ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক বর্ণময় চরিত্র

প্রথম পর্ব

২০২৩ সালের জুলাই মাসে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচন তো নয়, নির্বাচনী প্রহসন। এই নির্বাচনে দখল অভিযানে নেমে পড়েছিল শাসক দল অস্ত্র ও অর্থ, প্রচার মাধ্যম, নির্বাচন কমিশন, সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনকে সঙ্গে নিয়ে।অপর দিকে নির্বাচনে অবাধ ও সুষ্ঠুভাবে ভোটদানের জন্য এগিয়ে এসেছিল গণতন্ত্রপ্রেমী জনসাধারণ। বামপন্থী ও অন্যান্য শাসক-বিরোধী দলগুলো নেতৃত্ব দিচ্ছিল। দখল আটকাতে প্রতিরোধ কিছুটা হয়েছিল, আংশিক সাফল্যও এসেছিল। আসলে রাষ্ট্রশক্তির মোকাবিলা করতে জনশক্তির যে প্রস্তুতি নিতে হয়, যে-সব শর্ত পূরণ করতে হয়, সেখানে বামপন্থী শক্তি, কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব অনেক। সেই দায়িত্ব পালনে ঘাটতি আছে।

কমিউনিস্ট নেতা হরেকৃষ্ণ কোঙারের মতে, ‘‘ কিছু ‘নেতা’ বক্তৃতা দিলেই তাদের কথা শুনে জনগণ বিপ্লবী হয়ে ওঠে না। জনগণ শেখে নিজেদের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। নেতৃত্বের কাজ হল গনগণের দৈনন্দিন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাদের সংগঠিত করা এবং সেই সঙ্গে মার্কসবাদী প্রচারের দ্বারা তাদের চেতনাকে ধাপে ধাপে অর্থনৈতিক স্তর হতে রাজনৈতিক স্তরে উন্নীত করা।জনগণ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এর সত্যতা বুঝতে শেখে এবং ধাপে ধাপে নেতৃত্বের চেতনা জনগণের চেতনায় রূপান্তরিত হয়।’’(বিপ্লব সম্বন্ধে কয়েকটি মার্কসবাদী শিক্ষা) ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) ও অন্যান্য বানপন্থী দলগুলো এখনও সেই লাগাতার দীর্ঘ প্রস্তুতি নিতে পারে নি।
হরেকৃষ্ণ কোঙার (১৯১৫-৭৪)। উপনিবেশবাদ – বিরোধী জীবন ১৯৩৫ সাল থেকে আমৃত্যু।কমিউনিস্ট জীবন ১৯৩৮ সাল থেকে আমৃত্যু। এই কমিউনিস্ট জীবনের মধ্যেই আরও স্পষ্টভাবে উপনিবেশবাদ-বিরোধী জীবন অন্তর্ভুক্ত আছে। জন্ম ১৯১৫ সালের ৫আগষ্ট অবিভক্ত বর্ধমান জেলার কামারগড়িয়া গ্রামে এক কৃষক পরিবারে। পরে এই পরিবারটা কিছু পুঁজি নিয়ে পানিহাটি ঘুরে মেমারীর কাছে দক্ষিণ রাধাকান্তপুরে স্থায়ী বসবাস করে মেমারীতে ব্যবসাদার হয়ে ওঠেন। অবস্থাপন্ন পরিবারের মেধাবী সন্তান হরেকৃষ্ণ কোঙার ১৯৩০ সালে বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র থাকাকালীন আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারারুদ্ধ হন। কলকাতায় কলেজে পড়াকালীন জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী আন্দোলনে যোগ দিয়ে ১৯৩২ সালে ৬ বছর সশ্রম কারাদন্ডে দন্ডিত হন এবং ১৯৩৩-৩৮ সালে আন্দামানের কুখ্যাত সেলুলার জেলে বন্দী থাকেন।


১৯৩৮ সালে জেল থেকে মুক্ত হয়ে হরেকৃষ্ণ কোঙার অবিভক্ত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৫৮ সালে পার্টির জাতীয় কাউন্সিলের কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন।তখন পার্টিতে মতাদর্শগত বিতর্ক ক্রমশ বাড়ছিল। শেষ পর্যন্ত সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রমের মধ্য দিয়ে ১৯৬৪ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং হরেকৃষ্ণ কোঙার পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। মৃত্যুর সময়ও তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন। সংশোধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে হরেকৃষ্ণ কোঙারের যেমন অগ্রণী ভূমিকা ছিল, তেমনি অগ্রণী ভূমিকা ছিল পরবর্তীকালে সঙ্কীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে। তাঁর মৃত্যু হয় ১৯৭৪ সালের ২৩ জুলাই কলকাতায় ক্যান্সার রোগে। ২৪ জুলাই আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসের মধ্যে তাঁর শবদেহ নিয়ে কলকাতায় লক্ষ লক্ষ মানুষের শোক মিছিল ছিল অবিস্মরণীয়।
আন্দামান থেকে মূল ভূখন্ডে পা দিয়ে হরেকৃষ্ণ কোঙার ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন শুরু করেন। তারপর পার্টির নির্দেশে কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলায় আত্মনিয়োগ করেন।

দ্বিতীয় পর্ব

ভারতের কৃষক আন্দোলনের অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন হরেকৃষ্ণ কোঙার। ১৯৬৮ সাল থেকে আমৃত্যু ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক। তার আগে ১৯৫৩-৬৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভার সম্পাদক, ১৯৬৮-৭৪ সালে সভাপতি ছিলেন। নিকোসিয়া, বার্লিন,রোমে আন্তর্জাতিক কৃষি,বন ও বাগিচা শ্রমিক ইউনিয়নের সভায় যোগদান করেন।দেশের ভূমি ব্যবস্থা, ভূমি সমস্যা, ভূমি সংস্কার নিয়ে পাটনা, মুসৌরি ইত্যাদি শহরে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের, এমনকী আই এ এস অফিসার ক্যাডাদের কাছে আলোচনার জন্য আমন্ত্রিত হতেন।


১৯৬৭ সালে ৯ মাসের জন্য এবং ১৯৬৯-৭০ সালে ১৪ মাসের জন্য পশ্চিমবঙ্গে অকংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়। হরেকৃষ্ণ কোঙার ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী। বুর্জোয়া-জমিদার রাষ্ট্রে একটা অঙ্গরাজ্যে পার্টি কর্মসূচি অনুযায়ী একজন কমিউনিস্ট নেতা মন্ত্রী হিসাবে কেমনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন হরেকৃষ্ণ কোঙার। গ্রামাঞ্চলে কৃষক আন্দোলনে জোয়ার আসে, শক্তির ভারসাম্যে পরিবর্তন ঘটে। কৃষক সংগঠন মুখ্য ভূমিকায় থাকে, সহায়তা করে রাজ্য সরকার। হরেকৃষ্ণ কোঙার মনে করতেন, ‘‘ ১৯৬৭ সালের প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন এবং ১৯৬৯ সাল আরো উন্নত পর্যায়ের যুক্তফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠা কৃষক আন্দোলনের দুর্বার অগ্রগতির অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করল। পশ্চিমবঙ্গে সংগঠিত শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন কংগ্রেসকে পরাজিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলেই এখানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের চরিত্র ছিল সংগ্রামী। এইসব আন্দোলনের নেতা ও সংগঠক মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ছিল যুক্তফ্রন্টের প্রধান শক্তি। এই সরকার জনগণের মনে অলীক আশা সৃষ্টি করে নাই; জনগণের সংগ্রামের উৎসমুখ খুলে দিতে সাহায্য করেছিল মাত্র। গণ-আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশের অত্যাচার বন্ধ করে এই সরকার এক তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে।’’ (কৃষক আন্দোলনের কঠিন সমস্যা) এই প্রসঙ্গেই অন্যান্য পার্টির সঙ্গে কমিউনিস্ট পার্টির সম্পর্ক, বোঝাপড়া, ঐক্য, আঁতাত, ফ্রন্ট সম্পর্কে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে এক দীর্ঘ প্রবন্ধে হরেকৃষ্ণ কোঙার লেখেন,‘‘গণ-সংগ্রামের জন্য ও তার প্রয়োজনে যুক্তফ্রন্ট, কিন্তু মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মতে যুক্তফ্রন্ট কোনো স্থিতিশীল ধারনা নয়। জনগণের বিভিন্ন শ্রেণি ও স্তরের বিশেষ ঐক্যের একটা পার্টিগত প্রতিফলন হল যুক্তফ্রন্ট। যুক্তফ্রন্টের একটা বিশেষ রূপ অবস্থা নির্বিশেষে স্থায়ী হতে পারে না। অবস্থার পরিবর্তনে তার চরিত্রও পরিবর্তিত হয়। যুক্তফ্রন্ট সরকার ছিল সংগ্রামের হাতিয়ার। তাই, সঠিকভাবেই গণ-সংগ্রামের কোনো ছোটখাটো ত্রুটি বিচ্যুতি হয় না, তা নয়। কোটি কোটি মানুষ সংগ্রামে নামলে এরকম হতে বাধ্য।’’(গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামের বৈপ্লবিক তাৎপর্য) মনে রাখতে হবে তখন রাজ্যে একদিকে আধা-ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস চলছিল, আর অপরদিকে দেওয়ালে বন্দুক এঁকে বিপ্লবের মহড়া হচ্ছিল।

হরেকৃষ্ণ কোঙারের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছিল, মার্কসবাদ-লেনিনবাদে রীতিমতো দখল ছিল, লেখায় ও বলায় সাবলীলতা ও তীক্ষ্ণতা ছিল। ফলে তিনি ছিলেন সুলেখক। আর প্রশ্নাতীত আকর্ষণীয় বক্তা। গ্রামে মেঠো ভাষা, শহরে কেতাবী ভাষা, কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে কোন ফারাক হতো না। শ্রোতাদের বুঝতে আদৌ অসুবিধা হতো না। এখানে একজন সমঝদার শ্রোতার জবানীতে বক্তা হরেকৃষ্ণ কোঙারকে আমরা মেপে নিতে পারি।
১৯৬৭ সাল। সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগ আয়োজিত একটা সেমিনার। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বক্তা। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পক্ষে বক্তা হরেকৃষ্ণ কোঙার।

তৃতীয় পর্ব

বুদ্ধিজীবী মহল তাঁর গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে কারও কারও সংশয়। সেই সময় ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও পরে তুখোর সাংবাদিক বাসব দাশগুপ্ত এই সেমিনারের বিবরণ দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘‘সময় এসে গেল। অন্যান্য দলের নেতারা বক্তব্য শেষ করলেন। কমরেড কোঙার উঠে দাঁড়ালেন। বেতের মতো ঋজু চেহারা। তীক্ষ্ণ মুখ। … নির্দিষ্ট সময় ছিল আধ ঘন্টা। সময় পেরিয়ে গেল। সমস্ত শ্রোতারা তন্ময়। যেন বার্ক অথবা শেরিডানের ভাষণ শুনছেন। সুনির্বাচিত শব্দে গেঁথে গেঁথে রাজনৈতিক উপসংহারগুলিকে অনিবার্য সত্যতায় পৌঁছে দিচ্ছিলেন তিনি। আর শুধু আমরা নই, বিপক্ষীয় ছাত্ররাও যেন দুটি ঘন্টা হ্যামেলিনের সেই বাঁশি শুনে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।’’ (সেই বর্ণোজ্জ্বল মানুষটি চলে গেলেন)। হরেকৃষ্ণ কোঙার তাঁর এই বক্তব্য শুরু করেছিলেন ভারতের নৌ-বিদ্রোহ দিয়ে, আর শেষ করেছিলেন ‘কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার’ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে।
হরেকৃষ্ণ কোঙার ১৯৩০ সাল থেকে ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত হয় জেলের ভেতরে থেকেছেন, নয় আত্মগোপনে থেকেছেন, না-হলে জেলের বাইরে থেকেছেন, কিন্তু একদিনও সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতায়, মার্কসবাদ-লেনিনবাদ চর্চায়, তার প্রয়োগে, এবং সেই সূত্রে কমিউনিস্ট পার্টির কাজে বিরতি দেন নি। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মৃদুল দে মৃত্যুর আগে তাঁকে দেখে লিখেছেন,‘‘ নার্সিংহোমে একমাস ধরে তিনি উচ্চারণ করে গেছেন সবসময়ই পার্টির কথা, কখনও সজ্ঞানে, কখনও অজান্তে। মন পড়ে রয়েছে মানুষকে মুক্ত করার দিকে। ছোট থেকে বড় ঘটনা কোনটাই তাঁর দৃষ্টি এড়ানোর যো নেই। ২২শে জুলাই তিনি সর্বশেষ যে কথা বলেছেন, তা হলো,‘রেলওয়ে স্ট্রাইকের তাৎপর্য আমাদের বুঝতে হবে। এটা বোঝার প্রয়োজন আছে যে …।’ ঠিক এটাই ছিল তাঁর সমগ্র পার্টি জীবনের গতিধারা।’’ (হরেকেষ্টদা— কিছু স্মৃতি—কিছু কথা)। অকুতভয় হরেকৃষ্ণ কোঙার শ্রেণি শত্রুদের দ্বারা বারে বারে আক্রান্ত হয়েছেন ,আহত হয়েছেন, শয্যাশায়ী হয়েছেন,কিন্তু তাতে পার্টির কাজে ছেদ পড়ে নি। কুখ্যাত সেলুলার জেলে ‘কমিউনিস্ট কনসলিডেশন’-যোগ দিয়েছেন। ড: নারায়ণ রায়, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, সতীশ পাড়কাশী প্রমুখ বিপ্লবীর সংস্পর্শে এসেছেন, মার্কসবাদী সাহিত্য অধ্যয়ন করেছেন। এইভাবেই হরেকৃষ্ণ কোঙার নিজেকে তৈরি করেছেন, জনগণের নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।


১৯৬২ সাল। ৩১ ডিসেম্বর, বছরের শেষ দিন। রাত সাড়ে দশটা। হরেকৃষ্ণ কোঙার দমদম সেন্ট্রাল জেলে বন্দি। একটা খাতায় লিখেছেন, ‘‘ দেশপ্রেম ও মার্কসবাদী-লেনিনবাদী শক্তি এই সময়ে সংহত হচ্ছে। আমিও আমার ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে এই কাজে সক্রিয় অংশ নিতে পেরেছি। সারা বছরে এটাই আমার বড় গর্বের কথা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস,— ভুল করি নাই। দেশের বিপদের মধ্যে প্রতিক্রিয়ার আক্রমণ, দমননীতি ও সংস্কারবাদীদের কুৎসা প্রচার আমাদের উপর নেমেছে। কিন্তু মার্কসবাদী বিজ্ঞানের অমোঘ নিয়মে এ সবই ব্যর্থ হবে। … আমি গর্বিত যে আমি এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বেঁচে আছি ও মার্কসবাদ ও প্রগতির সঙ্গে আছি।’’(বর্ষশেষ) মনে রাখতে হবে সেই সময়ের পরিস্থিতি। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মহাবিতর্ক, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে মতাদর্শগত সংগ্রাম, চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ঘ, উগ্র জাতীয়তাবাদী প্রচার, জরুরী অবস্থা, ভারত রক্ষা আইন।সেই পটভূমিকায় হরেকৃষ্ণ কোঙারের অভিব্যক্তি আমাদের আলোড়িত করে।
হরেকৃষ্ণ কোঙারের বড় গর্ব ছিল ১৯৬০ সালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসাবে ভিয়েতনাম ওয়ার্কর্স পার্টির কংগ্রেসে যোগদান ও হো চি মিনের সঙ্গে


চতুর্থ পর্ব

আলোচনা। ভিয়েতনাম ও হো চি মিনের স্মৃতি, ভিয়েতনামের সংগ্রামের শিক্ষা তাঁর পরম প্রাপ্তি। ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে হরেকৃষ্ণ কোঙার লিখেছেন, ‘‘ বহু অভিজ্ঞতার বিনিময়ে মানুষ লড়াইতে সামিল হয়। সশস্ত্র প্রতিরোধ দেওয়ালে রাইফেল আঁকার মতো সোজা নয়। ‘লড়ব ও মরব’ এই মনোভাবে উদ্দীপিত হলে ও সেই মতো প্রস্তুত হলে তবেই জনগণ বিপ্লবী পরিস্থিতিকে সফলভাবে কাজে লাগাতে পারে। সত্যিই লেনিনের এই কথা আমরা কেবল পড়েছি, হৃদয়ঙ্গম করিনি। মরতে প্রস্তুত হলেই মানুষ লড়তে পারে। আর লড়তে শিখলে তবে বাঁচবে। নিজেরা বাঁচতে যারা পাগল তার বাঁচতে জানে না। জীবনকে ভালোবাসতে যে জানে, সে শত্রুকে ঘৃণা করতেও জানে। স্ত্রী, স্বজন, পরিজন ও জনগণের প্রতি ভালোবাসাই মানুষকে ন্যায় সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে। যে শত্রুকে ঘৃণা করতে অক্ষম সে জনগণকে ভালোবাসতেও অপারগ।’’(ভিয়েতনামের শিক্ষা ও স্মৃতি)
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ। জন্ম ১৮৮৯ সালের ৫ আগষ্ট। মৃত্যু ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর । তাঁকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে হরেকৃষ্ণ কোঙার লেখেন, ‘‘… যিনি নিজের সমগ্র ব্যক্তিসত্তাকে সেই আদর্শের (সাম্যবাদের আদর্শ) উপযোগী করে গড়ে তুলেছিলেন, যিনি কোনদিন সে আদর্শ হতে নিজেকে বিচ্যুত হতে দেন নাই, যিনি সেই আদর্শকে চিন্তার স্তর হতে শ্রমিক-কৃষক ও জনগণের সংগঠিত বিপ্লবী আন্দোলনের মধ্যে রূপ দিয়েছেন এবং সারা জীবনের সাধনার মধ্য দিয়ে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে পরিচালিত গণ-মুক্তির এক বিপ্লবী বাহিনী সৃষ্টি করে গেছেন, তিনিই হলেন আমাদের শ্রদ্ধেয় মুজফ্‌ফর আহ্‌মদ— আমাদের সকলের প্রিয় কাকাবাবু। অন্যান্য অনেকের মতো আমি নিজেও নিজেকে কাকাবাবুর সৃষ্ট সেই বাহিনীর একজন সৈনিক মনে করে গর্ববোধ করি।’’(কাকাবাবুর কথায় যা মনে আসে) এই গর্ববোধ তো আমরাও আমাদের মধ্যে সঞ্চারিত করতে চাই। তার জন্য চাই উপযুক্ত প্রস্তুতি।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন