২১শে জুন। ৪৩ বছর হয়ে গেল। হ্যাঁ , ১৯৭৭ সালের ২১ জুনেই তৈরী হয়েছিল প্রথম বামফ্রন্ট সরকার। রাইটার্স বিল্ডিংয়ের সামনে প্রবল জনোচ্ছাসের মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু শপথ নেবার পর ঘোষণা করেছিলেন তাঁর নতুন সরকারের অভিমুখ। স্পষ্ট উচ্চারন। এই সরকার রাইটার্স থেকে প্রশাসন পরিচালনা করবে না; মাঠে ময়দানে, কলে কারখানায়, স্কুল কলেজ , অফিস কাছারিতে জনসাধারণের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করেই এগোবে সরকারের কাজ।
ছোটবেলায় স্কুলপাঠ্যে পড়তাম গণতন্ত্রের ব্যখ্যা । ফর দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল , অফ দ্য পিপল। জনগণের জন্য , জনগণের তৈরী,জনগণের। কিন্ত পাঠ্য বইয়ের বাইরে মানুষের জীবনে ! ধর্ম,বর্ণ, ভাষা, শ্রেণী নির্বিশষে সবার কাছে! ব্যবধান ছিল,ব্যবধান বেড়েছে। এই ব্যবধান অতিক্রম করে প্রকৃত অর্থে গণতন্ত্রের স্বাদ, সবার কাছে , বিশেষ করে গ্রাম-শহরের শ্রমজীবী মানুষ , সামাজিক বৈষম্যের শিকার তপশীলি জাতি-উপজাতির মানুষ , ভাষা এবং ধর্মিয় সংখ্যালঘু মানুষ, লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার মেয়েদের কাছে পৌঁছে দেওয়াটাই ছিল চ্যালেঞ্জ।
তাই , উদ্বেল জনতার সামনে নতুন সরকারের অভিমুখের মূল নির্যাস তুলে ধরবার পর বিকেলে প্রথম ক্যাবিনেট মিটিং থেকে সিদ্ধান্ত হলো , সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হবে। আসলে ২১ শে জুন এসেছিল গণতন্ত্রের উপর তীব্র স্বৈরাচারী আক্রমণের আবহে। আধা ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাস আর দেশব্যাপী জরুরি অবস্থার পটভূমিতে। সুতরাং , রাজনৈতিক স্বাধীনতা এবং বিরোধিতার নিশ্কন্টক সুযোগ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার প্রশ্নটাই ছিল প্রথম অগ্রাধিকার।
তারপর সময় যতো এগিয়েছে , গণতন্ত্র আর সরকারকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্যে বামফ্রন্টের ইশতেহারে দেওয়া প্রতিশ্রুতি গুলো এক এক করে রূপায়িত হয়েছে।
শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া , শ্রমিকদের আন্দোলনে, গণ আন্দোলনে পুলিশের হস্তক্ষেপ বর্জন করা , শ্রমিক- মালিক দ্বন্দ ত্রিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা এইসব শ্রমজীবীদের মধ্যে আত্মবিশ্বাসের জন্ম দিয়েছিল। সরকার সাধারণত মালিকদের হয়ে ভূমিকা নেওয়া থেকে বিরত থেকেছে।
ঠিক একই ভাবে গ্রামাঞ্চলেও কৃষকের , বিশেষতঃ গরীব , ভূমিহীন আর প্রান্তিক কৃষকদের যে প্রধান প্রশ্ন , সিলিং উদ্বৃত্ত জমি পুর্নবন্টনের মধ্যে দিয়ে ভূমি সংস্কার তা অগ্রাধিকার পেয়েছে। আর , পাশাপাশি বর্গাদার কৃষকের বর্গার স্থায়িত্ব আর ফসলের ন্যায্য ভাগ স্বীকৃতি পেয়েছিলো ঐতিহাসিক অপারেশন বর্গার মধ্যে দিয়ে।
সামাজিক ক্ষেত্রে , শিক্ষায় ,স্বাস্থ্যে একই অভিমুখ। মুনাফা নয়, জনগণই মধ্যমনি। গণতন্ত্র । ছাত্র, শিক্ষক , কর্মচারীদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিকার আর পরিচালনায় অংশগ্রহণ। স্বাস্থ্যেও জোর প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রে, গ্রামীণ আর জেলা হাসপাতালে । আর মাথায় মেডিক্যাল কলেজ ঘিরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা। ফল পাওয়া গেছিল হাতে নাতে। স্বাক্ষরতার হারে , ছাত্র ভর্তিতে , কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্প্রসারনে। একই ভাবে স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও শিশুমৃত্যু বা প্রসূতি মৃত্যুর হারের তীক্ষ্ণ হ্রাসে।
এই তালিকা দীর্ঘ করাই যায়। পরিসংখ্যান ভারাক্রান্তও । কিন্তু উদ্দেশ্য সেটা নয়। উদ্দেশ্য তফাৎটা স্পষ্ট করা। নীতির, অভিমুখের, দৃষ্টিভঙ্গির। ২১ শে জুন, ১৯৭৭ যে নতুন যাত্রাপথের সূচনা হয়েছিল তার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল মানুষ। জ্যোতি বসুর অনুকরণীয় ভাষায় ' জনগণই ইতিহাস সৃষ্টি করে '। সুতরাং, গণঅংশগ্রহণ ছাড়া বামপন্থী সরকার , নৈব নৈব চ!
খন্ডচিত্র ২: ৩৪ বছর ।।
এই শব্দবন্ধটাই ২১শে জুন যে যাত্রাপথের সূচনা হয়েছিল তার বিরুদ্ধে ধিক্কারের, ঘৃণা উৎপাদনের সবচেয়ে সোচ্চার রণধ্বণি। কারণটা সহজেই অনুমেয়। গণতন্ত্র মানুষকে তার নিজস্ব স্বতন্ত্র ভূমিকা পালন করবার প্রসস্ত জমি তৈরি করে দেয়। আর রাজনীতিতে এই জমি যদি আর্থসামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতায়নের ভিত্তিতে দৃঢ় হয়, তাহলে তো কথাই নেই!
৩৪ বছর এই রাস্তা তৈরি করেছিল। মানুষ সামনে চলে এসেছিল। আর অধিকাংশ মানুষ যদি সশক্ত হয় , মুষ্টিমেয় স্বার্থের প্রতিনিধিদের কাছে সেটা কিভাবে গ্রহনযোগ্য হবে ! ৩৪ বছর লম্বা সময়। তাই দিন যতো গেছে , সমালোচনা ততোই তীব্র হয়েছে ; ঘৃণার চেহারা পেয়েছে।
বামফ্রন্ট সরকারের গণতন্ত্রকে সম্প্রসারিত করবার, সংহত করার প্রয়াস ছিল দ্বিমুখী। না , বামফ্রন্টের আশু লক্ষ্য বিপ্লবী রূপান্তর ছিল না । জ্যোতি বসু কোনো ধরনের ভণিতা ছাড়াই ঘোষণা করেছিলেন ' পশ্চিমবঙ্গ কোনো স্বতন্ত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয় , হওয়া সম্ভবও নয়'। কিন্তু যেটা সম্ভব ছিল , সেই রাস্তায় জোরালো ভাবে চলেছে বামফ্রন্ট। আনুষ্ঠানিক ভাবে যুক্তরাষ্ট্রবাদী সংবিধানকে কার্যকরী যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় পর্যবসিত করবার জন্য নিরলস প্রয়াস চালিয়ে যাওয়া। রাজ্যের জন্য অধিক ক্ষমতা। অর্থনৈতিক , রাজনৈতিক , বৈধানিক, প্রশাসনিক । পশ্চিমবঙ্গের মানুষের প্রতিষ্ঠিত অধিকার সম্প্রসারিত হবার পাশাপাশি ভিন্নধর্মী রাজ্য সরকার গুলোরও বৃহত্তর ভূমিকা পালনের রাস্তা প্রশস্ত করা । কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে ব্যাপকতর গণতন্ত্রমুখী শক্তিগুলোর বিন্যাস সৃষ্টি করা। বিকেন্দ্রীকরণ।
এই বিকেন্দ্রীকরণের দ্বিতীয় মুখ রাজ্যের মধ্যেই । রাজ্য থেকে গ্রাম , আর শহর-আধা শহরে । স্থানীয় সরকার , প্রশাসন। পঞ্চায়েত , মিউনিসিপ্যালিটি, কর্পোরেশন। রাইটার্স নয় ,সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়া জনগণের কাছে। আর ফলাফল পাওয়া গেছিল হাতে নাতে । অর্থনৈতিক উৎপাদনে , সামাজিক উন্নয়নে, সংহতিতে , বিপর্যয় মোকাবিলায়।
এই দ্বিমুখী অভিযান তাই ক্ষমতার কাঠামোর নক্সা আর রসায়নকেই বদলে দিতে দৃঢ় পদক্ষেপ রেখেছিল। সমাজের স্তরভেদে ভালোবাসা আর ঘৃণা, দুইই তাই জুটেছে ৩৪ বছরের ভাগ্যে।
কিন্তু ৩৪ বছরের এই খন্ডচিত্রের নির্যাসের উপলব্ধি অধরা থেকে যাবে পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তনটা বুঝতে না পারলে। দুটো স্পষ্ট ভাগ । ৭৭ থেকে ৯১। আর ৯১ থেকে ১১। মাঝখানে ১৯৯১ আর নয়া সংস্কার । নয়া উদারবাদী সংস্কার। খোলা বাজারের আধিপত্য। সরকার বাজারকে নয়, বাজারই সরকারকে নিয়ন্ত্রণ করবে।
প্রথম পর্যায়টা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের। আর সাথে, রাজ্যের অভ্যন্তরে জনগণের ক্ষমতায়ন বিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে। কিন্তু দ্বিতীয় পর্যায়টা এলো বাজারের চাপিয়ে দেওয়া নীতি , যার সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লো সরকার। জনকল্যাণমূলক সরকার -রাষ্ট্র রূপান্তরিত হলো নয়াউদাররবাদী রাষ্ট্রে। বিরাট পরিবর্তন। সরকারি বিনিয়োগ তীক্ষ্ণ ভাবে হ্রাস পেলো । কৃষিতে , শিল্পে , সামাজিক ক্ষেত্রে, পরিকাঠামো উন্নয়নে। আর্থিক বৃদ্ধি আর মুনাফা হয়ে উঠলো অর্থনীতির মূল্যায়নের একমাত্রিক মাপকাঠি।
ফলে এই পর্যায়ে বামফ্রন্ট সরকারের কাজ হয়ে উঠেছিল অনেক বেশি। একদিকে সীমিত অর্থনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে সরকারি বিনিয়োগে মানুষের স্বার্থে মৌলিক পরিষেবা জারি রাখা , কৃষি ক্ষেত্র এবং পরিকাঠামো গড়ে তোলা, ক্ষুদ্র এবং ম্যানুফ্যাকচারিঙ্গে কর্মসংস্থান বাড়ানো ,রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে বেসরকারিকরণের থাবা থেকে আগলে রাখা আর পাশাপাশি রাজ্যের পরিকল্পনার সঙ্গে সাযুজ্য রেখে বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। যেহেতু কৃষি এবং ছোট মাঝারি শিল্প অগ্রগতি ছিল তুলনামূলক ভাবে চোখে পড়বার মতো , গ্রামাঞ্চলে ক্রয়ক্ষমতা এবং চাহিদার লক্ষনীয় বৃদ্ধি বেসরকারি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করবার প্রশ্নে উল্লেখযোগ্য গতি নিয়ে আসে।
কিন্তু এটা ঠিক , বাজারের আধিপত্যের আবহে পুরো প্রক্রিয়াটিতে বামফ্রন্ট সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কিছু কিছু আপোষও করতে হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে , কিছু ত্রুটি বিচ্যুতি হয় নি এমন দাবিও কেউই করতে পারে না । কিন্তু গণতন্ত্র আর গণমুখীনতার মৌলিক বৈশিষ্ট্য অটুট থেকেছে। আর চোখের মণির মতো সযত্নে রক্ষিত হয়েছে, লালিত হয়েছে , জাত ধর্ম বর্ণ ভাষা নির্বিশেষে মানুষের ঐক্য। বিভাজনের শক্তি , দাঙ্গাবাজরা দাঁত ফোটাতে পারে নি এই রাজ্যের সম্প্রীতি-সৌহার্দ্যের পরিবেশে । কোনো ধর্মকে অসম্মান না করেও সরকারের কর্ণধারদের কখনো প্রকাশ্যে আনুষ্ঠানিক ধর্মাচরণ করতে হয় নি , মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগাতে।
স্বাভাবিকভাবে , এই মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে লঘু করতে , কালিমালিপ্ত করতে , ৩৪ বছরের বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়নের বদলে , এই ঘৃণার অভিযান চলেছে , চলছে।
খন্ডচিত্র ৩ : ৯ আর ৬এ , নয়ছয় পশ্চিমবঙ্গ ।।
২০১১ সাল থেকে ৯ বছর পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেসের সরকার। আর ২০১৪ সাল থেকে কেন্দ্রর নরেন্দ্র মোদীর এনডিএর সরকার গত ৬ বছর ধরে। ফলে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন যেটা ঘটে গিয়েছে। ১৯৯১ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্ঘাত ছিল , তা অন্তর্হিত। পৃথিবী জুড়েই উগ্র দক্ষিণপন্থার বাড়বাড়ন্ত , তার প্রধান উপাদান বামপন্থার প্রতি তুমুল বিরোধিতা।
২০১১ সালের অনেক আগে থেকেই তৃণমূল এই মাপকাঠিতে সগৌরবে উত্তীর্ণ হয়েছে। তার সঙ্গে বাড়তি পাওনা, পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থায় সিঞ্চিত রাজনৈতিক জমিতে বেড়ে উঠবার জন্য একটি প্রত্যক্ষ অ-ডানপন্থী বহিঃপ্রকাশের অনুপস্থিতি। কিন্তু 'নারদ তো স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে'! ফলে খুব দ্রুত স্বমূর্তি ধারণ করে তৃণমূল। অবশ্যই সবচেয়ে তীক্ষ্ণ প্রতিফলন ঘটে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণে। বিরোধীরা স্বাধীন বাধাবিঘ্নহীন পরিবেশে কাজ করতে পারবে না। মুখ্যমন্ত্রীর বয়ানে 'অন্তত দশ বছর বিরোধীদের মুখে স্টিকিং প্লাস্টার লাগিয়ে বসে থাকতে হবে'! পার্টি অফিস দখল , ট্রেড ইউনিয়ন অফিস দখল , ছাত্র ইউনিয়ন দখল , অস্থায়ী শ্রমিকদের কাজ থেকে ছাঁটাই , মিথ্যে মামলা , জেল এবং খুন যতো ধরনের অত্যাচার নামিয়ে আনা সম্ভব , সবই প্রয়োগ হয়েছে, হচ্ছে।
এর সঙ্গে সময় যত এগিয়েছে এবং সরকারের কার্যকলাপে বীতশ্রদ্ধ মানুষের মধ্যে বিক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে গণতন্ত্রের উপর আক্রমণের পরিধি টাও বিস্তৃত হয়েছে। ভোটে মনোনয়ন পত্র জমা না দিতে দেওয়া , নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রশাসনকে ব্যবহার করে চাপ দিয়ে বা টাকা পয়সা সরাসরি দলবদলে বাধ্য করা ।গণঅংশগ্রহণ তো নির্বাচিত সংস্থা গঠনে মানুষের ভূমিকাকে অপাঙক্তেয় করে দেওয়া। শ্রমিকদের ধর্মঘটের অধিকারকে কার্যত অবৈধ করে দেওয়া , এইসব এই ৯ বছরের পরিচিত লক্ষণ ।
অর্থনীতিতেও ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়েছে কোনো দীর্ঘমেয়াদী পরিপ্রেক্ষিত নিয়ে তৃণমূল কাজ করছে না । ম্যানিফ্যাকচারিং এর ভিত্তিতে সংগঠিত শিল্প গড়ে তোলার জন্য যেধরনের পরিকাঠামো এবং মানবসম্পদ থাকা দরকার , তৃণমূলের সামাজিক এবং নির্বাচনী সমর্থনের ভিত্তিতে , সেই পরিকল্পিত প্রয়াস নেওয়াটাও কষ্টসাধ্য। তৃণমূলের কর্মীরা মতাদর্শের ভিত্তিতে সংগঠিত নয় , মুখ্যমন্ত্রী এবং দলের সর্বোচ্চ নেতার প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্যই তার সাংগঠনিক কাঠামোর চালিকা শক্তি। সাধারণ ভাবে কর্মসংস্থানের সঙ্কট , এই কর্মীবাহিনীর আর্থিক ভরনপোষণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রশ্নেই , চিট ফান্ডের মতো অনৈতিক এবং বেআইনি কর্মকাণ্ডের মধ্যে প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা প্রকৃত লাভার্থীদের কাছে পৌঁছাতে কাটমানির প্রাদুর্ভাব একই প্রক্রিয়ার অঙ্গ। সবমিলিয়ে মানুষকে মধ্যমনি করে শহর আর গ্রামীণ শ্রমজীবীদের আর্থিক ক্ষমতায়নের যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল , স্থিতিশীল চেহারা পেয়েছিল তার বদলে তাৎক্ষণিকভাবে কিছু পাইয়ে দেওয়ার রণনীতি গড়ে উঠেছে। সরকারের দৃঢ় নিয়মবদ্ধ হস্তক্ষেপ ছাড়া এবং শিল্পের বিনিয়োগ ছাড়া সরকারি বদান্যতার উপর নির্ভরশীল এই পরিস্থিতি একটা স্বাভাবিক নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছে । সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ীও রয়েছে । কিন্তু যেহেতু সব মিলিয়ে সঙ্কটে রাজ্যের মানুষ , সুতরাং এই অনিশ্চয়তা এবং নিরাপত্তাহীনতা বিভাজনের রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরী করে দিচ্ছে।
তৃণমূল কংগ্রেস এই প্রশ্নে ধর্মীয় অনুভূতিকে ব্যবহার করতে গিয়ে সংখ্যালঘু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে উৎসাহিত করেছে। ধর্ম এবং রাজনীতির মধ্যে যে ব্যবধান ছিল তার বিরুদ্ধে গিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে মসজিদের ইমামদের ভাতা চালু করা হয়েছে। এটা মেরুকরণের আবহকে পুষ্ট করেছে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে আরএসএসের উপস্থিতি ছিল নামমাত্র। কিন্তু এই নতুন আবহে এবং কোনো মতাদর্শগত প্রতিরোধের অনুপস্থিতিতে তাদের দ্রুত বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। রাজ্য সরকার এবং তৃণমূল , এই মেরুকরণের আবহে অনেক জায়গায় হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সঙ্গে সমঝোতার রাস্তায় যাচ্ছে।
ফলে একদিকে অসামাজিক কার্যকলাপ আর সঙ্গে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের আবহাওয়া কিন্তু মানুষের মধ্যে রুটি রুজির বিপন্নতাকে তীব্র করছে। এই আবহতেই ২০১৪ সালে মোদী সরকার। তৃণমূলের রাজনৈতিক সুবিধাবাদ , তীব্র বাম বিরোধিতা এবং সক্রিয়ভাবে মেরুকরণকে ব্যবহার বিজেপির পায়ের তলায় প্রাথমিক জমি জুগিয়ে দেয়।
কেন্দ্রীয় সরকারের নিরঙ্কুশ ক্ষমতা । বহু অর্থনৈতিক অপরাধ এবং কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলোকে ব্যবহার করে তৃণমূলকে চাপে রাখবার সুযোগও তাদের সামনে চলে আসে। কিন্তু মানুষের মধ্যে যে আশা প্রাথমিক ভাবে তৈরি হয়েছিল এবং ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী নিজেই সেই বিভ্রমকে দৃঢ় করতে সাহায্য করেছে , যে তারাই তৃণমূলের মানুষের বিরুদ্ধে অন্যায়ের প্রতিকার করবে , সেটা বিজেপির তৃণমূল বিরোধী বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশের একটা ভিত তৈরি করেছিল । কিন্তু এখন ধীরে ধীরে অনেকটা স্পষ্ট যে এই দুটো শক্তির খুব একটা মূলগত পার্থক্য নেই। আর্থিক নীতি , স্বৈরাচারী শাসন পদ্ধতি এবং মেরুকরণের রাজনীতি , সবকিছুতেই এই দুই দলই স্বচ্ছন্দ। এবং এরা কেউই মুনাফার উর্দ্ধে মানুষকে স্থান দেবার অগ্রাধিকারে বিশ্বাসী নয়।
কিন্তু গত ছ বছরে মোদী সরকার , প্রথম এবং দ্বিতীয়, ভারতের গরীব এবং শ্রমজীবী মানুষকে চূড়ান্ত বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছে । অর্থনীতি শ্লথ হতে হতে এখন মন্দায় । কিন্তু শুধু আর্থিক বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়াই বৈষম্যের তীক্ষ্ণ বৃদ্ধি , কর্মসংস্থান তলানিতে ঠেকে যাওয়া , গভীর কৃষি সঙ্কট , খাদ্য নিরাপত্তার অনিশ্চয়তা , সরকারি বিনিয়োগে বিপুল নিম্নগতি , জনশিক্ষা আর জনস্বাস্থ্যের ভগ্নদশাকে সামনে নিয়ে । বেসরকারিকরণের তীব্র গতি জনসংখ্যার একটি বড় অংশকেই ন্যুনতম প্রয়োজনীয় চাহিদা এবং পরিষেবা থেকে ছিটকে দিচ্ছে।
হিন্দুত্বের একদিকে যেমন সাম্প্রদায়িক এবং অন্যান্য পরিচিতি সত্বার ভিত্তিতে বিভাজন আর মেরুকরণের পরিবেশ গড়ে তুলছে , আর সংবিধানের মৌলিক গণতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ ভিত্তিটাকেই দুর্বল করে দিচ্ছে। স্বাধীন এবং সাংবিধানিক স্বতন্ত্র সংস্থাগুলোকেও তাবেদারী করতে বাধ্য করছে । আইনের শাসন , নাগরিক অধিকারও বিপন্ন হয়ে পড়েছে। প্রশাসন নির্লজ্জের মতোই বিজেপিআরএসের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজ করছে। আগ্রাসী নয়াউদারবাদের অনিবার্য পরিণতি ধান্দার ধনতন্ত্রে। বিজেপির বিপুল অর্থশক্তি , আর কর্পোরেট গণমাধ্যমের সঙ্গে গাঁটছড়া সমকালীন রাজনৈতিক ভাষ্যকেও নিয়ন্ত্রণ করছে এটাও বলাই বাহুল্য।
এইরকম একটা প্রেক্ষিত যে গণতন্ত্র , মানুষ আর তার দৈনন্দিন জীবন জীবিকাকে তছনছ করে দেবে এটাই স্বাভাবিক। হচ্ছেও তাই। আর অন্য আর পাঁচটা রাজ্যের তা পশ্চিমবঙ্গেও গরীব শ্রমজীবীদের বিপন্নতা এই মোদী জমানায় তীব্র হচ্ছে । তৃণমূল আর বিজেপির মধ্যে নীতিগত অবস্থানের সাদৃশ্য দুটো দলকেই উৎসাহিত করছে পারস্পরিক ভাবে একে অপরের প্রতিপক্ষ হিসেবে হাজির করতে । মানুষ আর তার মৌলিক চাহিদার নিরিখে জরুরি প্র্রশ্নগুলোকেও পেছনে ঠেলে দিতে সুবিধা। আর এই কৃত্রিম মেরুকরণ বামপন্থীদের মানুষের মনোজগতে একটা প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দেবে । সব মিলিয়ে মানুষের এই নয়ছয় অবস্থাটাকে স্থায়ী করতে চাইছে দুপক্ষ ।
খন্ডচিত্র ৪ : সমকালীন সর্বনাশা বাস্তবতা।।
না ভাইরাসের সংক্রমণ পৃথিবীকে ভেঙ্গে চুরে দেয় নি । ভাঙ্গাচোরা যে ব্যবস্থাটা ছিল সেটাই অতিমারির তান্ডবে প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। এই ভাঙ্গাচোরা বাস্তব নয়াউদারবাদের অবদান । তীক্ষ্ণ আর্থসামাজিক বৈষম্য , বেসরকারিকরণের ধাক্কায় জন শিক্ষা আর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিধ্বস্ত হয়ে যাওয়া , জীবন জীবিকার অভুতপূর্ব সঙ্কট সৃষ্টি করেছে।
সংক্রমণের কোনো ওষুধ নেই , টীকাও নেই । ফলে পরীক্ষা করে কারা সংক্রামিত খুঁজে বার করা আর তাদের সম্পর্কে কারা এসেছে তাদের নজরদারির মধ্যে নিয়ে আসাটাই একমাত্র কার্যকর রাস্তা । আর তার ব্যকতিগতভাবে সংক্রমণ এড়াতে শারীরিক দূরত্ব আর হাত ভাইরাস মুক্ত রাখা । তার জন্য পরিকাঠামো , বৈজ্ঞানিক সচেতনতা এইটা করতে পারলেই এই যুদ্ধে সফল হওয়া যাবে ।
কিন্তু হচ্ছে কোথায় ! সবচেয়ে ধনী যারা স্বাস্থ্য পরিষেবাকে পুরোপুরি বেসরকারি বীমা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়েছে , সেখানেই সঙ্কট সবচেয়ে বেশি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , বৃটেন , ব্রাজিল আর এখন ভীষণভাবে ভারত ।
জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং পরিকাঠামোর দুরবস্থা এবং উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা ছাড়াই চার ঘন্টার নোটিসে সারা দেশে লকডাউন করে দেয় কেন্দ্রীয় সরকার। কোটি কোটি পরিযায়ী শ্রমিক যারা কাজ হারাবে , হাতে টাকা পয়সা থাকবে , বস্তি মালিকরা ভাড়া দিতে না পারলে ঘরছাড়া করে দেবে আর থাকতে দিলেও ১০×১০ এর ঘরে ৭/৮ জনকে , প্রতিদিন খাবার পাবে না - এই রকম পরিস্থিতিতে লকডাউন করা যায় না। তাই ব্যর্থতা। আসলে বিজেপির দর্শনে গরীব মানুষ নেই । শ্রমিক দিনমজুর নেই , পরিযায়ি নেই । নীতি নির্ধারণেও ওরা গরহাজির। গরীব মানুষের জীবিকার প্রশ্ন উহ্য রেখে , সংক্রমণের বিরুদ্ধে জীবনের লড়াই লড়া যায় না । অসম্ভব পরিস্থিতিতে মরিয়া হয়ে যখন ওরা হাঁটতে শুরু করলেন তখনও , ট্রেন বাস নেই , এমনকি ট্রেনের ভাড়া নিয়েও ঢরম মিথ্যাচার। আর লাঠি আর পুলিশের বুট । প্রায় দুমাস ধরে দেশের হাইওয়ে জুরে ট্র্যাজেডি । রক্তাক্ত রেল লাইন। অনাহারে মৃত্যু। এইসব অমানবিকতা শুধু নয় , সোজা সাপটা শ্রেনী আগ্রাসন।
শ্রম পুঁজি দুটোই চাই । অর্থনীতির নিয়ম। কিন্তু নয়াউদারবাদে অল্প কিছু মানুষের এতোটাই মুনাফা ,সম্পদ , বৈষম্য এতোটাই ক্রমবর্ধমান যে চেতনাতেই নেই শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি চাই । সামাজিক নিরাপত্তা চাই । ক্যাশ ট্র্যান্সফার চাই ।
উল্টোদিকে রাজ্য সরকার। তৃণমূল। সংক্রমণ নিয়ে , পরীক্ষা নিয়ে , কোয়ারান্টাইন নিয়ে , রেশন নিয়ে ,কাজ হারানো শ্রমিকদের বাঁচিয়ে রাখা নিয়ে , ১০০ দিনের কাজ নিয়ে কিছু পার্থক্য কি চোখে পড়ছে ? আসল কথাটা এক; শ্রেনী পক্ষপাতিত্ব । গণতন্ত্রহীনতা। আর ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গায়ের জোরের নিয়ন্ত্রণ। যারা নিয়ন্ত্রণ রাখার পদাতিক সেনা , তাদের অখুশি রাখল চলে কি করে ! তাই চাল চুরি , তোলাবাজি । কিন্তু শুধু অপরাধ ,বা তৃণমূল নির্দিষ্ট অপরাধ হিসেবে দেখাটা হবে পরিস্থিতি বুঝবার ক্ষেত্রে আমাদের উপলব্ধির অসম্পূর্ণতা।
মানুষের জন্য , মানুষের সরকার আর দক্ষিণপন্থী সরকারগুলোর মৌলিক তফাৎটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে কেরালাতে । সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা এবং শ্রমিকদের চাহিদাগুলো সহমর্মিতার ভিত্তিতে সমাধান করা। তাই দেশের মধ্যে কেরালাই একমাত্র। পরিপূর্ণভাবে সফল। কেরালা মডেল। সারা দুনিয়ায় চর্চার বিষয়। কিন্তু সেখানেও যেটা নোট করার বিষয় । গণচেতনা ,গণ অংশগ্রহণ। আর বিজ্ঞান মনস্কতা। তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা সচেতন সহযোগিতা। মানুষের । তাই জয় ।
সঙ্কটের এই কাল তাই ডান বামের ফারাক স্পষ্ট করেছে।
খন্ডচিত্র ৫ : একুশে বামফ্রন্টই ।।
কয়েকদিন আগেই করোনা সঙ্কটে এখন কোন রাজনীতি নয় হুঙ্কার তোলা ব্রিগেডের সহ অধিনায়ক অমিত শাহ ভার্চুয়াল ভাষন দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ নির্বাচনের প্রচার শুরু করে দিলেন। কয়েক হাজার টিভি মনিটার ব্যবহার করে কয়েক লাখ মানুষের কাছে সেই 'অমৃত ভাষন' এমনটা দাবি মূলস্রোতের গণমাধ্যমে। কতো টাকা খরচ হোলো , সেই টাকা ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে কোন অজানা কর্পোরেটের বদান্যতায় প্রাপ্ত তার অবশ্য 'পাপ' ! কিন্তু না জানলে তো বোঝা যাবে না , কাদের স্বার্থে সরকার চলবে । যতোই হিন্দু মুসলমান করে ভাগ করা হোক না কেন , করোনা সংক্রমণের শিকার এবং মৃত মানুষ মধ্যে জনসংখ্যার নিরিখে যে অনেক বেশি হিন্দু মানুষ মারা গেছেন , এটা বোঝার জন্যে রকেট বিজ্ঞানী হবার প্রয়োজন পরে না । অনুমান শুধু নয় , এটা প্রমানিত যে তুলনামূলক ভাবে রোগের শিকার অনেক বেশি গরীব । স্বাস্থ্য খাতে যদি কেন্দ্রীয় সরকারের খরচ জিডিপির ১% কম হয় , আর স্বাস্থ্য মূল দায়িত্ব যদি বেসরকারি বীমা কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়া হয় , এটা অনিবার্য । ফলে , হিন্দু মুসলমানের গল্পটা গরীব মারা নীতিটা আড়াল করতে সে নিয়ে আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
আর অর্থনীতির অবস্থা ভয়াবহ। গত দু আড়াই মাসে প্রায় ১৫ কোটি লোকের কাজ । মজুরি বাবদ চার লক্ষ কোটি টাকা হারিয়েছে শ্রমজীবী মানুষ। লোকের পেটে খাবার নেই , অথচ প্রায় ৬৫ লক্ষ টন খাদ্যশস্য এফসিআইর নষ্ট হয়ে গেছে। লোকের হাতে টাকা নেই ।ক্রয়ক্ষমতাও নেই। চাহিদাও নেই । ফলে উৎপাদনের জন্য বিনিয়োগ করবার চাড় নেই । থমকে গেছে অর্থনীতির চাকা । এইসব কোভিভ আসার আগের পরিস্থিতি । কোভিড আর লকডাউন অর্থনীতিকে কোন গভীর গহ্বরে নিয়ে ফেলেছে , ফেলবে , ভাবতেই শরীর শিউরে উঠছে। খালি মুকেশ আম্বানি এর মধ্যেই দশ জন সর্বোচ্চ ধনীর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে। গত দু মাসে প্রায় ৬৫, ০০০ কোটি টাকা সংগ্রহ পুঁজি বাজার থেকে । আর দেশের অর্থমন্ত্রীও ঘোষণা করে দিয়েছেন কোনো সঙ্কট নেই।
অমিত শাহ কিন্তু অকুতোভয়। ভোট প্রচারে। বীজমন্ত্র , ভোটে জিততে হবে। টাকা পয়সা , পুলিশ , সিবিআই ,এন আই এ ,সব মজুত। আর তারপরেও তো বিরোধীদের কেনা বেচার বিকল্প তো আছেই । হাফ ডজন ওরকম সরকার তো হয়েই গেছে।
কিন্তু তাও একটা খটকা লাগলো। শাহ বলল, আমাদের হয়তো অনেক খামতি থেকে গেছে। অনেক কিছু আমরা যা করতে পারতাম , তার করা হয়ে ওঠেনি। ইত্যাদি , ইত্যাদি। জাতীয় বিপর্যয় আইন জারি করে সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে , রাজ্যগুলোকে দেয় জিএসটির ভাগের ন্যায্য টাকা আটকে রাখবার পরে, পৃথিবীর দীর্ঘতম এবং কঠোরতম লকডাঊনকে সংক্রমণ বিস্তার রোধে নয় রাজনৈতিক বিরোধীদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা মেটাতে পুলিশকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করবার পরেও দেশের সর্বশক্তিমান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর এই নাঁকি কান্নার কি অর্থ থাকতে পারে ! আর সরকারে উনি, কিন্তু প্রশ্ন করছেন, বিরোধীরা কি করলো? এই দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়া সংক্রমণের মধ্যে অন্য রাজ্যের ভোট প্রচার না করে, বিরোধী বিধায়কদের কেনাবেচায় নিজেকে ব্যাস্ত না রেখে, নিজের কেন্দ্র আহমেদাবাদে যাওয় উচিৎ, গুজরাট, বিশেষ করে ওর কেন্দ্র তো কোভিডের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বধ্যভূমি! আর গুজরাট মডেল শব্দবন্ধ এখন আর ভুলেও উচ্চারিত হয় না। কিন্তু শাহের দাবি ক্ষমতায় এলে বাংলাকে সোনা দিয়ে মুড়িয়ে দেবেন! নিঃসন্দেহেই ওর সঠিক ডাক্তারের কাছে চিকিৎসা দরকার!
কিন্তু প্রশ্ন মানুষের বিরুদ্ধে ঘনিষ্ঠ কর্পোরেটের তেলা মাথায় তেল দেওয়া, মানুষকে ভাগ করা, সমস্ত ক্ষমতাকে কুক্ষিগত আর কেন্দ্রীভূত করে গণতন্ত্রের দফারফা করতে চায়, এই ভয়ঙ্কর শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জয় কি করে আসবে?
তৃণমূলকে সামনে রেখে? গত নবছরের অভিজ্ঞতা স্পষ্ট করে দিয়েছে, বিজেপির এই তিনটি মৌলিক বৈশিষ্ট্যের ক্ষেত্রে তৃণমূলের রাজনৈতিক প্রবনতা খুব ভিন্ন কিছু নয়। মোদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন আইন পাস করবার প্রশ্নে তৃণমূলের বিরোধিতার মুখে তাদের পড়তে হয় নি। আর্থিক নীতির ক্ষেত্রেও তাই। কর্মসংস্থান, কৃষি, শিল্প এবং শিক্ষা,স্বাস্থ্যের মতো সামাজিক ক্ষেত্রেও সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রয়োজনও তাদের নীতিতে প্রতিফলিত হয় নি। গণতন্ত্র রক্ষায় আর মেরুকরণের রাজনীতির বিরোধিতার প্রসঙ্গ যতো কম আলোচনা করা যায় ততোই ভালো! আর এগুলো না করে সরকারকে কিছুতেই মানুষের হাতে ফিরিয়ে দেওয়া যাবে না , মানুষের স্বপক্ষে কাজে লাগিয়ে তাদের আশা আকাঙ্খার রূপায়ণ ঘটানো যাবে না। সাম্প্রতিক সময়ে এটা আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শুধু অগত্যাই নয়। বামপন্থীরাই বিকল্প । মানুষের চাহিদা তো আকাশের চাঁদ ধরবার নয়। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা,স্বাস্থ্যের মতো প্রয়োজনীয় বেঁচে থাকার, টিকে থাকার উপাদানের উপর অধিকার । তার জন্য প্রয়োজনীয় কর্মসংস্থান। কৃষি , শিল্পের বিকাশ, উন্নয়ন। আর তার জন্যই দরকার সরকারকে জণগনের জন্য , জণগনের কাছেই ফিরিয়ে দেবার। নীতি না বদলে এটা করা সম্ভব নয়।
কে বদলাবে নীতি? তারাই যারা জনগণের স্বার্থের প্রতি বিস্বস্ত। কর্পোরেটের কাছে সীমাহীন গোপন চাঁদা নিয়ে যারা ভোটযুদ্ধে লড়তে চায় , বিরোধী বিধায়ক সাংসদের গরু ভেড়ার মতো কিনে নিজেদের সরকার বানাতে চায় , তারা কি সত্যিই মানুষের স্বার্থের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে পারে ? যারা ধর্মীয় এবং অন্যান্য পরিচিতি সত্বার ভিত্তিতে মানুষকে ভাগ করে, তারা ?
সেইজন্য , আলোচনা শুধুই কে ভোটে জিতবে , কে ভোটে জিততে পারে তার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখবার চেষ্টা। মানুষের ভালোমন্দের জায়গা নেই ঐ চর্চায়। স্বাভাবিকভাবেই কথা তাই বিজেপি না তৃণমূল, থোড় বড়ি খাড়া , খাড়া বড়ি থোড় ! মানুষের লাভ কোথায় মানুষের , নয় আর ছয়ের অভিজ্ঞতাই বা কি , নৈব নৈব চ !
৭% । কোনো স্থায়ী সংখ্যা তো নয়। মে কোনো ভোটে মানুষের সমর্থন সেই মূহূর্তে মানুষের বিবেচনার উপর নির্ভর করে। দক্ষিণপন্থীদের রাজনীতির বৈশিষ্ট্যই হোলো মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সমর্থন চাইবার বদলে একটা কৃত্রিম আবহ সৃষ্টি। সত্যিই মানুষের কি প্রয়োজন সেটাকে অন্তরালে পাঠিয়ে দেওয়া। খবরের কাগজ আর টেলিভিশন চ্যানেল তো রয়েইছে ঐ আবহ তৈরির জন্য।
কিন্তু বাদ সাধে অভিজ্ঞতা , জীবন জীবিকার উপর আক্রমনের অভিজ্ঞতা । বেঁচে থাকার, টিকে থাকার বিপন্নতা। গরীব মানুষ ,, গ্রামের মানুষ , পরিযায়ী শ্রমিক , সবাই । ত্রান , কমিউনিটি কিচেন , সব্জি বাজার এগুলো কোনো স্থায়ী সমাধান নয়। কিন্তু জরুরি । বন্ধু চেনার , জনস্বর্থের প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে সেই ঠিকানা খুঁজে নেবার।
বামফ্রন্ট এবং তার সহযোগীদের প্রতি সমর্থন , আসলে মানুষের সম্মিলিত উপলব্ধি আর চেতনারই বহিঃপ্রকাশ। সময় এখন দ্রুতগতি। সংক্রমণের মহামারি আর তার অর্থনৈতিক প্রভাব মানুষের অভিজ্ঞতাকে তীক্ষ্ণ করছে । মানুষের বড়ো অসহায় । তার পাশে দাঁড়িয়েই পরিস্থিতি বদলাবে। নীতির পরিবর্তনের ভিত্তি দৃঢ় হবে। ব্যক্তি নেতা নয়, সমষ্টির চেতনাই চাবিকাঠি। মানুষের উপর বিশ্বাস হারানো পাপ। তাই , ২১ শের ভোটে বামপন্থীদের জয় , মানুষের জয় অনিবার্য।