Chittaprasad Bhattacharya

চিত্তপ্রসাদঃ একজন সেতুশ্রমিক

তৌসিফ হক

‘এই-সব মূঢ় ম্লান মূক মুখে

দিতে হবে ভাষা’

চিত্তপ্রসাদ ভট্টাচার্য (১৯১৫–১৯৭৮) একাধারে সমাজসচেতন চিত্রশিল্পী, লেখক এবং রাজনৈতিক কর্মী। বিশ শতকের ভারতীয় শিল্প আন্দোলনে তিনি এক আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছিলেন তাঁর সরল অথচ তীক্ষ্ণ শিল্পভাষা ও সুগভীর রাজনৈতিক বোধের জন্য। চিত্তপ্রসাদের শিল্প কখনো নিছক সৌন্দর্যচর্চার জন্য ছিল না— তা ছিল সময়ের শোষণ, বঞ্চনা এবং লাঞ্ছনার এক দৃশ্যমান প্রতিবাদ। চিত্তপ্রসাদই সেই ব্যক্তি যিনি শিল্পচিন্তা ও রাজনৈতিক বোধের মধ্যে যে গভীর সংহতি রয়েছে,সেই সেতুটিকে দ্বিধাহীন তৎপরতায় বাঁধতে পেরেছিলেন।

এ হেন চিত্তপ্রসাদের শিল্পজীবনের সূচনা এমন এক সময়ে, যখন ভারত ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে উত্তাল। ভারতীয় সমাজে তখন শ্রেণীবৈষম্য, জাতপাত, ক্ষুধা ও দুর্ভিক্ষ চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। এই বাস্তবতাই চিত্তপ্রসাদের শিল্পচেতনার জন্ম দেয়। তাঁর আঁকা মুখগুলো ছিল সবার পরিচিত মুখ—রিকশাওয়ালা, দিনমজুর, অনাহারী শিশু, উদ্বাস্তু মা। শুধু এদেশে তখনও এই ভাবনাটি কারো ছিল না যে এইসব মুখগুলিকে ক্যানভাসে পাশাপাশি একসাথে আনতে হবে, সংগঠিত করতে হবে, অন্তজর কথা বলতে হবে।

একাডেমিক আর্ট স্কুলের শিক্ষার্থী না হয়েও চিত্ত নিজস্ব শিল্পভাষাটি তৈরি করতে পেরেছিলেন।ইউরোপীয় উডকাট বা লিনোকাট শৈলীকে তিনি ব্যবহার করেন বটে কিন্তু তাতে ভারতীয় বাস্তবতা ও রাজনীতি ঢুকিয়ে দেন। বলা যায় উডকাটের প্রলোভনে দর্শককে টেনে এনে তাঁর রাজনৈতিক বার্তাটি বলে দেবেন বলেই যেন প্রতিটি ছবি খোদাই করা।

চিত্তপ্রসাদের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের উপর ভিত্তি করে করা গ্রাফিক রিপোর্ট ‘Hungry Bengal’। এটি কেবল ট্রাভেলগ নয়, নেহাৎ শিল্পীখেয়ালের শিল্প নয়, বরং তার থেকেও অনেক বেশি একটি রাজনৈতিক দলিল। এ কাজ শুধু যে দুর্ভিক্ষের বিভীষিকা ফুটিয়ে তোলে তা-ই নয়, বরং তা ব্রিটিশ সরকারের ভূমিকা এবং ভূমিপতি শ্রেণির নিষ্ঠুরতা প্রকাশ্যে এনে দেয়।

এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর ব্রিটিশ সরকার বইটি বাজেয়াপ্ত করে, কিন্তু তার আগেই এটি মানুষের মধ্যে সাড়া ফেলে দেয়। অর্থাৎ রাজনৈতিকভাবে চিত্ত তাঁর কাজে সফল হন।

এই কাজটিই চিত্তপ্রসাদকে ভারতের প্রথম 'পলিটিক্যাল আর্টিস্ট'দের একজন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। যেটা তাঁর আজন্ম লালিত উদ্দেশ্য ছিল।

চিত্তপ্রসাদের রাজনৈতিক বোধ গভীরভাবে মার্কসবাদ দ্বারা প্রভাবিত ছিল তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শিল্পের মূলে শ্রেণীসংগ্রামের আদর্শে উদ্বুদ্ধ চিত্ত কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সমর্থক ছিলেন এবং শ্রমিক-কৃষক আন্দোলনের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ছিলেন।

তবে, তিনি কখনো দলীয় লাগামের ঘোড়া হয়ে ওঠেননি।তিনি ছিলেন স্বাধীন,মুক্ত পুরুষ।একমাত্র গরীব মানুষের কাছে তাঁর দায়বদ্ধতা ছিল। রাজনৈতিক আদর্শকে শিল্পের মাধ্যমে এমনভাবে রূপ দিয়েছিলেন,যা সহজে বোধগম্য, সহানুভূতিশীল এবং হৃদয়গ্রাহী। অর্থাৎ ভাবনা উদ্ভব হচ্ছে বৌদ্ধিক জগৎ থেকে, কিন্তু সেটি চুঁইয়ে নীচে নেমে শ্রমিকের ঝুপড়িতে ঢুকে যাচ্ছে।

চিত্তপ্রসাদের ভাবনা এমনই ছিল।

ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাতপাত, ধর্মীয় কুসংস্কার, এবং শ্রেণিবিভাজনের বিরুদ্ধে নিজের যাপনকে তিনি বেঁধেছিলেন। তাঁর শিল্পে বারবার ফিরে আসে ঐক্যের বার্তা,যেকোনোরকম শোষণের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার আহ্বান।

চিত্তপ্রসাদের কাছে শিল্প ও রাজনীতি ছিল একে অপরের পরিপূরক। তিনি বিশ্বাস করতেন শিল্প মানেই সমাজচিন্তা। সমাজকে অস্বীকার করে যে শিল্প রচিত হয়, সে পথকে তিনি যৌবনেই বিদায় দিয়েছেন।তাঁর চোখে শিল্পী কেবল একজন সৌন্দর্যস্রষ্টা নন, বরং একজন সময়ের দলিলকার, একজন সচেতন নাগরিক।

Hungry Bengal IV

চিত্তপ্রসাদের শিল্পে কল্পনার চেয়ে বাস্তবতাই বেশি, অলঙ্কারের চেয়ে সত্য। তিনি সরল রেখায় আঁকতেন, রঙের বাহুল্য এড়িয়ে চলতেন— কারণ তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বিষয়,রঙ নয়। রঙ দিয়ে আঁকতে বেশি সময় লাগবে, তার থেকে কম সময়ে আরো বেশি সাদাকালো ছবি এঁকে বেশি রাজনৈতিক বক্তব্য বলাকে তিনি বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। স্বভাবতই, তাঁর শিল্প হয়ে ওঠে এক প্রকার সমাজতাত্ত্বিক ভাষ্য।

তিনিই সেই বিরল শিল্পীদের একজন, যাঁর রেখায় ছিল ক্ষুধা, চোখে ছিল দ্রোহ। শিল্প কখনো কেবল ঘর সাজানোর উপাদান নয় বরং তা এক প্রকার প্রতিবাদ, একটা আন্দোলন, এ বোঝাপড়াকে তিনি এই মাটির শিরায় প্রবেশ করিয়ে দিয়ে গেছেন। রাজনৈতিক বোধ ও শিল্পের সংহতির যে নজির তিনি রেখে গেছেন, তা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক, আজও প্রেরণাদায়ী।

চিত্তপ্রসাদকে মনে রাখা মানে কেবল একজন চিত্রশিল্পীকে স্মরণ করা নয়, বরং এক চলমান রাজনৈতিক শিল্পবোধের উত্তরাধিকারকে সম্মান জানানো।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন