এঙ্গেলসের অসম্পূর্ণ ক্ল্যাসিক : রোল অফ ফোর্স ইন হিস্ট্রি

সৌভিক ঘোষ

ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের এই রচনাটি সাধারণ অর্থে পাঠকদের জন্য বহুল পরিচিত না। মার্কসীয় বিশ্ববিক্ষার ভান্ডারে তাঁর রচনার কয়েকটি যেমন জগতজোড়া সুখ্যাতি পেয়েছে, রোল অফ ফোর্স ইন হিস্ট্রি তেমন কোনো লেখায় রূপান্তরিত হয়নি। এর কারন এঙ্গেলস লেখাটি শেষ করে যেতে পারেননি। আজও কাজ করার সময় মার্কসবাদীদের যে কথাটি বারে বারে মনে রাখতে হয় ঠিক সেকারনেই অমনটি ঘটেছিল। প্রবন্ধ, পুস্তিকা থেকে শুরু করে গোটা একটা বই লেখার জন্যই ফ্রেডরিক এঙ্গেলস ব্যস্ত থাকতেন না, সে সময়কার আন্তর্জাতিক সংগঠনের বহু কাজ তাকে দেখতে হত, করতে হত। প্রতিদিন বহু মানুষের লেখা চিঠির জবাব লিখতে হত, সাংগঠনিক দলিল ইত্যাদির খসড়া চুড়ান্ত করার কাজ সম্পন্ন করতে হত তাকেই। বিভিন্ন সভায় বক্তৃতা দেওয়া, অজস্র ছোট বড় মিটিং এমনকি যখন তখন বিদেশ থেকে এসে উপস্থিত হওয়া কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ের বন্দোবস্ত করে দেওয়া – এসবই ছিল তাঁর রোজকার দায়িত্ব।

নিছক অতিথি আগমনেও তাঁর দরজা ছিল সর্বদা উন্মুক্ত, ইংরেজি সভ্যতায় যাকে ‘হোস্ট’ বলে সে ভুমিকায় তিনি রীতিমত প্রসিদ্ধ ছিলেন। পার্টির রাজ্য ওয়েবসাইটে ধারাবাহিক হিসাবে আমরা যে মতাদর্শ সিরিজ প্রকাশ করছি তাতেও পাঠক একাধিক চিঠিপত্রের উল্লেখ পাবেন যখন নেহাত আনাড়ি লোকের ‘আপনাদের লেখাপত্র পড়তে চাইছি, ঠিক কোনটা দিয়ে শুরু করি বলতে পারেন’ গোছের আবদারেও তিনি যত্ন করে উত্তর দিয়েছেন।

এসবের মাঝেই তিনি পড়তে, লিখতে বসতেন। সেভাবেই তাঁর কলমে একের পর এক ক্ল্যাসিক লেখা হয়েছে।

তাহলে একটি লেখা শেষ না হওয়ার বিষয়ে আমরা বাড়তি গুরুত্ব দেব কেন?

এই লেখা এঙ্গেলস শেষ করেননি বলেই আমরা কার্ল মার্কসের ক্যাপিটাল’র দ্বিতীয় ও তৃতীয় খন্ড পড়তে পারি। মার্কসের মৃত্যুর পর তাঁর ঘরে লেখার টেবিল জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাগজের স্তুপ থেকে এঙ্গেলসই সেসব উদ্ধার করেছিলেন। মার্কসের দুষ্পাঠ্য হাতের লেখা পড়ে বুঝতে পারতেন দুজন– প্রথমজন অবশ্যই জেনি ভন ওয়েস্টফ্যালেন, মার্কসের স্ত্রী, দ্বিতীয়জন এঙ্গেলস। মার্কসের কন্যা জেনি লঙ্গুয়েট একসময় পিতার সচিব হিসাবে কাজ করেছেন, তিনিও কিছুটা জানতেন- সবটা না।

জেনি আগেই চলে গেলেন, তারপরে মার্কস।

এঙ্গেলস বুঝেছিলেন তাঁর নিজেরও বয়স বাড়ছে, ক্যাপিটালের দ্বিতীয় আর তৃতীয় খন্ডের সম্পাদনা দ্রুত শেষ না করলে সম্ভবত আর কখনো করা হবে না। তাই নিজের জরুরী লেখা ফেলে রেখেও তিনি মার্কসের লেখা বই প্রকাশের জন্যই ব্যস্ত হয়েছিলেন। ক্যাপিটালের তিন খণ্ডই প্রকাশিত হল, রোল অফ ফোর্স ইন হিস্ট্রি পড়ে রইল। এ শুধু প্রিয় বন্ধুর স্মৃতির উদ্দেশ্যে কর্তব্যের উপাখ্যান মাত্র নয়, এটাই কমরেডশিপ, কমিউনিস্ট নৈতিকতা।

তাই আমরা বলছি এ লেখা ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের আনফিনিশড- অসম্পূর্ণ ক্ল্যাসিক।

লেখা শেষ হলে যে বই আরেকটি ক্ল্যাসিক হিসাবে চিহ্নিত হত, হতই।

১৮৭৫ সালের এপ্রিল মাস নাগাদ জার্মানির সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিশিষ্ট নেতা উইলহেলম লিবনেখ্‌ট এঙ্গেলসের কাছে এলেন বিশেষ দাবি নিয়ে। ইউজিন ড্যুরিং ততদিনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে বেশ সমাদর পেয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসাবেও তার বেশ নামডাক হয়েছে। সেই ড্যুরিং সমাজতন্ত্র প্রসঙ্গে নিজের ভাবনাচিন্তা লিখে প্রকাশ করেছেন- সেসব পড়ে তো পার্টির নেতাদের মাথায় হাত দেওয়ার উপক্রম! ড্যুরিং-কে একটা যুতসই জবাব দিতে হবে এবং কাজটা এঙ্গেলসকেই করতে হবে। ড্যুরিং-এর কাজকর্ম সম্পর্কে এঙ্গেলস জানতেন না এমন নয়। প্রাথমিকভাবে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল- ‘সে যুগের জার্মানিতে নিস্কর্মা বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একজন যথাযথ প্রতিনিধি হিসাবে বিজ্ঞানের নামে ড্যুরিং’র আবিষ্কারসমুহ আসলে এক মহোত্তম ছাইপাঁশ ছাড়া আর বিশেষ কিছু নয়’।

কিন্তু এটুকুতেই আর চলছিল না, সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি সম্পর্কে ভ্রান্তি রীতিমত বাড়ছিল। তাই দস্তুরমত পয়েন্ট ধরে ধরে জবাব লিখতে হয়েছিল। ভরোয়ার্টস পত্রিকায় ধারাবাহিক হিসাবে প্রকাশিত সে লেখাই পরে ‘অ্যান্টি ড্যুরিং’ হিসাবে পরিচিত হয়, পূর্ণাঙ্গ বই হিসাবে যার প্রথম প্রকাশ ১৮৭৮ সালের ৮ই জুলাই।

এঙ্গেলসের জবাবের ধাক্কায় ড্যুরিংয়ের আবিষ্কৃত ‘সিস্টেম’ ধ্বসে যায়, তিনি নিজেও মঞ্চ থেকে বিদায় নেন।

কিন্তু ১৮৮০’র মাঝামাঝি থেকে শুরু করে ১৮৮৫ অবধি ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের কাছে আবার নতুন করে অ্যান্টি ড্যুরিং প্রকাশ করার অনুরোধ আসতে শুরু করে। বিশেষ করে ঐ বইয়ের তিনটি অধ্যায়কে দুমলাটের মধ্যে নতুন বই হিসাবে ছেপে বের করার দাবি ওঠে। কোন তিনটি অধ্যায়? যেখানে তিনি থিওরি অফ ফোর্স-কে ব্যখ্যা করেছিলেন। সময়োপযোগী না করে একই লেখা নতুন করে বের করায় এঙ্গেলস রাজি ছিলেন না, তাই নতুন একটি পরিকল্পনাকে তিনি এর সাথে জুড়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। ইতিহাসের সঞ্চারপথ ব্যখ্যা করতে গিয়ে থিওরি অফ ফোর্স হিসাবে যা কিছু তিনি লিখেছিলেন তাকেই আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ততদিনে জার্মানিতে বিসমার্কের জমানা শুরু হয়েছে। নিজের শাসনকালকে মহিমান্বিত করতে তিনি নিজস্ব রাজনীতিকে ‘ব্লাড অ্যান্ড আয়রন পলিসি’ বলে ঘোষণা করেছেন। কার্যত এ রাজনীতির মূল কথা যুক্তিসঙ্গত, বিজ্ঞানসম্মত অবশ্যম্ভাবী পরিণতিকে এড়িয়ে জনসাধারণকে অলীক কল্পনার জালে জড়িয়ে রাখা। বিশাল বিশাল বাগাড়ম্বরের আড়ালে ধোঁকা দেওয়ার নীতি। ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার নির্মাতাদ্বয়ের অন্যতম একজন হিসাবে ফ্রেডরিক এঙ্গেলস উপলব্ধি করেছিলেন- এমন তঞ্চকতা, ভাঁড়ামো বেশিদিন চলতে পারে না। কিন্তু সমসাময়িক রাজনৈতিক শাসন, তা সে যতই প্রবঞ্চক হোক না কেন কেবলমাত্র ঐতিহাসিক তত্ত্বের জোরে উৎখাত করা যায় না, এ সত্যও এঙ্গেলসের উপলব্ধিতে ছিল। ১৮৪৮ সালের জার্মানিতে বিপ্লব প্রচেষ্টা যথেষ্ট সাড়া ফেলেও ব্যর্থ হয়েছিল (যে প্রেক্ষিতে মার্কস-এঙ্গেলস কমিউনিস্ট ইশতেহার শুরুই করেছিলেন ইউরোপ ভূত দেখছে বলে), সে অভিজ্ঞতা তখনও জনগণের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি। তাই পরিকল্পনা করলেন এক দীর্ঘ আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাকে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের আলোকে সবার সামনে তুলে ধরবেন যাতে জনসাধারণের সামনে স্পষ্ট হয়ে হয়ে যায় বিসমার্ক ও তাঁর রাজনীতি দুইই আসলে কতদূর অন্তঃসারশূন্য।

এ পরিকল্পনায় এঙ্গেলস ইউরোপের রাজনৈতিক ইতিহাসকে বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে পর্যালোচনা করেছেন। অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হিসাবে তুলে ধরেছেন চলতি রাজনীতি ও ক্রমবিকাশমান উৎপাদিকা শক্তির মধ্যেকার সংঘাতে রাজনীতির জয় সাময়িক সত্য হতে পারে, ভবিষ্যতে জিতবে উৎপাদনের নয়া পর্যায়কে আবৃত্তকারি শক্তিই। এমন রচনা মার্কসের কলমেও আমরা খুঁজে পাব, অবশ্য দুবার- একটি ‘ল্যুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার’, আরেকটি ‘ফ্রান্সে গৃহযুদ্ধ’। আজকের সময়ে মার্কসবাদী পণ্ডিতরা ওদুটি রচনাকে মার্কসের ‘পলিটিক্যাল ওয়ার্কস’ বলে চিহ্নিত করছেন কারণ ওগুলিতে মার্কস দেখিয়েছেন কীভাবে সমসাময়িক পরিস্থিতিতে ঐতিহাসিক বস্তুবাদের প্রয়োগ করতে হয়। ফ্রেডরিক যদি নিজে লেখা শেষ করতে পারতেন ‘রোল অফ ফোর্স ইন হিস্ট্রি’ও সে বর্গেরই সাহিত্য হিসাবে প্রসিদ্ধ হত।

ড্যুরিং ধ্বসে গেলেও সমাজতান্ত্রিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির বুনিয়াদী ভিত্তি হিসাবে কিছু ভ্রান্ত ধারণা তখনও নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। এখানেই ফর্ম্যাল লজিকের সাথে ডায়ালেক্টিক্যাল লজিকের পার্থক্যের প্রাসঙ্গিকতা। ড্যুরিং নিজেকেই শ্রেষ্ঠ মানব প্রতিপন্ন করতে উঠে-পড়ে লেগেছিলেন, যদিও তার কথাবার্তার শিকড়ে আসলে  যা লুকিয়ে ছিল তাকে সরল আরোহী যুক্তি ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। এহেন দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তি হল এক চিরায়ত স্থিতাবস্থার প্রতি অচেতন আস্থা। যে স্থিতাবস্থা কিছুতেই পরিবর্তন আর রূপান্তরের ফারাক উপলব্ধি করতে পারে না। সভ্যতার একেকটি পর্ব থাকে যখন সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার অর্থ মূলত পরিমাণের ফারাক, সে ব্যবধান বিরাট হতে পারে কিন্তু তা পরিমাণের নিরিখেই সামনে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কিছু নয়। এহেন ইতিহাসের পর্বকে পর্যায় ধরে নিলে যে ভ্রান্তি ঘটে সেটাই সমাজবিজ্ঞানে ফর্ম্যাল লজিকের প্রভাব। মার্কস ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণা নির্মাণ করে ঐ দৃষ্টিভঙ্গিকে ভুল প্রমাণ করে দিলেও নানা রূপে, নানা কায়দায় তা আজও ফিরে ফিরে আসে কারণ বেশিরভাগ মানুষ কিছুতেই নিজেকে নিজের সমসাময়িক বাস্তবতার থেকে বিছিন্ন করে ভাবতে, চিন্তা করতে, উপলব্ধি করতে পারে না। ঐতিহাসিক পর্যায়ের পরিবর্তন শুধু উৎপাদিকা শক্তির পরিবর্তন নয়, রূপান্তর। আগেকার বন্দোবস্তকে উৎখাত করে সামাজিক সম্পর্ক বা বলা উচিত উৎপাদন সম্পর্কের এক নতুন বিন্যাস। এমন নতুন বিন্যাসের অভিঘাতে ইতিহাসের গতিপথে ঝাঁকুনি লাগে, তার সন্ততা (কন্টিনিউটি) ভেঙ্গে যায়। ইতিহাস বাঁক নেয় নির্দিষ্ট অভিমুখে, গড়ে ওঠে নতুন সমাজ।

এই উপলব্ধির বিপরীত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়াই ভাববাদের (আইডিয়ালিজম)-র সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। সে পথে যুক্তি এগোয় নিরন্তর অ্যাবস্ট্র্যাকশনের ভিত্তিতে। এতে সত্ত্বাকে (বিইং) প্রথমে রূপান্তরিত হতে হয় মূলে (এসেন্স)। পুনর্বার অ্যাবস্ট্র্যাকশন হয়ে সেই মূল রূপান্তরিত হয় ধারণায় (কনসেপ্ট)। হেগেল আরও একধাপ এগিয়ে গেছিলেন, তাই ধারণার নেতিকরণে (নেগেশন) তিনি খুঁজে পান এমন এক পরমকে (অ্যাবসলিউট) যা বস্তুও না, ধারনাও না- একধরনের জগাখিচুড়ি। নিজের এহেন দ্বিচারি বিচারকে চিনেছিলেন বলেই সম্ভবত অমন অ্যাবসলিউটকে তিনি আইডিয়া হিসাবে নির্ধারণ করলেন। সংখ্যার সিস্টেমে শূন্যের যে গুরুত্ব, হেগেলের দর্শনে আইডিয়াও প্রায় সেই উদ্দেশ্যে বিবেচিত, নির্ধারিত। শাস্ত্রকে বাস্তবের মাটিতে নিটোল করার আকাংখা হতে গৃহীত পরিকল্পনা। এহেন পরম বা চরমভাবের বহু রুপভেদ থাকে, জেনে অথবা না জেনে পরিশীলিত ভাষার ব্যঞ্জনায় সেসব ঢেকে রেখেই অনেকে ভেবে ফেলেন সব কিছুর আসল কারণ খুঁজে পাওয়া গেছে। ড্যুরিং’ও তেমনই কিছু ভেবেছিলেন।

ইতিহাসের চালিকা শক্তি কী? এ প্রশ্নের বিজ্ঞানসম্মত উত্তর পেতে পিছন ফিরে দেখতে হয়। মানুষের সভ্যতা প্রকৃতির একের পর এক রহস্যভেদ করে সামনে এগিয়েছে, এ চলনে সে নিজেও প্রকৃতি হতে বিচ্ছিন্ন হয়েছে। ঐ বিচ্ছিন্নতার কারণেই সে কিছুতে মেনে নিতে পারে না তার অনেক আচরণ, অভ্যাস, রুচি এমনকি ভাবনা–চিন্তা অবধি আসলে সে ভাবছে বা ভাবতে চাইছে বলে নির্মিত হয়েছে এমনটা না। ইচ্ছানিরপেক্ষ প্রকৃতি হতে সে নিজে উৎপন্ন হয়েছে, অথচ সেই প্রকৃতিকেই চুড়ান্তরূপে নিজের ইচ্ছাধীন বিবেচনা করে সে মনে করে ইতিহাসের যা কিছু লজ্জার, অন্যায়ের, অবিচারের, শোষণের সেসবই আসলে মানুষের মস্তিস্কপ্রসূত অথবা কতিপয় মানুষের বিচ্ছিনস্বভাব ভোগসর্বস্ব স্পৃহার ফলাফল। এভাবে ভাবে বলেই মনে হয় ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলে যে অসাম্য, যে অবিচার তার গোড়ায় ধনতন্ত্র নেই, রয়েছে কিছু মানুষের সর্বগ্রাসী লোভ। এমন উপলব্ধি থেকেই আরোহী সিদ্ধান্ত হয় সামাজিক বন্দোবস্ত, বেগার শ্রমশক্তি নিংড়ে মুনাফা লুটের জন্য উৎপাদনের কৌশল এসব হল গুটিকয়েকের শয়তানি। এই অবধি ভাবলেই চলতি শোষণ ব্যবস্থার নিরসনে বিপ্লবপন্থার ভিত্তি হিসাবে সচেতন ন্যায়বোধের জায়গাটুকু অন্য সবকিছুকে পিছনে ঠেলে সামনে এগিয়ে আসে। তখন খোদ বিপ্লবের চাইতেও বিপ্লবী সত্ত্বার ইচ্ছা বড় হয়ে দেখা দেয়। এখানেই মার্কসবাদীদের ঐতিহাসিক উপলব্ধি গুরুত্বপূর্ণ- ‘Men make their own history, but they do not make it as they please; they do not make it under self-selected circumstances, but under circumstances existing already, given and transmitted from the past’ অর্থাৎ মানুষ নিজেদের ইতিহাস অবশ্যই নিজেরা রচনা করে। কিন্তু এহেন রচনা তারা নিজেরা নিজেদের ইচ্ছামতো করেন না, করতে পারেন না। ঐ কাজ নির্ধারিত হয় সমকালীন বাস্তবতার উপরে ভিত্তি করে। যে পরিপ্রেক্ষিত ইতিহাসের ধারা বেয়ে তাদের আজকের পারিপার্শ্বিকতাকে ঘিরে রেখেছে সে অবস্থাই নির্ধারণ করে দেয় আগামীর ইতিহাস কোনদিকে এগোবে। এটাই ইতিহাসের বস্তবাদী ধারণার মর্মবস্তু।

মার্কস পূর্ববর্তী ইতিহাস চর্চার গোড়ায় ছিল মানুষের জয়যাত্রার গাথা বা আরও বিশেষ করে বললে বিজেতার জয়ী হওয়ার বিবরণ। এমন খতিয়ান ভিত্তিক বয়ানের জন্যই মার্কসের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এর সংঘাত ছিল সেই গোড়াকে আশ্রয় করে। মার্কস ইতিহাস বিবেচনার একেবারে শিকড় অবধি নড়িয়ে দেন, প্রমাণ করেন উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের উপরে নির্ভর করেই শ্রেণী সংগ্রামের একেক পর্যায় আমাদের ইতিহাসকে নির্মাণ করেছে। ধনতন্ত্র তেমনই এক বিশিষ্ট পর্যায় এবং আগামিদিনে সে পর্যায়কেও অন্যান্য ঐতিহাসিক ব্যবস্থাগুলির মতোই উৎখাত হতে হবে। এহেন ব্যবস্থার মূলে যে অসাম্য, যে ভারসাম্যহিনতা তা কারোর ইচ্ছাধীন নয়। ধনতান্ত্রিকরা জিতেছেন বলে ধনতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি। জয়ী হয়েছে ধনতন্ত্র নিজেই আর তাই ধনতন্ত্রীরা আজকের সমাজের মাথায় বসেছেন।

ইতিহাস বিবেচনার এই দৃষ্টিভঙ্গিকে একসময় মানুষের ভূমিকাকে ছোট করে দেখার চেষ্টা, সংকীর্ণ অর্থনীতিবাগীশ ও জেদি একদেশদর্শী ইত্যাদি বলে দাগিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়। সেসবের জবাবও এঙ্গেলস দেন। ১৮৯৫ সালে Der socialistische Akademiker নামক জার্নালে প্রকাশিত এক চিঠির বয়ান স্মরণে রাখতে হয়, এঙ্গেলস লিখেছেন- ‘আমরা মনে করি মানবসমাজের ঐতিহাসিক বিকাশ শেষ অবধি সমাজের অর্থনৈতিক বাস্তবতার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। কিন্তু ‘জাতি’ (race) নিজেই একটি অর্থনৈতিক উপাদান। অবশ্য সংশ্লিষ্ট প্রশ্নে আরও দুটি বিষয়কে মনে রাখতে হবে-

ক) অর্থনৈতিক বিকাশের উপরে নির্ভর করেই রাজনৈতিক, আইনগত, দার্শনিক, ধর্মীয় ও শিল্প সাহিত্য ইত্যাদি বিকশিত হয়। কিন্তু সেটুকুই সব না, উল্টোটাও ঘটে। উপরিকাঠামোর অন্তর্ভুক্ত ঐ সকল বিষয়গুলিও ভিত্তি অর্থাৎ অর্থনৈতিক বাস্তবতার উপরে প্রভাব বিস্তার করে। এক্ষেত্রে অর্থনীতিকেই একমাত্র কারণ আর বাদবাকি সবকিছুই তার ফলাফল বিবেচনা করা চলে না। ভিত্তি ও উপরিকাঠামোর পারস্পরিক ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ার ফলাফল হিসাবে শেষ অবধি যা প্রতিষ্ঠিত হয় তার নির্ভরতা রয়ে যায় বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতার উপরে।

১৬৪৮ সাল থেকে ১৮৩০ সাল পর্যন্ত জার্মানির অর্থনৈতিক অবস্থা শোচনীয় ছিল। সেই থেকেই তৈরি হয় ভয়ানক অবসাদ ও অক্ষমতার মানসিকতা। সেই মনোভাবই প্রথমে ভক্তিধর্মে এবং পরে ভাবালুতায় ভেসে গিয়ে রাজা ও অভিজাতদের সমীপে পদলেহী দাসত্বরূপে আত্মপ্রকাশ করে। তার অর্থনৈতিক প্রভাবও সামনে আসে। পুনরুজ্জীবনের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ঐ মনোবৃত্তিই। যতদিন না বৈপ্লবিক পরিস্থিতি এবং নেপোলিয়নের সুবাদে যুদ্ধবিগ্রহ দীর্ঘস্থায়ী দুর্গতিকে সুতীব্র করে তুলেছিল, ততদিন সেই বাধা এতটুকু নড়েনি। তাই, কেউ কেউ নিজেদের সুবিধা অনুযায়ী যেমনটা ধরে নেন যে অর্থনৈতিক অবস্থার ফলাফল নিজে থেকেই ফলবে, সেটা আদৌ সঠিক নয়। মানুষ নিজের ইতিহাস নিজেরাই সৃষ্টি করে ঠিকই, কিন্তু তেমনটা ঘটে কেবলমাত্র এক নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতেই। সেই পরিস্থিতি ইতিমধ্যে বিদ্যমান বাস্তব সামাজিক সম্পর্কসমূহ ও ইতিহাসের শর্তাশধীন থাকে। ঐ সকল সম্পর্কের মধ্যে অবশ্য নানা রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত বিষয়গুলি যতই প্রভাব বিস্তার করুক না কেন শেষ অবধি অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভিত্তিতেই সামাজিক বিকাশকে উপলব্ধি করা যায়।

খ) মানুষ নিজেরাই তাদের ইতিহাস সৃষ্টি করে। কিন্তু এখনও অবধি তা কোনো যৌথ পরিকল্পনা কিংবা কোনো যৌথ অভিপ্রায় অনুসারে ঘটেনি। নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে আবদ্ধ কোনও সমাজের বেলায়ও তেমনটা হয় না। ইতিহাসের নির্মাণের পর্বে বিভিন্ন মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে সংঘাত লাগে। আর তাই যেকোনো সমাজই আসলে প্রয়োজনীয়তার দ্বারা শাসিত হয়। সেই শাসনেরই অনুবন্ধী চেহারায় সামনে এসে হাজির হয় আকস্মিক দুর্ঘটনার মতো নানা ঘটনাবলী। বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের মাধ্যমে যে সকল দুর্ঘটনাগুলি আড়াআড়িভাবে সামাজিক প্রয়োজনকে প্রতিস্থাপিত করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে সেসবই শেষ বিচারে অর্থনৈতিক বাধ্যবাধকতা। এমন পরিস্থিতিতেই প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন তথাকথিত মহাপুরুষরা। একটি বিশেষ দেশ ও বিশেষ সময়ে ঐ যে নির্দিষ্ট ব্যক্তিটির আবির্ভাব ঘটল সেটা অবশ্যই আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু ইতিহাসের বিবেচনায় যদি তাকে সরিয়ে রেখে দেখেন, দেখতে পাবেন চারিদিকে সেই নির্দিষ্ট বিকল্পের দাবিই উঠছে। এই বিকল্প পাওয়া যাবে, ভাল হোক মন্দ হোক শেষ পর্যন্ত সেই বিকল্প মিলবেই। ঠিক যেমন ঘটেছিল ফ্রান্সে। যুদ্ধ বিগ্রহে অবসন্ন ফরাসী প্রজাতন্ত্র এক সামরিক ‘ডিক্টেটর’কেই ইতিহাসের কর্তব্য সমাধানের জন্য আবশ্যক করে তুলেছিল। শেষ অবধি সেই ব্যক্তি হয়ে উঠলেন কর্সিকাবাসী নেপোলিয়নই। এখানে ব্যক্তি হিসাবে নেপোলিয়নের উত্থান আকস্মিক ঘটনা, তিনি সেই ভূমিকায় অবতীর্ণ না হলে তার বদলে অন্য যে কেউই সেই স্থান পূরণ করত। এর প্রমাণ কী? ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালেই দেখা যাবে যখনই তার এমন কোনও ব্যক্তির প্রয়োজন হয়েছে তখনই কাম্য মানুষটির খোঁজ ঠিকই পাওয়া গেছে। সিজার, অগাস্টস কিংবা ক্রমওয়েল সকলেই সেই ঐতিহাসিক উদাহরণ। মার্কস ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণাটির আবিষ্কার করেছেন ঠিকই। কিন্তু একথাও স্মরণে রাখতে হয় যে  ঐ আবিষ্কারের জন্য চেষ্টা চলছিলই। থিয়েরি, মিগনেয়, গিজো সহ ১৮৫০ সাল পর্যন্ত সকল বৃটিশ ঐতিহাসিকরাই সেই চেষ্টা করে গেছেন। মর্গানের হাত ধরে যে ঐতিহাসিক ধারণার আবিষ্কার হল সেটাই প্রমাণ করে দেয় যে ঐ আবিষ্কারের সময় উপস্থিত হয়েছিল- আজ হোক বা কাল কাজটা করতেই হত।’

অর্থাৎ ইতিহাসের গতিপথে একটি বল (ফোর্স) সর্বদা সক্রিয়। সেই ফোর্সকে সাময়িকভাবে অগ্রাহ্য করা গেলেও শেষ অবধি এড়িয়ে যাওয়া যায় না। শ্রেণীসমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যেকার ঘাতপ্রতিঘাতে একেক সময়ে এমন শাসনব্যবস্থাও কায়ে হতে পারে যা কোনও পক্ষেরই দাবী মেটাতে পারে না, তবু তা কায়েম হয় সেই সময়ের অভ্যন্তরীণ গতিময়তার (ডায়নামিক্স) কারণেই। কিছুদিনের জন্য মনে হতে পারে এমনটা কিভাবে সম্ভব হল কিংবা কায়েম হওয়া রাজনৈতিক শক্তি নিজেকে অমোঘ, অজেয় হিসাবেও প্রতিপন্ন করতে পারে। কিন্তু অচিরেই সেই অবস্থা সামনে চলে আসে যাকে এড়িয়ে যাওয়ার উদেশ্যেই ঐ শাসন কায়েম হয়েছিল। এ সংঘাত আসলে বিকাশমান উৎপাদিকা শক্তির সাথে সামঞ্জস্যহীন রাজনৈতিক কায়েমি স্বার্থের বৈপরীত্যের বহিঃপ্রকাশ। ঢক্কানিনাদের জোরে যারা নিজেদের অনড়, অটল শাসক হিসাবে তুলে ধরতে চাইছে তাদের যত সদিচ্ছাই থাকুক না কেন শেষ অবধি তারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারে না, পারবে না। রাজনীতি ও অর্থনীতিকে আলাদা আলাদা ঐতিহাসিক বিষয় হিসাবে বিবেচনা করার গলদটা সেখানেই, ড্যুরিং তো বটেই আরও অনেকেই এমন ভুল করেছিলেন, আজও করছেন। এটাই থিওরি অফ ফোর্সের মোদ্দা কথা।

‘ব্লাড অ্যান্ড আয়রন পলিসি’ ইত্যাদি বলে জার্মানিকে তৎকালীন দুনিয়ার অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে সরিয়ে রাখতে চেয়ে বিসমার্ক তখন ঠিক তেমনটাই করতে চাইছিলেন।

তৎকালীন জার্মানির রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এঙ্গেলস সেকথাই আরেকবার স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

অ্যান্টি ড্যুরিং-এ প্রকাশিত তিনটি অধ্যায়কে ঘষে-মেজে এবং তার সাথে সমসাময়িক জার্মানির রাজনীতি প্রসঙ্গে একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত করার পরিকল্পনা ছিল। এঙ্গেলসের পরিকল্পনা শেষ অবধি সম্পূর্ণ হয়নি, খসড়া (ড্রাফট) হিসাবেই রয়ে গেছিল। তাঁর মৃত্যুর পরে ১৮৯৬ নাগাদ দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের ডাকসাইটে নেতা এডুয়ার্দ বার্নস্টাইন নিউ জিয়েত পত্রিকায় সেই চতুর্থ অধ্যায়টি প্রকাশ করেন। একাজ করতে গিয়ে মূল খসড়ার বেশ কিছুটা অংশ তিনি চিরতরে হারিয়ে অবধি ফেলেন যা আর কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি, সম্পাদনার নামেও কার্যত যথেচ্ছাচার চালান।

সেই পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার সুবাদে পরবর্তীকালে লেখাটির একটি ফরাসী ও সেন্ট পিটার্সবার্গ থেকে একটি সংক্ষিপ্ত রুশ সংস্করণ বেরোয়। মস্কো থেকে প্রকাশিত মার্কস-এঙ্গেলস কালেক্টেড ওয়ার্কসের প্রথম সংস্করণে বার্নস্টাইনের সম্পাদনার ত্রুটি যতদূর সম্ভব দূর করে, মূল খসড়ার সাথে মিলিয়ে সে লেখার প্রথম পুর্নাঙ্গ রুশ অনুবাদ হয়েছিল।

আন্তর্জাতিক লগ্নী পুঁজির দাপটে বিশ্বব্যাপী সংকট চলছে। বিনিয়োগের নাম করে একের পর এক দেশকে নিজেদের জালে জড়িয়ে ফেলেছে লুটেরা ধনতন্ত্র। প্রাকৃতিক ও মানব সম্পদ লুটের পাশাপাশি নতুন বিপদ হিসাবে পরিবেশের বদল জনিত সমস্যাও ক্রমশ সামনে আসছে। আমাদের দেশে পুঁজি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির গাঁটছড়া (কর্পোরেট কমিউনাল নেক্সাস) সেই শাসনেরই নির্দিষ্ট চেহারা। যা চলছে সেটাই যদি চলে তবে যে পরিত্রানের কোনও উপায় নেই একথায় প্রায় সকলেই একমত, কিন্তু কিভাবে কোন পথে মুক্তি আসবে এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে।

এমন পরিস্থিতিতে দুনিয়াজুড়ে রাজনীতির মঞ্চে উথালপাতাল চলছে, সেটাই স্বাভাবিক। একদিকে শ্রীলংকায় জনসাধারণ বামপন্থীদের বিপুল সমর্থন দিচ্ছেন আরেকদিকে ইলন মাস্কদের কাঁধে চেপে ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয়বারের জন্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হচ্ছেন। প্যালেস্তাইনের মানুষকে কীটপতঙ্গের মতো মরতে দেখা যাচ্ছে অথচ কেউই এ সম্পর্কে নিন্দাসূচক বিবৃতি দেওয়ার চাইতে বেশি কিছু করছে না। এগুলোর কোনটাই একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এসবের মাঝেই বিজ্ঞান- প্রযুক্তির বিকাশপথে আবিষ্কৃত হয়েছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, যাকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদনের গতি ও প্রকৃতি বদলের ইঙ্গিত প্রতিদিন স্পষ্ট হচ্ছে। প্রতিদিন মানুষ বুঝছেন সমাজতান্ত্রিক শিবির বলে যেটুকু যা ছিল সেসব না থাকলে কিই না হয়।

ইতিহাসের আরেকবার বাঁক নেওয়ার সময় আসছে এটুকু বুঝতে অসুবিধা হয় না। এবারেও মানুষই ইতিহাস রচনা করবেন। যাই হোক না কেন তার সাথে অর্থনীতির যোগাযোগ কিছু নেই কিংবা রাজনীতির কোনও ভূমিকা থাকবে না এদুটি শিবিরই আসলে জনস্বার্থ বিরোধী, শাসকের, মালিকের পক্ষ। ওদের সব হারানোর ভয় রয়েছে তাই আগে থেকে গান গেয়ে আসর জমাচ্ছেন, মঞ্চ ফাঁকা না যায় সেই উদ্দেশ্যে ভাঁড়ামোর আয়োজন করছেন। তাদের বক্তব্য আগামী নির্মিত হয় ক্ষমতাসীনের অঙ্গুলিহেলনে তাই কেউ যেন বাড়াবাড়ি করার চেষ্টা না করেন। আমরা, মার্কসবাদীরা যেন নিজেরা সচেতন থাকি, কখনো না ভুলি ইতিহাসের সঞ্চারপথে একটি বল সর্বদা সক্রিয়। কিছুদিনের জন্য তাকে চেপে রাখা যায়, অগ্রাহ্য করা যায়- কিন্তু ব্যাপারটা চিরকাল চলে না, চলবে না। রাজনীতি ও উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের মাঝে যে সংঘাত তাতে শেষ অবধি জয় হবে নয়া উৎপাদন প্রক্রিয়ারই। সামাজিক ব্যবস্থাকে সেই অনুযায়ী নিজেকে বদলে ফেলতে হয়, হবে। নেপোলিয়ন ও তার ভাইপো ল্যুই বোনাপার্ট থেকে শুরু করে বিসমার্ক এমনকি হিটলারও শেষ অবধি ব্যর্থই হয়েছিলেন। আজ তাদের উত্তরসূরিরা সেসব ভুলে যেতে পারেন। আমাদেরই কাজ তাদের মনে করিয়ে দেওয়া। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা।

রোল অফ ফোর্স ইন হিস্ট্রি’কে চেপে রাখতে যখন যাবতীয় কুচক্রী রাজনীতি বলপ্রয়োগে উদ্যত, তখনই যে সমাজ বিকাশের বিষয়ী (সাবজেক্টিভ) উপাদানকে সক্রিয় হতে হয়। তেমনটা করা না গেলে নেপোলিয়ন, হিটলারের মতো চরিত্রেরা মাথায় চড়ে বসার সুযোগ পেয়ে যান। এখানেই ফ্রেডরিক এঙ্গেলসের প্রসঙ্গ, উত্তরাধিকার। এ লেখা যে প্রেক্ষিতে রচিত তৎকালীন সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতারা তাকে উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। ১৮৯১ সালে এঙ্গেলসকে উদ্দেশ্য করে অগাস্ট বেবেলের লেখা চিঠিতে রয়েছে- ‘To adopt the republic as our aim is impossible under our German conditions. Our people would be driven into a corner in their agitational activity, being constantly confronted with the accusation: you are going to use force...To make a stand against the petty states is unnecessary. We should be playing Prussia's game, and this would be both purposeless and unsuccessful... In the party, this question is regarded as irrelevant and finished. The petty states exist like dozens of other equally super- fluous institutions which will disappear of their own accord when the ground on which they stand begins to shake.’ সেবার বেবেল’রা ব্যর্থ হলেও লেনিন সেই শিক্ষা মনে রেখেছিলেন, আর তাই জার’কে উৎখাত করে কেরেনস্কির হাতে ক্ষমতার বদলে তিনি সন্তুষ্ট থাকেননি। কেন হননি তার উত্তর মেলে 'রাষ্ট্র ও বিপ্লব'এর পাতায়, এঙ্গেলসের অসমাপ্ত কাজই শেষ করেছিলেন লেনিন।

আজ তাঁর জন্মদিবস বলেই আমরা এ লেখার প্রসঙ্গে প্রতিবেদন প্রকাশ করছি না। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস স্মরণে সবচেয়ে জরুরী ও সময়োপযোগী কর্তব্য সম্ভবত মার্কসবাদী হিসাবে নিজেদের ভূমিকা (রোল)-কে স্মরণে রাখা।

   
লেখায় ব্যবহৃত চিঠির অংশের ভাষান্তর লেখকের নিজস্ব।
ব্যবহৃত ছবি সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে প্রাপ্ত।

শেয়ার করুন

উত্তর দিন