মৃদুলা মুখার্জি/আদিত্য মুখার্জি/সুচেতা মহাজন
দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, ১৩ অক্টোবর,২০২১,আমাদের জানায় যে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং দাবি করেছেন যে "সাভারকারের বিরুদ্ধে প্রচুর মিথ্যা ছড়ানো হয়েছিল।বারবার বলা হয় যে তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে একাধিক ক্ষমা প্রার্থনা করে আবেদন করেছিলেন। সত্য হল তিনি তার মুক্তির জন্য এই আবেদনগুলি দায়ের করেননি।সাধারণত একজন বন্দীর মুক্তি প্রার্থনা করে আবেদন করার অধিকার থাকে। মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, আপনি মুক্তির আবেদন করুন।গান্ধীর পরামর্শেই তিনি করুণার আবেদন করেছিলেন। এবং মহাত্মা গান্ধী আবেদন করেছিলেন যে সাভারকরকে মুক্তি দেওয়া হোক।তিনি বলেছিলেন যে আমরা যেভাবে শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার আন্দোলন চালাচ্ছি, সাভারকরও তাই করবেন।" রাজনাথ আরও বলেন যে “অনেকের মতের পার্থক্য থাকতে পারে, তবে তাকে(সাভারকার) অবজ্ঞার সাথে দেখা ঠিক নয়। তার দেশের জন্য অবদানকে অবমাননা করার কাজ বরদাস্ত করা হবে না।” (হুমকি লক্ষ্য করুন। গডসের মন্দির স্থাপন এবং তার বীর-পূজা করা সহ্য করা যায় তবে সাভারকারের সমালোচনা করা যাবে না!)
সত্যটা কী ?
রাজনাথ সিংয়ের বিবৃতিটি সম্ভবত ১৯২০ সালের একটি নথির উপর ভিত্তি করে: ভিডি সাভারকার এবং গণেশ সাভারকারের ভাই এনডি সাভারকারের কাছ থেকে গান্ধীজির কাছে একটি চিঠি, গান্ধীজির উত্তর এবং গান্ধীজির ইয়ং ইন্ডিয়াতে একটি নিবন্ধ।
ঘটনাগুলি রাজনাথ সিংয়ের দাবির থেকে কিছুটা ভিন্ন।বিনায়ক দামোদর সাভারকর নয় বছর আগে ১৯১১ সালে,তার দোষী সাব্যস্ত হওয়ার ছয় মাসের মধ্যেই প্রথম ক্ষমাভিক্ষার আবেদন দায়ের করেছিলেন,এবং পরবর্তী বছরগুলিতে আরও অসংখ্য আবেদন করা হয়েছিল,এবং এমন কোন প্রমাণ বা দাবি নেই যে এগুলোর ক্ষেত্রে গান্ধীজির পরামর্শ ছিল! সাভারকারের এরকম একটি আবেদন যেটি হোম মেম্বার স্যার রেজিনাল্ড ক্র্যাডককে ব্যক্তিগতভাবে জমা দেওয়া হয়েছিল, যখন তিনি ১৯১৩ সালে আন্দামান কারাগারে গিয়েছিলেন, তার মুক্তির জন্য, ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের প্রস্তাব রেখে, সেটির থেকে উদ্ধৃতি: "সরকার যদি তাদের বহুবিধ অনুগ্রহ ও করুণাতে আমাকে মুক্তি দেয় তবে আমি সাংবিধানিক অগ্রগতি এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্যের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচারক না হয়ে পারব না যা আমার এই মুক্তির প্রধান শর্ত। আমি সরকারকে তাদের পছন্দ অনুযায়ী সবরকম সেবা করতে প্রস্তুত,যেহেতু আমার এই রূপান্তর বিবেকপূর্ণ তাই আমি আশা করি আমার ভবিষ্যত আচরণও তদনুযায়ী হবে।একমাত্র সর্বশক্তিমানই করুণাময় হতে পারে এবং তাই এই অপব্যয়ী পুত্র পিতামাতার তুল্য সরকারের দরজা ছাড়া আর কোথায় ফিরে যেতে পারে?”
প্রসঙ্গত, ২২শে মার্চ,১৯২০-তে ইম্পেরিয়াল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলে সাভারকার সমর্থক জিএস খোপার্দে সাক্ষ্য দিয়েছেন, “মিঃ সাভারকর এবং তাঁর ভাই একবার ১৯১৫ সালে এবং পরবর্তীতে ১৯১৮ সালে সরকারের কাছে আবেদন জমা দিয়েছিলেন যে তারা, যুদ্ধ চলাকালীন, মুক্তি পেলে সেনাবাহিনীতে তালিকাভুক্তির মাধ্যমে সাম্রাজ্যের সেবা করা এবং সংস্কার বিল পাশ হওয়ার পর আইনটিকে সফল করার চেষ্টা করবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে"।এই প্রসঙ্গে জবাব দিতে গিয়ে, হোম মেম্বার, স্যার উইলিয়াম ভিনসেন্ট, নিশ্চিত করেন যে: "বিনায়ক দামোদর সাভারকরের কাছ থেকে দুটি পিটিশন গৃহীত হয়েছিল - একটি ১৯১৪ সালে এবং আরেকটি ১৯১৭ সালে,পোর্ট ব্লেয়ারের সুপারিনটেনডেন্টের মাধ্যমে।প্রথমটিতে তিনি যুদ্ধের সময় সরকারকে তার সর্বোচ্চ সাধ্যমত সাহায্য করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং প্রার্থনা করেছিলেন যে সমস্ত রাজনৈতিক বন্দীদের সাধারণভাবে ক্ষমা করা হোক। দ্বিতীয় আবেদনটি পরবর্তী প্রস্তাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল”।
এইভাবে, এটা খুবই স্পষ্ট যে সাভারকর ১৯১১ থেকে ১৯২০ সালের মধ্যে অসংখ্য পিটিশন জমা দিয়েছিলেন, গান্ধীর কোনো পরামর্শ বা প্ররোচনা ছাড়াই, ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং যেকোনো ক্ষমতায় তাদের সেবা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন।সুতরাং প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর বক্তব্য যে সাভারকর স্বেচ্ছায় ক্ষমার আবেদন করেননি বরং শুধুমাত্র মহাত্মার পরামর্শে তা করেছিলেন তা প্রকৃত ঐতিহাসিক নথি থেকে প্রমাণিত হয় না।
তাহলে এই গোটা ঘটনায় গান্ধীজি আসেন কোথায়? শুধুমাত্র ১৯২০ সালে, যখন কারাগারে থাকা দুই সাভারকার ভাইয়ের ছোট ভাই এনডি সাভারকর গান্ধীজিকে তাঁর পরামর্শ চেয়ে চিঠি লিখেছিলেন, যখন তিনি দেখতে পান যে ব্রিটিশদের রাজকীয় ঘোষণার অধীনে মুক্তিপ্রাপ্ত বন্দীদের তালিকায়(Royal Proclamation of Clemency)তার ভাইদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। গান্ধীজি উত্তর দিয়েছিলেন যে পরামর্শ দেওয়া কঠিন কিন্তু তিনি একটি সংক্ষিপ্ত আবেদনের খসড়া তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছিলেন।এছাড়াও, তিনি ২৬ মে, ১৯২০ সালে ইয়ং ইন্ডিয়াতে 'সাভারকার ব্রাদার্স' শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন, যেখানে তিনি রয়্যাল প্রক্লেমেশন অফ ক্লিমেন্সির কথা উল্লেখ করেন এবং উল্লেখ করেন যে এর অধীনে অন্যান্য অনেক রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দেওয়া হলেও সাভারকার ভাইদের মুক্তি দেওয়া হয় নি।
তিনি বলেন, "দুই ভাইই তাদের রাজনৈতিক মতামত ঘোষণা করেছেন এবং উভয়েই বলেছেন যে তারা কোন বিপ্লবী ধারনা পোষণ করেন না এবং যদি তাদের মুক্ত করা হয় তবে তারা সংস্কার আইনের অধীনে কাজ করতে চান…" (১৯১৯ সালের ভারত সরকার আইন) “তারা উভয়েই দ্ব্যর্থহীনভাবে বলে যে তারা ব্রিটিশ সংযোগ থেকে স্বাধীনতা চায় না। বরং তারা মনে করে যে ব্রিটিশদের সাথে থেকেই ভারতের ভাগ্য সবচেয়ে ভালো করা যেতে পারে।”
উল্লেখ্য যে গান্ধীজীর নিবন্ধে কোথাও সাভারকারের মুক্তির আবেদন নেই, যেমনটি প্রতিরক্ষা মন্ত্রী বলেছেন, "মহাত্মা গান্ধী আবেদন করেছিলেন যে সাভারকরকে মুক্তি দেওয়া হোক।" গান্ধীজি তাদের মুক্তি না দেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন কারণ তারা "জননিরাপত্তা" বা "রাষ্ট্রের জন্য বিপদ" বলে মনে হয় নি, কিন্তু ব্রিটিশদের কাছে আবেদন করেন নি।বা গান্ধীজি কোথাও তাঁর প্রবন্ধে বলেন নি, যেমন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী দাবি করেছেন, "আমরা যেভাবে শান্তিপূর্ণভাবে স্বাধীনতার আন্দোলন চালাচ্ছি, সাভারকরও তাই করবেন।" বরং, গান্ধীজি জোর দিয়েছেন যে সাভারকর ভাইরা স্বাধীনতা চান না, এবং সংস্কার আইনের অধীনে কাজ করতে চান।
এই পুরো পর্বে একটা অদ্ভুত বিড়ম্বনা আছে। মহাত্মা গান্ধীকে সাভারকারের জাতীয়তাবাদী পরিচয়পত্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাক্ষী করে দেওয়া হচ্ছে, তাও এমন দুর্বল যুক্তির ওপরে ! জনসাধারণের মনে একটি ছবি তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে যে গান্ধীজি এবং সাভারকারের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এমন পরিমাণে যে সাভারকার ক্ষমার আবেদনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গান্ধীজির পরামর্শ গ্রহণ করেছিলেন এবং গান্ধীজি তার মুক্তির জন্য আবেদন করেছিলেন।এটি সাভারকারের করুণার ভিক্ষাকে স্বাভাবিক করার একটি স্পষ্ট প্রয়াস যখন অন্যান্য অনেক জাতীয়তাবাদী তা করতে অস্বীকার করেছিলেন এবং এমনকি গান্ধীজি নিজের জন্য কঠোরতম শাস্তি দাবি করেছিলেন।
ঘটনা আসলে কী যা আমাদের ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে?
১৯৪৮ সালের জানুয়ারিতে,যখন গান্ধীকে হত্যা করা হয়, সাভারকারকে ষড়যন্ত্রের মূলচক্রী হিসেবে সন্দেহ করে গ্রেপ্তার করা হয়।সর্দার প্যাটেল,যিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে পুরো মামলার তত্ত্বাবধান করছিলেন, একজন বিচক্ষণ ফৌজদারি আইনজীবী হিসেবে,ব্যক্তিগতভাবে সাভারকারের অপরাধ সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন, অন্যথায় তিনি তাকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে রাজি হতেন না।তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছিলেন, ‘এটি সরাসরি সাভারকারের অধীনে হিন্দু মহাসভার একটি কট্টরপন্থী শাখার দ্বারা নির্ধারিত একটি ষড়যন্ত্রটি ছিল এবং গোটা বিষয়টা নজরে রেখেছিল'।(দুর্গা দাস, সর্দার প্যাটেল পত্রাবলী, ১৯৪৫-৫০, খণ্ড ৬,পৃ. ৫৬।)
হিন্দু মহাসভার অস্বীকৃতির প্রতিক্রিয়ায়, প্যাটেল ৬ মে, ১৯৪৮-এ হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জিকে লিখেছিলেন: “…আমরা এই সত্যটি থেকে চোখ বন্ধ করতে পারি না যে মহাসভার একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সদস্য এই ট্র্যাজেডির জন্য আনন্দিত হয় এবং মিষ্টি বিতরণ করে। এছাড়া, জঙ্গি সাম্প্রদায়িকতা, যা মহন্ত দিগ্বিজয় নাথ, প্রফেসর রাম সিং এবং দেশপান্ডের মতো ব্যক্তিদের সহ মহাসভার অনেক মুখপাত্র দ্বারা মাত্র কয়েক মাস আগে পর্যন্ত প্রচার করা হয়েছিল, সেটিকে জননিরাপত্তার জন্য বিপদ হিসাবে বিবেচনা না করে উপায় নেই।RSS-এর মত একটি সংস্থা যারা গোপনে সামরিক বা আধা-সামরিক লাইনে সংগঠন পরিচালনা করে তাদের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য হবে।” (সর্দার প্যাটেল পত্রাবলী, খন্ড ৬, পৃ. ৬৬।)
প্যাটেল শ্যামা প্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে আরো জানান যে, 'আরএসএস-এর কার্যকলাপ সরকার এবং রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য একটি স্পষ্ট বিপদ তৈরি করেছে'। (জুলাই ১৮, ১৯৪৮, সর্দার প্যাটেল পত্রাবলী, খন্ড ৬, পৃ. ৩২৩।)
বোম্বাইয়ের মুখ্যমন্ত্রী বিজি খের প্যাটেলকে মহারাষ্ট্রের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেছিলেন, 'হিন্দু মহাসভা কংগ্রেস এবং মহাত্মার বিরুদ্ধে ঘৃণার পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিল যা পরিণতি পায় কিছু মহারাষ্ট্রীয়দের হাতে মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার মধ্য দিয়ে।(বি জি খের কর্তৃক প্যাটেলকে লেখা পত্রাবলী, মে ২৬, ১৯৪৮, ঐ., খন্ড ৬, পৃ. ৭৭-৭৮।)
ফৌজদারি আইনের একটি প্রযুক্তিগত কারণে: অনুমোদনকারীর সাক্ষ্যকে সমর্থন করার জন্য স্বাধীন প্রমাণের অভাবে গান্ধী হত্যার বিচারে সাভারকারকে অবশেষে দোষী সাব্যস্ত করা হয়নি।
যাইহোক, ভারতের সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, বিচারক জীবন লাল কাপুরের অধীনে ১৯৬৫ সালে গঠিত তদন্ত কমিশন অনেক প্রমাণের সন্ধান পেয়েছিল যা মূল মামলার বিচারকের কাছে উপলব্ধ ছিল না।সাভারকারের দুই ঘনিষ্ঠ সহযোগী, এ পি কাসার এবং জি ভি দামলে, যারা মূল মামলায় সাক্ষ্য দেননি, কাপুর কমিশনের সামনে মুখ খোলেন এবং অনুমোদনকারীর বিবৃতিকে সমর্থন করেন যখন সাভারকার মারা গেছেন।এটা সম্ভব ছিল যে তারা মূল মামলায় সাক্ষ্য দিলে সাভারকার দোষী প্রমাণিত হতেন।প্রকৃতপক্ষে, কাপুর কমিশন সর্দার প্যাটেলের মতোই একটি উপসংহারে পৌঁছেছিল: 'এই সমস্ত তথ্য প্রমাণ একত্রিত করলে সাভারকর এবং তার গোষ্ঠীর হত্যার ষড়যন্ত্র ছাড়া অন্য কোনও তত্ত্বের উপস্থাপনা সম্ভব নয়'। (মহাত্মা গান্ধীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট, ১৯৭০, পৃ.৩০৩, অনুচ্ছেদ ২৫.১০৬।)
গান্ধীজির হত্যার পরেই, ভারত সরকার, যার উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে সর্দার প্যাটেল আরএসএস-কে নিষিদ্ধ করে এবং এর প্রায় ২৫,০০০ সদস্যকে জেলবন্দী করে।নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হলে হিন্দু মহাসভা নিজেদের সংগঠন অবলুপ্ত করার পথ বেছে নেয়।গান্ধীজীর হত্যার সাথে তাদের যোগসূত্রে কলঙ্কিত, হিন্দু মহাসভা একটি কৌশলগত পশ্চাদপসরণ করে এবং এর প্রধান নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি ১৯৫১ সালে ভারতীয় জন সংঘ প্রতিষ্ঠা করেন।এটি তখন থেকে উগ্র হিন্দু সাম্প্রদায়িক বক্তব্যের প্রধান রাজনৈতিক বাহন ছিল, ছিল হিন্দুত্ববাদের প্রথম সারির রাজনৈতিক দল, যতক্ষণ না এটি জরুরি অবস্থার পরে জনতা পার্টিতে মিশে যায় এবং তারপরে বিজেপি দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়।
এটা সত্যিই পরিহাসের বিষয় যে, যে রাজনৈতিক শক্তিগুলো নিজেদেরকে সবচেয়ে প্রবল জাতীয়তাবাদী বলে দাবি করে, ভারতের স্বাধীনতার জন্য যখন প্রকৃত সংগ্রাম চলছে তখন তাদের কোনো ভূমিকা ছিল না।সাভারকর, ১৯২৪ সালে কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর, কখনও ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতিতে অংশ নেননি।প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন হিন্দুত্বের তত্ত্বের প্রবর্তক, যা প্রকৃত ভারতীয়দেরকে সংজ্ঞায়িত করেছিল যাদের পিতৃভূমি এবং পুণ্যভূমি, ভারতে ছিল, যার ফলে মুসলমান এবং খ্রিস্টানদের বাদ দিয়েছিল এই বৃত্ত থেকে, যাদের পবিত্র ভূমি ভারতের বাইরে ছিল।হিন্দু মহাসভা ১৯৩০ এবং ১৯৪০ এর দশকে ক্রমশ ব্রিটিশদের অনুগত হয়ে ওঠে।যদিও অনুগত প্রবণতা আগেও ছিল, তাও প্রাথমিকভাবে এর কিছু নেতা কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭ সাল থেকে, যখন সাভারকর মহাসভার সভাপতি ও অবিসংবাদী নেতা হয়ে ওঠেন , তখন থেকে সাম্রাজ্যবাদীদের টেবিল থেকে ছুঁড়ে দেওয়া রুটির টুকরো খাওয়ার জন্য তারা মুসলিম লীগের সাথে প্রতিযোগিতা শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে তাদের মতপার্থক্য প্রকাশ্যে নিয়ে আসে।যদিও কংগ্রেসের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভাগুলো ভারতীয়দের সম্মতি ছাড়াই ভারতকে যুদ্ধে একটি পক্ষ করার ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিল, হিন্দু মহাসভার নেতারা ব্রিটিশদের সহযোগিতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন এবং ভারতীয়দের যুদ্ধ-প্রয়াসে অংশগ্রহণ করার এবং সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরামর্শ দিয়েছিলেন।মহাসভার সভাপতি হিসাবে সাভারকর হিন্দুদের কাছে আবেদন করেছিলেন 'ব্রিটিশ সরকারের সমস্ত যুদ্ধ-প্রয়াসে অংশগ্রহণ করার' এবং "কিছু মূর্খ" যারা এই নীতিকে 'সাম্রাজ্যবাদের সাথে সহযোগিতা' হিসাবে "নিন্দা" করে তাদের কথা না শোনার জন্য। (সাভারকর, হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন, পৃ. ২০৩।)
ব্যক্তিগতভাবে, সাভারকর ১৯৩৯ সালের অক্টোবরে ভাইসরয়কে বলেছিলেন যে হিন্দু এবং ব্রিটিশদের বন্ধু হওয়া উচিত এবং একটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন যে কংগ্রেসের মন্ত্রিসভাগুলি পদত্যাগ করলে হিন্দু মহাসভা কংগ্রেসকে প্রতিস্থাপন করবে। (লিনলিথগো, ভাইসরয়, জেটল্যান্ডের প্রতি, সেক্রেটারি অফ স্টেট, ৭ অক্টোবর, ১৯৩৯, জেটল্যান্ড পেপারস, খন্ড ১৮, রিল নং ৬।)
এই ব্রিটিশ আনুগত্যের নীতি অনুসারেই, যখন ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলন চলছিল, এবং গান্ধীজি সহ সমগ্র জাতীয়তাবাদী কংগ্রেস নেতৃত্ব জেলে ছিল, তখন হিন্দু মহাসভার শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি বাংলায় ফজলুল হকের মন্ত্রিসভায় ছিলেন।হিন্দু মহাসভা সিন্ধ এবং এনডব্লিউএফপিতেও মুসলিম লীগের সাথে জোট সরকার গঠন করে।এটা অন্য কথা যে এই সমস্ত আনুগত্য তাদের নির্বাচনী সাফল্য এনে দিতে পারেনি এবং ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তারা পরাজিত হয়েছিল!
আরএসএসও, একটি সংগঠন হিসাবে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্তির জন্য বড় কোনো লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করেনি। আরএসএস ১৯২৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ১৯২৮ সালে সাইমন কমিশন বয়কট ছাড়াও অন্তত দুটি বড় আন্দোলন, ১৯৩০-৩৪ সালের আইন অমান্য আন্দোলন এবং ১৯৪২ সালের ভারত ছাড়ো আন্দোলন আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠার পরে কংগ্রেসের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল।এর কোনোটিতেই আরএসএস কোনো ভূমিকা পালন করেনি।হেডগেওয়ার, আরএসএস-এর প্রতিষ্ঠাতা ১৯৩০ সালে তাঁর ব্যক্তিগত ভূমিকার জন্য জেলে গিয়েছিলেন, কিন্তু তিনি সংগঠন এবং তার সদস্যদের আইন অমান্য আন্দোলন থেকে দূরে রেখেছিলেন।ব্রিটিশ সরকারের কাছে এটা খুব পরিষ্কার ছিল যে আরএসএস কে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।আরএসএস সম্পর্কে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র দফতরের একটি নোটে বলা হয়েছে যে, 'কংগ্রেসের গোলযোগের সময় (১৯৪২) সঙ্ঘের সভায় বক্তারা সদস্যদের কংগ্রেসের আন্দোলন থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানিয়েছিলেন এবং এই নির্দেশগুলি সাধারণত পালন করা হয়েছিল'।
গান্ধীজির হত্যার চার-পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে আরএসএস এবং জনসংঘ-বিজেপি শিবিরে কেন সাভারকারের বিষয়ে নীরবতা ছিল তা জিজ্ঞাসা করা অবশ্যই ন্যায্য।জনসাধারণের মনে গান্ধীজীর হত্যার সাথে সাভারকার যুক্ত থাকায় তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা কি রাজনৈতিকভাবে আত্মঘাতী ছিল, এবং এখন অনেকটা সময় কেটে গেছে, এটা ধরে নেওয়া যেতে পারে যে জনসাধারণের স্মৃতি ক্ষয়িষ্ণু এবং সাভারকার এখন পুনরুত্থিত হতে পারে?এছাড়াও, জনসাধারণের ওপর নতুন আক্রমনাত্মক পর্বের অংশ হিসাবে 'হিন্দুত্ব'-এর উপর নতুন করে জোর দেওয়ার প্রয়োজনেই, ধারণাটির মূল স্রষ্টাকে উপেক্ষা করা কঠিন ছিল।তাছাড়া, 'জাতীয়তাবাদী' বলে দাবি করা একটি দলের পক্ষে দেখানোর মত কোনও স্বাধীনতা সংগ্রামী না থাকাটা অস্বস্তিদায়ক।অতএব, জাতীয়তাবাদী প্রতিভূ খোঁজার মরিয়া প্রচেষ্টায়, সাভারকরকে সেই ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করা হয়েছিল।
সাভারকারকে ক্রান্তিবীর, আন্দামানের বিপ্লবী হিসাবে স্মরণ করে তার সাম্প্রদায়িকতার ওপর একটা জাতীয়তাবাদী আচ্ছাদন টানা হয়েছে।যে সাভারকর আন্দামানে বারবার ক্ষমা চেয়ে বিপ্লবীদের লজ্জিত করেছিলেন এবং তিনি যে ব্রিটিশ সরকারের কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সেই অনুসারে তার মুক্তির পরে কখনই কোনও জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপে অংশ নেননি, তা ভুলিয়ে দিতে চাওয়া হয়েছিল।এবং ২০০৩ সালে, যখন বিজেপি-নেতৃত্বাধীন এনডিএ সরকার ক্ষমতায় ছিল, প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও, সংসদে সাভারকারের প্রতিকৃতি স্থাপন করা হয়েছিল।কেউ বুঝবে যে সাভারকার সম্পর্কে ন্যূনতম সন্দেহ থাকলেও এমনটি হওয়া উচিত ছিল না।এবং এখন নবতম সংযোজন : মহাত্মা কর্তৃক অনুমোদিত হিসাবে সাভারকারের বিব্রতকর ক্ষমার আবেদনগুলিকে প্রচার করে স্বাভাবিক করার মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার প্রচেষ্টা! উদ্দেশ্য হল উভয়ের মধ্যে একটি ঘনিষ্ঠ এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক উপস্থাপন করা এবং এইভাবে এই সত্যটি লুকানো যে তাদের মধ্যে কোন মিল ছিল না।হিন্দুত্বের তাত্ত্বিক এবং হিন্দু মহাসভার নেতা হিসাবে সাভারকর গান্ধীজির, বিশেষ করে তাঁর অহিংসা এবং মুসলমানদের প্রতি অন্তর্ভুক্তিমূলক মনোভাবের ধারাবাহিক এবং তীব্র সমালোচক ছিলেন। ভারত কাদের এই বিষয়ের তত্ত্বায়নে এর থেকে তীব্র বৈপরীত্য হতে পারে না। সাভারকর স্পষ্টভাবে বলেছেন যে "ভারতকে অবশ্যই একটি হিন্দু ভূমি হতে হবে যা হিন্দুদের জন্যই সংরক্ষিত"।তিনি দ্ব্যর্থহীনভাবে জোর দিয়ে বলেছেন যে হিন্দুদের "আমাদের নিজের ঘরে, হিন্দুস্থানে, নিজেদের জমিতে প্রভু হওয়া উচিত"। (হিন্দু রাষ্ট্র দর্শন, পৃষ্ঠা ৯২, ৬৩)।অন্যদিকে, গান্ধীজি, ১৯৪২ সালের আগস্টে বোম্বেতে তাঁর বিখ্যাত ভাষণে যেখানে তিনি 'ভারত ছাড়ো'র ডাক দিয়েছিলেন, দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছিলেন: “যারা ডঃ মুঞ্জে এবং শ্রী সাভারকরের মতো, তরবারির মতবাদে বিশ্বাসী, সেই সমস্ত হিন্দুরা মুসলমানদেরকে হিন্দু আধিপত্যে রাখতে চায়, আমি সেই অংশের প্রতিনিধিত্ব করি না। আমি কংগ্রেসের প্রতিনিধিত্ব করি।কংগ্রেস কোনও গোষ্ঠী বা কোনও সম্প্রদায়ের আধিপত্যে বিশ্বাস করে না। কংগ্রেস গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে যার বৃত্তে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, পার্সি, ইহুদি - এই বিশাল দেশে বসবাসকারী প্রতিটি সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্তি রয়েছে… এই দেশের লাখ লাখ মুসলমান হিন্দু উৎস থেকে এসেছে।তাদের জন্মভূমি ভারত ছাড়া অন্য কিছু হতে পারে কিভাবে ?
সাভারকর এবং তার অনুগামীরা, এবং ভগৎ সিং-এর মতো বিপ্লবীরা যারা কখনও ক্ষমা না চাওয়ায়, মৃত্যু সহ সমস্ত শাস্তি ভোগ করা বেছে নেওয়ার জন্য গর্বিত বোধ করেছিল, তাদের মধ্যে কী প্রবল ফারাক আছে এটা সহজেই অনুমেয়। প্রকৃতপক্ষে প্রথম দিন থেকেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদীরা ব্রিটিশ বিরোধী কাজ করার জন্য সাহসিকতার সাথে দায়িত্ব গ্রহণ করার, বিচারের মুখোমুখি হওয়ার, জাতীয়তাবাদী লক্ষ্যগুলিকে আরও প্রচারের জন্য বিচারব্যবস্থাকে ব্যবহার করার এবং তারপর স্বেচ্ছায় কারাদণ্ড, নির্বাসন বা এমনকি মৃত্যুকে শাস্তি হিসাবে গ্রহণ করার অভ্যাস গড়ে তুলেছিল।
এটি লক্ষণীয় যে সাভারকরের বন্দিদশা থেকে মুক্তির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করার এবং ভাল আচরণের প্রস্তাব দেওয়ার অভ্যাসটি ১৯২৪ সালে ব্রিটিশ কারাগার থেকে তার মুক্তির সাথে শেষ হয়নি।গান্ধীজির হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হওয়ার তিন সপ্তাহের মধ্যে, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮-এ, তিনি আর্থার রোড কারাগার থেকে পুলিশ কমিশনারের কাছে একটি প্রতিনিধিত্ব পাঠান এবং 'সরকারকে একটি অঙ্গীকার দেওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন যে … (তিনি) সরকার চাইলে অনির্দিষ্টকালের জন্য কোনো প্রকাশ্য সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকবেন। যদি তাকে সেই শর্তে মুক্তি দেওয়া হয়'।এমনকি সবচেয়ে শক্তিশালী প্রচারকের জন্যেও এটা প্রমাণ করা কঠিন হবে যে এটিও গান্ধীজীর পরামর্শে হয়েছিল, যদি না অবশ্যই উভয়ের মধ্যে এতটা শক্তিশালী বন্ধন ছিল যে নাস্তিক সাভারকার গান্ধীজীর আত্মার সাথে যোগাযোগের দাবি করতে পারেন!