Science and Philosophy Cover (5))

দর্শন, বিজ্ঞান এবং রাজনীতি – প্রাচীন ভারতের সাক্ষ্য (৫ম পর্ব)

প্রাককথন

বেদ প্রাচীন সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রাচীন বলেই এতে বর্ণিত যাবতীয় কিছু নির্ভুল এমনটা ভেবে নেওয়া কিংবা অন্যদেরো তেমনটা ভাবতে জোর-জবরদস্তি করা দুটিই অনুচিত। বিজ্ঞান শুধু কতিপয় প্রযুক্তিগত কৌশলের সমাহার না, শেষ অবধি বিজ্ঞান আসলে এক জীবনদর্শন। ইতিহাসকে বিবেচনার কাজেও বিজ্ঞানসম্মত কিছু বিধি-নিষেধ রয়েছে, সত্য-অসত্য যাচাই করে নেওয়ার পদ্ধতি রয়েছে। এসব সত্বেও দাবী ওঠে বেদ প্রাচীন আর তাই নাকি অভ্রান্ত! আসলে এই লড়াই দুটি বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গীর, দুটি দার্শনিক অভীক্ষার। সেই লড়াই আমাদের দেশে শুধুই আজকের বাস্তবতা না, এরও ইতিহাস রয়েছে। প্রাচীন যুগেই একদল ছিলেন যারা বেদের বানী’কে অভ্রান্ত বলে মানতে চাননি, চার্বাক তাদেরই অন্যতম।

এবারের আলোচনা সেই চার্বাক’দের প্রসঙ্গেই। যাতে আজকের প্রজন্ম মনে রাখে বিজ্ঞানসম্মত জীবনবোধ প্রচারের সংগ্রামে আমাদের দেশের ইতিহাসেও যথেষ্ট উপাদান রয়েছে।

ছয় পর্বের সিরিজটি প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হচ্ছে।

আজ পঞ্চম পর্ব।

শ্যামাশীষ ঘোষ

পর্ব ৫

লোকায়ত বা চার্বাক – বস্তুবাদী দর্শন

চার্বাকপন্থীদের কয়েকটি বক্তব্য তাঁদের প্রাথমিক পরিচয় পেতে সাহায্য করবে আমাদের।

‘না আছে বুদ্ধি, না খেটে খাবার মত গতর; এমনতর অকর্মণ্য যে পুরোহিতশ্রেণী, তাদেরই একটা হিল্লে হিসেবে রচিত হয়েছে অগ্নিহোত্র যজ্ঞের কথা, তিন তিনটে বেদ, এবং এইরকম আরও অনেক কিছু। আসলে স্বর্গ বা পারলৌকিক আত্মা বলে সত্যি কিছু নেই’। সামবেদ সত্যিকারের অর্থে আলাদা কোনও বেদ ছিল না।

‘মৃতের উদ্দেশে প্রেতকার্য প্রভৃতি ব্রাক্ষণদের জীবনোপায় ছাড়া আর কিছু নয়। যারা তিন তিনটে বেদ রচনা করেছে তারা বেবাক ভণ্ড-ধূর্ত-নিশাচরের দল’।

দেবীপ্রসাদ বলছেন, অন্তত আড়াই হাজার বছর আগে আমাদের দেশে এইরকম সাংঘাতিক কথা শোনা গিয়েছিল – শাসক শ্রেণির বিরুদ্ধে আক্রোশটা স্পষ্ট। সাথে সহজ বুদ্ধির খণ্ডনপদ্ধতিও। চার্বাকপন্থী বলেন, কর্মজীবনের কষ্টিপাথরে শাসক-শ্রেণীর দাবিগুলোকে ঘষে দেখো, দেখবে কী অসম্ভব রকমের মেকি। শুনতে ভদ্রলোকের রুচিতেও বাধে। দর্শনের “নৈর্ব্যক্তিক” আলোচনায় এ রকম শালীনতার অভাব কেন? কিন্তু মুশকিল এই যে, ‘ছোটলোকের’ দল শাসকের বিরুদ্ধে যখন রুখে দাঁড়ায়, তখন তাদের কাছে রুচি, শালীনতা প্রভৃতি তথাকথিত ‘মনুষ্যধর্ম’গুলো লোকঠকানো সাধুবাক্যেরই অঙ্গবিশেষ মনে হতে পারে বই কী! বিদ্রোহের সময় রক্তাক্ত বীভৎসতা করতে পর্যন্ত যে ‘ছোটলোকদের’ রুচিতে বাধে না, খিস্তি খেউড় তো নেহাত ছোট ব্যাপার!

লোকায়ত দর্শন বা চার্বাক দর্শন ভারতীয় দর্শনের প্রধান শাখাগুলোর অন্যতম। এটি আধ্যাত্মবাদবিরোধী নিরীশ্বরবাদী ও বস্তুবাদী দর্শন। ‘প্রমাণ’ই এর যথার্থ জ্ঞানের উৎস। লোকায়ত সংক্রান্ত তথ্য অত্যন্ত বিরল এবং একান্তই খণ্ড ও বিক্ষিপ্ত। লোকায়তিকদের নিজস্ব কোনো রচনাই খুঁজে পাওয়া যায় না। এককালে এ-জাতীয় গ্রন্থ রচনা হলেও, তা বিলুপ্ত হয়েছে। হয়তো বিপক্ষেরা সেগুলি স্বেচ্ছায় ধ্বংস করেছিলো। এ-বিষয়ে একমাত্র সম্বল ‘অর্থশাস্ত্র’ জাতীয় গ্রন্থ, প্রচলিত প্রামাণিক কিছু লোকগাথা আর বিরোধী সম্প্রদায়গুলির লোকায়ত-খণ্ডন। বিরুদ্ধ সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা লোকায়তর খণ্ডন-প্রসঙ্গে যা বলেছেন তার থেকেই লোকায়ত মতকে পুনর্গঠন করবার চেষ্টা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

চার্বাক বেদবিরোধী, অতএব সনাতন বৈদিক সমাজের ক্ষমার অযোগ্য বিদ্রোহী দার্শনিক। চার্বাক আক্রমণ করেছেন বেদের আড়ম্বরপূর্ণ জটিল প্রক্রিয়ার যজ্ঞগুলির কর্মকাণ্ডকে, যার পৌরোহিত্য করেছেন, ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা আর বৈশ্যের অর্থ দ্বারা সুরক্ষিত এবং পরিপুষ্ট, ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় সংহিতায় বর্ণিত অশ্বমেধ যজ্ঞে বলিদানের জন্য আনীত অশ্বকে যেখানে বৈদিক ঋষি অশ্বকে স্বর্গপ্রাপ্তির আশা দেখিয়ে দুঃখ করতে বারণ করছেন, সেখানে চার্বাক প্রশ্ন তুলেছেন: অত সহজেই যদি স্বর্গে পাঠানো যায়, তাহলে অবোধ পশুকে বলি দেওয়ার বদলে তো ঋষিবর নিজের বৃদ্ধ পিতাকেই বলি দিয়ে স্বর্গে পাঠাতে পারেন!

ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (আলো ও তাপের মূল উৎস), মরুৎ (বায়ু) এবং ব্যোম (আকাশ) এই পাঁচটি পঞ্চমহাভূত নামে প্রসিদ্ধ। বৈশেষিক মতে এই পাঁচটির সঙ্গে আত্মা, মন, কাল এবং দিক এই চারটি যোগ করে বলা হয়েছিল নয়টি দ্রব্যের কথা। এই নয়টি দ্রব্যের প্রথম চারটি – ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ – সূক্ষ্মতম বস্তুকণা (পরমাণু) দিয়ে গঠিত। সেই অর্থে বস্তুজগতের মূল উপাদান পরমাণু। সেজন্যই বৈশেষিক দর্শনকে পরমাণুবাদী বলা হয়। দার্শনিক তাৎপর্যের দিক থেকে চার্বাকদর্শনকে বলা হয় ভুতচৈতন্য বা দেহাত্মবাদ। চার্বাকমতে ক্ষিতি, অপ, তেজ এবং মরুৎ এই চারটিই মূলবস্তু যা বিশ্বজগতের উপাদান – আপসহীন, নির্ভেজাল বস্তুবাদী।

জীবের জীবনধারণের জন্য একান্ত অপরিহার্য ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বস্তুগুলির সূক্ষ্মতম অবস্থাকেই চার্বাক বস্তুজগতের উৎস বলে মেনেছেন। তিনি জড়বস্তু থেকে প্রাণিজগৎ এবং শেষ পর্যন্ত মানবদেহের ক্রমবিকাশের দিকে নজর রেখেই বস্তুজগতের মূল অনুসন্ধান করেছেন। চার্বাকের ধ্যানধারণা মানবকেন্দ্রিক। ঈশ্বর, স্বতন্ত্র চৈতন্য (আত্মা), পরলোক, জন্মান্তর, পূর্ব জন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, পারলৌকিক মুক্তি, স্বর্গসুখের আশ্বাস ইত্যাদি কল্পনার নিপীড়ন থেকে মানবচেতনাকে ভারমুক্ত করে একটি সামাজিক-ন্যায়বিচার-নির্ভর মুক্ত মানবসমাজ গড়ে তোলাই ছিল চার্বাকের দার্শনিক উদ্দেশ্য। মানুষের চেতনাতে যা প্রতিভাত হয় তার ওপরে নির্ভর করেই মানুষের মননশক্তি সত্যাসত্য নির্ধারণ করে। একমাত্র প্রত্যক্ষকে প্রমাণ বলে মানলে, নিপীড়িত শ্রমজীবী মানুষ তখন সমস্ত দুঃখ লাঞ্ছনার জন্য উচ্চবর্ণের কূটবুদ্ধি ও শ্রেণিস্বার্থ কলুষিত ধর্মীয় শাসনব্যবস্থাকে দায়ী করবে। এটাই চার্বাক দর্শনের সামাজিক তাৎপর্য। এর বাইরে ‘বিশুদ্ধ সত্য’ বলে কিছু হয় না।

ভূতচৈতন্যবাদের সংক্ষিপ্ত অর্থ হল: ‘বস্তুজগতের যা মূল উপাদান সেই উপাদানগুলির এক বিচিত্র জটিল প্রক্রিয়াজনিত সমন্বয়ের ফলে উৎপন্ন প্রাণীদেহে বিশেষত মানবদেহে চৈতন্যের আবির্ভাব হয়েছে। তাই চৈতন্য মূলত বিশেষ প্রক্রিয়ায় বিবর্তিত ও সংগঠিত দেহের উপাদান-সম্ভূত একটি বিশেষ গুণ’। অর্থাৎ, কোনো এক বিচিত্র প্রাকৃতিক নিয়মানুসারে প্রকৃতির মূল উপাদানগুলির – ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুতের সূক্ষ্মতম কনাগুলি – ক্রমপরিবর্তনশীল নূতন নূতন সমন্বয়ের ফলে বিপুল বস্তুজগৎ রূপে বিকশিত হয়। এই সমন্বয়গুলি আবার ক্রমবিবর্তিত হয়ে প্রাণীদেহে রূপান্তরিত হয়। বিবর্তন প্রক্রিয়া আরো অগ্রসর হয়ে মানবদেহের আকারপ্রকারের মধ্যে রূপান্তর লাভ করে। মানবদেহের ভৌতিক উপাদানগুলি মাংস-মজ্জা-অস্থি-রক্ত-স্নায়ুতন্ত্র-মস্তিষ্ক প্রভৃতি অঙ্গপ্রত্যঙ্গে পরিণতি লাভ করে। জীবদেহস্থিত মৌলিক উপাদানগুলির এক বিচিত্র ও সমন্বয়কারী ধর্ম জীবদেহে, বিশেষত মানবদেহে, একটি নতুন গুণের সঞ্চার করে – চৈতন্য – জ্ঞান, বুদ্ধি, চেতনা বা অনুভূতি। এটাই দেহপ্রকৃতির স্বভাব, এর মধ্যে কোন আত্মা বা অলৌকিক মহিমা নেই। প্রাণীদেহের তুলনায় মানবদেহে এই সন্নিবেশ-বৈচিত্র আরও সূক্ষ্ম ও জটিল, তাই মানবদেহের চেতনা অন্যান্য প্রাণীদের তুলনায় উন্নততর। আধুনিক জীবনবিজ্ঞান সম্মত এই বৈজ্ঞানিক ধারণার প্রাথমিক উন্মেষ ঘটেছে চার্বাকদর্শনে, যার জন্ম সুপ্রাচীন ভারতে খ্রিস্টজন্মের বহু শতাব্দী পূর্বে। প্রাচীন চিকিৎসাশাস্ত্রের আলোচনাতেও আমরা এই ধরণের বৈজ্ঞানিক মননের উদাহরণ দেখতে পাই। প্রশ্ন আসে, প্রকৃতির মূল চারটি উপাদান নির্মিত শরীরে যদি চৈতন্যের আবির্ভাব ঘটতে পারে, তবে ঘট পাথর প্রভৃতি থেকে চৈতন্যের উদয় হয় না কেন? চার্বাকের উত্তর: ‘এর কারণ বস্তুর স্বভাব। তাই ত্বক অস্থি মাংস শোণিত প্রভৃতির বিশিষ্ট সন্নিবেশ প্রক্রিয়া থেকেই চৈতন্যের উদ্ভব হয়। যে কোনো বস্তুসমষ্ঠি থেকেই তা হয় না’। চার্বাকদর্শনের বক্তব্যের ছাপ দেখতে পাওয়া যায় মাও সে তুং দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে যা বলেছেন তার মধ্যে: ‘দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদীরা মনে করে যে বাহ্যিক কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের শর্ত এবং অভ্যন্তরীণ কারণ হচ্ছে পরিবর্তনের ভিত্তি, এবং বাহ্যিক কারণসমূহ ক্রিয়াশীল হয় আভ্যন্তরীণ কারণের মাধ্যমে’।

চৈতন্য ভৌতিক প্রাণীদেহের একটি বিশেষ গুণ মেনে নিলে দেহব্যতিরিক্ত, দেহবহির্ভূত চৈতন্যময় আত্মা নামক স্বতন্ত্র পদার্থের অস্তিত্ব থাকে না। তাই দেহের সঙ্গেসঙ্গেই চেতনার জন্ম ও মৃত্যু। মৃতদেহে চেতনার কোনও অস্তিত্ব থাকে না। আর, স্বতন্ত্র আত্মা না-থাকলে জন্ম-জন্মান্তর, পূর্বজন্মের কর্মফল, অদৃষ্ট, স্বর্গ-নরক, পারলৌকিক মুক্তি, সৃষ্টিকর্তা, মুক্তিদাতা ঈশ্বর সবকিছুই অনাবশ্যক বলে বাতিল হয়ে যায়। অতএব, ভূতচৈতন্যবাদ কেবল চার মৌলিক বস্তুকণার অস্তিত্ব মানার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, দেহবিযুক্ত চৈতন্যময় আত্মার অস্বীকারও এর অন্তর্গত। এখানেই চার্বাক দর্শন প্রাচীন যুগের অন্য সব বস্তুবাদী দর্শনকে ছাড়িয়ে যায়।

সমস্ত বৈদিক ক্রিয়াকলাপের মূল লক্ষ্য ইহলোকের সুখসমৃদ্ধি। আসল কথা ইহলোকে সুখে খেয়ে-পরে বাঁচতে চাই। মনে রাখতে হবে ‘আত্মা’ শব্দের একটি প্রচলিত অর্থ হল বস্তুর স্বভাব। মীমাংসকরা, অন্তত প্রাচীন মীমাংসকরা, পারলৌকিক মুক্তি নিয়ে মাথা ঘামান নি। স্বর্গও প্রকারান্তরে ঐহিক সুখের কাল্পনিক পরাকাষ্ঠা, এজন্য ‘স্বর্গ’ শব্দের অর্থ করা হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন অবিমিশ্র অন্তহীন সুখ। উপনিষদের নানা জায়গায় ছড়িয়ে আছে বস্তুবাদী দর্শনের আভাস। তা সত্ত্বেও সেগুলিতে নানা ভাবে ভাববাদী দর্শনের ছাপ ফেলার চেষ্টা চলেছে পরবর্তী সময়ে। চার্বাক ছাড়া অন্যান্য বস্তুবাদী দর্শনের মধ্যে সেগুলির কট্টর বিরোধিতা দেখা যায় না। একমাত্র চার্বাক দর্শনই অনড় ভাবে নিজেদের বক্তব্য বলতে কুণ্ঠা করেনি।

তৈত্তিরীও উপনিষদের শীক্ষাবল্লী অধ্যায়কে বলা হয়েছে ব্রহ্মানন্দবল্লীর ভূমিকা বা প্রস্তুতিপর্ব। এই প্রস্তুতিপর্বে ব্রহ্মানন্দ লাভের প্রস্তুতিটা উপনিষদের এই প্রার্থনায় বোঝা যায়: ‘আমাকে বস্ত্র দাও, গোধন দাও, অন্ন দাও, পানীয় দাও, মেষ প্রভৃতি লোমশ পশু দাও, আমাকে শ্রী অর্থাৎ সৌভাগ্য সমৃদ্ধি দান কর’। এর সঙ্গে তুলনা করুন ‘একমাত্র ব্রহ্মই সত্য, এ জগৎ মিথ্যা’ এহেন উত্তুঙ্গ ব্রহ্মজ্ঞান! এই মিথ্যা জগতের মিথ্যা অন্নজল খেয়ে মিথ্যা বেঁচে না থাকলে, সবকিছু মিথ্যা মায়ামাত্র এই দিব্যজ্ঞান হবে কী করে? বেদান্তসূত্র-র ভাষ্যে ব্রহ্মজ্ঞানে অধিকার পাওয়ার জন্য কী কী গুণ প্রয়োজন, এর উত্তরে বলা হয়েছে ঐহিক ও পারত্রিক সকল রকম সুখভোগ লালসার প্রতি বৈরাগ্য। চার্বাক মতে, তা হলে ব্রহ্মানন্দে পৌঁছাবার জন্য সাংসারিক সুখসমৃদ্ধি লাভের এই আকূল আকূতি কেন?

ব্রহ্মানন্দবল্লী ও ভৃগুবল্লীতে ব্রহ্মের পাঁচটি কোশ বা স্তর উল্লেখ করা হয়েছে। মূল থেকে সূক্ষ্ম ও সূক্ষ্মতর রূপে পাঁচটি কোশস্তর: ১) অন্নময় কোশ, ২) প্রাণময় কোশ, ৩) মনোময় কোশ, ৪) বিজ্ঞানময় কোশ এবং ৫) আনন্দময় কোশ। এই পঞ্চকোশস্তরের স্বাভাবিক তাৎপর্য হল পাঁচটি কোশস্তর মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশধারা যা মানুষকে অন্য প্রাণী থেকে স্বতন্ত্র উন্নততর প্রাণীরূপে প্রতিষ্ঠিত করেছে। মনুষ্যত্ব লাভ করতে হলে মানুষকে সর্বপ্রথম প্রাণী রূপে বেঁচে থাকতে হবে এবং বেঁচে থাকতে হলে পৃথিবী থেকে অন্ন জল সংগ্রহ করতে হবে। সুতরাং অন্নই ব্রহ্ম। অন্ন থেকেই প্রাণীগণ জন্মগ্রহণ করে, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। কিন্তু প্রাণের জন্য আর একটি সূক্ষ্ম পদার্থ দরকার – বায়ু, দৃষ্টিগোচর নয়, স্পর্শগোচর। তৃতীয় কোশ হল মন। মন মানুষের মননশীলতা বা বিচারশীলতার উপকরণ। এখান থেকেই অন্য প্রাণী হতে মানুষের স্বাতন্ত্র্য সূচিত হয়। আবার মনের মননশীলতা বা মনোবৃত্তিই হল বিজ্ঞান বা বিশিষ্ট উন্নততর জ্ঞানের ভিত্তি। মানুষ মনের দ্বারাই বিশ্বচরাচর সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করে। একেই বলা হয়েছে বিজ্ঞানস্বরূপ ব্রহ্ম। বৈদিক ঋষির মতে বেদই হল সকল জ্ঞানের আধার। যাজ্ঞিক মতে নিখুঁতভাবে বৈদিক যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের দ্বারা উৎপন্ন হয় বাঞ্ছিত ফললাভের আনন্দ। আনন্দই জীবনের লক্ষ্য। এভাবেই অন্নব্রহ্ম থেকে আনন্দব্রহ্মে উত্তরণ। উপনিষদের আরম্ভ ও শেষ অন্নস্তুতি দিয়ে। আগে খেয়ে পরে থাকার ব্যবস্থা করো, তারপর অন্য কথা। The German Ideology তে মার্কস ও এঙ্গেলস বলেছেন: ইতিহাস সৃষ্টি করার জন্য সর্বপ্রথমে মানুষকে বাঁচতে হবে। ‘… the first premise of all human existence and, therefore, of all history, the premise, namely, that men must be in a position to live in order to be able to make history.’

ব্রহ্মজ্ঞানের আখর বৃহদারণ্যক-এ আরো অনেক চিত্তাকর্ষক উপদেশ ও উপাখ্যান আছে। ব্রাহ্মণদের রক্ষা করার জন্য একদল রক্ষাকর্তা প্রয়োজন। তাই ব্রহ্মা ক্ষত্রিয় জাতি সৃষ্টি করল। ব্রাহ্মণরা ক্ষত্রিয়ের মাথায় যশের মুকুট পরিয়েছে। কিন্তু ক্ষত্রিয়ের রাজত্ব চালাতে ধনদৌলতের প্রয়োজন। সেই জন্য ব্রহ্মা আবার এক বণিক সম্প্রদায়ের সৃষ্টি করল – বৈশ্য। কিন্তু, এই তিনটি সম্প্রদায়ের পরিচর্যা করবে কে? তাই ব্রহ্মা একটি পরিচারক সম্প্রদায় সৃষ্টি করল – শূদ্র। এদের একমাত্র ধর্ম হল উচ্চ তিন বর্ণের সেবা করা। এভাবেই ভারতীয় সমাজের চারটি বর্ণের মধ্যে বিভাজনের যৌক্তিকতা আরোপের চেষ্টা হয়েছে। যেভাবে ইউরোপে “স্বাধীন মানুষ ও দাস, প্যাট্রিশিয়ান ও প্লিবিয়ান, জমিদার ও ভুমিদাস, গিল্ড কর্তা ও কারীগর” শ্রেণির মধ্যে শ্রেণিসংগ্রাম বিকশিত হয়েছিল, ভারতে তা হতে পারেনি এই বর্ণপ্রথার দাপটে।

দেবতা ও অসুরদের পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়েও বৃহদারণ্যক-এ কাহিনী আছে: প্রজাপতির সন্তানরা দুই শ্রেণিতে বিভক্ত, দেব ও অসুর। অসুররা অগ্রজ, দেবতারা অনুজ। পৃথিবীর ভোগ্যবস্তুর অধিকার নিয়ে অসুর ও দেবতাদের মধ্যে লড়াই হল, অবশেষে দেবতারা জয়লাভ করল। কাহিনীটি একটি সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক ইঙ্গিত বহন করছে। আর্যদের ভারতবর্ষে আসার অনেক আগে থেকেই অনার্যরা এদেশে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাই অনার্য অসুরেরা অগ্রজ। দেবতা বা আর্যরা অনুজ, কারণ তারা পরে এসেছে। বৈদিক সাহিত্যে বার বার আর্য সমাজের নেতৃস্থানীয় ইন্দ্র কর্তৃক দাস বা দস্যু, নামান্তরে, অসুরদের সমৃদ্ধ নগরগুলি ধ্বংস করার কাহিনী বলা হয়েছে। এই উপাখ্যানের মধ্যে আর্যরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে কীভাবে পূর্বপ্রতিষ্ঠিত অনার্য সভ্যতাকে ধ্বংস করেছিল, তারই ইঙ্গিত পাই। অবশ্য শঙ্করের ‘উচ্চমার্গের’ ব্যাখ্যায় ‘অসুর’ শব্দটি ঐহিক ভোগাসক্তি মূলক মনোবৃত্তির পরিচায়ক, ‘দেব’ শব্দের অর্থ হল দ্যুতিময় অর্থাৎ জ্ঞানালোকের দীপ্তি, ঐহিক ভোগবিলাসের ঊর্ধ্বে জ্ঞান অনুসন্ধানী সাত্ত্বিক মনোবৃত্তির পরিচায়ক।

বৃহদারণ্যক উপনিষদে যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মতত্ত্বে জ্ঞানদানের প্রসঙ্গে বললেন: ‘আত্মা থেকে প্রজ্ঞান বা চৈতন্যকে আলাদা করা যায় না। সমগ্র প্রজ্ঞানঘন এই আত্মা ভৌতিক দেহ থেকেই উৎপন্ন হয়, আবার ভৌতিক দেহের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বিনাশপ্রাপ্ত হয়, তাই মৃত্যুর পর আর জ্ঞান বা চৈতন্য বলে কিছু থাকে না’। এই বক্তব্য চার্বাকমতের সাথে তুলনীয়। মৃত্যুর পর চৈতন্য বিলুপ্ত হয়, এই কথাটি শঙ্করের পছন্দ না হলেও, ন্যায়বৈশেষিক এবং অনেক মীমাংসকরা লুফে নিয়েছেন। কুমারিলের মতে, মুক্তি একটি অভাবাত্মক বা নঞর্থক ধারণা। সোজা কথায়, চেতনাহীন মুক্ত আত্মাগুলি জড়পিণ্ডের মতো ঘুরে বেড়ায়। আত্মাকে একেবারে ছেড়ে দিতেও অনীহা! এখানে চার্বাক সম্প্রদায় কিন্তু সোজাসুজি বলছেন: ‘এই যদি মুক্ত আত্মার সদ্গতি হয়, তবে একটি জড়পিণ্ডে পরিণত হওয়ার জন্য জন্ম-জন্মান্তরের তপস্যার কী প্রয়োজন? সোজাসুজি স্বীকার করাই ভালো চেতনা দৈহিক প্রক্রিয়ার একটি বৈশিষ্টমাত্র। মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই চেতনার অবলুপ্তি। এই অবলুপ্তির নামই মুক্তি। সুতরাং মুক্তি একটি নঞর্থক ধারণামাত্র’।

হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়-এর একটি উপসংহার দিয়েই এই আলোচনা শেষ করব: ‘শ্রেণিভেদ-শূন্য আদিম মানবসমাজের ধর্মীয় ধারণা চার্বাকের আক্রমণের লক্ষ্য নয়। ধর্মের উৎস সন্ধান করতে হলে আমাদের সেই আদিম সমাজে ফিরে যেতে হবে। রাষ্ট্রসমন্বিত শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ধর্মীয় ধারণার চারিত্রিক পরিবর্তনের দিকে লক্ষ্য রেখে মার্কস যে মন্তব্য করেছেন, চার্বাকের বক্তব্য কিন্তু তার বহুযুগ ব্যবহিত পূর্বগামী পদধ্বনি। ভারতের এক সুপ্রাচীন ঋষির এই সংকেতবহ পদধ্বনি আমাদের মনে চকিত বিস্ময়ের চমক সৃষ্টি করে’।

ঋণ স্বীকার: ১) সুকুমারী ভট্টাচার্য – প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য ২) সুকুমারী ভট্টাচার্য – বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য ৩) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে ৪) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – লোকায়ত দর্শন ৫) Debiprasad Chattopadhyay – Science and Philosophy in Ancient India ৬) Debiprasad Chattopadhyay – History of Science and Technology in Ancient India – The Beginnings ৭) হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় – চার্বাক দর্শন

ব্যবহৃত ছবিঃ সোশ্যাল মিডিয়া সুত্রে সংগৃহীত


শেয়ার করুন

উত্তর দিন