শমীক লাহিড়ী
জর্জি ডিমিট্রভ ১৯৩৫ সালের আগস্ট মাসে অনুষ্ঠিত কমিন্টার্ন বা কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সপ্তম কংগ্রেসের তৃতীয় প্লেনারী অধিবেশনে ফ্যাসিবাদের প্রকৃত চরিত্র, কার্যপদ্ধতি, উত্থানের কারণ এবং এর বিরুদ্ধে লড়াইয়ের পথ - সর্বপ্রথম ব্যাখ্যা করেছিলেন, ‘ফ্যাসিবাদের আক্রমণ এবং ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণির সংগ্রামে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের করণীয়’ শীর্ষক এক ঐতিহাসিক দলিল পেশ করে। এটি রচনায় জার্মানীর কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেত্রী ক্লারা জেটকিনও গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছিলেন।
ফ্যাসিবাদ কি
ডিমিট্রভের কথায়, ‘ফ্যাসিবাদ হলো লগ্নি পুঁজির সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল, সবচেয়ে উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং সবচেয়ে আগ্রাসী অংশের উন্মত্ত একনায়কত্ব।’
তিনি ব্যাখ্যা করেন যে, ফ্যাসিবাদ কেবলমাত্র একক ব্যক্তি বা দলের শাসন নয়, বরং এটি মূলত বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য একটি দমনমূলক শাসনব্যবস্থা। ফ্যাসিবাদ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করে, শ্রমিক শ্রেণির সংগঠন ধ্বংস করে এবং যুদ্ধ ও আগ্রাসনই এদের হাতিয়ার। ফ্যাসিবাদ আসলে লগ্নি পুঁজির ক্ষমতা। এটি শ্রমিক শ্রেণি এবং বিপ্লবী কৃষক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী প্রতিহিংসার সংগঠন। পররাষ্ট্রনীতিতে, ফ্যাসিবাদ হলো উগ্র যুদ্ধোন্মাদ জাতীয়তাবাদ, যা অন্যান্য জাতির প্রতি পাশবিক ঘৃণা উসকে দেয়। ফ্যাসিবাদের বিকাশ এবং ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র বিভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন রূপে থাকে, যা ঐতিহাসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, জাতীয় বৈশিষ্ট্য এবং সংশ্লিষ্ট দেশের আন্তর্জাতিক অবস্থানের ওপর নির্ভর করে।
ফ্যাসিবাদের চরিত্র
জোসেফ স্তালিন এর আগে ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের কংগ্রেসে ফ্যাসিবাদের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে এর মূল কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করেছিলেন। ফ্যাসিবাদ কেবলমাত্র একজন নেতা বা রাজনৈতিক দলের শাসন নয়, এটি মূলত বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ব্যবহৃত হয়। ফ্যাসিবাদী শাসন শ্রমিকদের অধিকার কেড়ে নেয়, ট্রেড ইউনিয়ন নিষিদ্ধ করে এবং বিপ্লবী আন্দোলন দমন করে। ফ্যাসিবাদ জাতীয়তাবাদকে চরম উগ্র পর্যায়ে নিয়ে যায় এবং সামরিক আগ্রাসনকে উসকে দেয়। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস করে এবং বিরোধী মতকে নির্মূল করে। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিক শ্রেণি ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
ডিমিট্রভ এবং স্তালিনের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ব্যাখ্যার সাথে আরও কয়েকটি বিষয় প্রখ্যাত মার্কসবাদী চিন্তাবিদ এবং ইতিহাসবিদ এরিক হবসবম উল্লেখ করেন। গণতন্ত্র যখন অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়, তখন মানুষ ফ্যাসিবাদী শাসকদের দিকে ঝুঁকে পড়ে। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি ফ্যাসিবাদ, শ্রমিক শ্রেণির বিপ্লবী আন্দোলনকে দমন করতে উদ্যত হয়। রুশ বিপ্লবের পর ইউরোপজুড়ে সমাজতান্ত্রিক ভাবনা প্রসারিত হচ্ছিল, যা পুঁজিপতিদের আতঙ্কিত করেছিল। ফলে, তারা ফ্যাসিবাদকে ব্যবহার করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ঠেকানোর চেষ্টা করে। ফ্যাসিবাদ শুধু সামরিক দমননীতির মাধ্যমেই টিকে ছিল না, জনগণের সমর্থনও পেয়েছিল, বিশেষত করে মধ্যবিত্ত শ্রেণির, যারা অর্থনৈতিক সংকটে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হলে কেবলমাত্র সামরিক যুদ্ধই যথেষ্ট নয়, এটি একটি আদর্শগত ও সামাজিক লড়াইও বটে। সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন, শ্রমিক সংগঠন এবং গণতান্ত্রিক শক্তির সম্মিলিত প্রতিরোধই একমাত্র ফ্যাসিবাদকে প্রতিহত করতে পারে। ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নয়, বরং এটি পুঁজিবাদী সমাজের গভীর সংকটের প্রতিফলন। ফ্যাসিবাদ হলো ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদের উগ্র একটা রূপ, যা কেবলমাত্র দমন-পীড়নের মাধ্যমে টিকে থাকে এবং গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনকে দমন করার চেষ্টা করে।
ফ্যাসিবাদের উৎপত্তি
জিওভানি জেন্টিল ফ্যাসিবাদী দর্শনের অন্যতম ব্যাখ্যাকার। বেনেটো মুসোলিনি নিজেই ‘ফ্যাসিবাদের দার্শনিক’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন জেন্টিলকে। তিনিই মুসোলিনির নামে প্রকাশিত ও প্রচারিত ‘দ্য ডকট্রিন অফ ফ্যাসিজম’ (১৯৩২) প্রবন্ধের প্রথম অংশের ছদ্ম লেখক ছিলেন। ফ্যাসিস্ট শব্দটি এসেছে ইতালীয় শব্দ ‘Fascio’ থেকে, যার অর্থ ‘গুচ্ছ’ বা ‘সংঘ’। ১৯১৯ সালে বেনিতো মুসোলিনি ‘Fasci di Combattimento’ নামে একটি রাজনৈতিক গোষ্ঠী প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে ‘জাতীয় ফ্যাসিস্ট পার্টি’ (PNF) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ‘ফ্যাসিস্ট’ শব্দটি প্রথম রাজনৈতিকভাবে ব্যবহৃত হয় ১৯১৯ সালে মুসোলিনির নেতৃত্বে ইতালিতে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে, যখন ইতালিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক সংকট প্রবল ছিল, সেই সময়ে মুসোলিনি ফ্যাসিবাদী আদর্শের প্রচার শুরু করেন। ১৯২২ সালে মুসোলিনি ইতালিতে প্রথম ফ্যাসিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরবর্তী সময়ে হিটলারের নাৎসি জার্মানি এবং অন্যান্য একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা তৈরিতে অনুপ্রাণিত করে।
ফ্যাসিস্টদের অন্তিম পরিণতি
অ্যাডলফ হিটলার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি জার্মানির পরাজয়ের সময় আত্মহত্যা করেন। ১৯৪৫ সালের ২ মে, সোভিয়েত লাল ফৌজ মার্শাল জর্জি কনস্টান্টিনোভিচ ঝুকভের নেতৃত্বে বার্লিনে প্রবেশ করে। তার আগেই আসন্ন পরাজয়ের গ্লানিতে ৩০ এপ্রিল ১৯৪৫, হিটলার তার বান্ধবী (পরে স্ত্রী) ইভা ব্রাউনকে নিয়ে সেনাছাউনির বাংকারেই মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন, আর ইভা ব্রাউন সায়ানাইড বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
বেনিতো মুসোলিনির মৃত্যু হয় জনগণের হাতে ১৯৪৫ সালেই। যুদ্ধে ইতালির পরাজয়ের পরেই মুসোলিনি পালানোর চেষ্টা করেন। ২৭ এপ্রিল ১৯৪৫, তিনি ও তার বান্ধবী ক্লারা পেতাচ্চি ধরা পড়েন। ২৮ এপ্রিল তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়। তার মৃতদেহ মিলানের পিয়াজ্জেল লরেটো স্কোয়ারে ঝুলিয়ে দেয় ক্ষিপ্ত সাধারণ মানুষ। এই হয়েছিল সেসয়ের ফ্যাসিস্টদের পরিণতি।
পরিস্থিতির পরিবর্তন
এরপর পৃথিবী সুর্যের চারিদিকে ৮০ বার পূর্ণ প্রদক্ষিণ করেছে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ড, সৌরজগত, পৃথিবী, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, সাহিত্য, ভাষা, সমাজ, অর্থনীতি কোনকিছুই এক জায়গায় দাঁড়িয়ে নেই। একইভাবে পুঁজিবাদ, লগ্নি পুঁজি, লুটেরা পুঁজি, শোষণের কায়দা-কানুন-কৌশল স্থানু হয়ে নেই বিগত ৮০ বছর ধরে। পরিবর্তিত পৃথিবীতে ফ্যাসিবাদও ১৯২০-৩০ এর মতো একই কায়দাকানুন, ধরনধারণ নিয়ে একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে আসেনি স্বাভাবিক ভাবেই। লগ্নিপুঁজির চরিত্রের মধ্যেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন ঘটে গেছে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে লগ্নিপুঁজি সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছিল। তার ভিত্তি ছিল মূলত দেশ বা জাতি ভিত্তিক। বর্তমান সময়ের লগ্নিপুঁজি অনেক বেশি আন্তর্জাতিক চরিত্রের। সেই সময়ের লগ্নি পুঁজির গতি ছিল অত্যন্ত ধীর এবং এক অথবা সামান্য কয়েকটি দেশের অভ্যন্তরেই সে বিচরণ করত। কিন্তু আজ সামান্য সময়ের মধ্যেই বেশি মুনাফার সুযোগ পেলে লগ্নি পুঁজিকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে তুলে নিয়ে বিনিয়োগ করা সম্ভব। অর্থাৎ আজকের সময়ে লগ্নি পুঁজি আন্তর্জাতিক এবং তীব্র গতি সম্পন্ন বিশেষত আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে।
বর্তমানে লগ্নি পুঁজি খুবই ভঙ্গুর (Fragile) হয়ে পড়েছে, যার ফলে বর্তমান তীব্র অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে। নয়া উদারবাদী অর্থনীতির যুগে রাষ্ট্রগুলো ঝুঁকির পরিমাণ কমিয়ে দেখানোর মাধ্যমে পুঁজিপতিদের জন্য অর্থ সংগ্রহ (পড়ুন শেয়ার বাজারের মাধ্যমে) সহজ করে দিয়েছে। লগ্নি পুঁজি এখন লুটেরা পুঁজিতে পরিণত হয়েছে। চলছে অবাধ লুট, ঘটেছে সম্পদের কেন্দ্রীভবন। নয়া উদারবাদী অর্থনীতি শ্রমজীবীদের মজুরির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা চাপিয়ে দেওয়ায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে পণ্যের সামগ্রিক চাহিদা ক্রমহ্রাসমান। এর ফলে আর্থিক ব্যবস্থা ভঙ্গুর হয়ে পড়েছে, যে কারণে বিভিন্ন দেশে অর্থনীতির রকেটগতির উত্থানগুলো বুদবুদের মতো ক্ষণস্থায়ী হয় এবং অর্থনৈতিক পতনগুলো হচ্ছে বিধ্বংসী। এছাড়াও নয়া উদারবাদী অর্থনীতি একটি অসম বিশ্ব ব্যবস্থা তৈরি করেছে।
ফ্যাসিবাদ ও নয়া-ফ্যাসিবাদের মধ্যে পার্থক্য
ফ্যাসিবাদ ও নয়া-ফ্যাসিবাদ (Neo-Fascism) একই মূল আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠলেও এদের মধ্যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। ফ্যাসিবাদ ছিল ২০ শতকের প্রথমার্ধের একটি রাজনৈতিক প্রবণতা। অন্যদিকে, নয়া ফ্যাসিবাদ হলো আধুনিক সমাজে ফ্যাসিবাদী মতাদর্শেরই বিবর্তিত রূপ, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর লগ্নিপুঁজি ক্রমশ আন্তর্জাতিক চেহারা নেওয়ার ফলে নতুন রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। লগ্নিপুঁজি আন্তর্জাতিক চেহারা পাওয়ায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আন্তসাম্রাজ্যবাদী দ্বন্দ্বও আজ অনেক স্তিমিত, ১৯২০-৩০ এর সময়ের তুলনায়। যদিও ট্রাম্প আমেরিকার ৪৭ তম রাষ্ট্রপতি হিসাবে নির্বাচিত হয়ে আসার পর, পরিস্থিতি দ্রুত পাল্টাচ্ছে৷
হিটলার জার্মান সংসদ (Reichstag) কার্যত অকার্যকর করে দিয়েছিলেন। ১৯৩৩ সালের রাইখস্টাগ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার পর, হিটলার ‘Reichstag Fire Decree’ জারি করে নাগরিক স্বাধীনতাকে অবলুপ্ত করে এবং বিরোধী দলগুলোর ওপর নারকীয় দমনপীড়ন শুরু করে। এরপর, ১৯৩৩ সালের ২৩ মার্চ ‘Enabling Act’ পাস করিয়ে হিটলার ও নাৎসি পার্টিকে নির্বিচারে আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেওয়া হয়, ফলে সংসদের ভূমিকা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে যায়।
১৯২২ সালে ‘মার্চ অন রোম’-এর মাধ্যমে মুসোলিনি ইতালির প্রধানমন্ত্রী হন। এরপর, ধীরে ধীরে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্বল করে দেওয়া হয়। ১৯২৬ সালে সব বিরোধী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করা হয়। সংসদকে ফ্যাসিবাদী গ্র্যান্ড কাউন্সিলের অধীনস্থ করে ফেলা হয়। ১৯২৯ সালের পর সংসদ কেবল আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান হয়ে যায়, যেখানে শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদী পার্টির সদস্যরা থাকতে পারত। ফলে, মুসোলিনি সরাসরি সংসদ ভেঙে না দিলেও, সেটিকে অর্থহীন করে ফ্যাসিবাদী একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে।
হিটলারের সময়ে নাৎসি জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন শিল্পের সংখ্যা সীমিত থাকলেও সরকার অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করত। এই মডেলকে কেউ কেউ ‘রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত পুঁজিবাদ’ বলেছেন, যেখানে বেসরকারি মালিকানা বজায় থাকলেও রাষ্ট্রের প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। যে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বেসরকারি মালিকানায় ছিল, সরকার তাদের কাজকর্মে ব্যাপক হস্তক্ষেপ করত। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ, মূল্য নিয়ন্ত্রণ এবং শ্রমশক্তির ব্যবস্থাপনা ইত্যাদিতে রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণ ছিল। অর্থনীতিকে পুনঃসামরিকীকরণের লক্ষ্যে পরিচালিত করা হয়, যা যুদ্ধ প্রস্তুতির জন্য হিটলারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই কাজে রাষ্ট্রীয় নির্দেশনাতেই বেসরকারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম উৎপাদনে নিয়োজিত ছিল।
এখনকার লগ্নিপুঁজি তাদের কার্যকলাপে রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ মোটেই চায় না। তারা তৈরি করেছে নয়া উদারবাদী নীতির ভিত্তিতে সম্পূর্ণ ‘মুক্তবাজার অর্থনীতি’। শুধু দেশ ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ হস্তগত করা, ব্যবসায়ে বিপুল মুনাফা নিশ্চিত করার কাজে রাষ্ট্রশক্তিকে তারা ব্যবহার করছে এখন।
হিটলারের নাৎসি সরকার শ্রমিক সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে এবং তাদের পরিবর্তে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ‘শ্রম ফ্রন্ট’ (Deutsche Arbeitsfront) তৈরি করে শ্রমিকদের উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে। ট্রেড ইউনিয়গুলিকে বেআইনি করা হয়েছিল। মুসোলিনিও ক্ষমতায় এসে ইতালির শ্রমিকদের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার কার্যত বিলুপ্ত করে দেন। ১৯২৫ সালের ‘পালমেরো প্যাক্ট’ এর মাধ্যমে শুধুমাত্র ফ্যাসিবাদ নিয়ন্ত্রিত শ্রমিক সংগঠনগুলোকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং অন্যান্য স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯২৬ সালের ‘রোকো লেবার আইন’ তৈরি করে স্বাধীন ধর্মঘট এবং শ্রমিক আন্দোলন সম্পূর্ণ অবৈধ ঘোষণা করা হয়। মুসোলিনি ‘কর্পোরেটিজম’ নামে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা চালু করে মালিকপক্ষ ও সরকার-নিয়ন্ত্রিত শ্রম সংগঠন যৌথভাবে কাজ করার ব্যবস্থা করে। কিন্তু সাধারণ শ্রমিকরা নিজেদের স্বার্থরক্ষা করতে পারত না, কারণ স্বাধীন ইউনিয়ন নিষিদ্ধ ছিল। এগুলোই ছিল ফ্যাসিস্ট একনায়কতন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
উগ্র জাতীয়তাবাদ, একনায়কতন্ত্র, আগ্রাসী যুদ্ধ এই ছিল সেসময়ে ফ্যাসিবাদের মূল চেহারা। আজকের ফ্যাসিবাদীরাও উগ্র জাতীয়তাবাদকেই ব্যবহার করে। কিন্তু সরাসরি একনায়কতন্ত্র কায়েম না করে, গণতান্ত্রিক কাঠামো বজায় রেখে স্বৈরাচারী শাসনের প্রচেষ্টা চালায়। মুসোলিনি হিটলারের মতো সামরিক অভ্যুত্থান, হিংসাত্মক দমননীতি, একদলীয় শাসন প্রতিষ্ঠা না করে আজকের ফ্যাসিস্টরা গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে, সংবাদ মাধ্যম সহ আধুনিক প্রযুক্তির নানাবিধ প্রচার মাধ্যমকে ব্যবহার করে শাসন ক্ষমতায় আসে বা টিকে থাকে। এখন কিন্তু ট্রাম্প বা বোলসেনারোকে নির্বাচনে হেরে ক্ষমতাচ্যুত হতে হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি কোনক্রমে সরকার রক্ষা করতে পেরেছেন।১৯৩০ এর দশকে এটা ছিল অকল্পনীয়।
সেসময়ে ফ্যাসিবাদ মূলত রাষ্ট্রীয় প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করত। অথবা সরাসরি হুমকির প্রচার করত। নয়া ফ্যাসিবাদ সামাজিক গণমাধ্যম ও অন্যান্য গণমাধ্যমের মাধ্যমে বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার ছড়ানোর মাধ্যমে মানুষের মতামতকে নিয়ন্ত্রণ ও নির্মান করে। নয়া ফ্যাসিবাদ আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুয়া সংবাদ, ষড়যন্ত্রের ভুয়ো তত্ত্ব ছড়িয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করে। খোলাখুলি বর্ণবাদ ও ইহুদি বিরোধিতার (অ্যান্টি-সেমিটিজম) মতো রাস্তায় না হেঁটে, সূক্ষ্মভাবে জাতিগত ও অভিবাসীবিরোধী প্রচার, ইসলামোফোবিয়া তৈরি করে নয়া ফ্যাসিবাদ মানুষের মনকে বিষিয়ে তোলে, বিদ্বেষ বিভাজন তৈরি করে। ফ্যাসিবাদ সরাসরি জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বের কথা বলত। যেমন, নাৎসিরা জার্মানিতে আর্য জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রচার করেছিল।
ট্রাম্পের পুনরুত্থান, ইউরোপের উগ্র-দক্ষিণপন্থী দলগুলির ক্ষমতা দখল বা শক্তিবৃদ্ধি, আমাদের দেশে হিন্দুত্ববাদী উগ্রপন্থার বিস্তার ইত্যাদির মাধ্যমে আজ নতুন চেহারায় ফ্যাসিবাদীরা আত্মপ্রকাশ করছে। নয়া ফ্যাসিবাদ সূক্ষ্মভাবে অভিবাসন বিরোধী নীতি গ্রহণের মাধ্যমে বিদেশিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ায় এবং ‘সাংস্কৃতিক পরিচয়’ বা ধর্ম রক্ষার নামে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ নির্মান করে। ফ্যাসিবাদ ও নয়া-ফ্যাসিবাদ উভয়ই একনায়কতান্ত্রিক প্রবণতা নিয়ে চলে, তবে নয়া-ফ্যাসিবাদ আধুনিক যুগের গণতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে থেকে কাজ করে। এটি খোলাখুলি স্বৈরতন্ত্র চাপিয়ে দেয় না, বরং গণতন্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ধ্বংস না করে, সেগুলিকে পঙ্গু বা দুর্বল করে, নিজেদের নিয়ন্ত্রণে এনে একনায়কতান্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে।
মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প, ইতালির জর্জিয়া মেলোনি, ব্রাজিলের বোলসেনারো, আর্জেন্টিনার জাভিয়ের মিলেই অথবা আমাদের দেশের নরেন্দ্র মোদি কেউই এখনও পর্যন্ত সংসদ তুলে দেননি, বা বিরোধী দলগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে চূড়ান্ত একনায়কতন্ত্র স্থাপন করেন নি। এমনকি সরাসরি ট্রেড ইউনিয়নকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করেনি। তবে অতি দক্ষিণপন্থীরা যাবতীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে বজায় রাখলেও ভেতর থেকে দুর্বল করে এগুলোর ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে খুবই তৎপর। অর্থাৎ ফ্যাসিবাদের মৌলিক ধারনা নিয়েই আজকের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন চেহারায় গণতন্ত্রের মুখোশ পড়ে নতুন কৌশল অবলম্বন করে নয়া ফ্যাসিবাদীরা চলতে চাইছে।
ফলে আমাদের দেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম হয়ে গেছে, একথা ভাবা রাজনৈতিকভাবে চরম ভুল। দেশে ফ্যাসিস্ট মতাদর্শের ভিত্তিতে চলা আরএসএস নিয়ন্ত্রিত বিজেপি এখানে সাম্প্রদায়িকতাকে হাতিয়ার করেই সরকার চালাচ্ছে। ফ্যাসিবাদী রাস্তায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাচ্ছে। অনেক বিষয়ে সাফল্য পেলেও ফাসিবাদ কায়েম করতে সক্ষম হয়নি এখনও পর্যন্ত। কিন্তু এদের কার্যকলাপ ও নীতিগুলো ফ্যাসিবাদের নতুন চেহারায় উপস্থিতির লক্ষণ। তাই, একে প্রতিরোধের জন্য ঐতিহাসিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মতোই গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোর সম্মিলিত প্রতিরোধ প্রয়োজন।