২০২০ মে দিবস: দুই দুনিয়া


মৃদুল দে


ভিয়েতনাম - আমেরিকা-

পাঁচ দশক আগে--
আমেরিকা দিয়েছিল নাপাম বৃষ্টি ভিয়েতনামে ।আজ ভিয়েতনাম আমেরিকাকে দিয়েছে সুরক্ষা পোশাক ।

ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিহত মার্কিন সেনার চেয়ে বেশি মার্কিন নাগরিক মারা গেল করোনা ভাইরাসে । দুঃখজনক ।১৯৫৫ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত আমেরিকার ভিয়েতনাম যুদ্ধে সরকারি হিসেবে মার্কিন সৈন্য নিহত হয় ৫৮,২২০ ।
২৯ এপ্রিল পর্যন্ত করোনা ভাইরাস সংক্রমনে আমেরিকায় দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যু হয়েছে ৫৮,৩০০ জনের । দু'দিনে বেড়েছে আরো পাঁচ হাজার । আক্রান্ত দশ লক্ষের বেশি, প্রায় ১১ লক্ষ , পৃথিবীর মোট আক্রান্তের তিন ভাগের এক ভাগ । শাসকের ঔদ্ধত্য ও শক্তিদম্ভের মূল্য প্রানের বিনিময়ে গুনতে হচ্ছে আমেরিকানদের ।
ইতালি,স্পেন,ফ্রান্স,ব্রিটেনের ভয়াবহ অবস্থা ।
ব্রাজিলে ফ্যাসিস্ট একনায়ক প্রেসিডেন্টের রাজত্বে একসপ্তাহে মৃত্যু সংখ্যা দ্বিগুনেরও বেশি বেড়ে এখন ৬০০৬, আক্রান্ত ৮৭ হাজার । চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অসাধারণ এই সাফল্যের মধ্যে কেন বিশ্বের সব মেধা, গবেষণা ও অর্থসম্পদকে এই রোগ দমনে একজায়গায় জড়ো করে যাচ্ছে না ! ভিয়েতনাম যুদ্ধে, পরবর্তী এমনকি এখনও নানা যুদ্ধ চালাতে এত সীমাহীন এনার্জি, এরকম ভাইরাস ও জানা-অজানা রোগ ব্যাধি থেকে নিজেদের দেশসহ দুনিয়ার মানুষকে বাঁচাতে কোথায় হারিয়ে গেল সেই এনার্জি ও ক্ষমতার ক্ষুদ্র অংশটুকু পর্যন্ত!

ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ -

৫০ বছর আগে এই সময়ে শত শত মার্কিন শিল্পী, অভিনেতা, গায়ক গায়িকা, লেখক, বিজ্ঞানী, ক্রীড়াবিদ, শিক্ষক,--- কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও হাইস্কুলের কাতারে কাতারে ছাত্রছাত্রী শামিল হয়েছিল বিক্ষোভে, ধর্মঘটে। একটাই স্লোগান-- আমেরিকা ভিয়েতনাম থেকে হাত ওঠাও, যুদ্ধের অবসান চাই । ভিয়েতনামের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে যেতে অস্বীকার করার জন্য শাস্তি ভোগ করতে হয়েছিল বিশ্ববিখ্যাত ক্রীড়া কিংবদন্তী মহম্মদ আলী । এরকম সাহসিকতার নজির আমেরিকাতেই অনেক ।
বীর ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে ভারত, পশ্চিমবঙ্গ, কলকাতা হয়ে ওঠে আন্দোলিত--- --'তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম, ভিয়েতনাম'। মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভের ঝড় আছড়ে পড়ে কলকাতায়, দেশ-দুনিয়ায়। পঞ্চাশ বছর পর সেই মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ আজও প্রেরণা ।

সাড়ে চার দশক আগে এসময়ে ভিয়েতনামের মাটিতে যুদ্ধবাজ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরাজয়।
৩০ এপ্রিল, ১৯৭৫ সায়গনের পতন। জয়োল্লাস গোটা পৃথিবীতে । ভিয়েতনামের ফৌজ গাড়িতে পতাকা উড়িয়ে চলেছেন দক্ষিণ ভিয়েতনামে, তার রাজধানী সায়গনে ।
সেই সায়গন নেই, আজ সেটা-- হো চি মিন সিটি। এই জয়ের পেছনে আছে সাড়ে আট লাখ মুক্তিযোদ্ধাসহ ২২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু ।

আন্তর্জাতিক মে-দিবস : সূচনা

১৮৮৬ সালে
আমেরিকার শিকাগো শহরের হেমার্কেটে ৮ ঘন্টা কাজের দাবিতে শ্রমিকদের রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের ঘটনার সময়টি বেছে নেওয়া হয়েছে ১ মে আন্তর্জাতিক মে দিবস হিসেবে । শ্রমিক সংহতির এই আন্তর্জাতিক দিবসে সেই থেকে প্রত্যয়ের পতাকা ওড়ে বিরামহীন । পৃথিবীর সব দেশে সব প্রান্তে শ্রমিকশ্রেণী ও সব স্তরের শ্রমজীবীদের স্বাধীনতা ও অধিকার অর্জনের সংকল্প দিবস হিসেবে এ দিনটি পালিত হয়ে আসছে । উদযাপিত হচ্ছে আমেরিকাতেও ।

করোনা-যুদ্ধে ভিয়েতনামের মানবিক ভূমিকা -

আর আজ ! অদৃশ্য যুদ্ধে!
২০২০ মে দিবসের প্রাক্কালে বিশ্বের নজর কেড়েছে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়ী-- ভিয়েতনাম। এখানে করোনায় আক্রান্ত তিনশ’রও কম, এখনো কোন মৃত্যু নেই। কিন্তু সতর্ক, কোন উছ্বাস নেই, কোন অহংকার নেই ।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় আমেরিকানদের রক্ষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভিয়েতনাম পাঠিয়েছে সাড়ে চার লক্ষ মাস্ক, পিপিই, সুরক্ষা পোশাক।

শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয়, কোভিড-১৯ মোকাবিলায় এর আগে বেশ কয়েকটি দেশকে মেডিক্যাল সরঞ্জাম সরবরাহ করেছে ভিয়েতনাম। পাঁচ লক্ষ উন্নত মাস্ক তারা তুলে দিয়েছে ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন এবং ব্রিটেনকে। মেডিক্যাল সরঞ্জাম পাঠিয়েছে লাওস ও কাম্বোডিয়াকে, যারাই চেয়েছে সাধ্যমত কমবেশি সহায়তা করেছে সকলকে। সবরকম সহায়তার হাত বাড়িয়েছে মার্কিন মুলুকেও । এই সামগ্রীর মধ্যে যেমন ছিল সুরক্ষা পোশাক, মাস্ক, তেমনই কোভিড-১৯ পরীক্ষার নির্ভরযোগ্য কিট। মানুষকে বাঁচানোর মানবিকতা অগ্রাধিকার, অভূতপূর্ব বিপদে নতুন নজির । ফেব্রুয়ারিতে কঠিন মুহূর্তে ভিয়েতনাম ৫ লক্ষ ডলার মূল্যের চিকিৎসা সরঞ্জাম জরুরি ভিত্তিতে দিয়েছে চীনকেও।

করোনা যুদ্ধে চীনের ভূমিকা -

চীন অসাধারন সাফল্যের পর সব অভিজ্ঞতা, সহায়তা নিয়ে দাঁড়িয়েছে সকলের পাশে । বিশ্বকে সহায়তা করতে উজাড় করে দিয়েছে কিউবা । গণস্বাস্থ্য রক্ষা ও সকলের সার্বিক চিকিৎসায় এরা দুনিয়াকে দেখিয়ে আসছে নতুন ব্যবস্থা, নতুন রাস্তা ।
এক কোটি মানুষের উহান শহরে এই অজানা রোগ প্রথম দেখা দেয় ডিসেম্বরের শেষে, নতুন বিপদের মোকাবিলায় করণীয় বুঝে উঠতে চীনের কিছু সময় লেগেছে, চিকিৎসায় প্রতিকার নেই । তাতে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে । সপ্তাহখানেক পর সরকার জনগন মিলে গোটা দেশ একযোগে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ২৩-২৫ জানুয়ারির মধ্যে সমস্ত প্রদেশ, পৌরসভা, স্বয়ংশাসিত এলাকা সংক্রমন প্রতিরোধের ও নিয়ন্ত্রনের ব্যবস্থাবলী কার্যকর করতে প্রচন্ড দ্রুততায় নেমে পড়ে । ৪০ হাজার স্থানীয় মেডিক্যাল কর্মী; গোটা দেশের সংকর্মন রোগ বিশেষজ্ঞ, চিকিৎসক, ফুসফুসের রোগের বিশেষজ্ঞ7শ 42 হাজার বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত চিকিৎসা কর্মী উহানে উচ্চ মানের মেডিক্যাল সহায়তা দেয় । এর ফলে হানে গুরুতর আক্রান্তদের মধ্যে ৮৯ শতাংশ সুস্থ হয়ে ওঠে ।

করোনা মোকাবেলায় ট্রাম্প তথা আমেরিকার ভূমিকা -

চীন কিভাবে পারলো অসাধ্য সাধন করতে, এর অনেক পরে সংক্রামিত, এপ্রিলে এই ভাইরাস ধরাশায়ী করে দেয় আমেরিকাকে, চীনের মতো যুদ্ধকালীন ব্যবস্থা নিতে পারেনি । ট্রাম্প প্রশাসনের এই চরম ব্যর্থতার দায় চাপাচ্ছেন ট্রাম্প স্বয়ং চীনের ওপর ।

চীনসহ যারা সফল তাদের সকলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে দুনিয়াকে এই বিপদ থেকে বাঁচানোর বিন্দুমাত্র কোন চেষ্টা ট্রাম্পের আমেরিকা করেনি । পুঁজিবাদের মূল শক্তিকেন্দ্র বলে নয়, মানবজাতি ও মানবিকতা নিয়ে পুঁজিবাদের আসল, মৌলিক ও চিরন্তন চরিত্র এটাই, ঠিক এটাই ; কোথাও বিপর্যয়ে কিছু ত্রাণ, সহায়তা দিলেও এই মূল চরিত্র তার অঙ্গীভূত । এ কারণেই দুনিয়া এদের নৃশংসতার শিকার । যুদ্ধ, বর্বর আধিপত্য, সংকট, মহামারী,পারমানবিক যুদ্ধের বিপদ, পরিবেশ দূষণে দুনিয়ায় আসন্ন অস্তিত্বের বিপন্নতা--- সবই বিষয় পুঁজিবাদের মারন-অবদান ।

২০২০ মে-দিবসের প্রাসঙ্গিকতা -
তাই, এবারের মে দিবস-এ
সংযোজিত পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন লড়াইতে নতুন এই অভিজ্ঞতা ও উপাদান ।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন