পর্ব-৪
মমতার ফেসবুক ওয়ালই ‘এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক’র আয়না
৯৯লক্ষ ২২ হাজার কর্মসংস্থান হয়েছে রাজ্যে — মমতা ব্যানার্জি গত লোকসভা নির্বাচনের ইশ্তেহারে ঘোষনা করেছিলেন। এখন তৃণমূল দাবি করে সেই সংখ্যা ১ কোটি পেরিয়েছে। রাজ্যে বুথের সংখ্যা ৭৭,২৪৭টি। সাধারন পাটিগণিত বলছে প্রতি বুথে অন্তত ১৩০ জনের কাজ হয়েছে মমতা-শাসনে। তৃণমূল কংগ্রেসের নেতা, মন্ত্রী, কর্মীরা ঘুণাক্ষরেও মমতা ব্যানার্জির ওই কাজের হিসাব এলাকায় বলেন না। কারন — এমন বুথটি কোথাও খুঁজে পাবে না কো তুমি! তারা জানেন।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201121_031328-563x1024.jpg)
মমতা ব্যানার্জির ফেসবুক অ্যাকাউন্ট আছে। রোজ তিনি কিছু না কিছু পোস্ট করেন। সেখানে কমেন্ট করেন অনেকে। তাঁদের বেশিরভাগ তৃণমূল কংগ্রেসের সমর্থক হতে পারেন। কিন্তু তাঁদের অনেকেরই পোস্টের মোদ্দা কথা — ‘একটা কাজ চাই।’ ‘নিয়োগ বন্ধ কেন?’ ‘চাকরি চাই।’ অনেকে মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতিগুলিই মনে করিয়ে দিয়ে আক্ষেপ লেখেন। বিদ্রূপও করেন। কমেন্টগুলি খেয়াল করলে বোঝা যাবে ‘দিদি তুমি এগিয়ে চলো’-র তুলনায় অনেক বেশি প্রবল কাজের জন্য হন্যে হয়ে থাকা রাজ্যের যুবসমাজের ক্ষোভের উত্তাপ।
অভিষেক ব্যানার্জি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো। চালু করেছেন সম্প্রতি ‘বাংলার যুবশক্তি।’ ডিওয়াইএফআই-র মুখপত্রর নকল করে নাম। তা নিয়ে মামলা হয়েছে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ হলো ভাইপোর সেই প্রচারে অংশ নেওয়ার শর্ত। শর্তাবলীতে স্পষ্ট লেখা — আপনি যুক্ত হলেও কোনও কাজ পাবেন এমন ভাববেন না। শর্তাবলীর ৭নং পয়েন্টে সতর্ক করা আছে — ‘স্বেচ্ছাসেবকরা কেউ কাজ, চাকরি চাইতে পারবেন না।’ স্পষ্ট দেওয়াল লিখন — কাজের দাবিই রাজ্যের প্রধান দাবিগুলির একটি। এবং তৃণমূল কংগ্রেস পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে কাজের সুযোগ তৈরি করতে।
নর্মদা চন্দ্র রায়ের কাহিনীটি এই ক্ষেত্রে চমকপ্রদ।
বিধানসভায় বামফ্রন্টের বিধায়ক নর্মদা চন্দ্র রায়। কুশমন্ডি তার এলাকা। তিনি একটি নিরীহ প্রশ্ন করেছিলেন, ২০১৬-র ২৮শে নভেম্বর। অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর কাছে তাঁর প্রশ্নটি ছিল — (ক) বর্তমানে রাজ্যে সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা কত? (খ) ২০১৫-১৬ আর্থিক বছরে বিগত আর্থিক বছরের তুলনায় ওই রূপ কর্মচারীর সংখ্যা কত পরিমাণে হ্রাস বা বৃদ্ধি পেয়েছে? প্রশ্নটির জবাব দিয়ে বামফ্রন্টের ‘অপপ্রচারের’ মুখতোড় জবাব দেওয়ার ইচ্ছা ছিল অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রর। এই সংক্রান্ত তথ্য চেয়ে রাজ্যের অর্থ দপ্তর ২০১৬-র ২রা ডিসেম্বর চিঠি (নং-৬২৩৮-৭৫-এফ-এইচ) পাঠিয়েছিল প্রতিটি দপ্তরে, বিভাগে। চিঠির নিচে ছাপার অক্ষরে লেখা ছিল ‘টপ প্রায়োরিটি’।
কিন্তু ওই পর্যন্তই। চার বছর পার হতে চলেছে। নর্মদা চন্দ্র রায়ের প্রশ্নের জবাব আজও দিতে পারেনি রাজ্য সরকার।
কেন? কারন — রাজ্যে সরকারী কর্মচারীর সংখ্যা লাগাতার কমিয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। শূণ্যপদ পূরণের প্রতিশ্রুতি ছিল। পালন করেননি।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201121_031259.jpg)
গত কয়েক বছরে সেই সংখ্যা আরও কমেছে। গত কয়েক বছরে যা নিয়োগ হয়েছে, তার বেশিরভাগ চুক্তিতে। তাঁদের বেতন, সুরক্ষা — কোনও বিষয়েই সরকারের বিশেষ দায়িত্ব নেই। ২০১৮-র ২৯শে জুন রাজ্য সরকার নির্দেশিকা জারি করে একটি কমিটি গড়েছে। নাম — ‘স্টেট লেবেল কমিটি অন র্যাশানালাইজেশন অ্যান্ড অপটিমাল ইউটিলাইজেশন অব হিউম্যান রিসোর্স।’ এর কাজ কী? সমস্ত শূণ্য পদের প্রয়োজনিয়তা খতিয়ে দেখা হবে। অতিরিক্ত কর্মী কোথায় আছে তা খুঁজে দেখা হবে। এমনকি নতুন পদ সৃষ্টিরও দরকার আছে কিনা — তার বাস্তবতা বিচার করা হবে। পাশাপাশি কত পদের আর দরকারই নেই, সেগুলির অস্তিত্বই মুছে দিতে হবে। তার জন্য কমিটি মমতা ব্যানার্জির।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201121_031407.jpg)
অথচ ২০১১-য় তৃণমূলের বিধানসভা নির্বাচনের ইশ্তেহারের সরকারী শূণ্য পদ পূরণের ঘোষণা ছিল। ইশ্তেহারের ৩৪ নম্বর পাতায় কী বলেছিলেন মমতা ব্যানার্জি? ‘‘গ্রামের আধাবেকারসহ এখন বেকারের সংখ্যা ১কোটি। এদের চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এর জন্য বিশেষ ভূমিকা নেবে এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক।’’ এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কটির এখন কী অবস্থা? গত ফেব্রুয়ারিতে বিধানসভার বাজেট অধিবেসন হয়েছে। বাজেট পেশের পরের দিন, ১১ই ফেব্রুয়ারি বাজেটের পরদিনই মঙ্গলবার বিধানসভায় রাজ্যের শ্রম মন্ত্রীর কাছে এ রাজ্যে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা কত, জানতে চেয়েছিলেন সিপিআই(এম)’র বিধায়ক আমজাদ হোসেন। প্রশ্নোত্তর পর্বে বিধায়কের এই প্রশ্নে জবাব দিতে গিয়ে শ্রম মন্ত্রী মলয় ঘটক বলেছিলেন, ‘‘২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজ্যের এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ৩৪ লক্ষ ৫ হাজার ৫৮২।’’
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201121_031218.jpg)
নথিভুক্ত বেকারের কতজন চাকরি পেয়েছেন? বিধায়ক জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অনুসারে রাজ্যে সরকারি ও অন্যান্য নিয়োগ সংবাদপত্র সহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিন মাধ্যমে বিজ্ঞাপিত হয়। উক্ত বিজ্ঞাপন অনুযায়ী কেউ চাকরি পেলে শ্রম দপ্তরের অধীন কর্ম বিনিয়োগ কেন্দ্রে জানানোর বাধ্যবাধকতা নেই।’’ মন্ত্রীর এই জবাব শুনে আমজাদ হোসেন বলেন, অর্থ মন্ত্রী কিন্তু বাজেটে এক বছরে ৯ লক্ষ কর্মসংস্থানের কথা বলেছেন। আর শ্রম মন্ত্রী বলছেন, কোনও তথ্য নেই! এ হলো এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্কের হাল। মমতা ব্যানার্জির প্রতিশ্রুতি ছিল — ‘স্থানীয় বেকারদের কর্মসংস্থানের জন্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উন্নয়নের জন্য বোর্ড গঠন করে বিশেষ তৎপরতা নেওয়া হবে।’(২০১১-র বিধানসভা নির্বাচনের ইশ্তেহার, পৃষ্টা ২৬) কথা ছিল — ‘বাইরে চলে যাওয়া ছাত্র-যুবদের বাংলায় ফিরিয়ে এনে তাদের মেধাকে কাজে লাগানো হবে।’ (ওই, পৃষ্ঠা ২২)। কত মেধাবীকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে? রাজ্যে পরিযায়ী শ্রমিকের সংখ্যা কী মারাত্মক জায়গায় পৌঁছেছে তা দেখিয়ে দিয়েছে লকডাউন। রাজ্যে বেকারত্ব বেড়েছে মমতা ব্যানার্জির শাসনকালে। রিপোর্ট রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার। তথ্য সরবরাহ করেছে রাজ্যের সরকার। তার ভিত্তিতে রাজ্যওয়াড়ি মানুষ, অর্থনৈতিক অবস্থার রিপোর্ট প্রকাশ করেছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। ‘হ্যান্ডবুক অব স্ট্যাটিসটিক্স অন ইন্ডিয়ান স্টেটস ২০১৯-২০’ শীর্ষক সেই রিপোর্টের তুলনামূলক আলোচনার মোদ্দা কথা— ২০১০-১১ সালের নিরিখে রাজ্যের পরিবর্তন মূলত পিছন দিকে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/11/IMG_20201121_031139.jpg)
নারী-পুরুষ মিলিয়ে রাজ্যে এখন বেকারত্বের হার ৩৫। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক ২০১৯-র মার্চ পর্যন্ত সময়কালের তথ্য দিয়েছে। ২০২০-র মার্চে তা আরও বেড়েছে সন্দেহ নেই। কিন্তু ২০০৯-১০ সালে তা কত ছিল? ১৯।
রাজ্যে শহরে অনেক বেকার। রাজ্যের তথ্যের ভিত্তিতে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক তা-ই জানাচ্ছে। শহরে বেকারত্বের হার ২০১০-এ ছিল হাজারে ৪০। ২০১৯-এ তা দাঁড়িয়েছে ৪৯-এ। পুরুষদের ক্ষেত্রে এই হার ৩৫ থেকে ৫৩-তে পৌঁছেছে গত ন’বছরে।
কাজের একটি বড় ক্ষেত্র ক্ষুদ্র ও ছোট শিল্প। এই ক্ষেত্রে উদাহরণ হতে পারে প্রধানমন্ত্রী এমপ্লয়মেন্ট জেনারেশন প্রোগ্রাম(পিএমইজিপি)। রাজ্যের সরকারের রিপোর্ট বলছে, তৃণমূল কংগ্রেস-মাওবাদী-বিজেপি-র নৈরাজ্যের দিনগুলিতেও তিন বছরে ওই প্রকল্পে কর্মসংস্থান হয়েছিল ১লক্ষ ৭০ হাজারের কিছু বেশি। শুধু ২০১০-’১১-তে পশ্চিমবঙ্গে ওই প্রকল্পে মোট কর্মসংস্থান হয়েছিল ৩৭৬৩২। আর মমতা-শাসনের শেষ তিন বছরে সেই একই ক্ষেত্রে কাজের সুযোগ হয়েছে মাত্র ৩১ হাজারের কিছু বেশি। রাজ্য সরকারের তথ্য জানাচ্ছে, ২০১৭-১৮-তে এবং ২০১৮-১৯ — ওই দু’ বছরে কাজ হয়েছে যথাক্রমে ১০,৯২৮ এবং ১৯,৩০৪ জনের। ২০১৯-২০-তে তা আরও কমেছে। হয়েছে ১১০০০-র কাছাকাছি জনের কর্মসংস্থান।
কাজের যে সম্ভাবনা রাজ্যে তৈরি হয়েছিল, তা ধ্বংস হয়েছে তৃণমূল কংগ্রেসের সময়কালে। বেকারত্ব এক মারাত্মক সঙ্কটের চেহারা নিয়েছে।
★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★★ ধারাবাহিক চলবে......
আগামী কাল ৫-পর্ব , বিষয়- কৃষক দরদ ও তৃণমূল কংগ্রেস সংক্রান্ত ....
শেয়ার করুন