রাজদেও গোয়ালাঃ ইতিহাস প্রতিফলিত যে জীবনে - সৌম্যজিৎ রজক

ইতিহাসের সামনে মাথা নত ক’রে দাঁড়িয়ে রয়েছি। ভারি হয়ে উঠছে স্লোগান, …“ভুলছি না, ভলবো না”! সামনে শোয়ানো ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত শ্রমিক নেতার মরদেহ। সাদা কাপড়ে ঢাকা, উপরে লাল পতাকা বিছানো। ফুলে ফুল উপচে পড়ছে। ৯২ বছর বয়সী নাকি শায়িত একটি যুবক?

ধরা যাক, তার বয়স বড়জোর বিশ! কদিন আগেই তার চোখের সামনে স্বাধীন হল দেশ। চোখের সামনে টুকরো হল দেশ। যত সাধ ছিল স্বাধীনতার, চোখের সামনে সে দেখছে, সেসব মিথ্যে কথার মতো উবে যাচ্ছে আকাশে। স্বাধীন দেশেও খিদেয় মরছে মানুষ, বেঁচে থাকছে আশ্রয়হীন। এমনই সময় বন্ধুদের মুখে মুখে একটি স্লোগান এসে পৌঁছয় তার কানে। "ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, ভুলো মত ভুলো মত"!

মরদেহ কোথায়? শোয়ানো রয়েছে যেন স্বচ্ছ দর্পন, তাতে স্পষ্ট দেখচে পাচ্ছি ইতিহাস। একটি যুবক তাড়া খেয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। বেলগাছিয়া ট্রাম ডিপোতে সে অ্যাপ্রেন্টিস মাত্র। কিছুক্ষণ আগে সেখানে হানা দিয়েছে পুলিশ। ট্রাম ডিপোর পাঁচিল টপকে ভেটেরেনারি হসপিটাল, তারপর টানটান দৌড়। এগলি-ওগলি-পথ-প্রান্তর ছাড়িয়ে সুদূর উত্তরপ্রদেশ। সেখানেও হানা, গ্রেপ্তারি এড়িয়ে হাওড়া। ফের এসে যোগ দেওয়া কাজে। ফের হানা। হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল এইবার। সোজা প্রেসিডেন্সি জেলে পাচার করে দেওয়া হল তাকে। ভেতরে আগে থেকেই শ’তিনেক রাজবন্দী মজুত। সকলেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মী। যুবকটি কিন্তু আরসিপিআই-এর সদস্য, তার সাথে জেলে ঢুকলেন সেই দলেরই আরও ১২-১৩জন। এঁরা সদ্য স্বাধীন দেশে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সমাধা করতে গেছিলেন! আর, বলাই বাহুল্য, ব্যর্থ হয়েছিলেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রয়াসে।

মরদেহ কোথায়? শোয়ানো রয়েছে যেন স্বচ্ছ দর্পন, তাতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি ইতিহাস। প্রেসিডেন্সি জেলের ভিতরে ধুন্দুমার কাণ্ড বেঁধেছে। কমিউনিস্ট পার্টির প্রায় অধিকাংশ সংগঠককে যেহেতু জেলে বন্দী করে রেখেছে স্বাধীন দেশের পুলিশ। অল্প কয়েকজন যাঁরা গ্রেপ্তারি এড়িয়ে বাইরে রয়েছেন, তাঁরাও প্রকাশ্যে কাজ করতে পারছেন না। শ্রমজীবী জনতার ওপরে হামলা তো থেমে নেই, অথচ বাংলাজুড়ে থমকে রয়েছে গণআন্দোলনের গতি। কমিউনিস্টদের জেলে আঁটকে লড়াই আন্দোলন এভাবে স্তব্ধ করে দেবে শাসক? তা হতে দেওয়া যায় না। তাই জেলের ভেতরই সংগ্রামের পরিকল্পনা, প্রস্তুতি ও বাস্তবায়ন। রাজবন্দীদের ওপর নামিয়ে আনা হামলার বিরুদ্ধে, বিনা প্রতিরোধে অত্যাচারের বিরুদ্ধে বার্তা দিতে।

সক্কালবেলা সমস্ত রাজবন্দী উঠে গেছেন একটি ওয়ার্ডের দোতলার ছাদে। সিঁড়িগুলোকে তাঁরা অবরুদ্ধ করেছেন বন্দীদের জন্য বরাদ্দ লোহার খাট, চেয়ার, টেবিলগুলি দিয়ে। প্রত্যেকের ব্যবহার্য মাটির কলসী, গ্লাস, ওষুধের শিশি, বোতল সব জড়ো করা হয়েছে উপরে। যেহেতু জেল-কিচেনের দখল ছিলো বন্দীদেরই হাতে তাই প্রচুর লঙ্কাগুঁড়ো জড়ো করতেও কোনও সমস্যাই হয়নি। বন্দীদের এই বেয়াদপি বন্ধ করার জন্য জেলপুলিশ সিঁড়ি দিয়ে ওঠার চেষ্টা করলে বন্দীরা লঙ্কাগুঁড়ো, শিশি, কাচের বোতল ইত্যাদি ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারতে শুরু করেছে তাদের উদ্দেশ্যে। এদিকে জেলের ভেতর সশস্ত্র পুলিশ বা সেনার প্রবেশ আইনত নিষিদ্ধ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রন করার জন্য কেন্দ্রিয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী বল্লবভাই প্যাটেলের বিশেষ অনুমতি নিয়ে দুপুর ২টো নাগাদ জেলে সশস্ত্র পুলিশ ঢোকানো হলো। সাথে ঢুকলো দমকলের প্রায় ৬টি গাড়ি। শুরু হলো জেলের প্রশস্ত মাঠ থেকে ছাদ লক্ষ্য ক’রে গুলিবর্ষণ। ছাদের মেঝেতে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন সকলে। এভাবেই চলল আত্মরক্ষা ঘন্টা দুয়েক। পুলিশ একদিকে টানা ফায়ারিং করে চলেছে, আরেকদিকে দমকলের লোকেরা শুরু করেছে প্রেসিডেন্সি জেলের মোটা দেওয়াল কাটার কাজ। দু’পাশের দেওয়াল কেটে বড়ো বড়ো ছিদ্র তৈরি করা হলো, যা দিয়ে মুহুর্মুহূ চার্জ করা হতে থাকলো টিয়ার গ্যাসের সেল। বিকেল ৪টে নাগাদ বন্দীরা পিছোতে পিছোতে সকলে একটা ছোট্ট ঘরে সেঁধিয়ে গেছেন। পিছু হটারও আর জায়গা নেই। উপরে উঠে ছাদের দখল নিয়েছে পুলিশ। বেধড়ক মার, পুলিশের মার্চপাস্ট। জখম অনেকে। লাইন দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নামানো হয়েছে বন্দীদের। স্ট্রেচারে করে নামানোর সময় সিঁড়ির ওপর থেকে ছুঁড়ে দিতে লেগেছে পুলিশ। সামনে শোয়ানো আয়না; স্বচ্ছ দর্পন। তাতে প্রেসিডেন্সি জেলের সিঁড়ি ভেসে যাচ্ছে রক্তে।

তারপর টানা ৫৬ দিনের অনশন শেষে জেল কর্তৃপক্ষ মেনে নিতে বাধ্য হয় রাজবন্দীদের দাবি। জেলের বাইরে ছড়িয়ে পড়ে সংবাদ, বিপুল উন্মাদনা তৈরি হয়ে যায় রাজ্যজুড়েই। কয়েকদিন পরে ছাড়া পান অনেকে। সেই যে যুবকটি, সেও ছাড়া পায়। ১৯৫১ সাল। ক’দিনের মধ্যেই আবার অ্যারেস্ট। আবার জেল। ’৫২-তে ফের মুক্ত হয়ে ফিরে যায় বাড়ি।

এখন কিন্তু আর পুরনো দলে নেই, জেলের অভিজ্ঞতা আর সহবন্দীদের সাথে আলাপচারিতা তার রাস্তা খানিক পালটে দিয়েছে। জেলের ভেতরেই কাকাবাবু দিয়েছেন নির্দেশ, সেইমতো কাশিপুর-বেলগাছিয়া চত্বরে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে হবে এবার রাজদেও গোয়ালাকে।

কলকাতা তখন শিল্পনগরী। কাশিপুর-বেলগাছিয়ার তল্লাটজুড়ে একের পর এক কলকারখানা। লাখো শ্রমিকের বসতি, মহল্লা। এই শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে তুলতে হবে, কিন্তু তেমন অভিজ্ঞতা কোথায়? তাছাড়া পরিবেশ-পরিস্থিতিও বেগতিক। লক্ষ্মী সেনকে সাথে নিয়ে তিনি চলে গেলেন বেলগাছিয়া গ্লাস ফ্যাক্টরিতে শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ার কাজে। এই কারখানায় কর্মরতদের ৮৫%ই ছিলেন অবাঙালী। পরিযায়ী। শ্রমিকরা এই কারখানায় শোষিত হতেন প্রায় মধ্যযুগীয় ধাঁচাতেই। চেতনা এতটাই অনুন্নত ধরণের ছিলো যে নিজেদের প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতেও পারতেন না। ফলে মালিকদের শোষণের বিরোধিতা করা দূরে থাক, মালিককেই মাই-বাপ মানতেন। ফি বছর দুর্গা পুজোর সময় মালিক একটা করে গামছা দিয়ে দিতেন, শ্রমিকরাও রীতিমতো ধুনুচি নিয়ে পুজো করতেন মালিকের। এমনই শ্রমিকদের কাছে গিয়ে মালিকের বিরুদ্ধে ইউনিয়ন গড়ার কথা বললেন অনভিজ্ঞ দুই ট্রেড ইউনিয়ন কর্মী। ফল যা হওয়ার, তাই হলো। শ্রমিকেরা রীতিমতো লাঠি সোটা নিয়ে তাদেরকে মারতে উদ্যত হলেন। একদিন তো আস্ত ইঁট ছুড়ে মারলেন শ্রমিকরা রাজদেও গোয়ালার বুকে। ইতিহাস মাঝে মাঝে তাজ্জব বানিয়ে দেয় আমাদের। তাজ্জব বনবেন না, যদি শোনেন, কয়েক মাসের মধ্যে সেই শ্রমিকরাই ইউনিয়নবদ্ধ হয়ে উঠেছিলেন এঁদের নেতৃত্বে? আঁজ্ঞে, এটাই ঘটেছে!

একদিন ঘটেছে কী, ইউনিয়ন অফিসে বসে আছেন রাজদেও। কারখানার গেট থেকে বেরিয়ে বিড়ি খেতে খেতে নিজের খেয়ালেই এক শ্রমিক এগিয়ে আসছিলেন। মুন্সি রাজা তাঁর নাম। কারখানার গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা এক পুলিশ অফিসার কষিয়ে একটা চড় মারলেন তাকে। আচমকাই। আসলে একজন মজুর তাঁর সামনে দিয়ে বিড়ি খেতে খেতে গটগট করে হেঁটে যাচ্ছে, এটা পুলিশ অফিসারের আত্মমর্যাদায় আঘাত করেছিল খুব। ইউনিয়ন অফিসে বসে এই দৃশ্য দেখে অকুস্থলে ছুটে আসেন রাজদেও। সোজা কলার চেপে ধরেন পুলিশ অফিসারটির। কী ভেবেছেন কী তিনি? ইউনিয়নের নেতার এই প্রতিক্রিয়া দেখে দল বেঁধে ছুটে আসেন শ্রমিকেরাও, হাতে হাতে রড নিয়ে। অতঃপর নেতাকেই সামাল দিতে হয়। শ্রমিকরা শান্ত হন, কিন্তু পুলিশ অফিসারটিকে ক্ষমা চাইতে হবে। এই গণ্ডগোলের জন্য মুন্সি রাজাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ থানায় নিয়ে গেলে রাজদেও গোয়ালাও সাথে যান। দল বেঁধে শ্রমিকেরাও থানায় পৌঁছে যান। ক্ষানিকক্ষনের মধ্যেই থানায় ঢোকেন ইউনিয়নের সভাপতি গণেশ ঘোষও। সেদিন হার মানতে হয়েছিল পুলিশকে। এদিকে ব্যাপারটা গ্লাস ফ্যাক্টরির মধ্যে আঁটকে থাকলো না। পাশাপাশি অঞ্চলের অন্যান্য কারখানার শ্রমিকরাও গ্লাস ফ্যাক্টরির গল্প শুনে উপলদ্ধি করলেন ইউনিয়নবদ্ধতার জোর। তার প্রয়োজনীয়তা।

এরপর একে একে অ্যাঞ্জেলো ব্রাদার্স, উষা অটোমোবাইল, ডিব্বাকল, ইলেক্ট্রিক কর্পোরেশন, ব্যাটারি কারখানা সহ প্রতিটি কারখানাতেই গড়ে ওঠে ইউনিয়ন। এমনি এমনি না, কোনো বাহ্যিক সহায়ক শক্তির মদতেও না। কারখানার পর কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে ওঠে নিজের মাজার জোরেই। ইউনিয়নের জন্য ইউনিয়ন না, শ্রমিকদের সংগ্রামের জন্য ইউনিয়ন। একের পর এক কারখানায় দাবি উত্থাপন, লড়াই, প্রয়োজনে ধর্মঘট অব্দি সংগ্রাম আর দাবি আদায় অব্দি পড়ে থাকা। শ্রমিক আন্দোলনের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয় গোটা এলাকা। মজবুত এক কমিউনিস্ট পার্টিও প্রতিষ্ঠিত হয়।

ও হ্যাঁ, বলতে ভুলেছি, ইতিমধ্যে কাকাবাবুর নির্দেশেই পার্টির জেলা পরিষদ সদস্য রমেন ব্যানার্জি এসে কমিউনিস্ট পার্টিতে অন্তর্ভুক্তির ফর্মে সই করিয়ে নিয়েগেছেন রাজদেও গোয়ালাকে। পার্টি সদস্যপদ পেয়েছেন তিনি ’৫৩ সালেই।

বাংলা উত্তাল তখন ’৫২-’৫৩-র খাদ্য আন্দোলনে। ’৫৩-র ৩রা জুলাই এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে জনগনের প্রত্যক্ষ প্রতিরোধ শুরু হয়ে যায় কলকাতায়। প্রথম দিনেই গ্রেপ্তার হয়ে যান জ্যোতি বসু সহ ৫৮৮ জন। ১৪৪ ধারা ভেঙে বেলগাছিয়া মোড়ে সভা করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন রাজদেও গোয়ালাও। ১৫দিনের জেল হেফাজত শেষে মুক্ত হয়েই সেন্ট্রাল অ্যাভিন্যুতে বিক্ষোভে সামিল। ফের গ্রেপ্তার। এইরকমটা চলতেই থাকে। ইতিহাস উথালপাথাল করে সংগ্রামে সংগ্রামে ঢেউয়ে।

আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছি, মাথা নত। আসলে তা আমাদের নেতার মরদেহ। আগেরদিনই রাজ্য নির্বাচন কমিশনের দপ্তরে বিক্ষোভে সামিল হতে গিয়ে কমরেডরা গ্রেপ্তার হয়েছেন দফায় দফায়। ২৯শে ডিসেম্বর ২০২১। এত হামলা, এত আক্রমন, এত অন্ধকার থরে থরে সাজানো চারপাশে! কোথাও কি আলো নেই? আলোর সন্ধান করছি তো আমরা হাতড়ে পাতড়ে! এখনই আয়নার সামনে দাঁড়ানোর সময়, যেখানে প্রতিফলিত হয়েছে ইতিহাস। সেখানে রসদ আছে। পথ কেটে, পথ খুঁজে, পথ বানিয়ে নেওয়ার হিম্মত আছে। আঁজলা ভরা ফুল ছড়িয়ে দিয়ে দুই হাতে সে হিম্মত সঞ্চয় করব না কেন? জুটিয়ে নেব না কেন আত্মবিশ্বাস?

ফলত কোনো ব্যক্তি নায়কের গল্প নয়, রাজদেও গোয়ালাকে নিয়ে লেখা যেকোনো আখ্যানই শেষমেষ হয়ে উঠবে ইতিহাসকে ফিরে পড়বার একটি প্রয়াস। ব্যক্তির স্মৃতি আওড়ানোর বদলে হয়ে উঠবে আমাদেরই যৌথ স্মৃতিচারণা। আমাদের। আমাদের লড়াইয়ের।

সেই যে সেবার, বেজায় যুদ্ধ লাগল সীমান্তে। চীন-ভারতের। জাতীয়তাবাদের জিগিরে ফিকে হয়ে গেল জনতার খাদ্য ও বস্ত্রের অভাব অনটনের কথাগুলি। এমনকি, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির শীর্ষনেতারাও অনেকেই সেদিন গা ভাসালেন জাতীয়তাবাদী নেতাদের ‘দেশরক্ষা’র ডাকে। আপাতত শ্রমিক-কৃষকের খাওয়া-পরা সংক্রান্ত অভাব-অভিযোগ, দাবি-দাওয়া, লড়াই-আন্দোলন সব স্তগিদ রাখা হোক। আপাতত “চীনা আক্রমণকারীদের হাত থেকে” দেশকে বাঁচানোর সংগ্রামকে শক্তিশালী করার জন্য কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের লেজুড়বৃত্তি করার প্রস্তাব করলেন তাঁরা। পার্টির বিপ্লবী অংশের নেতা-কর্মীরা সঙ্গতকারণেই মেনে নিতে পারেননি এই লাইন। তর্ক বাঁধে পার্টির ভেতরে। সে দ্বন্দ্ব এমনই তীব্র আকার ধারণ করে যে ১৯৬৪ সালের ১১ই এপ্রিল তেনালিতে পার্টির জাতীয় পরিষদের সভায় পার্টি নেতৃত্বের সংশোধনবাদী রাজনৈতিক লাইন এবং সংগঠনকে দখল করার জন্য নেতৃত্বের দক্ষিণপন্থী সাংগঠনিক লাইন নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক হয়। শেষে ৩২জন সদস্য জাতীয় পরিষদ থেকে বেরিয়ে আসেন। রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে। পরদিন মানে ১২ তারিখ। প্রমোদ দাশগুপ্ত ফিরে এসেছেন কলকাতায়। টালিগঞ্জে প্রশান্ত সূরের বাড়িতে তাঁর সাথে কিছু জরুরি কথাবার্তা সেরে কৃষ্ণপদ ঘোষ, লক্ষ্মী সেন ও রাজদেও গোয়ালা ফিরে আসছেন। একই বাসে উঠেছেন তিনজন, ফিরবেন একই দিকে। শহরের উত্তর মুখে। এত রাতে কোথায় কী ব্যবস্থা করা যাবে? রাতটুকু বাড়িতে কাটিয়ে ভোরবেলায় আণ্ডারগ্রাউণ্ডে চলে যেতে হবে, এই সিদ্ধান্ত নিয়ে মানিকতলায় বাস থেকে নেমে গেলেন লক্ষ্মী সেন। রাজদেও গোয়ালাও গেলেন তাঁর বাড়ি। সেখান থেকে নিজের বাড়ি যাবেন। কিন্তু তারই মধ্যে ঘটলো বিপত্তি। লক্ষ্মী সেনের বাড়ি থেকে বেরিয়েই রাজদেও দেখলেন, ইতিমধ্যে প্রায় ছয়-সাতজন পুলিশ জড়ো হয়ে গেছে। অর্থাৎ কংগ্রেসী পুলিশ ভোর অব্দিও সময় দিলো না তাদের। পুলিশের নজর এড়িয়ে কোনও মতে সেখান থেকে কেটে পড়লেন তিনি। সোজা হাঁটা দিলেন নিজের বাড়ির দিকে। রাজদেও গোয়ালা নিজের বাড়ি ঢোকার খানিক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির লক্ষ্মী সেনের ছেলে। বাবা দোতলার জানালার শিক বেঁকিয়ে নেমে গেছেন পাইপ বেয়ে। তলায় খাটা পায়খানার ট্যাঙ্ক ছিলো, সেখানেই গা ঢাকা দিয়েছেন। এক্ষুণি আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে হবে রাজদেও গোয়ালাকেও। অবিলম্বে নিরাপদ ডেরায় পাঠাতে হবে লক্ষ্মী সেনকে।

মোবাইল-হোয়াটস্‌অ্যাপহীন সে সময়, সেই দুর্ধর্ষ রাত্রি। আন্ডারগ্রাউন্ডের ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বে অলক মজুমদার, যোগাযোগ করা হলো তাঁর সাথে। রাতের আঁধারকে চাদরের মতো মুড়ি দিয়ে যেখানে লুকিয়ে আছেন লক্ষ্মী সেন, তার সামনের রাস্তা দিয়ে গাড়ি সোজা চলে গেলো বিটি রোডের দিকে। গাড়ি যাওয়ার সিগনালে মাটির ওপর উঠে এলেন তিনি, ইউ টার্ণ নিয়ে ফিরে এলো গাড়ি তৎক্ষণাৎ। উঠে পড়লেন চলন্ত গাড়িতে। পুলিশ কিছুই বুঝতেও পারলো না, লক্ষ্মী সেনকে নিয়ে গাড়ি চলে গেলো শোভাবাজারের দিকে। এক হিন্দুস্তানি সিকিউরিটি গার্ডের ছোট্ট থাকার জায়গা, কটা দিন সেখানেই আত্মগোপন পালা। ওদিকে ততক্ষণে বাস থেকেই গ্রেপ্তার হয়ে গেছেন কৃষ্ণপদ ঘোষ। এদিকে রাত্রি দু’টোর সময় আত্মগোপনে চলে যেতে হয়েছে রাজদেও গোয়ালাকেও।

সে এক দুর্ধর্ষ সময়। কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠকরা ছিলেন সাধারণ মানুষের আপনার জন। গরিব-শ্রমজীবি জনতার সাথে পার্টি কর্মীদের সম্পর্ক ছিলো এতটাই নিবিড় যে রাতবিরেতে যেকোনো মানুষের বাড়ি গিয়ে কড়া নাড়লেই কমিউনিস্টরা ঠাঁই পেতেন সেই বাড়িতে। এত রাতে কেন এসেছেন, কী উদ্দেশ্য, এঁকে ঠাই দিলে কোনও বিপদ আসবে কিনা বাড়িতে এইসব সাত পাঁচ না ভেবেই মানুষ আশ্রয় দিতেন পার্টির নেতা কর্মীদের। পার্টির নেতা কর্মীরা এতটাই ‘ঘরের লোক’ ছিলেন। এভাবেই বারেবারে ঝড়ঝাপ্টার সময় জনগন মা-পাখির মতো বিপুল ডানা দিয়ে আগলেছেন কমিউনিস্টদের; তারাও যে ছিলেন শিশু-পাখির মতনই অবিকল। কত রাত এভাবে পাড়া-প্রতিবেশী, শ্রমিকদের ঘরে কাটিয়েছেন রাজদেও গোয়ালা, তার ইয়ত্তা নেই।

একবার আণ্ডারগ্রাউণ্ড থেকেই গ্রেপ্তার হয়ে গেছিলেন তিনি। রাজা মনীন্দ্র রায় রোড থেকে ধ’রে পুলিশের জিপ তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিল পার্কস্ট্রীট থানা। পথিমধ্যে পুলিশ জানতে চাইল, খানিক বিভ্রান্তি বশতই, “আপনি ডাঙ্গের লোক নাকি জ্যোতিবাবুর?” পুলিশী হেফাজতে তিনি তো হেসে গড়াগড়ি যান! হাসি সামলে জবাব একটা দিয়েছিলেন অবশ্য, “আমি তো কমিউনিস্ট পার্টির লোক” –এটুকুই! আহাম্মক পুলিশ বেচারা, ছোট্ট এ বাক্যের অর্থ বুঝবে কীকরে?

আমরা বুঝতে পারি। শ্রমিকশ্রেণি ও তার পার্টির প্রতি হৃদয়ের কতটা দরদ আর আদর্শের কতটা ঋজুতা; এইভাবে গড়েপিটে নেয় একজন কমিউনিস্টকে। ইতিহাস কীভাবে সংগ্রামের আঁচে পোড়াতে পোড়াতে তাকে নির্মান করে। আর কীভাবে নিজেও নির্মিত হয় ইতিহাস। আঁধারকে কীভাবে পোড়ায় আগুন। এই ইতিহাস, এই শিক্ষা আমাদের জন্য রেখে গত ৩০ শে ডিসেম্বর প্রয়াত হলেন কমরেড রাজদেও গোয়ালা।

১৯৭০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত সিআইটিইউ-এর প্রতিষ্ঠা সম্মেলন থেকে যিনি ছিলেন সর্বভারতীয় ওয়র্কিং কমিটি সদস্য। গোড়া থেকেই রাজ্য সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য। পর্যায়ক্রমে ছিলেন সিআইটিইউ কলকাতা জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতিও। ১৯৬৪-তে সিপিআই(এম) গঠনের পর ’৬৫-তে কলকাতা জেলার প্রথম সম্মেলন থেকে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য। পার্টি রাজ্য কমিটির সদস্য। দীর্ঘ দীর্ঘদিন এইসব সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করেছেন রাজদেও গোয়ালা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার সদস্যের দায়িত্বও পালন করেছেন।

আর এইসবকিছুর বাইরেও নিজেকে পুড়িয়ে পুড়িয়ে আলো জুগিয়ে গেছেন খেটেখাওয়া মানুষের দিন-প্রতিদিনের লড়াইতে। সংগ্রামে। খাদ্য আন্দোলন থেকে জরুরি অবস্থা বেয়ে পার্টির ভেতরে কখনো শোধনবাদের বিরুদ্ধে, কখনো সংকীর্ণতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াই লড়েছেন আজীবন। কাগজে-কলমে নয়, রীতিমতো গায়ে-গতরে। কংগ্রেসী গুণ্ডা থেকে পুলিশ কিংবা নকশালদের সশস্ত্র হামলার বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ শারীরিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন নেতৃত্বদানকারী ভূমিকায়।

যুদ্ধক্ষেত্রে আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে অন্যতম একজন সেনাপতি চলে গেলেন। আমরা কী করব এখন? আঁধার সময়ে হতাশায় গা ঢাকা দিয়ে ঘরে ফিরে যাব? তাই হতে পারে কখনো?

আমরা দাঁড়িয়েই থাকব। মাথা নত, তবু শিরদাঁড়া টানটান ক’রে। ইতিহাসসূত্রে প্রাপ্ত হিম্মতে প্রস্তুতি নেব আগামী সমরের। ইতিহাসের কাছে শেখার অনেক আছে, দায় এটুকুই।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন