থাকলে বেসরকারি কৃষিব্যবসায়ীরা মার খাবে। বাজারে চাহিদা দামে প্রতিফলিত হবে না সরকারি ভরতুকিতে খাদ্য সংগ্রহ কাঠামো এবং সর্বজনীন রেশন ব্যবস্থা বজায় থাকলে। দেখা যাবে, সর্বজনীন রেশনের ধারণাটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে এই উদারনীতির পর্বে। ২০০৪’র পর কেন্দ্রে কংগ্রেস জোট সরকারকে বামপন্থীদের সমর্থন নিতে হয়েছিল টিকে থাকার জন্য। সমর্থক হয়েও লাগাতার সংসদে সর্বজনীন রেশনের দাবিতে সরব থেকেছেন বামপন্থীরা। বাজার মৌলবাদের পক্ষে থাকা সব অংশের লাগাতার আক্রমণ সহ্যও করতে হয়েছে। দুই, কৃষি পরিকাঠামোয় সরকারি বিনিয়োগ স্থগিত থেকেছে। বড় সেচ প্রকল্প নেই। কৃষককে প্রকৃতির মর্জির ওপর থাকতে বাধ্য করা হয়েছে। তিন, কৃষি বাজারে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের নিয়ন্ত্রণ সমানে বেড়েছে। ফাটকা এবং লগ্নি পুঁজি যাতে কৃষি বাজার এবং উৎপাদনের নিয়ন্ত্রক হতে পারে সেই অভিমুখে নেওয়া হয়েছে ব্যবস্থা। চার, ঊর্ধ্বসীমা হ্রাস করে জমির কর্পোরেট চাষে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে ক্রমাগত। সরকার নিয়ন্ত্রিত কৃষি বাজার ব্যবস্থা ভেঙে দেওয়ার পক্ষে রাজ্যগুলিকে ক্রমাগত চাপ দেওয়া হয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি, মূলধন বিনিয়োগ কৃষিতে জরুরি। কিন্তু উদারনীতির দাওয়াইয়ে তার জন্য ভূমিসংস্কার হবে না। পুনর্বন্টনমূলক ভূমিসংস্কারের প্রশ্নটিকে বাতিল করে ধনী কৃষক অথবা কর্পোরেটকে জমি দিয়ে হবে উন্নয়ন। দেশজুড়ে উচ্ছেদ হতে হয়েছে কৃষিজীবীদের। পাঁচ, এ রাজ্যে জোত এমনিই ছোট। তার ওপর হয়েছে খণ্ডীকরণ। বাবা জমি পেয়েছেন ভূমিসংস্কারে। তাঁর তিন সন্তান। অতএব ওই জমির ওপর নির্ভরশীল এখন তিন। পাঁচ, আমদানি শুল্ক কমিয়ে বিদেশ থেকে কৃষিপণ্য কম দামে দেশে আনার ব্যবস্থা হয়েছে। একদিকে কৃষকের সঙ্কট যেমন বেড়েছে, তেমনই আমদানি শুল্ক থেকে রাজ্য সরকারের প্রাপ্য কমেছে। বামফ্রন্ট সরকারকে এই চাপের মোকাবিলা করে চলতে হয়েছে। ছয়, কৃষিক্ষেত্রে চাপের কারণে খেতমজুরের মজুরিবৃদ্ধির হার এবং কাজের দিন কমেছে। কৃষক আন্দোলনকে খেতমজুরের মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে সক্রিয় থাকতে হয়েছে।
উদারনীতির দাওয়াই কিন্তু মেনে নিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস সরকার। ২০১৪-তে কৃষি সংক্রান্ত আইন পাশ করায় তৃণমূল সরকার। বিরোধী বামপন্থীরা দাবি জানালেও বিশদ পর্যালোচনার সুযোগ দেওয়া হয়নি বিধানসভার সিলেক্ট কমিটিকে। কৃষির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, এমন ফাটকাবাজদের অবাধ লাইসেন্সের ব্যবস্থা করা হলো। কৃষককে ফসল বিক্রির স্বাধীনতার নামে বেসরকারি ব্যবসায়ী, কর্পোরেটের জন্য খুলে দেওয়া হলো কৃষি। চুক্তি নিয়ে সমস্যা হলে আদালতের বদলে সরকারি আধিকারিকদের মুখাপেক্ষী হতে বাধ্য করা হলো। কৃষক মান্ডির বিজ্ঞাপন হলো প্রচুর, ফসল বেচতে পারলেন না কৃষকরা।
নরেন্দ্র মোদী সরকারের যে তিন আইনের প্রতিবাদে এখন সারা দেশ উত্তাল, আগেই একই মর্মে তেমনই বিল পাশ করিয়েছে তৃণমূল। কৃষকের উপকার হয়নি, হওয়ার কথাও ছিল না। ঘোষিত দামের চেয়ে কুইন্টালে পাঁচ-ছ’শো টাকা কম দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষকরা। কৃষক আত্মহত্যা চলেছে, সরকার আত্মগাতীদের নেশাগ্রস্ত বলেছে। কখনও বলেছে মামুলি পারিবারিক বিবাদ। এমনকি আত্মঘাতী কৃষকের তথ্য নথিভুক্তি বন্ধ করে দিল রাজ্য। কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন সময়েও তাগাদা দিলেও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, এমএসপি, তুলে দেওয়া তো দূর, জাতীয় মঞ্চে এমন চেষ্টা প্রতিহত করেছেন বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রীরা।
আশির দশকে শস্য উৎপাদনের হার যা ছিল নব্বইয়ের দশকে বা তার পরে তা থাকেনি। কিন্তু জাতীয় স্তরে শস্য উৎপাদনের হারের তুলনায় এগিয়ে থাকতে পেরেছে রাজ্য। ২০০৮-০৯ অর্থবর্ষে কৃষি সুমারি অনুযায়ী জাতীয় স্তরে উৎপাদনের হার ছিল ১.৬ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে এই হার ছিল ৪.৪ শতাংশ। ২০০৯-১০ অর্থবর্ষে জাতীয় স্তরে হার ছিল ০.২ শতাংশ। পশ্চিমবঙ্গে হার থেকেছে ৪.২ শতাংশ। কোন সঙ্কটের মোকাবিলা করে সাফল্য ভুলিয়ে দেওয়া হয় বামপন্থী বিরুদ্ধে চালিত রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে।