নয়া কৃষিআইনে লাভ শুধুই কর্পোরেট এবং সাম্রাজ্যবাদের

কৃষিকাজ এবং মুক্ত বাজার ব্যবস্থা

প্রভাত পট্টনায়েক

মূল নিবন্ধটি পিপলস ডেমোক্র্যাসি পত্রিকার ১৩ ডিসেম্বর,২০২০ সংখ্যায় প্রকাশিত

মোদী সরকারের নয়া তিনটি কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপি কৃষক আন্দোলন চলছে। কৃষকদের এই সংগ্রামে সারা দেশেই সমর্থনের আঁচ ছড়িয়ে পড়েছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে মোদীর বক্তব্যের সাথে সহাবস্থানে না থেকেও মুক্ত বাজার ব্যবস্থায় আমাদের দেশের কৃষিকাজ চালানো হবে না কেন কিছুজন এই প্রশ্ন তুলছেন। এই নিবন্ধে ইতিমধ্যে বহুচর্চিত সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা হবে।  

মুক্ত বাজার ব্যবস্থাকে অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানে মোটের উপরে কিছুটা হলেও সক্ষম প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন কেইন্স। আপাতত কেইন্সিয়ান অর্থনীতির কথা তুলে রাখা যাক। দুটি পৃথক এবং নির্দিষ্ট কারনের জন্য কৃষিক্ষেত্রে মুক্ত বাজার ব্যবস্থাকে ভয়ানক বলা যায়। সামাজিক বাস্তবতা রহিত হয়ে খোলা বাজারে কৃষিজাত পণ্যের যেভাবে মূল্য নির্ধারিত হবে এবং তার ফলে খাদ্যশস্যের দাম বেড়ে যাওয়ার সমস্যা যে চেহারা নেবে তা বীভৎস। এর পাশাপাশি কৃষিক্ষেত্রে মুক্ত বাজার ব্যবস্থা কৃষিজাতপন্য এবং কৃষিকাজে ব্যাবহারের নামে জমি দখলের যে পথ নেবে তারও সামাজিক ফলাফল হবে ভয়ংকর।

এই দুটি কারণের প্রভাব সম্পর্কে গভীর বিশ্লেষণে আরও এগোতে হবে – আপাতত ধরে নেওয়া যাক কৃষিকার্যের উৎপাদনে চরিত্র একমাত্রিক অর্থাৎ শুধুমাত্র খাদ্যশস্যই উৎপাদন করা হচ্ছে। খাদ্যশস্যের চাহিদা সেইসব পণ্যের দামের ওঠা-নামার সাথে বাড়ে-কমে না, যদিও কৃষিক্ষেত্রে সাধারনভাবে উৎপাদনের পরিমান একটি নির্দিষ্ট সময়ে পরিবেশের ভালো অথবা খারাপ প্রভাবের উপরে অনেকটাই নির্ভর করে। আর তাই কৃষিক্ষেত্রে এতদিন চাহিদা এবং যোগানের আন্তঃসম্পর্কে বহুবিধ ধারায় দামের ওঠা–নামা ব্যাপারটি জড়িয়ে থাকলেও মোটের উপরে স্বাভাবিক অবস্থায় বাজারে খুব বেশী অস্থিরতা ছিল না। কৃষিজাত পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে পড়ে যায় তবে কৃষক ঋণের জালে জড়িয়ে পড়ে এবং সেই বদ্ধাবস্থা চলতে থাকে আজীবন। আবার খাদ্যশস্যের দাম যদি অনেকটাই বেড়ে যায় তবে জনগণের একটি বড় অংশই কেনার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, বাজারে ক্রেতার অভাব তৈরি হয়। খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে তাই এমন কোন অবস্থা সমাজে বিপর্যয় নামিয়ে আনে।  

এধরনের চরম বিপর্যয়কর অবস্থার উদাহরন হিসাবে দুটি ঘটনার উল্লেখ করা যেতে পারে, একটি হল মহামন্দা চলাকালীন কৃষকদের ভয়ানক ঋণগ্রস্থ হয়ে পড়া, আরেকটি, ১৯৪৩ সালে বাংলার দুর্ভিক্ষের সময়ে ৩০ লক্ষ মানুষের না খেতে পেয়ে মারা যাওয়া। এই দুটি ঘটনাতেই যোগানের অভাব কিংবা প্রচুর উদ্বৃত্তি আদৌ সমস্যার কারন ছিল না। এই ঘটনাগুলির পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ করতে গিয়ে মূল সমস্যা হিসাবে খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়াকেই আমি সেইসময়ের প্রধান অর্থনৈতিক সংকট হিসাবে খুঁজে পাই। প্রথম ঘটনায় বাজারে ভয়ানক মন্দা সত্বেও খাদ্যের ক্রেতারা কিংবা পরেরবার দুর্ভিক্ষ বলে খাদ্যশস্যের উৎপাদক অর্থাৎ কৃষকেরা কেউই কোনোরকম বাড়তি সুবিধা পান নি। নির্দ্বিধায় বলা যায় যে দুটি ঘটনাই ছিল সামাজিক বিপর্যয়।

অর্থশাস্ত্রের প্রথাসম্মত মুক্ত বাজারের কোনো তত্ত্বই এধরনের কোনো সম্ভাব্য বিপর্যয় সম্পর্কে ভবিষ্যৎবাণী করতে একেবারেই অক্ষম। অর্থনীতির চলতি নিয়মে খোলা বাজারের সাম্যাবস্থা ধরে রাখা সম্পর্কে কেবল ধরে নেওয়া হয় যে সকল পণ্যই মোটের উপরে একে অন্যের পরিপূরক। এর অর্থ হল একটি পণ্যের দাম বেড়ে গেলেও অন্যান্য সকল পণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে অথবা একই থেকে সেগুলির চাহিদা বাড়িয়ে দেবে কিংবা আগের অবস্থাই বজায় থাকবে, সুতরাং বাজারে সাম্যাবস্থা ভাঙবে না। এধরনের স্বতঃসিদ্ধে খাদ্যশস্যের ন্যায় পণ্যের নির্দিষ্ট চরিত্রের কোন ধারণাই থাকে না, যেক্ষেত্রে যদি দাম বাড়ে তবে তার প্রভাবে অন্যান্য পণ্যের চাহিদা কমতে থাকে কারন মানুষজন খাদ্যের প্রয়োজন কমাতে পারে না বলে অন্যান্য পন্যে খরচ কমাতে বাধ্য হয়। এককথায় বলা যায় অন্যান্য কোন পণ্যই খাদ্যপন্যের পরিপূরক হতে পারে না, যেমনটা মুক্ত বাজারের সাম্যাবস্থার নীতিতে ধরে নেওয়া হয়।

এইকারনেই আমাদের এমন ব্যবস্থার প্রয়োজন যাতে খাদ্যশস্যের দাম খুব বেশী বেড়েও যাবে না অথবা খুব বেশী পড়েও যাবে না। এই কাজে সফল হতে গেলে সরকারকেই ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার মুক্ত বাজারের সাম্যের নিয়মকে যথেচ্ছ এগোতে দেবে না, প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করবে। সুতরাং সরকারি হস্তক্ষেপের জুগাবসান ঘটিয়ে মুক্ত বাজারের কথা যারা তুলছেন তাদের যুক্তি আগাগোড়া নিরর্থক।  

এবার উৎপাদনের পরিমানের প্রসঙ্গে আসা যাক। এক্ষেত্রে খোলা বাজারের হাতে কৃষিকাজে কতটা জমি ব্যাবহার করতে দেওয়া হবে সেই কথা আসবে। যেকোনো এমন পণ্য যা মূলত সহজপ্রাপ্য নয় তাদের উৎপাদনের ক্ষেত্রে মুক্ত বাজারের ব্যবস্থা নির্ভর করে ঐ পণ্যের বিভিন্ন সম্ভাব্য ক্রেতার আপাত ক্রয়ক্ষমতার উপরে। কৃষিকাজের গোটা ব্যাপারটাকে খোলা বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে কার্যত যা হবে তাতে বেশিরভাগ কৃষিজমির ব্যাবহার হবে সেইধরনের কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদনে পশ্চিম গোলার্ধের দেশে যেসবকিছুর ভালো চাহিদা রয়েছে কিংবা যাকিছু সমাজের মাথায় থাকা অংশের মানুষদের প্রয়োজন মেটায়। অন্যভাবে বললে এর মানে দাঁড়ায় উৎপাদিত খাদ্যপণ্যের বেশিরভাগটাই কিনে নেবে বিদেশ কিংবা দেশের ভিতরকার বড়লোকেরা। উন্নত অর্থনৈতিক ক্ষমতার দেশগুলি থেকে খাদ্যশস্য আমদানি করে যদি খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রনের যুক্তি দেওয়া হয় তবে এক্তহা মনে রাখতেই হবে এধরনের সিদ্ধান্তের ফলে আমাদের দেশের খাদ্যে স্বনির্ভরতা ধ্বংস হবে। খাদ্যপণ্য আমদানির উপরে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠে এক লম্বা সময় ধরে খাদ্যে স্বনির্ভর হয়ে ওঠা আজকের ভারত এতে ক্ষতিগ্রস্থ হবে, এছাড়াও জনগণের মধ্যে নিরন্ন মানুষের সংখ্যা বাড়বে।

এবার দ্বিতীয় প্রসঙ্গটিকে প্রথমে বিবেচনায় নেওয়া যাক। খাদ্যশস্য উৎপাদনের কাজে ব্যাবহৃত জমিকে যদি নয়া ব্যবস্থায় অন্যকিছু যেমন ফল উৎপাদনের কাজে ব্যাবহার করা হয়, তবে আগে যেখানে ফসল উৎপাদনের কাজে ১০ জনের প্রয়োজন হত এখন সেখানে ৫ জনেই কাজ চলে যাবে অর্থাৎ ৫ জন সরাসরি কাজ হারাবে। কাজ হারানো এই ৫ জন খাদ্যশস্য কেনার ক্রয়ক্ষমতা হারাবে, সুতরাং এই অবস্থায় খাদ্যশস্য আমদানি করে যোগানের দিকে সামাল দেওয়া গেলেও নিয়ন্ত্রনহীন দামে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে আমদানি করা সেই খাদ্যশস্যের ক্রেতা পাওয়া যাবে না। সুতরাং সবটা মিলিয়ে ফলাফল হিসাবে দেশে ক্ষুধাতুর মানুষ বাড়বে।

কেউ প্রশ্ন করতে পারে যে আমরা কেন ধরে নিচ্ছি খোলা বাজারের হাতে দেশের কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দিলে খাদ্যশস্যের বদলে অন্যান্য ফসল উৎপাদন করা হবেই। তারা মাথায় রাখেন না, সাধারণ নিয়মে উন্নত অর্থনীতির দেশসমূহের প্রধান চাহিদা কিংবা দেশের মহানগরগুলির চাহিদা যেসকল পণ্যের দিকে বেশী থাকে সেগুলির উৎপাদনের চরিত্র অপেক্ষাকৃত অনেক কম শ্রমনিবিড় হয়। কৃষিকাজের জমিকে যদি বিলাসবহুল আবাসন শিল্প কিংবা গলফ কোর্ট বানানোর কাজে ব্যাবহার করা হয় তবে তার ফলে যে কর্মসংস্থান অনেকটাই সংকুচিত হবে, সেকথা আদৌ অত্যুক্তি নয়। এধরনের নয়া ব্যবস্থায় ব্যাপক কর্মচ্যুতি এবং ভুখা পেটে থাকা মানুষের সংখ্যা এদুটিই শুধু বাড়ে। প্রথাবদ্ধ অর্থশাস্ত্রে এইসব আলোচনাই হয় না কারন সেখানে ধরেই নেওয়া হয় সমাজের সকল অংশের মানুষের জন্যেই উপযুক্ত কাজ বাজারে রয়েছে এবং খোলা বাজারে সাম্যাবস্থার জোরে কেউই নিপীড়িত নয়।

এবারে আমরা প্রথম প্রসঙ্গের বিষয়ে কথা বলি। খাদ্যশস্যে স্বনির্ভরতা ধ্বংস হলে নয়া ব্যবস্থায় খাদ্যের মজুত ঠিক রাখতে আমাদের বিদেশ থেকে খাদ্যপণ্য আমদানি করতে হবে, শস্য উৎপাদন করা হবে না। এতে দুটি অবশ্যম্ভাবী সমস্যার সৃষ্টি হবে। প্রথমত যখন সত্যই প্রয়োজন বেশী সেইসময় আন্তর্জাতিক ভান্ডারে খাদ্যের মজুত নাও থাকতে পারে। ঐ একই সময়ে অন্য কোন বড় দেশেরও যদি একই মাত্রার প্রয়োজন পড়ে তখন অবস্থা কি হবে তা অনুমেয়। ভারতের মতো কোন বৃহৎ দেশ যখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বিশাল পরিমানে খাদ্যশস্যের আমদানি করবে তার ফলে বাজারে দাম আগের তুলনায় অনেকটাই বেড়ে যাবে।

দ্বিতীয় সমস্যাটির কারন বাস্তবের মাটিতে আন্তর্জাতিক বাজার বইতে পড়া আন্তর্জাতিক বাজারের তুলনায় অনেকটাই আলাদা। বইতে লেখা রয়েছে এধরনের বাজারে বহুসংখ্যক ক্রেতা এবং বিক্রেতা একে অন্যের প্রভাবমুক্ত অবস্থায় থাকে। বিশ্বের খাদ্যবাজারে কোনো দেশ নিজের চাহিদা অনুযায়ী যোগান পেতেই পারে কিন্তু তা নির্ভর করবে আমেরিকান কিংবা ইউরোপীয় কোনো দেশের সরকারের সদিচ্ছার উপরে। তারা কারোর চাহিদায় সম্মতি দিতেই পারে আবার কোন দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে যথেচ্ছ খাদ্য রপ্তানি করার বাধা দূর করতে সেদেশের বিদেশনীতি পরিবর্তন করতে প্রবল চাপ সৃষ্টিও করতে পারে। এমনও হতে পারে দুর্যোগের কবলে পড়ে খাদ্যের চাহিদা নিয়ে হাজির হওয়া কোনো দেশকে নিজেদের বিপণন সংস্থাগুলির জন্য বাড়তি কিছু ‘সুযোগসুবিধা’ আদায় করতে তারা সচেষ্ট হল। সুতরাং সেই অবস্থায় আন্তর্জাতিক মজুত ভান্ডারে উপযুক্ত পরিমানে খাদ্যশস্য কিংবা কোন দেশের হাতে যথেষ্ট বৈদেশিক মুদ্রার সংস্থান থাকা সত্বেও খাদ্য আমদানি করতে গেলে কোনো দেশ বাড়তি দাম গুনগার দিতে বাধ্য থাকবে।

এইসমস্ত কারনে কোনো বড় দেশ যদি মনে করে তারা খাদ্যের প্রশ্নে সুরক্ষিত থাকবে তবে সেই দেশকে নিজের জমিতে খাদ্যশস্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। কৃষিজমিতে কি উৎপাদন করা হবে সেই সিদ্ধান্ত খোলা বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। দেশের মাটিতে কি ফসল উৎপন্ন হবে সেব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে সরকারকে হস্তক্ষেপের ব্যবস্থা হতেই হবে – এটাই অতি প্রয়োজনীয় সামাজিক বাস্তবতা। এই লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপই হল বাজারে ফসল বিক্রি হবে সরকার নির্ধারিত দামে। বাজারের ইচ্ছামতো দামে খাদ্যপণ্য বেচাকেনার বিরুদ্ধে গিয়েই সরকার বাজারকে নিয়ন্ত্রন করবে।

বহু বছরব্যাপি লড়াই-সংগ্রামের ফলে ভারতে ন্যুনতম সহায়ক মূল্য, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ মূল্য, এবং ভর্তুকি যুক্ত রেশনিং ব্যবস্থা জারি করা হয়েছিল। এইসবের ফলে বাজারের অবস্থার নিরপেক্ষ থেকেই জনগণের চাহিদা মেটানোর বাস্তবিক বন্দোবস্ত হয়। আমাদের দেশের এইসমস্ত সরকারি ব্যবস্থার বিরুদ্ধে উন্নত দেশগুলি প্রথম থেকেই সোচ্চার থেকেছে কারন তারা আমাদের দেশের বাজার দখল করতে চায়। মুনাফা লুটের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থ করতে না পেরে আমাদের দেশীয় কর্পোরেটরাও প্রথম থেকেই এইসকল ব্যবস্থার বিরোধিতা করে এসেছে। তারা চায়নি সরকার তাদের মুনাফা লুট করার পথে অন্তরায় হোক। নয়া কৃষি আইনগুলি লাগু করে মোদী সরকার এই সমস্ত বন্দোবস্তগুলিকেই ধ্বংস করে দিতে চলেছে। এইসব নয়া কৃষিআইনগুলিতে যদি কারোর লাভ হয়ে থাকে তবে তা হবে কর্পোরেট এবং সাম্রাজ্যবাদের।  

ওয়েব ডেস্কের পক্ষে অনুবাদঃ সৌভিক ঘোষ


শেয়ার করুন

উত্তর দিন