আদিত্য নারায়ণ হাজরা
১।
ভোর সাড়ে ছটা, ১১ শে সেপ্টেম্বর ১৯৭৩, উনি জানতে পারলেন সামরিক অভ্যুত্থানের কথা। সামরিক পোশাকে সজ্জিত তিনি প্রবেশ করলেন লা-মোনেডায়। ভোর সাড়ে সাতটার মধ্যে পাঁচ থেকে ছয়টি ফোন কল করেই তিনি বুঝতে পেরে গেছেন বিশ্বাসঘাতকতার গভীরতা। অগাস্টো পিনোশে - যাঁকে তিনি নিজে নির্বাচিত করেছিলেন সেনাপ্রধানের পদে, তাঁর নেতৃত্বে সমস্ত সামরিক শক্তি একত্রিত হয়ে তাঁকে নির্দেশ পাঠালো পদত্যাগ করে নিরাপদে দেশ ছেড়ে পালানোর জন্য। আটটার মধ্যেই তিনি উত্তর পাঠিয়ে দিলেন – পালানোর প্রশ্নই ওঠে না। শেষবারের মতো তিনি সম্বোধিত করলেন দেশের মানুষকে - নাতিদীর্ঘ ভাষণের শেষ অংশটুকু ছিল "Long Live Chile, Long Live the People, Long Live the Workers."
হাতে একটা AK-47 নিয়ে তিনি ঢুকে গেলেন ‘ইন্ডিপেন্ডেন্স রুমে’। স্থানীয় সময় তখন সাড়ে এগারোটা, ততক্ষণে সান্টিয়াগোর শহর, রেল, রাজপথের দখল নিতে নিতে সামরিক বাহিনী পৌঁছে গেছে লা-মোনেডার সদর দরজায়। কয়েকটি বুলেট…ইতিহাস রচনা হয়ে গেল।
লাতিন আমেরিকার দেশ চিলের প্রথম সমাজতান্ত্রিক প্রেসিডেন্ট সালভাডোর আলেন্দে পেছনে রেখে গেলেন পৃথিবীর ইতিহাসের বিজ্ঞানাগারে সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার এক অভূতপূর্ব অধ্যায় – যা নিয়ে বিশ্লেষণ, আলোচনা এবং সর্বোপরি শিক্ষাগ্রহণের অবকাশ থেকে গেল ভবিষ্যতের কমিউনিস্ট ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মী ও শিক্ষার্থীদের কাছে।

২।
১৯৭১ এর নভেম্বরের ২৩ দিনের চিলে সফরে ফিদেল কাস্ত্রো যখন আলেন্দেকে উপহার দিচ্ছেন AK-47 টি, তিনি বলছেন To my good friend Salvador, from Fidel, who by different means tries to achieve the same goal.
মানুষের শোষণমুক্তির প্রশ্নে, সমাজতান্ত্রিক সমাধানের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য যে রাস্তা আলেন্দে নির্বাচন করেছিলেন তা বুলেট নয়, ব্যালট এর মধ্যে দিয়ে গিয়েছিল। গণতান্ত্রিক ভাবে শান্তির রাস্তায় সমাজতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার প্রথম উদাহরণ তৈরি করেছিলন আলেন্দে - ১৯৭০ সালের ৪ই সেপ্টেম্বর যখন ৩৬.৬% ভোট পেয়ে তিনি চিলের প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হলেন, তিনিই হলেন সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথম মার্কসিস্ট প্রেসিডেন্ট, যিনি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেন। এর আগে দু'বার নির্বাচনে পরাজয়ের পরেও তিনি বিশ্বাস রেখেছিলেন সমাজতান্ত্রিক সমাধানের অনিবার্যতায় ও ধৈর্যশীল হয়ে অপেক্ষা করেছিলেন মানুষকে সঙ্গে নিয়ে সঠিক সময়ের জন্য। কিন্তু কিভাবে শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যেই নিহিত থেকে গেল এই সরকারের তিন বছরের মধ্যে সামরিক অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে পতনের বীজমন্ত্র, তা বিস্তারে বিশ্লেষণ করার অবকাশ থাকলেও একটি বাক্যেই সেটি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন ফিদেল – যখন তিনি আলেন্দেকে এই সতর্কবাণীতে সুস্পষ্ট ভাবে বোঝাচ্ছেন ভবিষ্যতের দিকনির্দেশ - The imperialists will never forgive you for taking back what was stolen - unless you are prepared to defend it with force.
৩।
এই লুন্ঠিত ধনসম্পত্তি পুনরুদ্ধার করে দেশের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার যে কাজ প্রেসিডেন্ট আলেন্দে করতে যত্নশীল হলেন, তার প্রেক্ষিত বুঝতে গেলে বুঝতে হবে সেই সময়ের চিলের সামাজিক চিত্র। রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষমতার ৯৫% এরও বেশি কুক্ষিগত ছিলো ভূস্বামী, শিল্পপতি বুর্জোয়া, এবং সরাসরি আমেরিকার অর্থপুষ্ট কর্পোরেশন গুলোর হাতে। চাষযোগ্য জমির ৮০ শতাংশের মালিকানা ছিল উপর্যুক্ত শ্রেণীর হাতে। কপার, ইস্পাত সহ সমস্ত ভারী ও মাঝারি শিল্পের মালিকানা থেকে শুরু করে, সেনেট ক্যাবিনেট সহ সংবিধানিক ও প্রশাসনিক সমস্ত পদাসীন থাকার অধিকার থেকে শুরু করে, সর্বক্ষেত্রেই মুষ্টিমেয় কয়েকটি উচ্চবিত্ত পরিবারের কাছেই কুক্ষিগত ছিল ক্ষমতা, পুঁজি, দেশ চালানোর ভার, ও ধর্মের জাদুদন্ড। এবং তাঁদের হাতেই ছিলো আনাকোন্ডা, ফোর্ড, নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলো চিলের মাটিতে লাভজনক ভাবে চালানোর ভারও।
১৯৩৩ সালের এপ্রিলে চিলের সোশ্যালিস্ট পার্টি গঠন হওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই তার নেতৃত্বের একদম সামনের সারিতে চলে আসেন বছর ২৬ এর তরুণ আলেন্দে। ১৯৭০ এর নির্বাচনে চিলের সোসালিস্ট পার্টি, চিলের কমিউনিস্ট পার্টি, চিলের র্যাডিকেল পার্টি এবং আরো কয়েকটি পার্টির সঙ্ঘবদ্ধতায় তৈরি হয় Unidad Popular (Popular Unity) এবং সেই কোয়ালিশন আলেন্দেকে সামনে রেখে নির্বাচনে জয়লাভ করে। ১৯৭১ এর পার্লামেন্টে এই পপুলার ইউনিটির পাশাপাশি ছিল ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্র্যাট, যারা ছিল প্রায় দক্ষিণপন্থায় লীন হয়ে যাওয়া মধ্যপন্থী, আর ছিল ন্যাশনাল পার্টি অর্থাৎ চরম দক্ষিণপন্থীরা। ১৯৭১ এর নির্বাচনের আগেই আলেন্দের প্রতিশ্রুতি ছিল কপার সহ ভারী শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ - নির্বাচনে জয়লাভের অব্যবহিত পরেই তিনি এই কাজে হাত দেন। সেই সময় পৃথিবীর বৃহত্তম কপার উৎপাদনকারী দেশ হিসেবে চিলের জায়গা বিশ্ব মানচিত্রে মজবুত (প্রায় ২১ থেকে ২৫ শতাংশ)। একদিকে ভিয়েতনামের যুদ্ধে আমেরিকার বিপুল সমরসজ্জার ভার, অন্যদিকে দীর্ঘ শীতল-যুদ্ধের মধ্যভাগ - সব মিলিয়ে বিভিন্ন সামরিক অস্ত্র, রাডার, যুদ্ধবিমান, ট্যাঙ্ক, উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর কমিউনিকেশন ব্যবস্থা, রণতরী - সর্বক্ষেত্রেই কপার অন্যতম প্রধান উপাদান। সেই কপারের ধাত্রীভূমি চিলে। চিলের মোট কপার উৎপাদনের ৮0% আসতো চুকিকামাতা, এল সালভাডোর, এল-টেনিকেন্টের মতো খনিগুলো থেকে, যেগুলো মূলত তিনটি বহুজাতিক সংস্থার মালিকাধীন ছিল - অ্যানাকোন্ডা কিনেকট ও শেরো কর্পোরেশন। এবং এই সবকটিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পুঁজি ও ক্ষমতার সরাসরি যোগ ছিল। সেই মৌচাকে ঢিল মারতে চললেন আলেন্দে - ঘোষণা করলেন এটা চিলের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম। এই সংস্থাগুলোর উপর ঘনিয়ে এলো আলেন্দের মুষলাঘাত। রাষ্ট্রায়ত্তকরণের পাশাপাশি হিসেব কষে আলেন্দে প্রমাণ করে দিলেন কিভাবে বিগত ১৫ বছর ধরে এই সংস্থাগুলি বিনিয়োগের থেকে সঙ্গতিহীনভাবে অতিরিক্ত মুনাফা করে গেছে এবং চিলের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত থেকে গেছে চিলের সাধারণ মানুষ। ২০০ মিলিয়ন ইউএস ডলারের বিনিয়োগ থেকে বিগত ১৫ বছরে ইতিমধ্যেই এক বিলিয়ন ইউএস ডলারের অধিক মুনাফা করেছে উক্ত সংস্থাগুলি - ভোগ করেছে করছুটের মতো বিবিধ সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা। অতিরিক্ত মুনাফার ভাগ ক্ষতিপূরণের অংকের থেকে অনেক বেশি; অতএব রাষ্ট্রায়ত্তকরণের জন্য এই সংস্থাগুলি কোন ক্ষতিপূরণের দাবি করতে পারে না। আলেন্দের ভাষায় ‘We are not expropriating. We are recovering what has always belonged to Chile।’ রাষ্ট্রপুঞ্জের সভায় গিয়ে আলেন্দে ঘোষণা করে এলেন ‘We are faced with a new kind of war: the economic aggression of imperialist. We have only taken back what belonged to us.’ এই রাষ্ট্রায়ত্তকরনের ফলে এক ধাক্কায় চিলের রাষ্ট্র ক্ষমতায় চলে এলো কপার উৎপাদনের প্রায় ৯৫%।
৪।
নিক্সন তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। সিআইএ ইতিমধ্যেই মধ্যে সক্রিয় ছিল চিলেতে- এবার নখ দাঁত বের করে সিআইএকে সামনে রেখে শুরু হল আলেন্দের বিরুদ্ধে বহু মাত্রিক যুদ্ধ প্রস্তুতি। একদিকে মিডিয়াকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আলেন্দের বিরুদ্ধে জনমত গঠন (এল-মার্কিরিও), আভ্যন্তরীণ বুর্জোয়া শ্রেণীকে আয়ন্দের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করা, লক-আউট, অবরোধের মাধ্যমে উৎপাদন শৃংখলে গভীর বিচ্যুতি ঘটানো, দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোকে কোটি কোটি ডলারের বিনিময়ে আবার সক্রিয় করে তোলা - কিছুই বাদ গেল না। এবং সর্বোপরি নিক্সন চিলেতে রাষ্ট্রদূত করে পাঠালেন ন্যাথানিয়াল ডেভিসকে যার প্রধান এজেন্ডাই ছিল আলেন্দের পতন সুনিশ্চিত করা।
এই বিরোধিতার কাঁটা মাথায় নিয়েই আলেন্দে দ্বিতীয়ত দুঃসাহসিক পদক্ষেপটি নিলেন - ভূমিবন্টন। ৬০% চাষযোগ্য জমির মালিকানা পুনরুদ্ধার করা হলো সামন্ততান্ত্রিক, বুর্জোয়া, অভিজাত উচ্চবিত্ত শ্রেণীর থেকে এবং সেই ৬০ লক্ষ হেক্টর জমি সুষমভাবে বন্টিত হল প্রায় দেড় লক্ষ গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে। তৈরি হল কৃষক সভা, হলো ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। অন্যদিকে দ্রুত শ্রমিকরাও জোট বাঁধছিলেন - শ্রমিক কৃষক ঐক্যের বুনন দৃঢ় হতে শুরু করেছে তখন চিলের বাস্তুতন্ত্রে। পাশাপাশি আলেন্দের হাত ধরে চলতে থাকলো আরো জনকল্যাণকারী কর্মকান্ডগুলো - বিনামূল্যে জনস্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থা (আয়ন্দের সময়কালে স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ ৫০ শতাংশ বাড়ে), বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার, বয়স্ক শিক্ষার প্রসার, শিশুদের প্রতিদিন আধলিটার দুধের ব্যবস্থা, মৌলিক চাহিদার সামগ্রীর দামের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ, রেশন ব্যবস্থার সংস্কার, বস্তি উন্নয়ন ও নিম্নবিত্তদের জন্য প্রায় এক লক্ষ বাসস্থান নির্মাণ ইত্যাদি। তাছাড়া ব্যাংক ও বীমা ক্ষেত্রে তিনি নিয়ে এলেন রাষ্ট্রায়ত্তকরণ। এই প্রয়াসগুলি যে শুধু খাতায়-কলমে থেকে গিয়েছিল তাই নয়, বছর দেড়েকের মধ্যেই লক্ষ্য করা যাচ্ছিল শিশু মৃত্যুর হার কুড়ি থেকে ত্রিশ শতাংশ কমে যাওয়া, স্কুল পড়ুয়ার সংখ্যা ২৫ শতাংশ থেকে ৩০ শতাংশ বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি; অর্থাৎ সবমিলিয়ে জনহিতকারী রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি ধারণা থেকে বাস্তবে রূপায়িত হতে শুরু করেছিল।
৫। এক কথায় ইতিহাস এই ঘটনাকে মনে রাখবে শান্তির রাস্তায় সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হিসাবে। কিন্তু সেই শান্তি কিভাবে চিরস্থায়ী হতে পারে, যখন শ্রেণী বৈষম্য থেকে মুক্তি ঘটে নি? অর্থাৎ সমাজের যে কৃষক নিম্নবিত্ত শ্রমিকদের উন্নয়নের জন্য এতসব প্রয়াস তার বিপ্রতীপে তখনও আছে রাষ্ট্রযন্ত্রের মধ্যে অভিজাত, পুঁজিপতি, বুর্জোয়া, উচ্চবিত্তদের প্রবল প্রতাপ ও নিয়ন্ত্রণ। এবং এই জনহিতকর সবকটি প্রকল্পে তাদের লাভের ঘর ছিল শূণ্য, বরং ক্ষতির খাতা ভরে উঠছিল রোজ। আলেন্দের প্রথম বছরটা এই শ্রেণী অনেকটা ধৈর্যশীল হয়ে অপেক্ষা করছিল - তাদের প্রত্যাশা ছিল দু-একটা ছোটখাটো শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ হলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ আলেন্দের মাধ্যমে তাদের হাতেই থাকবে। কিন্তু কিছু সময়ের মধ্যে পরিষ্কার হয়ে যায় আলেন্দে ওই শ্রেণীর ক্রীড়নক হতে আসেননি; এবং তখনই শুরু হয় সর্বাত্মক বিরোধিতা। পার্লামেন্টের ভেতরে তীব্র প্রতিবাদের মুখে পড়তে হয় আলেন্দেকে। এক্ষেত্রে মনে রাখা প্রয়োজন যে রাষ্ট্রপতি হওয়া সত্ত্বেও পার্লামেন্টে আলেন্দের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। রাষ্ট্রায়ত্তকরণের রাস্তায় পদে পদে বাধা সৃষ্টি করতে থাকলো আদালত ও নিয়ামক সংস্থাগুলি, এমনকি ১৯৭৩এর এর আগস্টে দা চেম্বার অফ ডেপুটিস আলেন্দেকে ‘প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সংবিধান বিরোধিতায়’ অভিযুক্ত করল। শেষ অবধি এই সমস্ত বিরোধী শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ধ্বংস করে আলেন্দের শাসনকাল।
৬।
এখান থেকে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির মেধাবী ছাত্রদের একরাশ আলোচনার ও বিশ্লেষণের বিষয় বেরিয়ে আসে। দেখা যাচ্ছে আলেন্দের পূর্ববর্তী সময় লাতিন আমেরিকায় সমাজতান্ত্রিক বা কমিউনিস্ট শাসন প্রতিষ্ঠার সফল উদাহরণ যা রচিত হয়েছিল সেটি ফিদেল ও চে গুয়েভারার হাত ধরে কিউবাতে - কিন্তু সেটি সশস্ত্র বিপ্লব ছিল - ছিল বুর্জোয়া অভিজাত গোষ্ঠীর হাত থেকে রাষ্ট্রক্ষমতা কে ছিনিয়ে নিয়ে সামগ্রিকভাবে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রবর্তন। কিন্তু আলেন্দে যে পথ বেছে নিলেন তাতে ওই উচ্চবিত্ত শ্রেণীর হাতে রাষ্ট্রের শাসন ক্ষমতার একটা বৃহৎ অংশ থেকে গিয়েছিল। শ্রেণী বিলুপ্তি না ঘটিয়ে সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা যে বাস্তবসম্মত নয় তার করুণ সাক্ষী হয়ে ইতিহাসের কাঠগোড়ায় থেকে গেলেন চিলির মানুষ ও আলেন্দের সময়কাল।
আলেন্দের সময়কাল সম্বন্ধে ফিদেল কাস্ত্রোর মূল্যায়ন মার্কসীয় বিশ্লেষণের চিরায়ত আকর হয়ে থাকবে। ফিদেল বলছেন - আলেন্দে উপভোক্তাদের ক্ষেত্রে সুষম বন্টনব্যবস্থা যতটা নজর দিয়েছেন, উৎপাদন শৃঙ্খলাকে সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রায়ত্তকরনের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অতটা মনোযোগী হতে পারেন নি - বরং কিছুটা দ্বিধাগ্রস্তই ছিলেন। পুঁজিবাদী শক্তিকে রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে থাকতে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রবর্তনের যে কথা আলেন্দে ভেবেছিলেন সেটিও স্বাভাবিক নিয়মে বাস্তবসম্মত ছিল না। আলেন্দের সমসাময়িক সংবিধান যা ইতিমধ্যেই শ্রেণীবৈষম্যের অভিঘাতে চূড়ান্ত পক্ষপাত দুষ্ট ছিল, তাকে শিকড় থেকে উপরে না ফেলে ধীরগতিতে সংশোধন করার চিন্তাও হয়তো একদমই বাস্তবসম্মত ছিল না। এক কথায় সেই জনপ্রিয় প্রবাদে ফেরত যেতে হয় They used the law of Republic to kill the Republic.
চিলের প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের প্রয়াসের কিন্তু যে স্বপ্নের বীজ আলেন্দেরদের মাধ্যমে প্রোথিত হয়ে গেল চিলে সমেত লাতিন আমেরিকা ও সারা পৃথিবীর শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণী সচেতনতায়, তা আজও থেকে গেছে মৃত্যুঞ্জয়। নোবেল জয়ী কবি ও মার্কসীয় চিন্তক পাবলো নেরুদা ব্যথিত হৃদয়ে Elegia কবিতায় লিখলেন 'The blood of the people waters the field, where the traitors planted their flag.'
সামরিক অভ্যুত্থানের পরবর্তী ক্রূরতম শোষণকালের মধ্যেও চিলের খনিতে শ্রমিক, জমিতে কৃষক আর স্কুল কলেজে পড়ুয়াদের মুষ্টিবদ্ধ হাতের পাঞ্জা প্রতিস্পর্ধায় শক্ত হয়ে থাকলো। শাসকের নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে চিলের দেওয়ালে দেওয়ালে রাতের অন্ধকারে ফুটে উঠতো গ্রাফিটি - কোন সময়ে চারকোলে আঁকা কাস্তে হাতুড়ি, কখনো UP লেখায়, কখনো মুষ্টিবদ্ধ হাতের প্রতীকে, বা কখনো আলেন্দের কালো চশমার ছবিতে... আর সবার ওপরে বুক ভরা সংগ্রামের স্পর্ধা নিয়ে মানুষ লিখে রাখত, এবং যা আজও চিলের রাজপথে লেখা আছে, ALLENDE VIVE - আলেন্দে আছেন।