ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ, নিও পপুলিজম ও বামপন্থার বিকল্প
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/RSS-cartoon.jpg)
বাংলার নির্বাচনে বিজেপি বড় ধাক্কা খেল। এর ফলে সারা দেশে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরদ্ধে সংগ্রামরত মানুষ উৎসাহিত ও বটে। কিন্তু বিজেপি কে পরাস্ত করে যে শক্তি বাংলায় পুনরায় ক্ষমতায় এলো তাতে সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী সংগ্রাম যথেষ্ঠ প্রশস্ত হবে এ কথা বলা যায় না।মনে রাখা দরকার যে গত দশ বছরে এ রাজ্যে টি এম সি র শাসন কালে বিজেপির শক্তি বৃদ্ধি হয়েছে সব চেয়ে বেশি। বামপন্থী দের ঘায়েল করতে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত ধরা, বিজেপি মন্ত্রী সভায় অংশ নেওয়া এবং সর্বোপরি প্রশাসনিক পদক্ষেপ ও সরকারি অনুদান এবং প্রকল্পের বণ্টনে সম্প্রদায় ভিত্তিক পরিচয় ও বার্তার আমদানী এ রাজ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির উর্বর জমি তৈরি করেছে।মনে রাখা প্রয়োজন যে বিজেপি এই নির্বাচনে পরাস্ত হলেও দু কোটির বেশি ভোট পেয়েছে। যারা বিজেপি কে ভোট দিয়েছেন তারা সবাই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির সমর্থক এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। এদের বড় অংশটাই তৃনমূল শাসনে আক্রান্ত অথবা নায্য অধিকার বা প্রাপ্য র থেকে বঞ্চিত। এই নির্বাচনে তাদের অনেকে টি এম সি কে পরাস্ত করতে বিজেপি কে ভোট দিয়েছেন কারণ মনে করেছেন যে বাম বা অন্য শক্তির তুলনায় বিজেপির জয়ের সম্ভাবনা বেশী। অন্য দিকে যারা টি এম সি কে ভোট দিয়েছেন তারা তৃণমূলের কার্যক্রমে যথেষ্ঠ খুশি একথা বলা যায় না। অনেকেই মনে করেছেন যে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি কে ক্ষমতায় আসা থেকে আটকাতে হবে। সংখ্যালঘুদের বড় অংশ বিজেপির আস্ফালনে রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং চরম নিরাপত্তাহীনতার থেকে বিজেপির পরাজয় সুনিশ্চিত করতে তৃণমূলের পক্ষে রায় দেয়। সর্বোপরি বাঙালি মনে একরকম হিন্দি-হিন্দুত্ব আধিপত্যে র আতঙ্ক কাজ করেছে বিজেপি নেতৃত্বের প্রচারের আস্ফালনে। এই মেরুকরণের ফলে বামপন্থি প্রার্থীদের ভোট কমেছে। তৃণমূল বিরোধী ভোট মূলত বিজেপি তে জড়ো হয়েছে আর বিজেপি বিরোধী ভোট বড় অংশেই টি এম সি তে গেছে। দুই মেরুর মধ্যে একজনকে বেছে নিতে হবে এই রকম একটি পছন্দের কাঠামো সবচেয়ে সুবিধে করে দেয় বুর্জোয়া পার্টি গুলিকে। বিজেপি র বিরোধিতা করতে হলে তৃনমূল হতে হবে আর তৃণমূলের বিরোধিতা করতে হলে বিজেপি হওয়াই সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত মনে হবে । এই রাজনীতির মেরুকরণ চলতে থাকলে বাম বিকল্পকে ক্রমাগত অপ্রাসঙ্গিক ও অযৌক্তিক দেখাতে সুবিধা হবে। মনে রাখা দরকার যে এই নির্বাচনে বামপন্থীরা প্রায় আঠাশ লক্ষ ভোট পেয়েছে এবং জোট পেয়েছে প্রায় ছাপ্পান্ন লক্ষ ভোট। যারা বামপন্থীদের ভোট দিয়েছেন তারা দুই দক্ষিণপন্থী দলের বিরুদ্ধে তাদের মতদান করেছেন। অনেকের কাছেই এটা 'নির্বোধের’ কাজ মনে হলেও এটাই ছিল দুই শক্তির বিরুদ্ধে বিকল্প হাজির করার রাস্তা। সব সময় সব চেষ্টা সফল নাও হতে পারে, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাকে পরাস্ত করার নামে তৃণমূলে বিলীন হয়ে যাওয়াটা কোনো বামপন্থি অবস্থান হতে পারে না। এই নির্বাচনে শাসক দল ছিল তৃণমুল। তাদের কাজের জবাবদিহি চাওয়া রাজ্যের নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ। তৃণমূলের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো সে এই নির্বাচনকে একমুখিভাবে বিজেপি বিরোধী মতদানে রূপান্তরিত করতে পেরেছে।
![34 years Of LeftFront 1](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/06/5.jpg)
বামপন্থীদের কাছে বড় উদ্বেগের বিষয় হল রাজ্যের অধিকাংশ গরীব নিম্নবিত্ত মানুষের রায় দুই দক্ষিণপন্থী দলের পক্ষে গিয়েছে। পৃথিবী জুড়ে যে দক্ষিণপন্থী প্রবণতা বিরাজমান তাতেও এরকম লক্ষণ প্রকট। টমাস পিকেটির সর্বশেষ গবেষণা দেখাচ্ছে যে একুশটা পশ্চিমী দেশে এরকম একটা পরিবর্তন লক্ষণীয়। আগে উচ্চ বিত্ত ও উচ্চ শিক্ষিত ভোটাররা দক্ষিণ পন্থী দের ভোট দিত এবং নিম্ন আয় ও অল্প শিক্ষিত মানুষ মুলত বামপন্থী বা লেবার পার্টি বা সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি গুলিকে ভোট দিত। সাম্প্রতিক কালের ফলাফল দেখাচ্ছে যে গরীব ও অল্প শিক্ষিত দের ভোট দক্ষিণ পন্থীদের পক্ষে যাচ্ছে আর বামপন্থী দের ভোট মূলত শিক্ষিত লোকেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। উচচ বিত্তরা যদিও দক্ষিণ পন্থাতেই আস্থা রেখেছেন। গরীব মানুষের মধ্যে দক্ষিণপন্থী প্রবণতা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এটি ফ্যাসিবাদী রাজনীতি ও অন্যান্য দক্ষিণপন্থী শক্তির উত্থানের ইঙ্গিত বহন করে। সাধারণ ভাবে কোন দেশে ফ্যাসিবাদি শক্তি ক্ষমতায় আসে তখনই যখন একচেটিয়া পুঁজির সবচেয়ে খতরনাক অংশ একথা মনে করে যে প্রচলিত প্রতিষ্ঠান গুলির মাধ্যমে সে আর তার স্বার্থ কার্যকরী করতে পারছে না এবং সে কারণে গণতান্ত্রিক পথে ক্ষমতায় এলেও গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠান গুলোকে ধ্বংস করা তাদের পক্ষে জরুরি হয়ে পড়ে। এই উত্থানের জন্যে আর একটা প্রয়োজনীয় শর্ত হলো শ্রমিক শ্রেণীর পার্টির দুর্বলতা, সমাজের শ্রমজীবী অংশের মধ্যে সমাজতন্ত্রী রাজনীতির প্রসার ঘটাতে অক্ষম হওয়া। এর ফলে গরীব মানুষ যখন প্রচলিত গণতান্ত্রিক দলগুলির প্রতি হতাসগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন সেই শ্রমজীবীদের ফ্যাসিবাদী শক্তির পেছনে জড়ো করার কাজ সুবিধাজনক হয়ে যায়। ফ্যাসিবাদী প্রচার এলিট দের বিরুদ্ধে সাধারণ জনতার ক্ষোভ হিসেবে সংঘঠিত করা হয়। ফ্যাসিবাদী আন্দোলন ও বচনে বুদ্ধিজীবী বিরোধী, এলিট বিরোধী অবস্থান গরীব ও অল্প শিক্ষিত মানুষদের আকর্ষণ করতে থাকে। ফ্যাসিবাদী চিন্তা প্রকরণে একটি ‘জনতার’ ধারণা তৈরি করা হয়। এই জনতা ধর্ম বা বর্ণের ভিত্তিতে হতে পারে, আর তার বাইরে যারা তারা শত্রু হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই পদ্ধতিতে জনতার শত্রু ও মিত্র নির্ধারিত হয়ে যায়। হিন্দুত্ব বাদী ফ্যাসিবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনতার কাল্পনিক একমাত্রিক সংস্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি হিসেবে দেখাতে চায়। এর ভিত্তিতে তাদের হিন্দু রাষ্ট্রের কল্পনা। ফ্যাসিবাদ নেতার নিরঙ্কুশ কর্তৃত্বে বিশ্বাস করে এবং তার জনপ্রিয়তার আধারে মানুষকে সন্ত্রস্ত করে চরম সৈরাচারী শাসন চালায়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/10/660902-rss1-1024x576.jpg)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েতের নেতৃত্বে ফ্যাসিবাদী শক্তি পরাস্ত হওয়ায় এবং এক অন্ধকারময় সময়ের প্রতি ইউরোপের দেশগুলোতে এক সাধারণ বিতৃষ্ণা তৈরী হওয়ায় দক্ষিণ পন্থার এক নতুন রূপ বিভিন্ন লাতিন আমেরিকার দেশে দেখতে পাওয়া যায়। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কলম্বিয়ায় এক ধরনের কমিউনিস্ট বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসে যারা বিদেশী বহুজাতিক সংস্থার জাতীয়করণের কথা বলে এবং রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে আয়ের পুনর্বণ্টন এর মাধ্যমে গরীব মানুষের কিছু আর্থিক সুরাহার ব্যবস্থাও করে। এই ধরনের শক্তিও এক নেতার জনপ্রিয়তা নির্ভর, কোনো স্থায়ী ঘোষিত মতাদর্শের অভিমুখ নেই। কিন্তু তারা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিশ্বাসী ও ফ্যাসিবাদি দের মত সন্ত্রাস নির্ভর নয়। বরং তারা সরকারের পক্ষে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে জনমত গড়ে তোলায় বিশ্বাসী। নব্বই এর দশকে এসে এই 'পপুলিজম’এর চেহারা বদলাতে থাকে। মূল আধার টা এক থাকলেও নয়া উদারবাদী যুগে পপুলিজম এর নতুন চেহারা দেখা দিল। পেরু তে আলবার্তো ফুজিমরি এবং আর্জেন্টিনায় কার্লোস মেনেম এই নব রূপের প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রাষ্ট্রীয় পুনর্ব্টন ও বিদেশী পুঁজির বিরোধিতার পরিবর্তে সমস্ত সর্বজনীন জনকল্যাণের প্রকল্প গুলির পরিবর্তে টার্গেটেড স্কিম চালু হলো এবং ব্যাক্তিগত ও বিদেশী পুঁজির পক্ষে দরজা খুলে দেওয়া হলো। এই প্রজন্মের জনকল্যাণের প্রকল্পগুলি সমাজের বিভিন্ন খণ্ডিত অংশের জন্য পরিকল্পিত হলো যা বয়সের ভিত্তিতে বা জাত বা লিঙ্গের ভিত্তিতে বা অঞ্চল অনুযায়ী নির্ধারিত হতে পারে। এই ধরনের প্রকল্পের সুবিধে হলো যে তা সবার জন্য নয় বলে মোট সরকারী খরচ কমল যা নয়া উদারবাদী অর্থনীতির শর্ত পূরণ করলো। আবার এই ধরণের প্রকল্পে সুবিধা প্রাপকদের মধ্যে একরকম কৃতজ্ঞতার ভাব গড়ে তোলা যায় যা শাসক দলের পক্ষে ভোট জোগাড় করতে বিশেষ কার্যকরী হয়। অধিকার ভিত্তিক সর্বজনীন জনকল্যাণ মূলক কাজ এই একই রাজনৈতিক প্রতিদান তৈরি করে না। এই রাজনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো একজন নেতা জনগণের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগের মাধ্যমে কাজ করে থাকে। টেলিভিশন বা নানা নতুন প্রযুক্তির প্রচার ও সরাসরি মতামত মূল্যায়ন ব্যবস্থা এ ক্ষেত্রে গুরুত্তপূর্ণ হয়ে ওঠে। পার্টি ও প্রথাগত কমিউনিকেশন এর রাস্তাগুলি ধীরে ধীরে অপ্রয়োজনীয় হয়ে যায়।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/05/1-1024x768.jpg)
এ কথা ঠিক যে নিও পপুলিস্ট ও ফ্যাসিস্টদের মধ্যে পার্থক্য আছে বিশেষত জনতার সমর্থন গঠনে ভাওলেন্স এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োগের নিরিখে। কিন্তু পৃথিবী জুড়েই তারা যে বিষয় সমদর্শী তাহলো কমিউনিস্ট দের কোণঠাসা করার লক্ষ্যে। একারণেই জনতার কথা বললেও এই জনতা যাতে শ্রেণী ভিত্তিক ঐক্য ও সংগ্রাম গড়ে তুলতে না পারে সে বিষয় তারা সর্বদা সতর্ক থাকে। মানুষকে কখনোই অধিকার বা পারস্পরিক সম্মানের ভিত্তিতে সংঘঠিত হতে দেয় না। জনতা হয়ে ওঠে ব্যাক্তি ও গোষ্ঠীর যোগফল যেখানে ব্যাক্তি বা জনগোষ্ঠী বা কোনো অংশ নিজেদের প্রাপ্তির অংশের জন্য সরকারের সঙ্গে দর কষাকষি করবেন, তাতে তাদের কিছু আর্থিক উন্নতিও হবে কিন্তু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ব্যবহার করে একটি সম্মিলিত লক্ষ্য তৈরী করবে না। এই শ্রেণী অস্তিত্ব বিযুক্ত জনতা আসলে যে কোনো সময়ে সবচেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ফ্যাসিবাদি রাজনীতির শিকার হতে পারে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/common-man.jpg)
এ রাজ্যে তৃণমূলের উত্থান ও কার্য্য প্রক্রিয়া নিও পপুলিসট রাজনীতির প্রতিবিম্ব। এক নেত্রী, তিনি নিজেই সব কেন্দ্রে কার্যত প্রার্থী, যিনি নিসন্দেহে জনপ্রিয়, তার এলিট বিরোধী ইমেজ জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ। তীব্র বাম বিরোধীতা তার মৌলিক পরিচয়। প্রশাসন, বা সরকারি নিয়ম কানুনের তোয়াক্কা না করার এক প্রতিবাদী ইমেজ। ট্রেড ইউনিয়ন, ধর্মঘট এসবের তীব্র বিরোধী। বিভিন্ন অংশের মানুষের জন্য নানা প্রকল্প চালু করেছেন এবং সেই সব অনুদানে মানুষের কিছু উপকার অবশ্যই হয়েছে। কিন্তু কোনো স্থায়ী সর্বজনীন অধিকার প্রনীত হয় নি। এই গুলি নির্বাচনী সমর্থন আদায় যথেষ্ট কার্যকর বলেই মনে হয়। দল এর পরিবর্তে প্রফেশনাল কনসালট্যান্ট রাজনৈতিক স্ট্র্যাটেজি ঠিক করছে ইত্যাদি। কিন্তু এই মানুষই ক্ষুব্ধ হলে কখনও সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে, অথবা জাত ও অন্যান্য পরিচয়ের ভিত্তিতে সংঘটিত করা যথেষ্ট সহজ হয়ে যায়। যা আমাদের রাজ্যেও প্রতিনিয়ত ঘটে চলেছে এবং সেটাই রাজ্যে বিজেপির বিপুল শক্তি বৃদ্ধির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ। গত এক বছর ধরে অবশ্য সমস্ত প্রচার মাধ্যম নির্বাচনী পাটিগণিতের হিসাব দেখিয়ে একথা বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছে যে বামেরাই বিজেপির উত্থানের জন্যে দায়ী অর্থাৎ তারা ভোট ট্রান্সফার করছে। এর মর্মার্থ হলো বামেরা বিপুল জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার পরেও এতটাই আধিপত্য ধরে রেখেছে যে তারা নিজের প্রার্থীদের জয়ী করতে না পারলেও তাদের কথায় লক্ষ লক্ষ লোক অণ্য পার্টি কে ভোট দিয়ে দিচ্ছে!
![Victory](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2020/12/back4-1024x682.jpg)
জনতা বনাম এলিট এই সংঘর্ষ ও শ্রেণী সংঘর্ষের সম্পর্ক এ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। দক্ষিণপন্থী শক্তিগুলি এলিট বিরোধী বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে উদারবাদী গণতন্ত্র সম্পর্কে গরীব মানুষের হতাশাকে কাজে লাগায় কিন্তু এই সংগ্রাম কখনোই শ্রেণীর চেতনায় গড়ে উঠতে দেয় না। বামপন্থী শক্তি ই একমাত্র এলিট বিরোধি সংগ্রামকে পূর্ণ রূপ দিতে পারে তার কারণ তাদের কাছে জনতার নানা প্রশ্নের অধিকার প্রতিষ্ঠা আসলে শ্রেণী সংগ্রামের আধারে গড়ে ওঠে। শ্রেণী সংগ্রাম কোনো প্রচারমূলক নৈর্ব্যক্তিক অবস্থান নয়। এই লড়াই সেখানেই হয় যেখানে শোষণ চলছে, যেখানে পুঁজির জন্য উদ্বৃত্ত মূল্য তৈরি হচ্ছে। কারখানায়, খেতে, খামারে, খনিতে, অথবা কোনো পরিষেবা উৎপাদনে। এই লড়াই করার মধ্যে দিয়ে শ্রমজীবী মানুষ তার কাঠামোগত শত্রু ও বন্ধুকে চিনতে পারে। ফলে রাজনীতির পরিসরে যখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা সমঝোতার মধ্যে পছন্দ করতে হয় তখন স্থায়ী শত্রু মিত্রর ধারণা তাকে রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করার দিশা দেখায়। যা সব সময় নির্বাচনে জেতা হারার বা ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনার উপর নির্ভরশীল নয়। সমাজের সমস্ত ক্ষেত্রতে এই ধরনের সরাসরি শ্রেণীর সংঘর্ষ প্রাসঙ্গিক হবে তা নয়। এরকম অনেক ক্ষেত্র থাকবে যা সরাসরি শোষণের সম্পর্ক নয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রও গুলিতে প্রচলিত ব্যবস্থার উপযোগী মনোভাব তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রও বামপন্থী অবস্থান হাজির করা আসলে শ্রেণী আধিপত্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রয়োজনীয় লড়াই। লিংগ বৈষম্য বা জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্যর বিরুদ্ধে সজাগ অবস্থান সমস্ত নিপীড়িত মানুষের ঐক্য গড়ে তুলতে সাহায্য করে। পুঁজির সঙ্গে প্রকৃতির সংঘাত আজ মূর্ত হচ্ছে মানব সভ্যতার বৃহত্তম সংকট হিসেবে। এইসব প্রশ্নে বামপন্থীদের সমাজতন্ত্রী চিন্তা শ্রমজীবী মানুষের কাছে হাজির করার সুযোগ করে দিচ্ছে।
![](http://i0.wp.com/cpimwb.org.in/wp-content/uploads/2021/04/images-1.jpg)
মনে রাখা দরকার যে রাজ্যের গরীব মানুষের কাজের ধরন বদলে যাচ্ছে। বড় কারখানার অথবা খনির শ্রমিক, জুট মিলের শ্রমিক, ইঞ্জিনিয়ারিং ক্ষেত্রের শ্রমিক, বন্দর শ্রমিক, বিভিন্ন সংঘঠিত পরিষেবা ক্ষেত্রের কর্মচারি ইত্যাদি যারা বামপন্থী আন্দোলনের প্রধান আন্দোলনের শক্তি ছিল তারা আজকে রাজ্যের বা দেশের শ্রমজবীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ নয়। শুধু তাই নয় এই সমস্ত ক্ষেত্রে মূলত বামপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের ফসল হিসেবে শ্রমিক কর্মচারীরা বেশ কিছু অধিকার ও কাজের স্থায়িত্ব অর্জন করেছে। কিন্তু নয়া উদারবাদী জমানায় মূলত চুক্তভিত্তিক কাজের প্রসার ঘটে চলেছে। আউটসর্সিংয়ে র প্রক্রিয়া ক্রমাগত অরক্ষিত শ্রমিকের অংশ বাড়িয়ে চলেছে। এই বিপুল অরক্ষিত শ্রমজবীদের মাঝে সংঘঠিত শ্রমিক কর্মচরীদের অর্জিত অধিকারকে বিশেষ সুবিধা হিসেবে উপস্থিত করা সহজ হচ্ছে। নতুন প্রজন্মের শ্রমিক কর্মচারীদের কাজের ধরন, শর্ত, সময় সব বদলে যাচ্ছে। এরকম পরিস্থতিতে বামপন্থি দেরকে তুলনামূলক ভাবে ‘সুবিধাভোগী’ শ্রমজবীদের প্রতিনিধি হিসেবে দেখানো হচ্ছে। এলিট বনাম জনতার উপাখ্যান ব্যাবহার করে শ্রমজীবীদের মধ্যে বিভাজন তৈরী করা হচ্ছে। ছোট কারখানায় কর্মরত শ্রমিক, দোকান কর্মচারী, দোকানদার, পরিবহন শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, মুটে মজদুর, গৃহস্থালি শ্রমিক, ডেলিভারি শ্রমিক, ক্ষুদ্র চাষী, ক্ষেত মজুর এরাই আজকের শ্রমজীবীদের প্রধান অংশ। সমাজের সবচাইতে দরিদ্র, নিপীড়িত অংশ যারা এখনো পর্য্যন্ত তাদের শ্রেণী অস্তিত্ব নিয়ে সমাজে উপস্থিত হতে পারেনি। তাদের জীবন জীবিকায় অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইতেই বামপন্থী দের আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। আগামী দিনে তৃনমূলের চরিত্র বদলে যাবে না। অন্যদিকে বিজেপি তার নির্বাচনী সমর্থনকে ক্রমাগত সাম্প্রদায়িক খাতে সংঘঠিত করার চেষ্টা করে যাবে। সমাজের বৃহত্তর শ্রমজীবী জনগন তৃনমূল সরকারের কার্যকলাপের প্রতিবাদে সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী শক্তির হাত ধরবে না লাল ঝাণ্ডা কাঁধে তুলে নেবে আগামী দিনে তা ঠিক হবে বামপন্থীদের এই লড়াইতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করার উপর।
*মতামত লেখকের নিজস্ব