নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভ ও অনাস্থা প্রদর্শন কৃষকদের প্রতি হয়ে চলা অবিচারের বিরুদ্ধে কোন স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ নয়।এটি বরং গত ছয় বছরে কৃষকদের বিস্তৃত ইস্যু-ভিত্তিক ঐক্য গড়ে তোলার লক্ষণীয় প্রচেষ্টার ফল।গত ছয় বছরে বিভিন্ন ইস্যু ভিত্তিক ঐক্যমত্য নির্মিত হয়েছে।প্রথমটি হয়েছিল যখন ২০১৪ এর ডিসেম্বরে বিজেপি সরকার ভূমি অধিগ্রহণ অধ্যাদেশ নিয়ে আসে।অবিলম্বে ৪০০ এরও বেশি জেলায় অধ্যাদেশ পুড়িয়ে এর বিরোধিতা করা হয়েছিল এবং ভূমি অধিকার আন্দোলন নামে একটি ইস্যু ভিত্তিক ঐক্য জমি / বন অধিকার সম্পর্কিত বিষয় এবং নির্বিচারে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে হয়েছিল। কৃষক, ক্ষেতমজুর, আদিবাসী, দলিত, মৎস্যজীবি এবং অরণ্যজীবিদের সংগঠন একত্রিত হয়েছিল।ভূমি অধিকার আন্দোলন কর্তৃক গৃহীত সংগ্রামগুলো অধ্যাদেশ প্রত্যাহারের অন্যতম কারণ ছিল। সংঘবদ্ধ সংগ্রামের বছরগুলোতে একসাথে চলা সংগঠনগুলোর লড়াইয়ের বিস্তার ঘটে নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি, ফ্যাসিবাদী শক্তি, সাম্প্রদায়িক, বর্ণবাদী আক্রমণ, সংবিধানের উপর হামলা এবং গণতান্ত্রিক অধিকারকে দমন করা সহ বিস্তৃত ইস্যুতে ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে আন্দোলন বৃদ্ধি পায়। ২০১৭ সালে মধ্যপ্রদেশের মন্দসৌরে পুলিশের গুলিতে ৬ জন কৃষকের নিহত হওয়ার পরে অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশান কমিটি গঠন করা হয়েছিল।প্রাথমিকভাবে দুটি ইস্যুতে ঐক্যের ভিত্তিতে এটি তৈরি হয়, যথা ফসলের ন্যায্য মূল্যের প্রতিশ্রুতি এবং ঋণগ্রস্থতা থেকে মুক্তি।এর ছত্রছায়ায় এখন সারা দেশ জুড়ে দুই শতাধিক কৃষক সংগঠন থাকার কারণে, গত ৩ বছরের একসাথে লড়াই চলাকালীন বিস্তৃত বিভিন্ন বিষয়ে ঐক্যমত্য গড়ে উঠেছে।শ্রমিক শ্রেণির সংগঠনগুলি ইস্যু-ভিত্তিক ঐক্যের পূর্ববর্তী ঐতিহ্য রয়েছে যেখানে বিভিন্ন ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলোর ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়েছে এবং অর্থনৈতিক দাবিতে দেশব্যাপী ধর্মঘট সহ অসংখ্য যৌথ পদক্ষেপ করেছে।গত ৬ বছরে গড়ে ওঠা এই কাজকর্মের সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য দিক হল কৃষকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো এবং শ্রমিক শ্রেণির প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলোর পাশাপাশি নিপীড়িতদের অংশের প্রতিনিধিদের মধ্যেও বৃহত্তর সংহতি দেখা দিয়েছে।অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকরা এবং চিট ফান্ডের কেলেঙ্কারীর শিকাররাও এই লড়াইয়ের সমর্থনে বেরিয়ে এসেছেন। কৃষকদের এবং শ্রমিক শ্রেণীর পাশাপাশি নিপীড়িত শ্রেণীর একাত্ম হয়ে ব্যাপক সংসদ অভিযানগুলো করা ছিল ২০১৪-১৯ এর অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য।২০১৭ এর শেষ দিনগুলিতে শ্রমিক-কৃষক ঐক্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন গণ ও শ্রেণী সংগঠনের পাশাপাশি সামাজিক ও নাগরিক সংগঠনগুলো নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি ও ফ্যাসিবাদী শক্তির বিরুদ্ধে ইস্যুভিত্তিকভাবে জন একতা জন অধিকার আন্দোলন (জেইজেএএ) তৈরি হয়। এই যৌথমঞ্চের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় দমন, সংবিধানের উপর আক্রমণ এবং মানুষের জীবন জীবিকার ওপরে আক্রমণের বিরুদ্ধে বহু সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ সংগঠিত হয়েছিল।এই প্রবণতার দেশের ভবিষ্যতের জন্য সুদূরপ্রসারী প্রভাব আছে। মোদির দ্বিতীয় আগমন, তীব্রতর আক্রমণ ও এগিয়ে যাওয়ার উপায়
২০১৯ এ বৃহত্তর ব্যবধানে মোদির দ্বিতীয়বার জিতে আসার ফলে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রদায়িক,বিভাজক লক্ষ্যগুলোর পাশাপাশি নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক নীতির উদ্ধত ও আগ্রাসী অনুসরণ।আচ্ছে দিনের প্রতিশ্রুতি, প্রতি বছর যুবকদের জন্য ২ কোটি কর্মসংস্থান এবং কৃষকদের আয়ের দ্বিগুণ হওয়া সবই অশ্বডিম্ব প্রসব করেছে।অর্থনৈতিক মন্দা ও তীব্র কৃষি সংকটের এমন একটি পরিস্থিতিতে যেখানে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়েছে, সঙ্কটে কৃষকরা আত্মহত্যা করেছে, যুবকরা বেকার রয়েছে, দরিদ্ররা ক্ষুধার্ত সেখানে সরকার নিরলসভাবে কর্পোরেটের সেবাদাসের ভূমিকায় নীতিপ্রনয়ন করেছে।এমন পরিস্থিতিতে কোভিড-১৯ মহামারি আঘাত হানে।অপরিকল্পিত লকডাউনের কারণে সমগ্র কৃষক ও মেহনতি জনগণের উপার্জনের বিশাল ক্ষতি হয়েছে।বেকারত্ব সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ ছুঁয়েছে এবং ১২ কোটিরও বেশি মানুষ কাজ হারিয়েছে বলে জানা গেছে।গরিবদের জন্য উন্নত স্বাস্থ্য এমনকি খাদ্যশস্যের সংস্থান নিশ্চিত করা যায়নি।তাদের আয়ের সহায়তা, ঋণ মকুব, খাদ্যশস্য সরবরাহ, কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্য সুবিধাসহ সুরাহা দেওয়ার পরিবর্তে বিজেপি সরকার কেবলমাত্র কর্পোরেট সংস্থাগুলোর জন্য সীমাহীন ছাড় ও সুবিধার ব্যবস্থা করছে। শাসকগোষ্ঠী মহামারিকে তার ধান্দাবাজ কর্পোরেট বন্ধুদের যথেচ্ছাচারের সুযোগ হিসাবে দেখেছিল। জনগণ ভয়াবহ সঙ্কটের মধ্যে রয়েছে, তাদের আয়ের বিপুল ক্ষতি হয়েছে আর এর মধ্যেই ধান্দাবাজ কর্পোরেটরা তাদের সম্পদ বাড়িয়ে চলেছে যাদের মধ্যে সবার ওপরে নাম আছে মুকেশ আম্বানির যে লকডাউনের সময় থেকে প্রতি ঘন্টায় ৯০ কোটি টাকা করে সম্পদ বাড়িয়েছে।আমরা দেখেছি যেভাবে কীভাবে শ্রমিকদের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে এবং কীভাবে তিনটি বিলকে রাজ্য সরকার বা কৃষকদের সংগঠনের কোনও পরামর্শ ছাড়াই চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।একইসাথে বিরুদ্ধস্বর রুদ্ধ করা, বিরোধী নেতাকর্মীদের দমন ও গ্রেপ্তার চালানো হচ্ছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।কৃষক ও শ্রমিকদের বিষয়গুলোতে ব্যাপক বিক্ষোভ হয়েছে।তিনটি অধ্যাদেশ এবং বিদ্যুৎ (সংশোধনী) বিল, ২০২০ ঘোষণার এক সপ্তাহের মধ্যে প্রতিবাদে ভারতজুড়ে প্রায় তিন হাজারেরও বেশি স্থানে বিলগুলোর কপি পোড়ানো হয়।শ্রমিক, কৃষক এবং ক্ষেতমজুরদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন চলছে এবং বৃহত্তর সংগ্রামের জন্য একটি পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল।৯অগাষ্ট ২০২০ ভারত ছাড়ো আন্দোলনের বার্ষিকী তে এবং৫ সেপ্টেম্বর ২০২০ গোটা দেশ জুড়ে বিশাল ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম হয়, এর প্রতিটিতেই ২০লক্ষেরও বেশি মানুষ অংশগ্রহণ করেছিলেন। অল ইন্ডিয়া কিসান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশান কমিটি তে ২৫০টিরও বেশি সংগঠন রয়েছে এবং এআইকেএস এর অন্যতম প্রধান সংগঠন এছাড়া কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলো এবং 'ভূমি অধিকার আন্দোলন' এই লড়াইয়ে সমর্থন জানিয়েছে এবং লড়াইয়ের সামনের সারিতে আছে।প্রতিরোধ দিবস দেখেছিল কৃষক বিরোধী বিলগুলোর বিরুদ্ধে একটি অনবদ্য প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে।বিজেপি তার চূড়ান্ত-জাতীয়তাবাদী এবং বিভাজক সাম্প্রদায়িক প্রচারের মাধ্যমে কৃষক এবং মেহনতি জনগণের আসল বিষয়গুলো থেকে মনোযোগ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
স্পষ্টতই, অর্থনৈতিক ইস্যুতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদকারী কৃষক, শ্রমিক এবং জনগণের একটি বিরাট অংশ বিজেপির ভোটার এবং তাদের মধ্যে সংঘ পরিবারের ফ্যাসিবাদী লক্ষ্য যেমন সংবিধানের পাশাপাশি গণতান্ত্রিক অধিকারের ওপরে আক্রমণ নিয়ে তেমন মতপার্থক্য ছিল না।আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ হল বিজেপি, সংঘ পরিবারের জনবিরোধী চেহারাটা উন্মোচিত করা এবং দাবি আদায়ে পথে নামা জনসাধারণের জনমুখী বিকল্পের জন্য সমর্থন আদায় করা, প্রয়োজন একটা অভিন্ন ন্যূনতম কর্মসূচী যার চারপাশে সবাই ঐক্যবদ্ধ হতে পারে।কেরালার এলডিএফ সরকার মহামারির সময়ে উচ্চ প্রশংসিত হয়েছিল, তারা উন্নত সার্বজনীন স্বাস্থ্য ও শিক্ষা পরিষেবা , সার্বজনীন গণবন্টন ব্যবস্থার মাধ্যমে খাদ্যশস্য ছাড়াও অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় পণ্য সরবারহ,সার্বজীনন বাসস্থান ও সমাজকল্যাণ পেনশনের ব্যবস্থা করেছিল যা প্রতিটা পরিবারকে স্পর্শ করেছিল।কেরালায় ভর্তুকির মাধ্যমে কৃষকদের সহায়তা, উপযুক্ত সহায়ক মূল্যে শস্য ক্রয় এবং কর্পোরেটগুলোর বিপরীতে সমবায়গুলোর প্রসারের উপর জোর দেওয়া হয়েছে।উল্লেখ্য যে রেশন ব্যবস্থার মাধ্যমে ৮৮ লক্ষ মানুষকে ভোজ্যতেল, চিনি, নুন, ডাল, মশলা, সাবান এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় খাবার সহ একটি খাদ্য কিট দেওয়া হচ্ছে।প্রায় ২৬ লক্ষ স্কুল পড়ুয়াকেও একই ধরণের খাদ্য কিট দেওয়া হচ্ছে। ৫৫ লক্ষ সুবিধাভোগীকে মাসে মাসে ১,৪০০ টাকা করে সামাজিক কল্যাণ পেনশন দেওয়া হচ্ছে।লাইফ মিশনের আওতায় প্রায় ৪ লাখ লোকের বাসস্থানের কাজও দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলছে।জনগণের জন্য সর্বোত্তম সুবিধার নিশ্চয়তা দিতে রাজ্যের সরকারী স্কুল এবং হাসপাতালগুলো উন্নত করা হয়েছে। এলডিএফ সরকার ধান সংগ্রহ করছে ২৭৫০টাকা/কুইন্টাল দরে যা কেন্দ্রের ঠিক করা দরের থেকে ৯০০টাকা/কুইন্টাল বেশি।ধান চাষীদের জন্য ২ হাজার টাকা / হেক্টর রয়্যালটি এবং শাকসবজির জন্য ন্যূনতম সহায়তা মূল্য নির্ধারণও করা হয়েছে।এই ব্যবস্থাগুলো জনসাধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সুরাহা করে এবং তাদের মর্যাদাসম্পন্ন জীবনযাপনের উপযুক্ত একটা সমষ্টিগত সহায়ক পরিকাঠামো স্থাপন করে যা অন্যত্র অনুকরণীয়। এই উপাদানগুলো ও জমি ও বন অধিকারের পাশাপাশি বিকেন্দ্রীভূত পরিকল্পনা নয়াউদারবাদী অর্থনৈতিক নীতি, জাতিগত নিপীড়ন, লিঙ্গ বৈষম্য, সাম্প্রদায়িকতা এবং ধর্মীয় বৈষম্য ,রাষ্ট্রীয় দমনের বিরুদ্ধে ইস্পাত দৃঢ় প্রতিরোধ হিসাবে দাঁড়াতে পারে এবং বিকল্প হিসাবে ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং সংবিধানের মর্যাদা রক্ষা করে ভারতে রাজনৈতিক রূপান্তর আনতে একটি সূচনাবিন্দু হতে পারে।জন একতা জন অধিকার আন্দোলনের মত বিকল্প প্রয়াসের থেকে শিক্ষা নিয়ে শ্রমিক, কৃষক, সমস্ত নিপীড়িত শ্রেণি, মহিলা, ছাত্র ও যুবকদের সংগঠনের একটা ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামী ফ্রন্টের পরিকল্পনা করা দরকার।এর জন্য ধৈর্য এবং অপরিসীম সাহস প্রয়োজন; এটি নির্বাচনী পাটিগণিত এবং জোটের ঊর্দ্ধে উঠে চিন্তা উচিত।এমনকি একটা আপাতভাবে বন্ধু সরকার থাকাকালীনও এই বিস্তৃত ফ্রন্টটি সক্রিয়ভাবে নজরদারি চালাবে যাতে সেই সরকার সঠিক পথে চলে। এই চ্যালেঞ্জটা অবশ্যই সহজ নয় তবে এটা অসম্ভবও নয়।এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামগুলো এই আশ্বাসই দেয় যে একটা বিকল্প অবশ্যই সম্ভব।
শেয়ার করুন