গান্ধীহত্যাকারীদের হাতে কতোখানি নিরাপদ দেশ?
গৌতম রায়
অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গী এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার জন্যে মহাত্মা গান্ধী প্রথম থেকেই ছিলেন হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শক্তির আক্রমণের কেন্দ্র স্থল।১৯৩৪ সালে পুনেতে একটি জনসভায় যাওয়ার পথে গান্ধীজীর গাড়ি লক্ষ করে বোমা ছড়া হয়।পরিকল্পনার অভাবেই হামলাকারীরা ব্যর্থ হয় --এই হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা সম্পর্কে গান্ধীজীর সবিব প্যারেলাল অভিযোগ করেছিলেন।সেইবার গান্ধীজী ও ছিলেন সস্ত্রীক।
দ্বিতীয়বার গান্ধীজীকে হত্যা করবার চেষ্ট হয়েছিল পুনে শহরের কাছেই একটা ছোট্ট পাহাড়ি জায়গা পাঁচগানিতে।ঘটনাটি ঘটে ১৯৪৪ সালের মে মাসে। পনের থেকে একুশ বছরের কয়েকটা ছেলে হত্যার উদ্দশ্য নিয়ে তাঁর উপরে চড়াও হয় নাথুরাম গডসের নেতৃত্ব। আর এস এস কর্মী নাথুরাম নিজে ছোঁড়া হাতে মহাত্মার উপরে চড়াও হওয়ার উপক্রম করে ভয়ঙ্কর রকমের গান্ধী বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে।গান্ধীভক্ত মণিশঙ্কর পুরোহিত (স্থানীয় শ্রুতি লজের মালিক) এবং ডি ভাইলারে গুরুজী( মহারাষ্ট্রের সাতারার এই ব্যক্তিটি পরবর্তী কালে সেখানকার কংগ্রেস নেতা হিশেবে উঠে এসেছিলেন) প্রবল বাঁধা দিয়ে নাথুরামকে মহাত্মার কাছ পর্যন্ত পৌঁছতেই দেন নি। গান্ধী হত্যার পর গঠিত কাপুর কমিশনেও ভাইলারে গুরুজী নিজের সেদিনের ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন।
১৯৪৪ সালের সেপ্টেম্বরে গান্ধীজীকে হত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে সেই নাথুরামের নেতৃত্বেই আবার আক্রমণ হয় । মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গে কথা বলবার জন্যে গান্ধীজী সেই সময়ের বম্বে যাওয়ার জন্যে সেবাগ্রাম আশ্রম থেকে বের হওয়ার সময়ে এই আক্রমণ হয়েছিল।হামলাকারীদের হাতে ছোঁড়া ছিল।'৪৮ সালের ২০ শে জানুয়ারী মদনলাল পাওয়া(বর্তমান পাকিস্থানের মন্টেগমারি জেলায় এর পৈতৃক বাড়ি।হিন্দু মহাসভা, আর এস এসের সেই সময়ের রাজনৈতিক সংগঠন,সেই সংগঠনের সঙ্গে মদনলালের সংযোগ গড়ে উঠেছিল বিষ্ণু কারকারের মাধ্যমে।আহমদনগরের ফল ব্যবসায়ী পাওয়াকে গডসে এবং নারায়ণ আপ্তের কাছে নিয়ে গিয়েছিল কারকারেই।), শঙ্কর কিস্টাইয়া,দিগম্বর বাদজে(হিন্দু মহাসভার সক্রিয় সদস্য), বিষ্ণু কারকারে(হিন্দু মহাসভার সক্রিয় কর্মী), গোপাল গডসে ( গান্ধী হত্যাকারী নাথুরামের সহোদর। ইনি আর এস এসের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন।পাশাপাশি হিন্দু মহাসভার ও কর্মী ছিলেন), নাথুরাম গডসে ( স্কুলের পড়াশুনা মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে ইনি আর এস এস কর্মী হন।পাশাপাশি সঙ্ঘের রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভার ও কর্মী ছিলেন। সেই হিন্দু মহাসভারই বর্তমান বিবর্তিত সংস্করণ হলো বর্তমান বি জে পি।) এবং নারায়ণ আপ্তে ('৩৯ সালের পর আপ্তে হিন্দু মহাসভাতে যোগ দিয়েছিলেন) বিড়লা হাউসে গান্ধীজীর উপরে হামলার চেষ্টা করেছিল।সেদিন হোসেন শাহিদ সোহরাওয়ার্দীকেও তারা হত্যার ব্যার্থ চেষ্টা চালিয়েছিল।
অসাম্প্রদায়িক এবং ধর্মনিরপেক্ষতার যে প্রবাহমান ঐতিহ্য ভারতের রয়েছে যে কোনো মূল্যে তাকে বাঁচানোর জন্যেই আত্মবলিদান দিতে হলো মহাত্মা গান্ধীকে। '৪৭ এর ১৪ ই আগষ্ট অবিভক্ত আংলার শেষ প্রিমিয়ার সোহরাওয়ার্দি সাহেব মহাত্মাজীকে স্বাধীনতার উৎসব কেমন হবে জানতে চান।ব্যথিত গান্ধীজী তাঁকে বলেছিলেন;"চারিদিকে মানুষ একমুঠো ক্ষিদের ভাতের তাগিদে প্রাণ দিচ্ছে।না খেতে পেয়ে তারা মারা পড়ছে।এমন একটা ভয়াবহ সঙ্কটের মুহুর্তে আপনি উৎসবের আয়োজনের ভাবনা ভাবছেন?"
জাতীয় আন্দোলনের সময়কালে গান্ধীজীর সর্বাত্মক অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি কোনো অবস্থাতেই মেনে নিতে পারে নি।আর এস এসের চিন্তাচেতনার উৎসস্থল গোলওয়ালকর ভারতের রূপরেখা নির্মাণের প্রাথমিক শর্ত হিশেবে নাগপুরে সঙ্ঘের সদর দপ্তর অনুমোদিত যে "হিন্দুত্বে"কথা বলেছিলেন তা হিটলার , মুসোলিনীর জাতিসত্তার ধারণার ই পুনরুক্তি ছিল। "একের অনলে বহুরে আহুতি দিয়া বিভেদ ভুলিল , জাগায়ে তুলিল একটি বিরাট হিয়া"-চিরন্তন ভারতবর্ষের এই ধারাবাহিকতাকে অস্বীকার করে ফ্যাসিস্ট শক্তির বিশুদ্ধ আর্য গরিমার আদলে গোলওয়ালকর "সাস্কৃতিক জাতীয়তীয়তাবাদ" নামক এক চিরন্তন ভারতীয় চেতনা বিরোধী তত্ত্বের অবতারণা করেন।
গান্ধীজীর জীবনব্যাপী সংগ্রাম,যে জীবনকেই তিনি তাঁর বাণী বলে উল্লেখ করেছিলেন, তা ছিল সর্ব অর্থে ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে লড়াই। সেই সংগ্রাম ছিল জাতপাত আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে কেবল একটি রাজনৈতিক সংগ্রামই নয়, বিষয়টিগুলি যাতে স্বাধীন ভারতে সমূলে উৎপাটিত হতে পারে সে জন্যে তিনি একটি সামাজিক আন্দোলনের পটভূমিকাও নির্মাণ করেছিলেন।সাম্প্রদায়িকতা এবং জাতপাতের বিরুদ্ধে জেগে ওঠা রাজনৈতিক এবং সামাজিক পটভূমি চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেওয়ার ক্ষমতার দিকে এগোচ্ছিল গোলওয়ালকরের সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের হাত ধরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের পরিকল্পনা।তাই গান্ধীজীকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়াই হিন্দুত্ববাদীরা সবথেকে নিরাপদ বোধ করেছিল।সেই জন্যেই সেই তিনের দশক থেকে তারা ধারাবাহিক ভাবে গান্ধীজীকে হত্যার চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে ১৯৪৮ সালের ৩০ শে জানুয়ারী সফল হয়। অন্নদাশঙ্কর রায় সে সময়ে মুর্শিদাবাদ জেলার জেলা শাসক হিশেবে কর্মরত ছিলেন।বেদনাহত চিত্তে তিনি দেখেছিলেন গান্ধীজী শহিদ হওয়ার পর আর এস এস বহরমপুর শহরে মিষ্টি বিলি করেছিল।
যে স্বাধীনতার জন্যে তিনি লড়াই করেছিলেন তা খন্ডিত দেশের জন্যে নয়।যে ভয়াবহ ভাতৃঘাতী দাঙ্গা স্বাধীনতা প্রাপ্তির আগের এক বছর ধরে গোটা দেশে ঘটেছিল তা হিন্দু মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তিকেই স্বাধীন ভারতে রাজনৈতিক বিস্তার লাভের সুযোগ করে দিলেও মহাত্মার হৃদয়কে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দিয়েছিল।তাই '৪৭ 'র ১৫ ই আগস্ট কলকাতার বেলেঘাটায় বাপু চব্বিশ ঘন্টা অনশন করেছিলেন। হানাহানির নীরব সাক্ষী হিশেবে চুপ করে বসে না থাকাই তাঁকে দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরে ও মরীয়া করে তোলে।
রাজনীতি ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার প্রতি গান্ধীজীর চিরদিনই আকর্ষণ ছিল।সেই আকর্ষণ থেকেই একবার আর এস এসের একটি শিবির দেখে সেখানে প্রকাশ্যে তিনি বলেছিলেন; হিন্দুরা যদি ভেবে নেন যে, ভারতবর্ষে হিন্দু ছাড়া আর কারো ঠাঁই হবে না , যদি তারা এটাই ঠিক করে নেন যে, মুসলিম ইত্যাদিদের ভারতবর্ষে থাকতে হলে থাকতে হবে হিন্দুদের দাস হয়ে --তাহলে সবার আগে মৃত্যু ঘটবে হিন্দু ধর্মের।
তখনই সঙ্ঘের সাম্প্রদায়িক কাজকর্ম সম্পর্কে জোরদার অভিযোগ উঠতে শুরু করেছিল। এই প্রেক্ষিতে অভিযোগের ভিত্তি আছে কি না তা প্রমাণ করতে হবে আর এস এস কেই--খুব স্পষ্ট ভাষাতেই এই কথা গান্ধীজী বলেছিলেন(To Members of the R S S--Hirijan,28 th sep,1947)
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বল্লভভাই প্যাটেল কে নেহরু বলেছিলেন;দিল্লীতে তো বটেই দেশের নানা প্রান্তে যে সব গন্ডগোল হচ্ছে তার পিছনে আর এস এসের যে একটা মস্ত বড়ো ভূমিকা রয়েছে , সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত। অমৃতসরে তো তাদের কাজকর্মের প্রমাণ খুব পরিস্কার।
নেহরু গান্ধীজীর জীবিতাবস্থাতেই বলেছিলেন; হিন্দু ফ্যাসিস্ট মহল থেকে এই সরকারকে ফেলে দেওয়ার ,অন্ততপক্ষে সরকারের বর্তমান চরিত্র ভেঙে দেওয়ার জন্যে সুনির্দিষ্ট এবং সুসংগঠিত প্রয়াস চালানো হচ্ছে।এটা নিছক সাম্প্রদায়িক গন্ডোগোল নয়,তার থেকেও অনেক অনেক বেশি কিছু।এদের ভিতরে অনেকেই চরম নিষ্ঠুরতা এবং নৃশংসতার পরিচয় ইতিমধ্যেই রেখেছে।এদের আচরণ নির্ভেজাল আতঙ্কবাদীদের মতোই(Neheru to Patel ,20th sep,1947,see--Sardal Patel Correondence,1945 to 1950,10th vols.for this letter vol 4,page-297 to 299.publisher--Ahmedabad :Navjiban Press,1971 to 1974)।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে ১৯৩৮ সালেই গোলওয়ালকর তার "উই ,অর আওয়ার নেশন ডিফাইন্ড" নামক বইতে লিখেছিলেন;
হিন্দুস্থানের যারা হিন্দু নন,সেই সব লোকেদের বাঁচবার জন্যে দুটো পথের ভিতরে যে কোনো একটা পথকেই বেছে নিতে হবে।হিন্দুস্থানের অহিন্দুদের হয় হিন্দু সংস্কৃতি এবং হিন্দুভাষাকে মেনে নিতে হবে।তাদের হিন্দু ধর্মশিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।হিন্দুকে মর্যাদা দিতে হবে।হিন্দুকে শ্রদ্ধা করতে হবে। হিন্দু জাতি এবং সংস্কৃতির গৌরবগাঁথা ছাড়া অন্য কোনো ধারণাকে মনের ভিরতেও ঠাঁই দেওয়া চলবে না।তেমন ধারণাকে প্রশ্রয় ও দেওয়া চলবে না।খুব পরিস্কার ভাবে বলতে গেলে বলতে হয় অহিন্দুদের কোনো অবস্থাতেই বিদেশি হয়ে থাকলে চলবে না।তাদের এই বিদেশি হয়ে থাকার প্রবণতাকে এই মুহুর্তেই ছেড়ে দিতে হবে।
অন্যথায় এইসব অহিন্দুরা এই দেশ থেকে চলে যেতে পারেন। এই দেশে তাদের থাকার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন নেই।এদেশে অহিন্দুদের থাকতে হলে সম্পুর্ণভাবে হিন্দুজাতির অধিনস্থ হয়ে থাকতে হবে।এদেশের কোনো কিছুর উপরে অহিন্দুদের বিন্দুমাত্র দাবি থাকবে না।অহিন্দুদের বিশেষ কোনো অধিকার ও থাকবে না।তাদের বিশেষ কোনো সুবিধা পাওয়ার প্রশ্নতো আসছেই না।এমন কি তাদের নাগরিক অধিকার পর্যন্ত থাকবে না(সংশ্লিষ্ট গ্রন্থের ১৯৪৭ সালের সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৫৫,৫৬।তাছাড়া ও দেখুন, Hindi against India:The Makeing of DMK--New Delhi, Rachna Prokashan.1968,page -64)
স্বাধীনতা প্রাপ্তির অব্যবহিত পরেই '৪৭ সালের ৭ ই ডিসেম্বর দিল্লির রামলীলা ময়দানে একটি সমাবেশ করে আর এস এস।সেই সভাতে কৌশলগত কারনে গোলওয়ালকর নিজেদের " হিন্দুরাষ্ট্র" প্রতিষ্ঠার ভাবনার কথা অস্বীকার করে বলেন; আমাদের লক্ষ্য হিন্দু সমাজের সংহতিকে প্রতিষ্ঠা করা।সেই আদর্শ কে সামনে রেখেই কুচকাওয়াজ করতে করতে আর এস এস এগিয়ে যাবে।এই এগিয়ে যাওয়াকে কোনো ব্যক্তিই ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না।কোনো কর্তৃত্বই আর এস এসের এই এগিয়ে যাওয়াকে রুখতে পারবে না(Hindustan Times 8th dec,1947)।
গান্ধীজীর সভাগুলিতে নানা রকম বিঘ্ন ঘটানো তখন আর এস এসের একটা নিত্য কর্ম হয়ে উঠেছিল।সভাতে গান্ধীজীর কোরাণ পাঠ নিয়ে আপত্তি তুলতো শ্রোতার ছদ্মবেশে সভায় আসা সঙ্ঘ কর্মীরা।তাদের ভিতরেই কেউ হয়তো চিৎকার জুড়ে দিতো, কেন এখন ও পাকিস্থানে বসবাসকারী শিখ আর হিন্দুদের দুর্দশা নিয়ে গান্ধীজী নীরব রয়েছেন , তা নিয়ে।এ প্রসঙ্গে ডি জি তেন্ডুলকর লিখেছিলেন ; পাকিস্থানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের দুঃখ কষ্ট নিয়েও বাপু সমান ভাবেই চিন্তিত ছিলেন।তাঁদের দুঃখে সান্ত্বনা দিতে পারলে তিনি খুশিই হতেন।কিন্তু খোদ দিল্লির মুসলমানদেরই নিরাপত্তা তিনি নিশ্চিত করতে পারছেন না। তাই কোন মুখে সেখানে যাবেন তিনি?(Mahatma by Tendulkar.vol 8,page-246 to 266)।
গান্ধী হত্যাকারী সেই দানবীয় শক্তি আর এস এস ই এখন বকলমে ভারতবর্ষের রাষ্ট্র ক্ষমতাতে রয়েছে। তাদের প্রচারক নরেন্দ্র মোদি এখন দেশের প্রধানমন্ত্রী।এই নরেন্দ্র মোদিই গোলওয়ালকরের ভারতে থাকতে হলে আর এস এসীয় হিন্দু হয়ে থাকাতে হওয়া তত্ত্বের হাতে কলমে প্রয়োগ দেখিয়ে দিয়েছেন গুজরাটে নিজের মুখ্যমন্ত্রীত্ব কালে গণহত্যার ভিতর দিয়ে।মুসলিম নিধনের সেই হাতে কলমে প্রয়োগের ভিতর দিয়ে তিনি গান্ধীজীকে পথের কাঁটা মনে করে যারা দুনিয়া থেকে সরিয়ে দেওয়াটাই একমাত্র উপায় মনে করে তাঁকে হত্যা করে সেই হিন্দু ফ্যাসিস্ট শক্তি বলে নেহরু কর্তৃক অভিহিত আর এস এসের সবথেকে আস্থাভাজন হয়েই তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপির প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হয়েছিলেন গত লোকসভা নির্বাচনে।স্বয়ংসেবক আডবাণীর থেকেও সঙ্ঘের কাছে প্রচারক মোদি বেশি গ্রহণযোগ্য সেদিন হয়ে উঠেছিলেন এই কারনে যে, সঙ্ঘ মোদি সম্পর্কে এই নিশ্চয়তায় পৌঁছেছিল যে, গোলওয়ালকরের ভাবনার হিন্দুরাষ্ট্র তৈরীতে অন্য যে কোনো বিজেপি নেতার থেকেই ক্ষিপ্র হবেন মোদি।
সঙ্ঘ প্রচারক মোদি ক্ষমতায় এসে সঙ্ঘের অভিপ্রায় পূরণে সবটুকু শক্তি নিংড়ে দিতে শুরু করে দিয়েছেন।জাতীয় আন্দোলন এবং স্বাধীন ভারতের ভিত্তি নির্মানে গান্ধী , নেহরুর ভূমিকা এবং অবদানকে মুছে দেওয়া মোদির সঙ্ঘের স্বপ্নের হিন্দু রাষ্ট্র স্থাপনের প্রাথমিক পদক্ষেপ হয়েছে।গান্ধীজীর অবদানকে মুছে দিতে কংগ্রেসের ভিতরে হিন্দু সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম ধারক বাহক বল্লভভাই প্যাটেল কে নিয়ে মাতামাতি করে মোদি এক ঢিলে দুই পাখি মারতে চেয়েছেন। একদিকে স্বাভাবিক শত্রু গান্ধীজীকে মুছে দেওয়া গান্ধীজীকে মুছে দেওয়া আর সেই অস্ত্রেই স্বাভাবিক মিত্র প্যাটেলকে মহিমান্বিত করে মোদি গুজরাটি অস্মিতাকে চাগিয়ে দিয়ে সাম্প্রদায়িক শিবিরের মনোবলই বাড়াবার চেষ্টা করেছেন।
যে শক্তি একদিন গান্ধীজীকে খুন করে ভারতবর্ষের প্রাণ শক্তিকেই বিনষ্ট করতে চেয়েছিল, সেই শক্তিই এখন "হিন্দু জনজাগৃতি সমিতি" ইত্যাদি নানা ছদ্মবেশ ধারণ করে নরেন্দ্র দাভোলকর, গোবিন্দ পানসারে, কালবুর্গিকে হত্যা করে চলেছে।এই "হিন্দু জনজাগৃতি সমিতিই গোলওয়ালকরের " হিন্দু রাষ্ট্র " প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ৬ থেকে ১০ জুন গোয়াতে দ্বিতীয় অখিল ভারত হিন্দু কনভেনশন করে।
সেই সময়ে গোয়াতেই বিজেপির জাতীয় কর্ম সমিতির বৈঠকে ব্যস্ত থাকার জন্যে সেই কনভেনশনে যেতে পারেন নি মোদি।তবে সেই সন্মলনের সাফল্য কামনা করে বার্তা পাঠাতে মোদি ভোলেন নি।গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রীর লেটার হেডেই ২০১৩ সালের ১ লা জুন হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির প্রধান শিবাজী ভাটকর কে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছিলেন গুজরাটের তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।হিন্দু জনজাগৃতি সমিতির সেই কনভেনশনে তাদের নেতারা প্রকাশ্য মঞ্চে গান্ধীজীকে "দেশদ্রোহী"," ধর্মদ্রোহী" বলেই ক্ষান্ত হয়নি। তারা নাথুরাম গডসেকে প্রকাশ্যে তাদের কনভেনশন মঞ্চ থেকেই প্রশংসাতে ভরিয়ে দিয়েছিল। সংগঠনের নেতা কে ভি সীতারামাইয়া সেখানে বলেছিলেন; দেশদ্রোহীদের হত্যাকরাকে আইনী স্বীকৃতি এই মুহুর্তে দিতে হবে।সংসদ সদস্যরা দেশদ্রোহীদের এবং ধর্মদ্রোহীদের হত্যার যদি বিরোধিতা করেন , তাহলে সেই সব সাংসদদের মৃত বলে ঘোষণা করা হবে।
দাভোলকর, পানসারেকে হত্যা যারা করেছিল, সেই সনাতন সংস্থার মূল সংগঠন হল এই হিন্দু জনজাগৃতি সংস্থা।গান্ধীহত্যাকারী আর এস এস এবং তাদের রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার ফলেই আত্মহত্যায় বাধ্য হয়েছেন হায়দ্রাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী গবেষক রোহিত ভেমুলা।তাঁর একমাত্র অপরাধ ছিল, তিনি জন্মেছিলেন একটি দরিদ্র দলিত পরিবারে।আর এস এসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদের কর্মী নামক তিন দস্যু বিক্রম কুমার, অঙ্কিত কুমার এবং সুনীল প্রতাপ গান্ধীহত্যাকারীদের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার সুযোগ নিয়ে গত ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর দিল্লির জে এন ইউর ছাত্রাবাস মাহী মন্ডবী হস্টেলে গিয়ে হুমকি দিয়ে এসেছিল মেধাবী ছাত্র নাজিবকে। নাজিবের একমাত্র অপরাধ , সে জন্মসূত্রে মুসলমান। পরের দিন , অর্থাৎ ১৪ অক্টোবর থেকে নাজিব নিঁখোজ। আজ ও তাঁর সন্ধান পাওয়া যায় নি।
এই গান্ধীহত্যাকারীরা যখনই রাষ্ট্র ক্ষমতায় গিয়েছে নানা ছুতো নাতায় জয়ললিতা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আঞ্চলিক ও কায়েমী স্বার্থবাহী শক্তি তাদের কাছাকাছি চলে এসেছে। মুখে অসাম্প্রদায়িকতার কথা বলে সাম্প্রদায়িক বিজেপির সঙ্গে ক্ষমতার মৌতাত নিতে কেন্দ্র বাজপেয়ী মন্ত্রীসভার সদস্য হতে মমতার এতোটুকু সমস্যা হয় নি। বিমুদ্রাকরণের জেরে নিজের এবং নিজেদের লুম্পেন ক্যাপিটাল অনিশ্চিত হয়ে পড়ায় মমতা অপসারণ চেয়েছেন মোদির, তাবলে গান্ধী হত্যাকারী বিজেপির অপসারণ একটি বারের জন্যেও চান নি। বরং মোদির বদলে আডবানী বা জেটলির মতো বিজেপি নেতারা প্রধানমন্ত্রী হলে তাঁর কোনোই আপত্তি নেই-তা প্রকাশ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন। আর তার বিনিময়ে গান্ধীহত্যাকারী আর এস এস 'র বর্তমান প্রধান মোহন ভাগবত খোদ কলকাতার বুকে সভা থেকে মমতা বা তাঁর "গরমেন" কিংবা তাঁর দল সম্পর্কে সম্পুর্ণ নীরব থেকে উভয়ের বোঝাপড়ার মাত্রাটিকে পরিস্কার করে দিয়ে গিয়েছেন।এই অমানিশার অবসানে সমস্ত গণতন্ত্রপ্রিয়, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষকে আজ প্রত্যয়ে দৃঢ় হতে হবে।সাম্প্রদায়িক এবং অগণতান্ত্রিক পশু শক্তির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াইয়ের পাশাপাশি সংগঠিত করতে হবে সামাজিক আন্দোলনকেও।